ভালোবাসি তোকে পর্ব-৫১+৫২

0
4058

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫১
.
পুরো বাড়ি ফাঁকা, তারওপর রূপকে দরজা বন্ধ করতে দেখে আমার বুক কেঁপে উঠলো। কী করতে চাইছে কী ও? আর হঠাৎ করে এভাবে টেনে রুমে এনে দরজা বন্ধ করার মানে কী? মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল আমার। কিন্তু ভেতরে জমে থাকা ভয়টাকে প্রকাশ না করে আমি রেগে বললাম,

— ” এটা কেমন অসভ্যতা মিঃ রূপ।”

রূপ খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,

— ” আই এম রিয়েলি সরি। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনতেই চাইছিলেনা আর আমার বলাটা ভীষণ জরুরি ছিল তাই।”

– ” তাই আপনি এরকম অসভ্যতামো করবেন?”

রূপ একটু অধৈর্য হয়ে বলল,

— ” আ’ম সরি। কিন্তু আমার আর কোন উপায়ই ছিল না। তুমি কোনমতেই আমার কথা শুনতে চাইছিলে না।”

— ” আপনাকে কে বলল যে আমি এখন শুনবো? দেখুন আপনি রিকোয়েস্ট করেছেন তাই আমি আদ্রিয়ানকে এখনও কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আপনি আপনার লিমিট ক্রস করলে আমি আদ্রিয়ানকে সবটা বলে দিতে বাধ্য হব।”

রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলে আমি গিয়ে দরজা খুলতে গেলেই রূপ এসে আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। আমি এবার বেশ রেগে গিয়ে ঝাড়া দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললাম,

— ” আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন এবার। আমারই বাড়িতে আমার সাথে অসভ্যতামো করছেন।”

রূপ একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল,

— ” প্লিজ আমার কথাটা একটু শুনে দেখো। জাস্ট দশ মিনিট নেবো আমি। আমার কথাটা শোনা তোমার দরকার ট্রায় টু আন্ডারস্টান।”

আমিও এবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললাম,

— ” আমিও তো আপনাকে বলেছি যা বলার আদ্রিয়ানকে বলুন। কিন্তু আপনি তো… আপনার কোন ধারণা আছে যদি আদ্রিয়ান এসব জানতে পারে তাহলে আপনার সাথে কী করবে?”

রূপ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

— ” কী আর করবে? আমাকেও মেরে ফেলবে।”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,

— ” আপনার কী আমার হাজবেন্ডকে খুনী মনে হচ্ছে যে আপনাকে মেরে ফেলবে?”

রূপ একই ভঙ্গিতে বলল,

— ” যে নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে নিজ দায়িত্বে ওরকম নৃশংসভাবে খুন করেছে। তার কাছে আমাকে খুন করা কোন ব্যাপার না।”

আমি চমকে তাকালাম রূপের দিকে। ওর কথাটা মাথায় ঢুকতে কয়েক সেকেন্ড লাগল আমার। আমি কাঁপা গলায় বলল,

— ” ক্ কী।”

— ” হ্যাঁ, ইশরাক কে আর কেউ না আদ্রিয়ান নিজে খুন করেছে।”

আমি বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে।রাগে শরীর কাঁপছে, ইচ্ছে করছে রূপটা সর্বশক্তি দিয়ে একটা অন্তত চড় মারি। লোকটা ভাবল কীকরে যে আদ্রিয়ান ও যা বলবে আমি তাই বিশ্বাস করে নেবো? নিজেকে সামলে নিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আমি বললাম,

— ” আপনার কী মনে হচ্ছেনা আপনার জোকস ওভারলোডেট হয়ে যাচ্ছে? আদ্রিয়ান? মার্ডার করেছে? আপনি জানেন একদিন রাস্তায় ওর গাড়ির সামনে একটা কুকুর চলে এসছিলো, ও জানতো গাড়িটা টার্ন করলে ওটা গাছের সাথে ধাক্কা লাগবে আর ওর সাথে মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারে তবুও কুকুরটাকে বাঁচাতে গাড়িটা টার্ন করেছিল, মারাত্মক কিছু না হলেও কিন্তু ছোট্ট ইঞ্জুরি হয়েছিল, ভয়ংকর কিছুও হতে পারত। আর আপনি বলছেন সেই মানুষটা খুন করেছে? তাও কাকে? ইশরাক ভাইয়াকে? মানে সিরিয়াসলি?

রূপ চোখ সরিয়ে আফসোসের একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” সবসময় চোখে যেটা দেখা যায় সেটা সত্যি হয়না অনিমা। তুমি ওকে যেভাবে চেনো, বা ওকে যেরকম মনে কর ও একদম সেরকম নয়। ওর ভেতরেও একটা ভয়ংকর নৃশংস মানুষ আছে। যে প্রয়োজনে সব করতে পারে। এমনকি নিজের বন্ধুকে নির্মমভাবে খুন করতে পারে।”

আমি এবার একটু চেঁচিয়ে বললাম,

— ” কিন্তু ও নিজের বন্ধুকে কেন মারবে? যাকে ও এতো ভালোবাসে?”

