#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫৭
.
অভ্র আর আদিব ভাইয়ার কাশির আওয়াজ শুনে আমি আর আদ্রিয়ান একে ওপরকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালাম। দুজনেই হালকা মিটমিট করে হাসছে। আমি আড়চোখে একবার আড়চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে দিলাম। অভ্র বলল,
— ” স্যার চলুন তাহলে?”
আদ্রিয়ান আমার একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল ‘চলো’। এরপর আদ্রিয়ানকে নিয়ে আমরা হসপিটালে গেলাম ওর হাত ব্যান্ডেজ করিয়ে ডক্টরের কাছ থেকে ঔষধ নিয়ে বাংলোতে ফিরে এলাম।
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া করে আদ্রিয়ান আর আমি দুজনেই ঘুমিয়েছি কারণ দুজনেই বেশ ক্লান্ত ছিলাম। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে পাশে হাত রেখে ফাঁকা পেয়ে ভ্রু কুচকে চোখ খুলে তাকালাম পাশে আদ্রিয়ানকে দেখতে পেলাম না। একটা ছোট্ট হাই তুলে উঠে বসে ধীরপায়ে ব্যালকনির দিকে গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ব্যালকনিতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দৃরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি গিয়ে আদ্রিয়ানের হাত জড়িয়ে ধরে বললাম,
— ” কী ভাবছ?”
ও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— ” উঠে গেছ?”
— ” হুম।”
আদ্রিয়ান কিছু না বলে আমায় একহাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওর পেটের ওপর হাত রেখে বললাম,
— ” সবটা কত অদ্ভুত ছিল তাইনা? আর সবকিছুই খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল তাইনা?”
— ” হ্যাঁ। আর এসব কিছু তোমার জন্যেই হয়েছে। তুমি এতটা হেল্প না করলে কাজটা এতো সহজ হত না।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে বললাম,
— ” কিন্তু রূপ? ও কীকরে আমার ওপর এতটা ভরসা করে ফেলল? মানে ও কীকরে ভেবে নিল যে আমি ওকে হেল্প করব? ওর কথা শুনব?”
আদ্রিয়ান স্বাভাবিকভাবেই বলল,
— ” সিম্পল। ও জানতো তুমি খুব ইমোশনাল। আর তোমার ইমোশনকে হাতিয়ার করাটা সহজ হবে। তাই ইশরাকের মৃত্যু, আমার ভালোবাসা এসব বলে তোমার উইক পয়েন্টে আঘাত করে তোমার ব্রেইন ওয়াস করতে চেয়েছে। সেদিন যদি আমি তোমাকে সত্যিটা না বলতাম তাহলে হয়ত সত্যিই তুমি একটা ভুল করে বসতে।”
আমি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললাম,
— ” রূপতো সব আমায় আলাদা করে বলেছিল। কিন্তু তুমি কীকরে জানলে এসব কথা?”
আদ্রিয়ান একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” আসলে ওর ওপর আমাদের কিছু অফিসারস্ দের সারাক্ষণ নজর ছিল। তাই এইসব প্লানস্ আমরা সবই জানতাম।”
আমি এবার হালকা ধরা গলায় বললাম,
— ” জানো? কাল সারারাত আমার কতটা ভয়ে কেটেছে? প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা মনে যেকে বসে ছিল। খুব বেশিই ভয় করছিল। ছাড়তেই ইচ্ছে করছিল না আজ সকালে তোমাকে! তুমি যাওয়ার পর প্রতিটা সেকেন্ড বিষের মত কেটেছে আমার। আজ বুঝতে পারছি নূর আপু কতটা কষ্ট পেয়েছে আর আজও পাচ্ছে।”
আদ্রিয়ান শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
— ” জানো? ওদের জেরা করে যা বুঝলাম তাতে ইশরাক ওর মৃত্যুর পনেরো মিনিট আগেই বুঝতে পেরেছিল টেরোরিস্টরা ওকে টার্গেট করেছে। ও আমাদের ফোর্সকে জানিয়েছিল কিন্তু আমায় জানায়নি। কারণ ও জানতো আমি জানতে পারলে কিছু না ভেবেই একাই চলে যাবো ওখানে। ও সেটা চায়নি, তাই আমাকে মেসেজটাও হোয়াটসঅ্যাপে করেছে কারণ ও জানতো আমি ওই মুহূর্তে অনলাইন যাবো না। কিন্তু সব অফিসারস্ তাদের ফোর্স নিয়ে পৌছতে পৌছতে ওখানে গিয়ে ইশরাককে আর খুজে পায়নি। আর পরে যখন পেলো তখন ও আর..।”
আমি চুপ করে আছি। আদ্রিয়ান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
— ” আমাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু এটা বুঝলো না যে সারাজীবন ওর মৃত্যুর এই দায় এই গ্লানিবোধ বয়ে বেড়াতে বেড়াতে কেটে যাবে আমার। চাইলেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা আমি।”
আমিও ভাঙা গলায় বললাম,
— ” দায় তো আমারও আছে! তুমি যত যাই বল। সবটা তো আমার জন্যে হয়েছে তাইনা। না হলে তো ওদের জানার কথাই না ফাইলটা আপনাদের কাছে আছে?”
