গল্পঃ- ভালোবাসি
লেখকঃ- সাব্বির আহমদ
পর্বঃ- ০৫
আমি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আমানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম .উনি প্রথমে খেয়াল করেননি.পরক্ষনেই মোবাইল থেকে চোখ উঠিয়ে আমার আপাতমস্তক একবার দেখে বলে.
-কালো রংটা বোধ হয় আপনার জন্যই তৈরী হয়েছে.
আমি হালকা হেসে মাথা নিচু করে ফেললাম.উনি গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বলে,
-ভেতরে গিয়ে বসুন.
আমি সিটে বসার পর উনিও গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেন.গাড়ি তার আপন গতিতে চলছে.আমি আমানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ,
-আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
আমার কথায় আমান আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনে দিকে তাকিয়ে বলে ,
-সারপ্রাইজ!
সারপ্রাইজ?এই সারপ্রাইজ জিনিসটা আমার কাছে বড্ডো বেশি বিরিক্তকর.কারণ আমার কাছে মনে হয় সারপ্রাইজ মানে হলো অযথা এই জিনিসটা নিয়ে ব্রেনকে প্রেসার দেয়া.যেমন এই মুহূর্তে মাথার মধ্যে অনেক প্রশ্ন গুরুপাক খাচ্ছে .যেমন কি সারপ্রাইজ?কেমন হবে দেখতে?আমার কাছে কেমন লাগবে etc etc .তার চেয়ে সবটা বলে দেয়ায় ভালো .
মাথাটা সিটের সাথে ঠেস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি.হঠাৎ খেয়াল করলাম গাড়িটা একটা শুনশান জায়গা দিয়ে যাচ্ছে .আমি এবার নড়েচড়ে বসে জানালা দিয়ে বাহিরটা ভালো ভাবে দেখছি .কিন্তু এইদিকে কোনো মানুষ বা বাড়ি ঘর নেয়.রাস্তার দুপাশে শুধু গাছপালা.মনে মনে অনেক চিন্তা ভাবনা আসতে শুরু করলো .কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন উনি.আর এই নীরব রাস্তা দিয়ে কেন?বেশ অস্বস্থি লাগছে .আমার অস্বস্থিটা বোধ হয় আমান টের পেলো .উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,
-ভয় পাবেন না প্রত্যাশা .আপনি আমার সাথে সেইফ.আর আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গাটায় মেইন্ রোড দিয়েও যাওয়া যায় .কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই এই রাস্তা দিয়ে এসেছি .সাবা বললো আপনার নাকি নীরব পরিবেশ পছন্দ তাই ভাবলাম আরকি এই রাস্তা দিয়ে গেলে আপনার ভালো লাগবে .কিন্তু আপনার যদি অস্বস্থি লাগে তাহলে আমি গাড়ি ব্যাক করবো .
আমি ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম ,
-না না সমস্যা নেয়.আপনি এই রাস্তা দিয়েই যান
কথাটা বলে আমি আবার সিটে হেলান দিয়ে বসি।
‘
প্রায় ১ ঘন্টা বাদে গাড়িটা একটা বিশাল মাঠের সামনে থেমে গেলো.আমান গাড়ি থেকে নেমে আমার পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে আমাকে নামতে বললো.আমি গাড়ি থেকে নেমে আশে পাশে চোখ বুলাচ্ছি.বোঝার চেষ্টা করছি কোথায় আসলাম কিন্তু আশে পাশে খোলা প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না.
‘
আমান আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-চলুন .
আমান সামনে সামনে হাটছে আর আমি উনার পেছন পেছন গুটি গুটি পায়ে হেটে চলছি.বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর আমি থমকে গেলাম সামনের দৃশ্যটা দেখে.আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি রূপকথার কোনো রাজ্যে চলে আসছি .আমার চোখের সামনে বিশাল এক ফুলের বাগান .এতটাই বিশাল যে আমার চোখের সীমা এই বাগানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না.আমার সব থেকে বড় উইকনেস হলো ফুল .নির্দিষ্ট কোনো ফুল না সব ফুলই আমার পছন্দ .বলতে গেলে এক প্রকার পাগল আমি ফুলের জন্য.আর আমার চোখের সামনে এখন এত্ত এত্ত ফুল .বিভিন্ন রকম ফুল .কি সুবাস চারপাশে.আমি অবাক চোখে দেখে যাচ্ছি সব কিছু.আমান আমার কাছে এসে বলে ,
-কেমন লাগলো জায়গাটা?