— ” কারণ আদ্রিয়ান শুধু একজন ইঞ্জিনিয়ার বা সাইন্টিস্ট নয় ও একজন টেরোরিস্ট। ইয়েস, হি ইজ আ টেরোরিস্ট। যার কাজ নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য নিরীহ মানুষের প্রাণ নেওয়া। কারো প্রতি দয়া নেই ওর। কাউকে ছাড়েনা ওরা, কাউকে না। অনেক নিরিহ মানুষকে মেরেছে। আর এই সত্যিটাই ও ইশরাক জেনে ফেলেছিল তাই ইশরাক কেও মেরেছে, আর সেদিন তোমাকেও তিন তলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।”

আমি স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি রূপের দিকে। এতক্ষণ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলেও এবার আর নিজেকে সঞ্জত রাখতে পারলাম না, কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে দিলাম রূপকে। রাগান্বিত কন্ঠে বললাম,

— ” ইনাফ হ্যাঁ? আর একটাও কথা না। আমার স্বামী সম্পর্কে এত জঘন্যতম কথা বলার সাহসটা কে দিল আপনাকে? আপনাকে এ বাড়ি থেকে বেড় করার কথা আমি আজই বলছি বাবাকে।”

— ” আমি যা বলছি সব সত্যি বলছি।”

— ” সবটাই মিথ্যে বলছেন আপনি।”

বলে চলে যেতে নিলেই রূপ বলে উঠল,

— ” আর দু-বছর আগেও যা হয়েছিল সেটা?”

আমি থমকে গেলাম। আমি অবাক হয়ে রূপের দিকে তাকাতেই ও একটু হেসে বলল,

— ” দু-বছর আগে ঐ জঙ্গলে যেটা হয়েছে সেটাও মিথ্যে?”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রূপের দিকে তাকাতেই রূপ বলল,

— ” হ্যাঁ জানি। যদিও ঐদিন ওখানে আদ্রিয়ান ছিলো কী না আমার জানা নেই। কিন্তু সেটাও কী মিথ্যে? নবীণ বরণের দিন তোমার ওপর অ‍্যাটাক হওয়ার পরেও আদ্রিয়ানের এরকম শান্ত থাকাটা মিথ্যে? তোমাকে মারার চেষ্টা করা হলো তারপরেও তোমার কাছে জিজ্ঞেস না করেই আদ্রিয়ানের এটাকে এক্সিডেন্ট বলাটা মিথ্যে? এত বড় বড় ঘটনাগুলোকেও স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সবটা নরমাল? তোমার মনে প্রশ্ন জাগেনা যে কেন আদ্রিয়ানের ল্যাপটপে কাউকে হাত দিতে দেয়না? ইভেন তোমাকেও? কেনো ওর ল্যাবে সহজে কাউকে যেতে দেয়না? আর গেলেও সিকরেট রুমটাতে কাউকে ঢুকতে দেয়না?”

আমি চোখ সরিয়ে নিলাম ওনার থেকে। এসব প্রশ্ন যে কখনও আমার মনেও আসেনি তা কিন্তু না। আজ রূপও বলল। সত্যিই এগুলো নরমাল। রূপ বলল,

— ” কী হলো বল?”

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

— ” ও যাই করেছে তার পেছনে নিশ্চয়ই ক্ কোন কারণ ছিল। আর এ্ এগুলো তো প্রমাণ করেনা যে ও টেরোরিস্ট, তাইনা? আর ইফাজ ভাইয়ার মার্ডারের কথা বলছেন? ইশরাক ভাইয়া যেদিন মারা গেছিলেন সেদিন আদ্রিয়ান আমাদের সাথেই ছিল। তাহলে কীকরে মারল?”

রূপ আবারও ব্যঙ্গ করে হেসে বলল,

— ” উমহুম, সারাদিন নয়। সকালে বেশ অনেকটা সময় ও গায়েব ছিল তাইতো?”

আমার মনে পরল ও সেদিন সকালে প্রায় তিন ঘন্টার মত কাউকে কিছু না বলেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আমি রুপের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত গলায় বললাম,

— ” ওর কাজ ছিল তাই গিয়েছিল। অনুষ্ঠান বাড়িতে অনেকরকমের কাজ থাকে। অনেক কিছু বাজার করে আনতে হয়েছিল ওকে। আর তাছাড়াও ইশরাক ভাইয়া মারা যাওয়ার পর আদ্রিয়ানের অবস্থা দেখেছি আমি। চার চারটা মাস নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সবার থেকে, অনুভূতিহীন, বদমেজাজি, রুড একজন মানুষ হয়ে গেছিল। অনেক কষ্টে ওনাকে স্বাভাবিক করেছি আমরা। এতোটাই কষ্ট পেয়েছিল লোকটা, আর আপনি এসব বলছেন। আর আমাকে মারার চেষ্টা করবে ও? ও কী বলে জানেন? আমি ওর প্রাণভোমরা। আর তার প্রমাণ ও আমার হসপিটালে ভর্তি থাকার দিনগুলো দিয়েছে। নিজের হাতে নিজেরই প্রাণ ভ্রোমরাকে শেষ করতে পারে কেউ? ”