আদ্রিয়ান এবার আমার দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
— ” আর এসব কথা বলবে না। তুমি তো এসবের কিছু জানতে না, আর না এসবের মধ্যে ছিলে।”
আমি কিছু বললাম না শুধু নিরব ধারায় দু-ফোটা চোখের জল বিসর্জন দিলাম। আদ্রিয়ান আমার দুটো চোখ মুছে দিয়ে বলল,
— ” যা হয়ে গেছে সেটা আমরা বদলাতে পারবোনা। কিন্তু তোমাকে একটা কথাই বলছি, আমায় কখনও ছেড়ে যেওনা প্লিজ। ইশরাক চলে যাওয়ার পর তুমি আমাকে সামলে নিয়েছিলে। কারণ আমায় সামলানোর ক্ষমতা তোমার ছাড়া আর কারোর নেই। কিন্তু তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে আমি শেষ হয়ে যাবো।”
ও আমার দুই হাত নিজের দুই হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
— ” প্লিজ আমাকে একা ফেলে কোনদিন ছেড়ে যেওনা। প্লিজ!”
আমি কিছু না বলে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরলাম, আদ্রিয়ানও আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আদ্রিয়ান আর আমি একে ওপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি। আমার এমন মনে হচ্ছে যেন কত যুগ পর ওকে কাছে পেলাম আমি, ছেড়ে দিলেই আবার কোথাও একটা হারিয়ে যাবে।
পরেদিন সকাল বেলা আমরা খাওয়া-দাওয়া করছি খেয়ে বেড়িয়ে যাবো। আদ্রিয়ান খেতে খেতে বলল,
— ” অভ্র চল আমাদের সাথে ঢাকা?”
অভ্র মুচকি হেসে বলল,
— ” না স্যার এখন আর না। পরে একসময় যাবো। প্রমিস!”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
— ” আজ অবধি তো এখনও যাওনি আমাদের বাড়িতে। আর তোমার গার্লফ্রেন্ডকেও তো দেখা হলো না।”
— ” যাবোতো ম্যাম! সুযোগ করে গার্লফ্রেন্ডকেও দেখিয়ে নেব। যদিও এখনও গার্লফ্রেন্ড বলা যায়না, আবার গার্লফ্রেন্ড না সেটাও বলা যাচ্ছে না।”
আদ্রিয়ান মাথা তুলে তার সেই বিখ্যাত স্টাইলে ভ্রু জোড়া বাঁকিয়ে নিয়ে বলল,
— ” হাফ গার্লফ্রেন্ড পাতিয়ে বসে আছো নাকি?মেয়েটাকে দেখার ইন্টারেস্টতো দিন দিন বেড়ে চলেছে!”
আদিব ভাইয়া আর অভ্র দুজনেই শব্দ করে হেসে দিল। আমি একটু হাসলাম কিন্তু কিছু বললাম না। সত্যি বলতে এখন আমারও মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
__________________
এরমধ্যেই দুইদিন কেটে গেল। গতকাল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে এসছি আমরা। আসার পর আদ্রিয়ানে ব্যান্ডেজ করা হাত দেখে সবাই উত্তেজিত হয়ে গেছিল এটা ওটা প্রশ্ন করছিল। পরে আদ্রিয়ান নিরবিলি বসে সবটা বলেছে। সবটা শুনে সবাই তো মারাত্মক অবাক হয়েছে, আবার আমাদের একটু ওপর রাগও করেছে কেন আমরা নিজেরা এত বড় রিস্ক নিতে গেলাম। আদ্রিয়ান আর আমি বহু কষ্টে এদের সবাইকে ম্যানেজ করে নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। আর সবার ভয়ের একটা বিশেষ কারণ ছিল রূপের পালিয়ে যাওয়াটা। হ্যাঁ! রূপ পালিয়েছে। কীভবে পালালো তার জন্যে আদ্রিয়ান বেশ রেগেও গেছিল প্রচুর। যদিও খোঁজা হচ্ছে ওকে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়া নয় কারণ আমার আর এত প্রেশারগুলো আর ভালো লাগছিল না। তাই আদ্রিয়ানও আমার সাথে এসব নিয়ে কোন আলোচনা করে নি। সন্ধ্যায় আমি,আপি,জাবিন মিলে ছাদে বসে পাকোরা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছি। আপি খেতে খেতে একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” আমাদের কাউকে কিছু না বলে চিটাগং গিয়ে যে এমন কান্ড ঘটিয়ে চলে এলি যদি কিছু হয়ে যেতো?”