আমি উনার দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়ে ফুলগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়.হাত দিয়ে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছি সেগুলোকে.এতটাই হালকা ভাবে হাত বুলাচ্ছি যেন একটা পাপড়িও না পরে যায়. উফফ আমার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর জায়গায় চলে এসেছি.আমি প্রাণ ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম .তারপর মনে মনে বললাম’থ্যাংক ইউ আল্লাহ .আমাকে এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য’আমি দাঁড়িয়ে ফুলগুলো দেখে যাচ্ছি আমানও আমার পাশে এসে দাঁড়ায়.আমি উনার দিকে তাকিয়ে বলি.
-থ্যাংক ইউ.
‘
উত্তরে আমান মৃদু হাসলো.তারপর আমাকে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে সামনের দিকে কিছু একটা দেখালেন.আমি উনার ইশারা অনুসরন করে সামনে তাকিয়ে দেখলাম .সামনে বিশাল একটা গাছের ডালে একটা দোলনা বাধা .সব থেকে বড় কথা হলো দোলনাটা পুরো ফুলে সেজে আছে.আমি খুশি মুখে একবার আমানের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে সেই দোলনাটাই বসলাম.আমান আমার ডান পাশে এসে দাঁড়ালো.আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম ,
-আচ্ছা এই এত বড় বাগানের পরিচর্চা কারা করে?
-ওই যে দেখুন সামনে কয়েকটা টিনের ঘর ঐখানে কিছু মানুষ থাকেন আর উনারাই এই বাগান পরিচর্চা করেন
.
উনার কথায় আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের থেকে কিছুটা দূরে কয়েকটা টিনের চালার ঘর.আমান হঠাৎ বললো .
-প্রত্যাশা আপনি এখানে বসুন.আমি একটু আসছি.
আমি দোলনা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম ,
-আমাকে একা রেখে কোথায় যাবেন?এই জায়গাটা খুব নীরব আমি একা থাকতে পারবো না.
আমার কথায় আমান হেসে বললো
-আরে আমি বেশি দূরে কোথাও যাচ্ছি না .ওই যে সামনের টিনের ঘরটাই যাবো.আপনি বসুন আমি যাবো আর আসব.
‘
কথাটা বলে উনি সেইদিকে হাঁটা শুরু করলো.আমি দোলনায় বসে উনার যাওয়া দেখছি.উনি একটা টিনের ঘরে ঢুকে বেশ কিছুক্ষন বাদে হাতে কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে আসে.দূর থেকে বুঝতে পারলাম না কি এটা.কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম উনার হাতে একটা ফ্লাওয়ার ক্রাউন.ফ্লাওয়ার ক্রাউনটা দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো.উনি সেটা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় ক্রাউনটা পরিয়ে দেয় আমি হাসি মুখে একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবার সেই ফুলগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বলি,
-কি এবার মনে হচ্ছেনা এই ফুলের রাজ্যের রানী আমি!
আমান মুচকি হেসে বললো.
-হুম ফুলের রাজ্যের রানীও একটা আস্ত ফুল.
উনার কথা শুনে আমি লজ্জা পেয়ে উল্টোদিকে দিকে ঘুরে দাঁড়ায়.
‘
বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমা আকাশে ঢলে পড়েছে. চারদিকে তার লাল আভা বিস্তৃত।সূর্যের লাল আভায় বাগানের ফুলগুলোকে যেন ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।উফফ!সময়টা যদি এখানেই থেমে
থাকত;যদি বছরের পর বছরের এইভাবেই প্রকৃতির এই ভয়ংকর সুন্দরটা দেখে যেতে পারতাম তাহলে কিন্তু খুব একটা মন্দ হতো না।অবাক চোখে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখছিলাম আমি আর আমান।দুজনের মাঝেই পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করছে. কেউ কোনো কথা বলছি না.দোলনাটা বড় হওয়ায় এর দুই মাথায় দুজন বসে আছি দুজনের দৃষ্টিই সামনের বিশাল সৌন্দর্যের দিকে.আরো কিছুক্ষন চুপ থাকার পর আমান বললো.