রূপ আবার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তারপর বলল,

— ” তোমাকে আগেও বলেছি আমি কখনও অন্ধ বিশ্বাস করোনা। হ্যাঁ ইশরাককে মার্ডার করে ও কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু ও বাধ্য হয়েই ইশরাককে মেরেছে। ওর কাছে ওর কাজটাই সবার আগে। তারজন্যে ও সব করতে পারে। তোমাকে জানানোটা দরকার ছিল তাই জানিয়েছি। আমার কথা বিশ্বাস করো সেটা বলছিনা তোমায়? কিন্তু এটলিস্ট নিজের বুদ্ধি দিয়ে তো ভাবো? তুমি চাইলেই সব প্রমাণ পেতে পারো। ওর ল্যাবে, ওর ল্যাপটপে হয়ত এমন অনেক কিছু পেতে পারো যাতে তোমার সবটা বিশ্বাস হয়ে যাবে।”

আমার মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম,

— ” তার দরকার নেই, আমি ব্ বিশ্বাস করিনা এসব।”

— ” আমিতো বলছিনা যে আমাকে বিশ্বাস কর? শুধু এটুকুই বলছি নিজে একবার যাচাই করো?”

আমি কিছু বলতে পারছিনা। এত কনফিডেন্টলি কীকরে বলছে ও? তাহলে কী আদ্রিয়ান সত্যিই… ন্ না না, ও এরকম কক্ষনো করতে পারেনা। রূপ বলল,

— ” তবে সবকিছুর মধ্যে একটা কথা সত্যি। ও তোমাকে সত্যি ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। ওর সারা দুনিয়া একদিকে আর তুমি একদিকে। হ্যাঁ সত্যিই তুমি ওর প্রাণভোমরা। কিন্তু সেদিন কেন ও তোমাকে তিনতলা থেকে ধাক্কা দিয়েছিল আমি জানিনা। কিন্তু ওই দিয়েছিল। কারণ আপাতত তোমাকে মারার তো কোন কারণ নেই আর ও চাইলেও তোমাকে মারতে পারবেনা হয়তো। তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে যে আমি এতকিছু কীকরে জানি? আর তোমাকে কেন বলছি? আমার স্বার্থ কী? সেটা বলতে পারবোনা আমি তোমাকে। এটা শুনে হয়ত তুমি বিশ্বাস করবেনা আমায় কিন্তু আমি বলিনি আমায় বিশ্বাস করতে নিজেই প্রমাণ খোঁজ।”

আমি জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,

— ” প্রমাণ?”

— ” তুমি সবসময় ওর সাথেই থাকো। ওর ল্যাপটপের সব ইনফরমেশন ডেফিনেটলি ওর পেনড্রাইভে থাকবে। তুমি সেটা কালেক্ট করে দেখে দিতে পারো। আর যে করেই হোক তোমাকে ওর ল্যাবের সিকরেট সেই রুমে যেতে হবে। সবটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে তোমার কাছে।”

আমার মাথা কাজ করছেনা। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আসলে কী করা উচিত আমার সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। রূপ বলল,

— ” আর হ্যাঁ আদ্রিয়ান যদি জানতে পারে ও কী সেটা আমি জানি তাহলে ও আমাকেও মেরে ফেলবে। এটা ঠিক যে তুমি ওর কাছে অনেক বড় কিছু কিন্তু ওর কাজটা ওর কাছে আরও বড়। আর নিজের সেই কাজের জন্য ও ওর নিজের প্রাণ আর প্রাণভোমরা দুটোই শেষ করে দিতে পারে। তাই যা করবে সাবধানে। একবার যদি ও জেনে যায় এসব ও তোমাকে মারতেও দু-বার ভাববেনা। তোমাকে মেরে হয়তো নিজেও মরে যাবে। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেবেনা। এতোটাই ভয়ঙ্কর ও। তাই আবেগে পরে নিজের আর তোমার পরিবারের ক্ষতি করোনা। আমি তোমাদের সকলের ভালো চাআ আদ্রিয়ানেরও। তাই তোমাকে বলছি। একমাত্র তুমিই পারবে ওকে সঠিক পথে আনতে। যেকোন ভয়ংকর বিপদে জড়িয়ে যাওয়ার আগেই ওকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে।”