জাবিনও সায় দিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ ভাবি! একদম সত্যি কথা কিন্তু। কতটা রিস্কি ছিল। তারওপর ঐ টেরোরিস্টটা নাকি আবার পালিয়ে গেছে।”
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম,
— ” করতে তো হতই বল কিন্তু তোমাদের আগে বললে কী লাভ হত? শুধু টেনশন বাড়তো। যাই হোক বাদ দেও এসব। তো আপি বেবির নাম ঠিক করল ভাইয়া? ”
আপি একটু বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল,
— ” থামবি তুই! সবে চারমাস হল।”
জাবিন ফোন দেখতে দেখতে বলল,
— ” হ্যাঁ সেই। দেখতেই তো পাই কী কী চলে চারপাশে।'”
বলে জাবিন আর আমি দুজনেই হেসে দিলাম। কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর জাবিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ফোনের দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। আমি আর আপি ভ্রু কুচকে একে ওপরের দিকে তাকালাম। জাবিনকে জিজ্ঞেস করতেই বেশ সুন্দরভাবে এড়িয়ে চলে গেল এই মেয়ে। কিন্তু কিছু যে ঘোট পাকিয়ে বসে আছে সেটা আপি আর আমি দুজনেই বেশ ভালো করে বুঝতে পারলাম।
_________________
সময়ের খুব দ্রুতই প্রবাহমান। দেখতে দেখতে দুটো বছর পার হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। দুই বছর পর আজ এই ডায়রিতে লিখছি। মাঝখানে ডায়রিটা হারিয়ে গেছিল। আজ হঠাৎই ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে মনি উদ্ধার করল এটা। তাই ভাবলাম বাকি লেখাটা এখানেই লিখি। নূর আপুর সাথে যেচে আর দেখা করতে যাইনি আমি। নিজেকে অপরাধী মনে হয় ওনার চোখের দিকে তাকালে। মনে হয় ওনার এই অবস্থা শুধু আমার জন্য। দু-বছরে অনেক কিছু বদলে গেছ আপির ছেলে বাবু হয়েছে। নাম রেখেছি হিয়াজ। আপি আর ইফাজ ভাইয়া দুজনের ঠিক করা নাম এটা। এখন দেড় বছর হয়েছে ওর। আমাদের সকলের ভীষণই আদরের। এখনও মনে পরে সেই দিনটা যেদিন হিয়াজ এল। আপিকে ডেলিভারির সময় আপির বেশ কষ্ট হয়েছিল। সেদিন রাতে মুঘোতে যাওয়ার সময় আদ্রিয়ান আমারয় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে কাঁপা কন্ঠে বলেছিল,
— ” যখন আমাদেরও বেবি হবে তোমারও এরকমই কষ্ট হবে তাইনা?”
আমি ঘুরে ওর বুকে মাথা রেখে বলেছিলাম,
— ” তা তো হবেই। মা হওয়া তো এত সহজ নয় তাইনা? দীর্ঘ ন-মাসের প্রতিটা মাস আলাদা আলাদা রকম অসহনীয় কষ্ট, এরপরে ডেলিভারির সময় সেই চরম কষ্টের ফলেই একটা মেয়ে মা হয়, পূর্ণ হয়।”
ও অসহায় কন্ঠে বলেছিল,
— ” আচ্ছা একটা বাচ্চা এডপ করে নিলে হয়না?”
আমি অবাক কন্ঠে বলেছিলাম,
— ” কী?”
— ” একটা বাচ্চা হলেই তো হয় তাইনা? আমরাতো একটা এডপ করতেই পারি?”