-এবার আমাদের যাওয়া উচিত .সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে .কিছুক্ষন পর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে সব কিছু .সেই সময় এই শুনশান রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানোটা একটু রিস্কি হয়ে যাবে .তাই আমাদের এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিত .
চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো.এইসব কিছু ছেড়ে চলে যাবো!একদমই যেতে ইচ্ছে করছে না.মন চাইছে এই সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে.আমাকে মন খারাপ করতে দেখে আমান বলে ,
-মন খারাপ করছেন কেন?আমরা না হয় আবার আসব।
আমি আনমনেই বলে দিলাম,
-বিয়ের পর কিন্তু আমি যখন চাইবো তখনি নিয়ে আসবেন.
কথাটা বলার পর বুঝতে পারলাম আমি কি বলে ফেলেছি.হায় খোদা কি বলতে কি বলে ফেলেছি উনি কি ভাববেন.একবার বিয়ে আটকানোর জন্য এত কিছু করলাম এখন আবার বিয়ে পর ঘোরাঘুরিরও প্লেন করে ফেলছি.উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি মুখ টিপে হাসছেন.উনার হাসিতে আমি আরো লজ্জা পেয়ে গেলাম.
উনি হেসে বললেন,
-আচ্ছা বিয়ের পর যখন বলবেন তখনি নিয়ে আসব।আর মন খারাপ করতে হবে না.
আমি মাথা নিচু করে আস্তে করে বললাম,
-হুম ।
-আচ্ছা তো চলুন .নয়তো এবার সত্যি সত্যি লেইট হবে যাবে.
আমি দোলনা থেকে উঠে বললাম ,
-আচ্ছা চলুন.
যাওয়ার আগে ফুলগুলোকে আরো একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে এলাম.
‘
সন্ধ্যা ৬.৩০টা ,
একটা কফি শপে আমি আর আমান মুখোমুখি বসে আছি.ওয়েটারকে কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে আছি দুজন.এখনো নীরবতা ছেয়ে আছে দুজনের মাঝে.হঠাৎ আমান একটু নড়েচড়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,
-আমরা তো কথা বলতে এসেছিলাম.অথচ পুরো বিকেল কাটিয়ে দিলাম কোনো কথায় বললাম না.
আমি হালকা হেসে বললাম.
-আপনি আমাকে এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে গেছেন, সেখানে গিয়ে এত মুগ্ধ হয়েছি যে মাথায় আর অন্য কোনো কথা আসেনি.আচ্ছা আপনি কি আগে থেকেই জানতেন আমার ফুল পছন্দ?
-হুম.সাবা বলেছিলো.
-না জানি এই মেয়ে আরো কত কি বলেছে.
উনি হেসে বললেন ,
-যতটুকু আমাকে বলা যায় ততটুকুই বলেছে.আর আপনার বিয়ে না করার কারণটাও আমি জানি .
আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকালে উনি বলে ,
-সব পুরুষরা এক হয় না প্রত্যাশা .কেউ কেউ তার প্রিয়তমাকে অনেক ভালোবাসাও দিতে পারে.
আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলি ,
-আমরা কি অন্য কোনো ব্যাপারে কথা বলতে পারি !
আমান ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে.
-জি অবশ্যই. আপনি যদি এই ব্যাপারে কথা বলতে আনকমফোর্টাবল ফিল করেন তাহলে আর এই ব্যাপারে কথা বলবো না.
আমি হালকা হাসার চেষ্টা করে বললাম ,
-আচ্ছা সাবা আর কি কি বললো আপনাকে?
-এইতো আপনার কি পছন্দ অপছন্দ.আপনার ভালো লাগা খারাপ লাগা.মোটকথা সাবা আপনার সম্পর্কে যা যা জানে তা সবই আমাকে বলেছে.
-তাহলে আপনি তো আমার সম্পর্কে সবকিছুই জেনে গিয়েছেন .কারণ আমি সাবার কাছে সব কিছু শেয়ার করি.ও আমার সম্বন্ধে সব কিছুই জানে.
আমান হেসে বললো ,
-হুম আপনার পিকও আমি সাবার কাছেই প্রথম দেখি আজ থেকে ২ বছর আগে.
আমি অবাক হয়ে বলি ২ বছর আগে.!
চলবে..