আমি ভাবছি সঠিক পথ? ধরে নেই যদি রূপের কথা সত্যি হয় তাহলে আদ্রিয়ানেয সঠিক পথে আনার প্রশ্নেই ওঠেনা। এগুলো সত্যি হলে ও কেবল একটা জিনিসেরই যোগ্য সেটা হল শাস্তি। ভয়ংকর শাস্তি। আর যাই হোক না কেন কোন খুনিকে ক্ষমা করা যায়না। কিন্তু এসব সত্যি হতে পারে? আমার মন কিছুইতেই মানতে রাজি নয়। কিছুইতেই না। রূপ চলে যেতে নিয়ে বলল,

— ” আর হ্যাঁ। আদ্রিয়ান মানুষ নৃশংস, ভয়ংকর, খুনি যাই হোক। ও কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে। অতিরিক্ত বেশিই ভালোবাসে। ওর সব মিথ্যের মধ্যে যদি একটা সত্যি থাকে সেটা হলো তোমার প্রতি ওর ভালোবাসা। শুধু ও যেটা করছে সেটা ভয়ানক অন্যায়। আমার যা বলার বলে দিয়েছি আমি। বাকিটা তোমার হাতে। কিন্তু খুব সাবধান। ও কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। এতোটাই যে তুমি ভাবতেও পারছোনা। ”

বলে রূপ দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। আর আমি ধীর পায়ে আস্তে আস্তে নিজের রুমে গিয়ে বেডে বসে পরলাম। সবটাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রূপের বলা প্রতিটা কথা কানে বাজছে। ওর কথাগুলো সব একেবারেই ফেলে দেওয়ার মত নয়। আজ আদ্রিয়ানের সব অস্বাভাবিক ব্যবহারগুলো চোখে ভাসছে। আমার সাথে পরপর এতোগুলো অ্যাটাককে ইগনোর করা, ল্যাপটপে হাত দেওয়ায় ওভাবে কথা বলা, ওর ল্যাবে যেতে না দেওয়া, আর যেদি গেলাম সেদিন এক জায়গায় বসিয়ে রাখা। উফ, কী হচ্ছে এসব? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। কিচ্ছু মেলাতে পারছিনা আমি। কিচ্ছু না। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে।

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫২
.
ব্যালকনির রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশটা একটুউ বেশিই অন্ধকার, চাঁদ আজ দেখা দেয়নি আকাশে। রাতের অন্ধকার কোনকালেই ভালোলাগে না কিন্তু আজ চোখ সরাতে ইচ্ছে করছেনা এই অন্ধকার থেকে মনের মধ্যেও অন্ধকার গ্রাস করছে। আমার সাথে মন আর মস্তিষ্কের লড়াই কতটা কঠিন হয় আজ বুঝতে পারছি। আমার মন বলছে যে রূপের সব কথাকে উড়িয়ে দেই। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে একটাবার যাচাই করে দেখতে। আচ্ছা! আমিতো জানি আদ্রিয়ান এমন কিছুই করতে পারেনা, তাহলে একবার চেক করে দেখে নিতে সমস্যা কোথায়। এতো ভয় কেন করছে আমার? যদি সত্যিই রূপের কথাগুলো সত্যি হয় সেই ভয়ে? সবকিছু এত কম্প্লিকেটেড কেন হয়ে যাচ্ছে? সবটাই গুলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কেউ আমার মাথায় একটা টোকা মারল। আমি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান হেসে রেলিং এর সাথে উল্টোঘুরে হেলান দিয়ে বলল,

— ” তো ভাবনাকুমারী? আজও কী আমার ভাবনায় মগ্ন ছিলেন না কী?”

আমি স্হির দৃষ্টিতে আদ্রিয়ানকে দেখছি। রুম থেকে আসা লাইটের পুরো আলোটাই ওর ওপর এসে পরছে। কত সুন্দর লাগছে দেখতে। আচ্ছা? এই মানুষটার পক্ষে অতোটা ভয়ংকর হওয়া সম্ভব? আমি ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— “তোমার সেটাই মনে হয়?”

ও হাত বাড়িয়ে আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ” মনে হয় কী না জানিনা কিন্তু ইচ্ছে হয়।”

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম, আদ্রিয়ানও চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” আচ্ছা তোমার ল্যাবে কেন সবাইকে যেতে দাওনা? স্পেশালি সেই সিকরেট রুমে?”

আদ্রিয়ানের ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসিটা মিলিয়ে গেল। ও একটু শক্ত কন্ঠে বলল,

— ” ওটা আমার অফিসিয়াল কাজের ব্যপার অনি। ডোন্ট ইউ থিংক তোমার এসবে নিয়ে মাথা না ঘামানোটাই বেটার?”

আমি ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে মাথা নেড়ে বললাম,

— ” হুম, সরি।”

বলে রেলিং ধরে আবার আকাশ দেখায় মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ ও আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

— ” রাগ করলে?”

— ” না, না রাগ কেন করতে যাবো? ঠিকই তো বলেছো।”

— ” সরি।”

— ” সরি কেন?”

— ” সময় এলে বলব?”