আমি মাথা তুলে ওর গালে হাত রেখে বলেছিলাম,
— ” সব মেয়েকেই এই কষ্টটা সহ্য করতে হয়। আর আল্লাহ এই কষ্ট সহ্য করার শক্তি ঐসব মেয়েদের মধ্যে এমনিই দিয়ে দিয়েছেন। সবাই করে, আমিও করে নেব আদ্রিয়ান। কিন্তু সন্তান গর্ভে ধারণ করার যে সুখ সেটা থেকে আমায় বঞ্চিত করবেন না। আজ দেখেছেন এত কষ্ট পাওয়ার পরেও যখন বাচ্চাটাকে আপির কোলে দেয়া হয়েছিল তখন আপির মুখে তৃপ্তির এক হাসি ছিল।”
ও একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বলেছিল,
— ” হু বুঝলাম!”
— ” কী বুঝলে?”
— ” আমার পিচ্চি বউটা বড় হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।”
আমি বরাবরের মত লজ্জা পেয়ে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে ছিলাম আর ওও কাছে টেনে নিয়েছিল আমায়।
সেদিনের কথা মনে পরতেই হাসলাম আমি। হ্যাঁ এখন বড় হয়েছি বটে। তখন উনিশের ছিলাম এখন একুশ হলো।
হঠাৎ করেই আপির ডাক পরল। আমি এখন মামুর বাড়িতে আছি। আমরা সবাই আছি। আসলে আজ সজীব ভাইয়ার গায়ে হলুদ। হ্যাঁ দীর্ঘ কয়েক বছরের পর কাল সৃষ্টি আপুর সাথেই ভাইয়ার বিয়ে হবে। আমি নিচে চলে গেলাম। নিচে গিয়ে আদ্রিয়ান, ইফাজ ভাইয়া, কাব্য আমার সব কাজিন ভাইরা সবাই কোমর বেঁধে লেগে পরেছে কাজে। ইফাজ ভাইয়া আর আদ্রিয়ানকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবেনা এরা বাড়ির জামাই। দুজনেই ঘরের ছেলের মত লেগে পরে কাজ করে যাচ্ছে। আমিও ওড়নাটা বেধে আপিদের সাথে কাছে হাত লাগাচ্ছি। কিন্তু আমার শরীরটা তেমন ভালো নেই। সকাল থেকেই কেমন লাগছে মাথা। মাথা ঘুরে উঠছে মাঝেমাঝে। কিছু খেতেও ইচ্ছে করছেনা।কাউকে বলিনি কারণ বিয়ে বাড়িতে সবাই এখন আবার আমায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবে। আপি আমায় ফলের ঝুড়িটা আনতে বলল। আমিও ফলের ঝুড়ি নিয়ে বেড়িয়ে এসে আরেকটু এগোতেই মাথাটা ভীষণ জোরে ঘুরে উঠল। সবটা অন্ধকার হয়ে আসছে। ঝুড়িটা আর ধরে রাখতে পারলাম না, পরে গেল হাত থেকে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কী হল জানিনা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না লুটিয়ে পরলাম মাটিতে।
#চলবে…
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫৮
.
মাথায় ভার অনুভব করে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। ঘরে অনেক মানুষের উপস্থিতিও টের পেলাম। তখনকার কথা মনে পরতেই বুঝতে পারলাম সবাই মিলে আমার জন্যে হয়তো এতক্ষণে আমি মাথা চেপে ধরে উঠে বসতে নিলেই আপি বলে উঠল,
— ” এই কী করছিস টা কী? চুপচাপ শুয়ে থাক।”
বলে একটা বালিশ রেখে বেডে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিল। আমি ক্লান্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম আল্লাহর রহমতে বাড়ির ছোট থেকে বড় সব একসাথে এসে আমার রুমে ভীর জমিয়েছে। বাড়িতে এত কাজ সব ফেলে এরা আমার এখানে এসে বসে আছে। আম্মু এসে আমার পাশে বসে বলল,
— ” এরকম শরীর খারাপ কীকরে করলি বলত? সকাল থেকে দেখেছি ঠিকমত খাস নি কিচ্ছু। এমন করার কোন মানে হয়?”
আব্বু আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আচ্ছা, এভাবে ওকে বকাবকি করছ কেন? এমনিতেই অসুস্থ মেয়েটা।”
সবাই এটা ওটা বলছে আর আমি আশেপাশে তাকিয়ে আদ্রিয়ানকে খুঁজছি। না জানি কী অবস্থা হয়েছে লোকটার। আমার একটু কিছু হলেই তো পাগল পাগল হয়ে যায়। কিন্তু পুরো রুমে আদ্রিয়ানকে দেখতে পেলাম না। আব্বু আম্মু আর বাকি বড়রা চলে গেল। নানু, বড় মামী আর আম্মু এখনও আছে। রাতে আবার হলুদের অনুষ্ঠান আছে। মলি আপু আমার পাশে বসে বলল,
— ” কী হয়েছে কী তোর বলত হঠাৎ এভাবে মাথা ঘুরে পরে গেলি?”