— ” হুম।”

আবারও বেশ অনেকটা সময় নিরবতায় কাটলো। নিরবতা ভেঙ্গে আমি আড়চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম,

— ” ইশরাক ভাইয়াকে মিস করো না?”

আদ্রিয়ানও এবার ঘুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

— ” হঠাৎ এ প্রশ্ন করলে যে?”

আমিও চোখ সরিয়ে আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে তাকিয়ে বললাম,

— ” এটাই কী উত্তর ধরে নেব?”

— ” নিতেই পারো।”

আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। কিন্তু কিছু বললাম না, বলার মত নেই ও আমার। আমায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে গভীরভাবে কপালে চুমু দিয়ে বলল,

—- ” ভালোবাসি।”

আমি কিছুক্ষণ স্হির দৃষ্টিতে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকানো হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— ” হুমম।”

ওও আমার চোখে চোখ রেখে একই ভঙ্গিতে হাসলো। আমি ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

— ” চলো? ঘুমাবেনা?”

— ” হ্যাঁ চলো।”

এরপর দুজন মিলেই ঘুমোতে চলে গেলাম। আদ্রিয়ান শুয়ে পরার পর আমি শুতে নেবো তখনই আদ্রিয়ান বলল,

— ” বুকে আসবে?”

আমি বেশ অবাক হলাম। রোজ তো নিজেই বুকে টেনে নেয়। আর আজ জিজ্ঞেস করছে? কেনো? ওর আবার কী হল? কিন্তু আমি কিছু না বলে ওর বুকে মাথা রাখলাম ও আমাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।

___________________

দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেল। এই দুইদিনে সব ঠিক চললেও আমি আদ্রিয়ানের সাথে আমার ব্যবহারে খুব সামান্য হলেও জড়তা এসছে। রূপের বলা ঐ কথা আর যুক্তিগুলো অনেক চেষ্টা করেও মন থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারিনি। আর এগুলোই সারাক্ষণ আমার মাথায় চলছে। এমন না যে আমি আদ্রিয়ানকে অবিশ্বাস করছি ‘কিন্তু’ কোথাও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। রূপ যা বলছে সব না হয় মিথ্যে কিন্তু আমি নিজে যেটুকুর সাক্ষী? আমার মনে যেটুকু প্রশ্ন আছে? তার জন্যে তো অন্তত আমার সবটা জানা দরকার সবটা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার হলো আমার আচরণের এই পরিবর্তনগুলো যেনো আদ্রিয়ান বুঝেও বুঝছে না। রূপ এরমাঝে দুবার আমার সাথে এবিষয়ে কথা বলেছে আমি শুনেও শুনিনি। ড্রয়িং রুমে বসে এসব ভাবতে ভাবতেই মামনী এসে বলল,

— ” অনি। হিয়ার জন্যে এই চালতার টকটা করেছি। এটা গিয়ে ওর রুমে একটু দিয়ে তো। মেয়েটা কাল থেকেই টক টক করছিল।”

আমি মুচকি হেসে মাথা নেড়ে উঠে গেলাম টকের বাটিটা নিয়ে। ঐ সমস্ত চিন্তাভাবনা মাথা থেকে বেড় করে নিয়ে গেলাম আপির রুমে। গিয়ে দেখি আপি বসে বসে ফোন দেখছে। আমি গিয়ে বসে গলা ঝাড়তেই আপি ফোন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। আমি বাটিটা আপির দিকে এগিয়ে দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললাম,

— ” কী ব্যপার? ফোনে ডুবে আছো যে? ভাইয়ার সাথে কথা বলছো?”

আপি লাজুক হেসে একটা মেসেজ সেন্ট করে ফোনটা পাশে রেখে টকের বাটিটা আমার থেকে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তোর ইফাজ ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম।”

— ” ওও। আজকাল ভাইয়ার কেয়ার আর পেয়ার দুটোই খুব বেশিই বেড়ে গেছে হুমম?”

আপি কিছু বলল না কিন্তু মুখে লজ্জার আভা ঠিক ফুটে উঠল। আমিও দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললাম,

— ” হুমম। আগেতো ভাইয়া তোমাকে চোখে হারাতোই এখনতো বলতেই হবেনা, কী প্রেম।”

আপি চালতার একটু টুকরো মুখে পুরে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল,

— ” তুই কথা বলিস না হ্যাঁ। আদ্রিয়ান এখনই তোর যতটা খেয়াল রাখে আর যত্ন নেয়, যখন তুই কন্সিভ করবি না জানি তখন কী করবে ঐ ছেলে কে জানে?”

আদ্রিয়ানের এর কথা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল। আবারও মনে সেই দ্বিধা আর দন্দ্বগুলো নাড়া দিয়ে উঠল। আমিও চুপ করে বসে রইলাম। আপি বলল,

— ” কী হয়েছে তোর বলতো? দুদিন যাবত দেখছি তুই কেমন মনমরা হয়ে রয়েছিস? কোন সমস্যা হয়েছে?”

আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম,

— ” আচ্ছা আপি তোমার মন আর মস্তিষ্ক যদি আলাদা আলাদা কথা বলে তাহলে তুমি কার কথা শুনবে?”

আপি ভ্রু কুচকে ফেলল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী হয়েছে? হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি?”

— ” বলোনা?”

আপি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

— “দুটোরই। কারণ মস্তিষ্ক সবসময় যুক্তি খোঁজে। তবে সবকিছুকে তো আর যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না? কিন্তু কিছু কিছু যুক্তিকে ফেলেও দেওয়া যায় না। তাই আগে মস্তিষ্ক দিয়ে যুক্তিগুলো বুঝে এরপর মনকে জিজ্ঞেস করবি সে কী বলছে? তারপরেই যেকোন সিদ্ধান্ত নিবি।”

আমিও মাথা নাড়িয়ে বাটি থেকে এক টূকরো চালতা নিয়ে মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে ভাবতে শুরু করলাম। আপি ঠিকই বলেছে। এবার আমাকে সেটাই করতে হবে যেটা ঠিক। আদ্রিয়ানকে অবিশ্বাস করতে পারিনা আমি কারণ তাহলে ওর প্রতি অন্যায় করা হবে। আবার ওকে অন্ধবিশ্বাসও করতে পারিনা আমি, তাহলে সবার প্রতি অন্যায় করা হবে। যেটা আমি করতে পারিনা।

__________________

সকালে আদ্রিয়ান ল্যাবে যাবে বলে হচ্ছে আর আমিও রেডি হয়েছি। আদ্রিয়ান জ্যাকেটটা পরে আমার দিকে ঘুরে বলল,

— ” চলো?”

আমি নিজের ভাবনাতে মগ্ন ছিলাম ওর ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

— ” আজকে মেডিকেল যেতে ইচ্ছে করছেনা, বাড়িতে থাকতেও ভালো লাগবেনা। তোমার ল্যাবে নিয়ে যাবে আমাকে?”

আমি ভেবেছিলাম আদ্রিয়ান অবাক হবে কিন্তু আমাকেই অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,

— ” ব্যাগটা রেখে যাও তাহলে।”

আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। পাল্টা একটা প্রশ্নও করল না? আদ্রিয়ান আমার দিকে ঝুঁকে বলল,

— ” এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? অবাক হচ্ছো? এতো অল্পতেই? জলে নামলে পা তো ভিজবেই তাইনা?”

— ” ম্ মানে?”

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,

— ” আরে অনেকদিন পর কিছু চাইলে তাই রাজি হয়ে গেলাম। এতে এতো ঘাবড়ানোর কী আছে।”

আমিও উত্তরে একটা জোড়পূর্বক হাসি দিলেও স্বস্তি পেলাম না। ও যে ওর কথা দিয়ে অন্যকিছু ইঙ্গিত করছে? অন্যকিছু বোঝাতে চাইছে? আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে আদ্রিয়ান বলল,

— ” কী হলো চলো?”

আমি মাথা নেড়ে ওর সাথে বেড়ায়ে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রূপকে চোখে পরল। আমার সাথে ওর চোখাচোখি হলো। আদ্রিয়ান রূপকে দেখেও না দেখার ভান করে আমার হাত ধরে আমায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু মনে এক ভয়ংকর ভয় বাসা বাঁধছে। আমি যা করতে চলেছি রূপের ভাষায় সেটা আগুন নিয়ে খেলা। কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে আমি এমন কিচ্ছু পাবোনা যেটাতে আমায় আদ্রিয়ানকে দোষী মনে হয়।

আমি চুপচাপ ল্যাবে আদ্রিয়ানের কেবিনে বসে আছি। আদ্রিয়ান আর আদিব ভাইয়া একমনে দুজন দুটো ল্যাপটপে কাজ করে যাচ্ছে। আমি টেবিলে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবছি কী করা যায়? ওরা না সরে গেলে তো আমি আমার কাজটাও করতে পারবোনা। সকাল থেকে ওয়েট করছি কখন ওরা কখন এদিক ওদিক যাবে আর আমি সিকরেট রুমে ঢুকবো। আচ্ছা আদ্রিয়ান আমায় একা না ছাড়লেতো আমি কিছু করতেও পারবোনা। আদিব ভাইয়া উঠে বলল,

— ” তোরা থাক হ্যাঁ আমি এখন উঠি।”

আদ্রিয়ান ল্যাপটপে কাজ করতে করতেই বলল,

— ” রাইমা কল করেছে বুঝি?”