আমি মাথায় হাত রেখে বললাম,
— ” আসলে সকালবেলা থেকে কিছুই ঠিক করে খেতে পারিনি আজ তাই হয়ত।”
এরমধ্যে মেঝ মামু আর আপি একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” তোকে নিয়ে আর পারা যায় না। আদ্রিয়ান কিন্তু খুব রেগে আছে।”
আমি কিছু বলব তারমধ্যেই আদ্রিয়ান দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। আদ্রিয়ানকে দেখে আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম। আদ্রিয়ানের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না ওর মুড এখন ঠিক কীরকম। আমি উঠে নামতে গেলেই আদ্রিয়ান শক্ত গলায় বলল,
— ” মামনী ওকে নড়তে না করো আমি কিন্তু এবার ঠ্যাং ভেঙ্গে ফেলব। আর তাতে যদি তোমাদের কারও সমস্যা হয় তাহলে বল আমি তোমাদের মেয়ে তোমাদের কাছেই রেখে যাবো।”
সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে আর আমি মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। বড় মামী বলল,
— ” আদ্রিয়ান থাকনা। মেয়েটার ওপর এখন আর রাগ করোনা।”
আদ্রিয়ান বিরক্ত হয়ে ভেতরে কী এসে বলল,
— ” রাগ করবো না তো কি করব বলতে পারো মামী ? দুইটা দিন একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই ম্যাডামের খাবারের দিকে নজর দেওয়া হয়নি আমার , দেখ আজ শরীরের অবস্থা দেখ।”
আম্মু যেন আদ্রিয়ানেরই আসার অপেক্ষা করছিল। এখন নিশ্চয়ই নিজের সেই বিখ্যাত কুটকাচালি করবে। আম্মু বলল,
— ” হ্যাঁ সেটাই। ধরে বেধে একটু খাওয়াও তো। একমাত্র তোমার কথাই তো শোনে ও।”
আমি একটু বিরক্ত হয়ে তাকালাম আম্মুর দিকে। কী শান্তি পায় আমায় এভাবে ফাঁসিয়ে দিয়ে? আদ্রিয়ান মাথা ঝাকিয়ে বলল,
— ” একদমি না মামনী। তোমার মেয়ে আমার কথা একদমই শোনে না। শুনলে নিজের এরকম হাল করত না। উনি অসুস্থ হবেন, আমি ওনার টেনশনে আধপাগল হয়ে যাবে এটা দেখে তো উনি ভীষণই মজা পান। তাইনা?”
আমি মুখ কাচুমাচু করে বসে আসি। বাকি সবাই একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আস্তে আস্তে চলে গেল। আমি আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিলাম। না জানি এখন ঠিক কী কী ভাবে বকাবকি শুরু করবে। আদ্রিয়ান শান্তভাবে আমার দিকে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে থেকে পাশের টি-টেবিল এ রেখে দেওয়া এক প্লেট কাটা ফল এগিয়ে দিয়ে বলল,
— ” তাড়াতাড়ি শেষ করো। একটা ফলের পিসও যাতে বাকি না থাকে।”
আমি প্লেটটা হাতে নিয়ে অসহায় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলব তার আগেই ও ধমক দিয়ে
— ” তাড়াতাড়ি শুরু করো!”
আমি খানিকটা চমকে উঠে তাড়াতাড়ি খেতে শুরু করে দিলাম। একদমি ভালো লাগছে না খেতে কিন্তু আদ্রিয়ানের চোখ মুখ দেখে খেয়ে নিতে বাদ্ধ হলাম। যেই আমি হাফ পিছ আপেল একঘন্টা লাগিয়ে নাক কুচকে খাই, সেই আমি পুরো এক প্লেট ফল বিশ মিনিটের মধ্যে খেয়ে নিলাম। পুরোটা শেষ করে ফাঁকা প্লেট আদ্রিয়ানের হাতে দিতেই আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,
— ” গুড গার্ল।”
আমি দুর্বল দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে ঢেকুর দিলাম। উনি আঙ্গুল দিয়ে আমার চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,
— ” একদম বেড থেকে নামবেনা এখন। প্রোগামের সময় বউমনি এসে সাজিয়ে নিয়ে যাবে।”
আমি অসহায় মুখ করে বললাম,
— ” আমি সৃষ্টি আপুদের বাড়ি যাবোনা? হলুদ আর গিফটস গুলো নিয়ে?”