আদিব ভাইয়া সব গোছাতে গোছাতে বলল,

— ” হ্যাঁ ওই আরকি। তুই তো বিয়ে করে বউ নিয়ে হ্যাপি লাইফ লিড করে নিচ্ছিস। কিন্তু আমার তো এখনও হয়নি ভাই। একটাই গার্লফ্রেন্ড আমার যদি কোনভাবে চটে যায়। আমার কপাল থেকে বিয়ে শব্দটা উঠে যাবে।”

আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। আদ্রিয়ানও ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বাঁকা হাসলো। কাজ করতে করতেই বলল,

— ” হ্যাঁ সেই। কাজ পরেও করা যাবে কিন্তু গার্লফ্রেন্ড চটে গেলে মহা মুসকিল। বউ সামলানোটাই যতটা প্রেশারের গার্লফ্রেন্ডের কথাতো বলতেই হবেনা।”

বলে আমার দিকে তাকালো, আমি একটা মুখ ভেংচি দিলাম । আদিব ভাইয়া ব্যাগটা কাধে নিয়ে বলল,

— ” হয়েছে থাম। এখন আবার তোদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করিস না। আমি আসছি।”

আদ্রিয়ান এবারও ল্যাপটপে তাকিয়েই হাত উঁচু করে বিদায় দিল। আদিব ভাইয়া আমাকেও বাই বলে চলে গেল। আমিও এবার চুপচাপ বসে ভাবছি কী করা যায়। এই ছেলে তো একমনে কাজ করেই যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর হঠাৎ ও বলে উঠল,

— ” তুমি একটু বসো হ্যাঁ আমার ফিরতে এক ঘন্টার মত লাগবে। তুমি থাকতে পারবেনা একা?”

আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। এতক্ষণ তো এটাই চাইছিলাম আমি। সাথেসাথেই একটা মেকি হাসি দিয়ে বললাম,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি পারবো একা থাকতে। তুমি যাও যেখানে যাবে।”

আদ্রিয়ান একটু অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। আমি একটু তুতলে বললাম,

— ” ন্ না মানে কাজ থাকলে তো যেতে হবে তোমাকে।”

— ” হুম। বোর হলে ল্যাবটা ঘুরে দেখতে পারো। আসছি হ্যাঁ?”

আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম। আদ্রিয়ান চলে গেল। আদ্রিয়ানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সেদিন তো ও আমাকে এক মিনিটের জন্যেও একা ছাড়ে নি। বরং চোখে চোখে রেখেছে, একজায়গায় বসিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ কী হল? মাথায় কিছু ঢুকছেনা আমার। ও চলে যাওয়ার দশ মিনিট পর আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে এখন ঐ সিকরেট রুমে যেতে হবে। দেখতেই হবে যে ওখানে এমন কী আছে। ঐ রুমের সামনে গিয়ে আরও অবাক হলাম কারণ দরজাটা লক করা না,এটা কীকরে সম্ভব? এই রুমটা সবসময় করা সিকিউরিটিতে থাকে। সবকিছু এরকম অদ্ভুত কেন হচ্ছে? সবটাই অস্বাভাবিক, এবনরমাল। ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, মনের ভেতরে অজানা আশঙ্কা বাসা বাধছে। কিন্তু না আমায় ভয় পেলে চলবে না। যেকরেই হোক আমার প্রশ্নের উত্তর আমায় পেতেই হবে। আমি নিজেকে শক্ত করে দরজাটা খুললাম। ভেতরে গিয়ে দেখি গোটা রুমটাই অন্ধকার। ফোনের টর্চ অন করে রুমের লাইট অন করলাম। চারপাশে তাকিয়ে চরম অবাক হলাম আমি। অদ্ভুত সব তার আর কিছু যন্ত্রপাতি চোখে পরল আমার। একটু ভালো করেই চারপাশে তাকাতেই দেখতে দুটো কম্পিউটার দেখতে পেলাম। বা পাশের দেয়ালটায় তাকাতেই ডিফিউজ করার কিছু যন্ত্র, পোশাক দেখতে পেলাম। এসব এখানে কেন? এগুলো তো এখানে থাকার কথাই না। ওখানে বড় একটা টেবিলও আছে আর সেখানে আমি তাড়াতাড়ি সেই টেবিলের ওপরের ড্রয়ারটা সবার আগে খুললাম। একটা বন্দুক, আর কিছু কাগজ, হ্যান্ড গ্লাভস আছে। বন্দুক দেখে আমার ভেতরে ধাক্কা লাগলো। তারমানে কী সত্যিই ও কোন অন্যায় কিছু করছে? আমি সবগুলো কাগজ এক এক করে দেখতে শুরু করলাম। কাগজ গুলোর আগামাথা কিছু না বুঝলেও কিছু কঠিন কঠিন ফর্মুলা আছে। কিছু কিছু আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথাও একটা দেখেছি আগে। আমি ড্রয়ারটা বন্ধ করে নিচের ড্রয়ার খুলে রোল করে রাখা কিছু বড় কাগজ পেলাম। একটা একটা করে খুলে দেখলাম কিছু ডিজাইন করা আছে। সবগুলোই অদ্ভুত রকমের। এখন রাগ হচ্ছে, মেডিকেল না পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটাই ভালো ছিল, কিছুতো মাথায় ঢুকতো? কিন্তু বোম ডিফিউজার, পোশাক, গান এগুলো এখানে থাকা নরমাল না একদমি না। ও এসবই সবার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চাইত। তাহলে ঘুরেফিরে মানেতো একটাই দাঁড়ায় যে…। কপাল বেয়ে চিকন একফোটা ঘাম গড়িয়ে পরলো আমার। রূপের বলা ঐ কথাটাই মনে পরল যে “আদ্রিয়ান একজন টেরোরিস্ট।” জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা একবার ভিজিয়ে নিলাম আমি। কিছুই বুঝতে বা ভাবতে পারছিনা। কী হচ্ছে এসব। হঠাৎ মনে হলো আদ্রিয়ানের আসার সময় হয়ে গেছে। আমাকে এখান থেকে। সবকিছু যথাসম্ভব ঠিকঠাক করে রেখে লাইট অফ করে বেড়িয়ে গেলাম ওখান থেকে। কিছুক্ষণ পরেই আদ্রিয়ান চলে এলো। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিল উত্তরে আমিও হাসার চেষ্টা করলাম। আদ্রিয়ান চেয়ারে বসে বলল,