উনি শক্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
— ” আচ্ছা যাবোনা।”
উনি শার্ট হাতে নিয়ে পরতে পরতে বলল,
— ” একটু পর বউমনি এসে রেডি করে দেবে। আমিও যাচ্ছি।”
বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল আমিও ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। লোকটা সত্যি পাগল। এমনিতে রাগ দেখালেও এমন কিছু করতেই পারেনা যেটাতে আমি কষ্ট পাবো।
হলুদের রাতটা বেশ ভালোভবেই কাটলো নাচগান মজা খাওয়া-দাওয়া করে ভালোই কাটলো। ঘুমোতে যাওয়ার আগে আদ্রিয়ান জোর করে এক গ্লাস দুধ খাইয়েছে। যদিও দুধটা খাওয়ার পর একটু গা গোলাচ্ছিলো কিন্তু আদ্রিয়ানকে বুঝতে দেইনি।
__________________
পরেরদিন সকালে ভোর ভোর আমরা সবাই পুকুর ঘাটে পানি আনতে গেলাম। গ্রামে এই রিতীটা খুব সুন্দরভাবেই মানা হয়, দেখতেও ভালো লাগে হলুদ রঙের শাড়ি পরে, কোলে কলসি নিয়ে পানি আনতে যাওয়া। সবাই একে একে একে কলসে পানি ভরে চলে এল। আমি কলস ভরে নিয়ে উঠে আসার সময় হুট করে আবারও আমার মাথাটা ঘুরে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি কলসটা রেখে গাছ ধরে দাঁড়ালাম। আপি, আপুরা সবাই তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বললাম,
— ” আমি ঠিক আছি। জাস্ট মাথাটা ঘুরছিল। প্লিজ তোমাদের ভাইকে এসব বলনা। আজ আমার সব আনন্দ মাটি করে ছাড়বে!”
আপি ভ্রু কুচকে বলল,
— ” নিজের অযত্ন করে অসুখও বাঁধাবে আবার আদ্রিয়ানকে ভয়ও পাবে ওয়াও।”
হঠাৎ কিছু একটা ভেবে আপি বলল,
— ” এই তুই প্রেগনেন্ট নস তো? কাল থেকেই এমন হচ্ছে?”
মলি আর মিলি আপুও সায় দিয়ে একই কথা বলল। আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললাম,
— ” তোমরা থামবে? আজাইরা প্যাঁচাল শুধু! চলো তো। এরকম তো আমার প্রেশার ফল করলেও হয়।”
মলি আপু বলল,
— ” হ্যাঁ তাও হতে পারে। বমি টমি হয়?”
আমার যে কাল রাতে গা গোলাচ্ছিল সেটা বলা যাবেনা তাহলেই পুরো যেকে ধরবে আমায়। তাই মাথা নেড়ে না করলাম।ওরাও আর কথা বাড়ালোনা। সকালে ভাইয়াকে হলুদ তেল মাখিয়ে গোসল-টোসল করিয়ে সবাই ফ্রি হয়ে আমাদের মামাবাড়ির বিরাট উঠোনে পাটি বিছিয়ে বাড়ির সবাই কলা পাতায় খিচুড়ি খাচ্ছি। আদ্রিয়ান আমার পাশেই বসেছে। আমি অর্ধেক খিচুড়ি খাওয়ার পর হঠাৎ করেই আমার ভীষণভাবে গা গুলিয়ে উঠল। মুখ চেপে ধরে তাড়াতাড়ি উঠে দৌড়ে একটু দূরে একটা গাছ ধরে বমি করে দিলাম। আদ্রিয়ানও আমার পিছে চলে এসে আমার পিঠে হাত বুলাতে শুরু করল। অর্ণব ভাইয়া অলরেডি পানি নিয়ে এসছে। কিছুক্ষণ পর আমার বমি থামতেই আদ্রিয়ান আমায় একহাতে জড়িয়ে ধরে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে দিল। তারপর পানি খাইয়ে দিয়ে ওখানের একটা চেয়ার এনে বসালো। আম্মু চিন্তিত হয়ে বলল,
— ” আজ আবার এমন কেন হল? কাল থেকে তো ঠিকমতই খাচ্ছে।”
নানু বলল,
— ” দেখেছ আমিতো কালকেই বুঝেছিলাম নতুন মেহমান আসছে। বুড়িদের কথা বাসি হলে তবে ফলে।”
নানু সবার সামনে এভাবে বলছে যে আমার খুব লজ্জা লাগছে। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। বড় মামী বলল,
— ” আচ্ছা ঠিক আছে বিয়ের অনুষ্ঠানটা মিটুক এরপর ঢাকা গিয়ে টেষ্ট করিয়ে নেবে। আদ্রিয়ান যাওতো ওকে নিয়ে ঘরে যাও।”
আদ্রিয়ান সবার সামনে দিয়েই আমায় কোলে তুলে নিয়ে হাটা দিল। এই ছেলেটা এমন কেন? শুধু সবার সামনে লজ্জায় ফেলে আমায়। রুমে এনে আমাকে বেডে বসাতেই আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে বললাম,
— ” দেখো আমি কিন্তু কাল থেকে তোমার সব কথাই শুনেছি। আমায় বকবেনা।”
ও আমার পাশে বসে বলল,
— ” সেজন্যই বেশি টেনশন হচ্ছে। হঠাৎ এমন হচ্ছে কেন? অনেক খারাপ লাগছে না? চল ডক্টর দেখিয়ে নিয়ে আসি?”
আমি ওর হাত ধরে বললাম,
— ” পাগল হয়ে গেছ নাকি? কালকের দিনটাইতো পরশু আমরা চলে যাব। আর তাছাড়াও আমার এখন খারাপ লাগছে না। কাল থেকে বিয়ে বাড়ির উল্টোপাল্টা খেয়েছি তাই হয়ত এমন হয়েছে। বমি করার পর ভালো লাগছে।”
কিন্তু আমার কথায় যে মহাশয় তেমন সন্তুষ্ট হতে পারেননি, আর তার চিন্তা এক বিন্দুও কমেনি সেটা বুঝতে পারছি। হঠাৎ করেই আমায় নিয়ে একটু বেশিই চিন্তায় পরে গেলো ও। বাড়ির সবাইও একটু টেনশনে আছে। আমাকে কম্প্লিট বেড রেস্টে থাকতে বলে চলে গেলো সে। ধুর কার ভালোলাগে এসব?
_________________
দশটার দিকে বাবা মামনীরা চলে আসার পর আর নিজেকে আর রুমে আটকে রাখতে পারিনি বাইরে চলে এসছি। আমায় বাইরে দেখে আদ্রিয়ান একটা চোখ রাঙানী দিয়েছিল বাট আপাতত আই ডোন্ট কেয়ার, পরেরটা পরে দেখা যাবে হুহ। সবাইকে বলে দিয়েছি আমি এখন পিট আছি তাই আর কেউ কিছুই বলেনি। সবার সাথে মজা, আনন্দ করে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছি তখনই নূর আপুকে দেখতে পেলাম ওনাকে দেখেই আমার কেমন জেন একটা অপরাধবোধে ভুগি আমি। ওনার চোখে চোখ রাখার সাহস করে উঠতে পারিনা। নীড় আদ্রিয়ানের কোলে খেলা করছে। আমি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে যেতে নিলেই নূর আপু ডাকল আমায় আমি দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলাম আপু নিজেই এগিয়ে এল আমার দিকে। আমি হেসে বললাম,
— ” তোমার তো কাল আসার কথা ছিল আজ এলে যে?”
আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নূর আপু আমার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল আমার রুমে এনে হাত ছেড়ে বলল,
— ” এভাবে ইগনোর করছিস কেন আমায়? রেগে আছিস?”
— ” না, না। রাগবো কেন?”
— ” তাহলে?”
আমি কিছু বলতে পারলাম না মাথা নিচু করে আছি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নুর আপু বলল,
— ” মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী হয়না অনি। ওটাই নিয়তি। ইশরাকের মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী কেন হবি? ও যা করেছিল নিজের বন্ধুত্বের জন্যে করেছে। আর একদম ঠিক করেছে।”
আমি চমকে তাকালাম নূর আপুর দিকে। তারমানে আপু সবটা জানে? নূর আপু একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ওনার ফোন বের করে কিছু একটা করল। ফোন থেকে ইশরাক ভাইয়ার কন্ঠ ভেসে এল,
— ” আই এম সরি নূর। এটাই হয়ত তোমাকে বলা আমার শেষ কথা। আমি জানি আমি হয়ত খুব স্বার্থপরের মত কাজ করছি। কিন্তু কী করব বল? আদ্রিয়ানও আমার প্রাণ। তুমি জানো ছোটবেলা থেকে আজ অবধি অনেক করেছে ও আমার জন্যে যা আমি বলেও শেষ করতে পারবোনা। আমার সবরকম মুহূর্তে আমার পাশে ছিল ও। তার বিনিময়ে এটুকু করবো না? পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও, আর আমার বাবুকে কিন্তু সুস্হভাবে তোমাকেই পৃথিবীতে আনতে হবে। ওকে বল ওর বাবা ওকে ভিষণ ভালোবাসে, ওকে নিজের হাতে মানুষ করার স্বপ্নও দেখেছিল। কিন্তু ওর বাবার ভাগ্যে এসব ছিলোইনা, বেশি স্বপ্ন দেখেছিলাম তো। খুব ইচ্ছে করছে জানো তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে কিন্তু পারছিনা। জানি তোমাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, পারলে তোমার এই স্বার্থপর হাজবেন্ডকে ক্ষমা করে দিও। ভালোবাসি, খুব বেশিই ভালোবাসি।”
আমার চোখ দিয়ে নিরবে ছল পরছে নূর আপুও কাঁদছে। আপু চোখ মুছে আমার কাধে হাত রেখে বলল,
— ” ও যা করেছে তার জন্যে আমার গর্ব হয়। গর্ব হয় যে আমি ওর মত একজনের স্ত্রী। আর আমি এটাই প্রার্থনা করি ওর মত এরকম স্বার্থপর যেন সবাই হতে পারে। কিন্তু এসবে তোর দোষ নেই। একদমই নেই।”
আমি নূর আপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। নূর আপুও কাঁদছে শব্দ করেই কাঁদছে। আমিও আটকাচ্ছি না। কখনও কখনও কাঁদা উচিত। ভেতরটা হালকা হয়।
_____________________
ভাইয়ার বিয়ে মিটিয়ে কালকেই ঢাকা চরে এসছি আমরা। আর আজ হসপিটালে এসছি।হসপিটালের বাইরে আমি গাড়িতে বসে টেনশন করছি আর আদ্রিয়ানের আসার অপেক্ষা করছি। জানিনা রিপোর্টে কী আসবে। চিন্তা হচ্ছে কুব। কিছুক্ষণ পর আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আদ্রিয়ান এল। এসে ড্রাইভিং সিটে বসল। চোখে মুখে একরাশ গাম্ভীর্য। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ও জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” রিপোর্ট পসিটিভ।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আদ্রিয়ানের দিকে। কিছুক্ষণ ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে কাঁপাকাঁপা হাতে নিজের পেটে হাত রাখলাম। পেটে হাত রেখেই ছলছলে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” আমি মা হবো? আমাদের বেবি আসছে?”
— ” হুম।”
আমি সাথে সাথেই চোখের কোণের জলটা ছেড়ে দিলাম কিছুক্ষণ চোখ বুঝে ফিল করলাম এই মুহূর্তটাকে। কিন্তু আদ্রিয়ানের গম্ভীর মুখ মনে পরতেই চোখ খুলে বললাম,
— ” তুমি খুশি হওনি?”
আদ্রিয়ান অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। ওর হালকা ঘাম বেড়োচ্ছে ও আমার হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
— ” নূরকে, বউমনিকে দেখেছি আমি। তুমি পারবেতো? আমার আরেকটু সময় দেওয়া উচিত ছিল তাইনা?”
আমি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললাম,
— ” আদ্রিয়ান আমার একুশ বছর হয়ে গেছে। এতটাও বাচ্চা নই আমি। আমি নিজেও একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট, তাই আমি জানি আমি ঠিক পারব।”
আদ্রিয়ান আমার কথায় খুব একটা স্বস্তি পেলোনা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ করেই আমার পেটে হাত রাখল। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
— ” এখানে আমাদের বেবি আছে তাইনা? একটু একটু করে বড় হবে। এরপর বাইরে আসবে, কচিকচি হাতপা নাড়বে, খিলখিল করে হাসবে, কাঁদবে, আমি বুকে জড়িয়ে ওর কান্না থামাবো, ওর হাত ধরে একপা একপা একপা করে হাটতে শেখাবো, আদো আদো কন্ঠে বাবা ডাক শুনবো।”
এটুকু বলে ঝুকে আমার পেটে আলতো করে একটা চুমু দিলো। আমি একদৃষ্টিতে দেখছি ওকে। একটু আগেই ভয় পাচ্ছিল কিন্তু মুহূর্তেই এই বাচ্চা নিয়ে কত স্বপ্ন বুনে ফেলল মনে। এরকম পাগলামো আরেকনকেও করতে দেখেছিলাম আমি। কত স্বপ্ন, ইচ্ছা ছিল তার মনে। কিন্তু শেষে? শেষে সেই স্বপ্নগুলো একেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই না এখন।
#চলবে…