— ” কী বুঝলে?”

আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললাম,

— ” কী বিষয়ে?”

আদ্রিয়ান ল্যাপটপ অন করতে করতে বলল,

— ” এইযে ল্যাবে এসে কী বুঝলে? তোমার হাজবেন্ড খুব ব্যস্ত মানুষ তাইনা?”

আমি দুইহাত টেবিলের ওপর রেখে থুতনিতে হাত রেখে বললাম,

— ” হ্যাঁ সেটাই দেখলাম।”

আদ্রিয়ান কিছু না বলে কাজে মনোযোগ দিলো। আর আমিও যেটা দেখেছি সেটা নিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলাম।

__________________

দেখতে দেখতে আরও একটা দিন চলে গেল। কাল থেকে আমি শুধু এসব নিয়েই ভেবেছি।কয়েকবার চেষ্টা করেও ওর ল্যাপটপের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। আমায় আরও বেশি ভাবাচ্ছে আমার এত সহজে সবকিছু হাতে পেয়ে যাওয়াটা। এমন মনে হচ্ছে যেনো সবকিছু আমার দেখার জন্যেই খুলে রেখে দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাকতেই তাকিয়ে দেখি রূপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই বলল,

— ” ল্যাবে কী কী পেলে?”

আমি ওনার দিকে না তাকিয়েই বললাম,

— ” আমি ল্যাবে কিছু খুঁজিনি।”

— ” মিথ্যে বলছো।”

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম 0,

— ” যদি খুঁজে থাকি, আর পেয়েও থাকি আপনি ভাবলেন কীকরে আমি আপনাকে কিছু বলব? স্বামী হন উনি আমার। আমার অর্ধেক অংশ। আমার অর্ধেক অস্তিত্ব। আর ওনার দোষ, গুন, ভালো, খারাপ সবকিছুরই অর্ধেক ভাগ আমার। তাই আমার কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করবেন না।”

আমি চলে যেতে নিলেই রূপ বলল,

— ” তাই বলে ওর সব অন্যায়কেও চুপচাপ মেনে নেবে? মার্ডারের মত এরকম জঘন্যতম কাজকে?”

— ” ঐযে বললাম? ওনার সবকিছুর অর্ধেক ভাগিদার আমি। তাই সে কোন অন্যায় করলে তার বদলে আমায় কী করতে হবে আমি বুঝে নেব। তার কোন জবাবদিহিতা আমি আপনাকে করবোনা।”

আমি আবার চলে যেতে নিলে ও আমার হাত ধরে বলল,

— ” তোমার মনে হচ্ছেনা একটু ইমোশনালি ভাবছো?”

— ” যেখানে আবেগ থাকেনা যেখানে কেবল জন্তু আর যন্ত্র থাকে। আমি দুটোর কোনটাই নই।”

বলে রূপের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এলাম ওখান থেকে।

________________

গভীর রাত। রুমের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে শুধু। আদ্রিয়ান একটু আগেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। আজ ডায়েরি লিখতে বসেও হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখের পানিতে ফোটায় ফোটায় পরছে ডায়েরির ওপর। আজ সারাদিন যা যা হয়েছে তা কাগজে লিখতে গিয়েও বুক কেঁপে উঠছে আমার। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা আমি। আমার জন্যে শুধুমাত্র আমার জন্যে আজ এসব হয়েছে। দুজন মানুষের কাছে চিরকালের মত অপরাধী হয়ে গেলাম আমি। কোনোদিনও ওদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবোনা, কোনদিন না। সব দোষ তোমার আদ্রিয়ান। তোমার উচিত হয়নি এটা করা। অন্যায় করেছো তুমি। ক্ষমা করবোনা আমি তোমাকে,কক্ষণো না।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে