#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৮
.
সকাল! সবসময়ই নতুন কিছু নিয়ে আসে। নতুন একটা দিন, নতুন আলো, নতুন সময়, নতুন চিন্তা। আজকের দিনটাও আমার জন্য নতুন একদম নতুন। সূর্যের নতুন মৃদুর আলোর রশ্মি মুখে এসে পরাতে ঘুম ভেঙে গেল আমার আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে নিজেকে আদ্রিয়ানের বুকে আবিষ্কার করলাম। ওর লোমহীন উন্মুক্ত বুকে লেপ্টে শুয়ে আছি আর ও নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে রেখেছে আমাকে। কালকে রাতের কথা মনে আসতেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম আমি। নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার চোখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ঘুমন্ত মুখ, এলোমেলো চুল কতো সুন্দর লাগছে ওকে যদিও সবসময়ই সুন্দর লাগে। আমি ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে উঠতে নিলেই ও আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেই বলল,
— ” জানপাখি নড়োনাতো। আমার ঘুম হয়নি এখনও।”
আমার এমনিতেই ওর কাছে থাকতে লজ্জা লাগছে, তাই ও ওঠার আগেই উঠে পরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনতো এ ছাড়ছেনা। কিন্তু ও উঠে গেলে তো ওর দিকে তাকাতেও পারবোনা আমি। আমি কাঁপা গলায় বললাম,
— ” ত্ তুমি ঘুমোও, আমাকে অ্ আটকে রেখেছো কেনো?”
ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— ” তোমাকে ছাড়লে আর ঘুম আসবেনা চুপচাপ শুয়ে থাকো তো।”
আমি এবার মহাবিপদে পরলাম। এই ছেলে আমাকে ছাড়ার নামও নিচ্ছে না। কিন্তু ও কেন বুঝতে পারছেনা ওর কাছে থাকতে এই মুহূর্তে আমার লজ্জা লাগছে। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,
— ” প্লিজ ছাড়ো এখন, বেলা হয়ে গেছে।”
এবার ও অাস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। ওর চোখে চোখ পরতেই আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। ও বলল,
— ” এখন উঠে কী করবে হ্যাঁ? সবে সকাল হয়েছে।”
আমি নিচের দিকে চোখ রেখেই ইতস্তত কন্ঠে বললাম,
— ” বেড়োবেনা আজ?”
— ” হ্যাঁ বেড়োবোতো। কিন্তু আরও পরে এতো তাড়াতাড়ি কী?”
— ” ন্ না ফ্রেশ হয়ে র্ রেডি হতে সময় লাগবে তো।”
— ” তুমি নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছো কেনো, আর তোতলাচ্ছো কেন?”
— ” ক্ কই?”
ও এবার আমার থুতনি ধরে আমার মূখটা উঁচু করে ধরল। কিন্তু আমি এখনও নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। ও আমার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
— ” এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে হ্যাঁ? এতোদিন পেতে তাও না হয় বুঝতাম। কিন্তু কাল রাতের পর… ”
আমি সাথেসাথেই ওর বুকে মুখ গুজে দিলাম। ও আমায় আলতো হাতে জড়িয়ে নিলো। কেউ কিছু বললাম না। দীর্ঘসময় দুজনেই চুপ করে ছিলাম। বেশ অনেকটা সময় পর আদ্রিয়ান বলল,
— ” জানো আজ এতোদিন পর নিজেকে হালকা লাগছে। যেই মুহূর্তে তুমি ভালোবাসি শব্দটা বলেছো আমার মনে হয়েছে আমি সব পেয়ে গেছি আর কিচ্ছু চাইনা আমার। কিন্তু তার সাথে ভয়ও হচ্ছে। সবকিছু পেয়েও যদি হারিয়ে ফেলি। যদি কোন দমকা হাওয়া সব এলোমেলো করে দেয়?”
আমি কিছুই বললাম না কারণ এই একই ধারণা আমার মনের মধ্যেও এসে জেকে বসে আছে। কিছুতেই মন থেকে বেড় করতে পারছিনা। আজ সব ভালো হচ্ছে, দিনগুলো স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে কিন্তু সাথে একটা ভয়ও কাজ করছে। এসবকিছু কপালে সইবে তো হারিয়ে ফেলবো না তো সব? ও আবার বলল,
— ” ভালোবাসি জানপাখি। ভীষন ভালোবাসি। আর যাই হোক কখনও আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ। আমি পারবোনা তোমাকে ছাড়া বাঁচতে। আমি নিজেও জানিনা কীকরে তোমার মায়ার নিজেকে এতটা জড়িয়ে ফেলেছি। কিন্তু এই মায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবোনা। প্লিজ কখনও ছেড়ে যেওনা আমায়।”
আমি ওর বুকে মুখ গুজে রেখেই বললাম,
— ” এসব কথা কেন বলছো। আমি কেন তোমাকে ছেড়ে যাবো। আর তাছাড়া আমার সবটা জুড়েই তো শুধু তুমি আছো। তোমাকে ছেড়ে যাবোটা কোথায়?”
— ” আই লাভ ইউ।”
— ” আই লাভ ইউ টু।”
ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল আর আমিও ওর বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি। আর নিজের ভারাক্রান্ত মনটাকে ভালো করার চেষ্টা করছি।
শাওয়ার নিয়ে দুজনে ফ্রেশ হয়ে ইফাজ ভাইয়াদের কল করে চারজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে নামলাম। ব্রেকফাস্ট এর সময় আজ আপি বা ইফাজ ভাইয়া কেউই আমাদের পঁচাতে আসেনি কারণ কাল এদের দুজনের সজ্জিত রুম দেখেছি আমি। তাই কিছু বলতে আসলে যে ওদের লেগ পুল করতেও যে আমরা কোন অংশে বাকি রাখবোনা সেটা ওরা খুব ভালো করেই জানে। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে ঠিক করলাম মিউজিয়াম যাবো। সুইজারল্যান্ড যখন এসেই গেছি এদেশের ইতিহাস, শিল্প সম্পর্কে জানবোনা সেটা কী হয়? তো চারজনেই আমাদের ভাড়া করা গাড়িতে করে গেলাম মিউজিয়াম অফ আর্ট এন্ড হিস্ট্রি তে। আদ্রিয়ান আর ইফাজ ভাইয়া বলল এই মিউজিয়াম টা নাকি ওখানকার সবচেয়ে বড় মিউজিয়াম। ভেতরে গিয়ে আমি বেশ অবাক হলাম এখানে আঠারো উনিশ দশকের সুইজারল্যান্ডের যেসব স্হাপত্য, ঐতিহাসিক জিনিসপত্র, ঐতিহ্য সবরকমের জিনিস সাজানো আছে। ঐসময়ের মানুষের জীবণযাপনের নমূনা তাছাড়াও বর্তমানের সমস্ত জিনিসপত্রও আছে ওখানে। আর এসব কিছুই কখনও আদ্রিয়ান কখনও ইফাজ ভাইয়া আমাদের দেখাচ্ছে আর এক্সপ্লেইন করছে। প্রায় দু ঘন্টার মত সময় নিয়ে মিউজিয়াম ঘুরে দেখার পর আমরা ওখান থেকে বেড় হলাম। এরপর লাঞ্চ করতে “Manora” তে গেলাম। ওখানে লাঞ্চ করে কিছুক্ষণ পার্কে রেস্ট করলাম এরপর “জেড ডি’ আউ” তে গেলাম। এটা জেনেভার সবচেয়ে বিখ্যাত আর আইকনিক ল্যান্ডমার্ক। একটা দারুণ জলজেট। জল পাম্প থেকে তীব্র গতিতে জল বয়ে চলেছে। আল কৃত্রিম ঝর্ণাটি এই জেট এর সৌন্দর্য অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ভেতরে গিয়ে আমি আর আদ্রিয়ান, আপি আর ইফাজ ভাইয়া আলাদা আলাদা হয়ে গেলাম। জলে অনেকে সুইমিং কস্টিউম পরে সাতার কাটছে মজা করছে। আমি আর আদ্রিয়ান পাশাপাপাশি হাটছি আর চারপাশটা দেখছি। জলের কলকল আওয়াজটা ভীষণ ভালো লাগছে। সত্যিই এই জল জেট টা ভীষণই সুন্দর। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান বলল,
— ” ভালো লাগছে?”
— ” খুব। কী সুন্দর ঝর্ণা টা। আর পাম্প থেকেও ঐ পানিগুলো কী সুন্দর লাগছে। কতো তীব্র গতিতে ছুটছে।”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,
— ” হ্যাঁ এই জেটের প্রধান আকর্ষণই হলো এই ঝর্না। এটা প্রতি সেকেন্ড প্রায় ৫০০ লিটার পানি ১৪০ মিটার উচ্চতায় বেড় হয়ে আসে পাম্প থেকে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ” এত স্পিডে?”
— ” হ্যাঁ।”
— ” এইজন্যই এতো সুন্দর লাগছে দেখতে।”
কিছুক্ষণ হাটার পর খেয়াল করলাম যে পুলে এনজয় করতে থাকা কয়েকজন মেয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একবার সুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে। একটা গ্রে রং এর টিশার্ট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, টিশার্টে ঝুলিয়ে রাখা সানগ্লাস, কপালে পরে থাকা সিল্কি চুল, সবমিলিয়ে দুর্দান্ত দেখাচ্ছে একে। কিন্তু প্রতিবারের মত এবার আমি মুগ্ধ হচ্ছিনা একদমি হচ্ছিনা, বরং বিরক্ত হচ্ছি। কে বলেছিল হ্যাঁ এতো সুন্দর হতে। দেশের মেয়েরা হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকত তো থাকতো এখন এখন এসব ফরেন কান্ট্রির সাদা চামড়ার মেয়েরাও দেখবে আমার কিউট জামাইটাকে? আমি আদ্রিয়ানের হাত জড়িয়ে ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে একটা মুখ ভ্যাংচি দিয়ে দিলাম। মেয়েগুলো একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল হয়তো আমার আচরণে। আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি হকচিয়ে গিয়ে বললাম,
— ” ক্ কী হয়েছে?”
— ” এটা কী ছিল?”
— ” ক্ কই কী ছিল?”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে আমাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
— ” আমার জানপাখির তাহলে জেলাস ফিলও হয়?”
আমি মুখ ফুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” একদম কথা বলবেনা সব দোষ তোমার।”
ও অবাক হয়ে বলল,
— ” আমি কী করলাম? ওরা তাকায় তাতে আমি কী করব?”
আমি ওর হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বললাম,
— ” কী করবে মানে? এতো স্টাইল করে, পোজ নিয়ে, ফুট বাবু হয়ে ঘোরো কেন হ্যাঁ? সবাইকে দেখাতে? ‘ লুক লুক আমি কতো হ্যান্ডসাম?’ ”
আদ্রিয়ান নিঁচের ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু হেসে বলল,
— ” বুঝলাম।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” কী বুঝেছো হ্যাঁ?”
— ” আমার বউ আমায় নিয়ে খুব ইনসিকিওর ফিল করছে।”
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বললাম,
— ” বয়ে গেছে আমার।”
— ” তাই? তাহলে আমি গেলাম ওদের কাছে? দেখো কীভাবে তাকিয়ে আছে? এমনিতেও অনেকদিন যাবত সাতার কাটা হয়না।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— ” খুব শখ না সাতার কাটার?”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,
— ” হ্যাঁ তো। সাথে যদি এরকম সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা থাকে তাহলে…”
আমি সাথে সাথেই ওকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিলাম। ও হাবুডুবু খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মেকী হেসে বললাম,
— ” নাও এবার মনের মতো সাঁতার কাটো তোমার ঐ সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের সাথে।”
বলে হনহনে পায়ে ওখান থেকে এগিয়ে চললাম। আমার সামনে অন্য মেয়েদের সুন্দরী বলার সাহস কীকরে হয় ওর? কথাই বলবোনা। কিন্তু একা রেখে যাবো ওখানে ওকে? ওখানে তো আবার ঐ পেত্নী গুলা আছে। দূর। ভাল্লাগেনা।
#চলবে…
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৯
.
ওইসব গায়ে পরা মেয়েদের কাছে ওকে ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক হবে তো। এরকম নানারকম উদ্ভট চিন্তাভাবনা করতে করতে এগিয়ে যেতে যেতেই ও পেছন থেকে বলে উঠল,
— ” অনি আর ইউ শিউর আমি এদের সাথে সাঁতার কাটবো? দেখো ওরা কিন্তু আমায় ডাকছে।”
এটা শুনে সাথেসাথে থেমে গেলাম আমি। পেছন ঘুরে চোখ মুখ কুচকে রেগে উল্টোঘুরে হনহনে পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম,
— ” খবরদার আদ্রিয়ান। একদম ওদিকে যাবেনা তাড়াতাড়ি উঠে এসো বলছি।”
আদ্রিয়ান টিশার্ট টা খুলে ভেজা চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে জল ঝড়াতে ঝড়াতে জোরে বলল,
— ” বাহরে তুমিই তো বললে যে ওদের সাথে এনজয় করতে, মিনিটে মিনিটে রঙ বদলাও কীকরে?”
আমি মুখ ফুলিয়ে রাগী কন্ঠে চেঁচিয়ে বললাম,
— ” আদ্রিয়ান উঠে এসো বলছি।”
— ” আচ্ছা বাবা আসছি।”
বলে উঠে আসতে নিলেই ওই ফরেইনার তিনজন মেয়ে ওকে ঘিরে ধরল। কী বলছে শুনতে পারছিনা তবে একটা ফোন হাতে নিয়েছে, নিশ্চয়ই সেলফি তুলবে? আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকালো আমি চোখ কটমট করে তাকালাম ওর দিকে ও কোনোরকমে একটা মেকী হাসি দিয়ে মেয়েগুলোকে সামলে নিলো সরিয়ে একটু এগিয়ে এলো। আরে বাহ মেয়ে সামলানোর ট্রেনিং ও খুব ভালো করে নেওয়া আছে দেখছি। একবার ফিরি হোটেলে দেখাচ্ছি হুহ। ও পারে দিকে এসে বলল,
— ” আনি হাত দাও উঠবো।”
আমি হাত ভাজ করে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
— ” আমি পারবোনা, নিজে উঠে নাও।”
— ” ওকে ফাইন। তাহলে আমি আবার ওদের কাছেই যাচ্ছি।”
আমি তাড়াতাড়ি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” দেখো ভালো হবেনা কিন্তু।”
ও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— ” তাহলে তোলো।”
আমি আর উপায় না পেয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। ও আমার হাত ধরে সাথে সাথেই জোরে টান দিলো আর সোজা পানিতে গিয়ে পরলাম। ভয় পেয়ে ওকে জাপটে ধরে আছি আমি। আমি বিরক্তির সাথে অবাক হয়ে বলল,
— ” এটা কী হলো?”
ও মুচকি হেসে বলল,
— ” শুধু আমি একাই ভিজবো তুমি ভিজবেনা সেটাতো হবেনা জানপাখি।”
আমি ইচ্ছামতো কিল মারলাম ওর বুকে। ও হাসিমুখে নিরবে আমার এই মারগুলো সহ্য করল। জলে কিছুক্ষণ কাটানোর পর আমরা উঠে এলাম ওখান থেকে তবে ওর প্রতি আমার বিরক্তি আর রাগ একচুল পরিমাণও কমেনি। ইফাজ ভাইয়ারা এসে আমাদের এরকম কাকভেজা অবস্হায় দেখে আপি আর ভাইয়া দুজনেই অট্টহাসি দিলো। আমি বিরক্তি নিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালাম। আদ্রিয়ানও ঠোঁট চেপে হাসছে। আপি হাসতে হাসতে বলল,
— ” কী ব্যাপার। তোমরা দুজন ভিজলে কীকরে?”
আদ্রিয়ান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
— ” আর বলোনা বউমনি তোমার এই বোন কী পরিমাণ ক্লামজি তুমি তো জানো। হুট করে পানিতে পরে গেলো আর ওকে তুলতে গিয়ে আমিও পরে গেলাম।”
ইফাজ ভাইয়া বলল,
— ” সিরিয়াসলি ইয়ার তুই পারিসও।”
আদ্রিয়ান চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
— ” সব তোমার বোন প্লাস শালিকে বলো। সব ওর জন্যেই হয়েছে।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কী মিথ্যাবাদী এই ছেলে। না জানি আর কী কী করে বেড়ায় কোথায় কোথায়। ওখানে আর না থেকে আমরা সবাই সোজা হোটেলে চলে গেলাম।
__________________
রাতে রুমের বেডে বসে বসে রাগে ফুসছি আমি। তখন থেকে একটাও কথা বলিনি আদ্রিয়ানের সাথে। প্রচন্ড রেগে আছি ওর ওপর, একটা বদের হাড্ডি এই ছেলে। আদ্রিয়ান একটু বাইরে গেছে, কখন আসবে কে জানে। হঠাৎ দরজা লাগানোর শব্দে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান এসছে। আমি বেডে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছি। ও আমার দিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হেসে ওয়াসরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে একটা টু কোয়ার্টার প্যান্ট আর চিকন স্লিভস এর গেঞ্জি পরে বেড়িয়ে আয়নায় দেখে চুলটা ঠিককরে আমার পাশে হেলান দিয়ে শুয়ে পরল। কিছুক্ষণ আমায় পর্যবেক্ষণ করে বলল,
— ” হুমম। আকাশে আজ মেঘ জমেছে। পরিস্থিতি ভালো নয়। ম্যাডামের হেব্বি রাগ হয়েছে না?”
আমি ভ্রু কুচকে একবার ওর দিকে তাকালাম কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। আদ্রিয়ান আবার বলল,
— ” তুমিযে আমাকে নিয়ে এতটা জেলাস সেটাতো আগে জানতাম না? জানলে আর…”
আমি ওকে আর কথা বলতে না দিয়েই বালিশ দিয়ে ওকে হিট করতে করতে বললাম,
— ” জানলে কী হ্যাঁ? জানলে কী? অসহ্য লোক একটা। আমার সামনেই এতো কিছু করে না জানি আমার আড়ালে কী সব করে বেড়ায়। ইউকে থেকে থেকে মেয়েদের সাথে কত ফ্লার্ট করেছে আল্লাহই জানে।”
— ” জ্ জানপাখি থামো। আচ্ছা সরি। আরে সরি বলছি তো ইয়ার। থামো প্লিজ। আরেহ্।”
আমি হয়রান হয়ে বালিশটা নামিয়ে রেখে চুপচাপ শুয়ে পরলাম। একটু পরেই ও আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— ” আরে আমি তখন মজা করছিলাম। আর তাছাড়াও আমি নিজেতো আর ওদের কাছে যাইনি ওরা নিজেরাই এসছিলো। আমি যথাসম্ভব ইগনোর করে সরিয়ে দিয়েছি।”
আমি তবুও কিছুই বললাম না। ও এবার আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আমার ওপর আধশোয়া হয়ে বলল,
— ” কথা বলছোনা কেনো?”
কিন্তু আমি তবুও কোন শব্দ করলাম না। ও আমার ঠোঁটে হালকা করে ঠোঁট ছুইয়ে বলল, ‘কথা বলো’ কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম কিন্তু কিছু বললাম নাভ ও এবার আমার ঠোঁটে হালকা করে কামড় দিলো। আমি হালকা কেঁপে উঠলাম। ও আমার নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,
— ” এখনও রেগে আছো?”
আমি কিছু না বলে জড়িয়ে ধরলাম ওকে শক্ত করে। ওর ওপর রেগে কোন কালেই থাকতে পারিনা আমি আর না কখনও পারবো।
_________________
পরেরদিন ঘুরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের দুল খুলছি হঠাৎ গলার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। আমার গলায় আদ্রিয়ানের দেওয়া লকেটটা নেই। বুক কেঁপে উঠলো আমার। ওটা আমার কাছে কী শুধূ আমিই জানি। আদ্রিয়ান এখনও রুমে আসেনি। আমি গোটা রুম জুড়ে পাগলের মতো খুজলাম, ওয়াসরুমেও খুজলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না। কেঁদেই দিয়েছি আমি। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব খুজছি কিন্তু পাচ্ছিনা। আদ্রিয়ানের দেওয়া ভালোবাসার এই উপহার হারিয়ে ফেললাম আমি? কীকরে? এতোটা কেয়ারলেস কীকরে হলাম তাও এই বিষয়ে? আদ্রিয়ানের এসে আমায় এরকম করতে দেখে অবাক হয়ে আমার কাছে এসে বলল,
— ” কী হয়েছে অনি? এরকম করছো কেনো? বলো?”
আমি করুণ চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললাম,
— ” ল্ লকেট টা সারা রুম খুজেছি পাচ্ছিনা ..”
আদ্রিয়ান আমার গলার দিকে একবার তাকিয়ে এরপর নিজেও একটু খুজলো কিন্তু না পেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— ” হারিয়ে ফেললে ওটা?”
আমি অসহায়ভাবে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শব্দ করে কেঁদে দিলাম। ও আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,
— ” আরে কাঁদছো কেনো? কিছূ হয়নি।”
— ” আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্যই না আদ্রিয়ান। একদম যোগ্য না।”
বলে ওকে ছাড়িয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলাম। দূরের দিকে তাকিয়ে নিশব্দে কাঁদছি। কিছুক্ষণ পর গলায় কালো স্পর্শে চমকে উঠলাম। আদ্রিয়ান আমার গলায় সেই লকেটটা পরিয়ে দিচ্ছে। পরানো শেষ হলে আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” এটা..”
ও মুচকি হেসে বলল,
— ” করিডরে ফেলে এসছিলে। আমি তুলে রেখে দিয়েছি। তুমি আমার ভালোবাসা হেলায় হারিয়ে ফেলে রাখলে কী হবে। আমি ঠিক সেটাকে যত্ন করে তুলে আবার তোমায় মুরিয়ে দেবো। প্রমিস। কিন্তু এতোটাও দূরে ফেলে রেখোনা যেখান থেকে তুলে আনা সম্ভব নয়।”
আমি কিছু না বলে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। কীকরে এত ভালোবাসে কেউ কাউকে? সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি হয়তো কখনও পাবোও না।
জেনেভার সুন্দর পরিবেশ আর আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্হান ঘুরে দেখে আর আদ্রিয়ানের সাথে নিজের খুব ভালো কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে এক সপ্তাহ পর ফিরে এলাম বাংলাদেশে। বাড়ির সবার জন্যে সবার পছন্দের জিনিসপত্র কেনাকাটা করেও নিয়ে এসছি। এরপর আমাদের বাড়ি থেকেই কয়েকদিন ঘুরে এসছিলাম। দেখতে দেখতে আরও একমাস কেটে গেলো। এই একমাসে আমার কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হয়েছে। এতো ভালোলাগা, এতো সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত আদ্রিয়ান আমাকে উপহার দিয়েছে যে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুখী ব্যাক্তি বলে মনে হয়। আমি যখন পড়তে থাকি তখন নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া, রোজ রাতে চুল বেঁধে দেওয়া, মাঝে মাঝে চুলে তেল দিয়ে দেওয়া, আমার ছোট ছোট বিষয়গুলিকেও খুব যত্ন আর গুরুত্বসহকারে দেখা, আর সবচেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট আমায় এতো এতো ভালোবাসা। বাবা মামনী, বড় আব্বু, বড় আম্মু, দাদী সবার কথা আর নাই বললাম। একটা মেয়ের আর কী চাওয়ার থাকতে পারে কিন্তু আমার ভয় হয়। কথায় আছে অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। আদ্রিয়ানের এই অতিরিক্ত ভালোবাসা আমার সহ্য হবেতো?
মেডিকেল থেকে ক্লাস থেকে বেড়োতে বেড়োতে অরুদের বললাম অনেকদিন হলো ফুচকা খাইনা। আরু, ইসু, ঐশি চারজনেই আমার কথায় সম্মতি প্রকাশ করল। আসলেই অনেকদিন যাবত ফুচকা খাওয়া হয়না। ফুচকার দোকানে গিয়ে ফুচকাওয়ালা মামাকে বললাম,
— ” মামা। চার প্লেট ফুচকা দাও আর টক জলটা জেনো বেশি টক হয়।”
অরুমিতা পিঞ্চ করে বলল,
— ” আরে বাস। একমাস হলো হানিমুন সেরে এলি এখনই এতো টক খাওয়ার ইচ্ছা? গুড নিউস পাবো নাকি?
আমি বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” এই সবসময় এত ভাট বকিস নাতো। সেরকম কোনো চান্স এখন নেই।”
ইশু একটু অবাক হয়ে বলল,
— ” আরেহ। তুমি এতোটা সিউর কীকরে?”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম,
— ” এখন সেটাও তোদের এক্সপ্লেইন করতে হবে আমার?”
ওরা সাথে সাথেই চুপ হয়ে গেলো। আমিও আর কিছু বললাম না। চারজন মিলে ফুচকা খাচ্ছি হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ ডাকল। আমি ফুচকা মুখে পুরেই চিবুতে চিবুতে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখি রূপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভ্রূ কুচকে ফেললাম। রূপ মুচকি হেসে বলল,
— ” ভালো আছো?”
তুমি করে বলাতে বিরক্ত হলাম আবার। আদ্রিয়ান না করার পরেও তুমি করে বলছে আমায়। লজ্জা নেই নাকি এর। তবুও সৌজন্যতার খাতিরে বললাম,
— ” জ্বী ভাইয়া।”
— ” তোমার সাথে একটু কথা ছিলো। একদিন সময় দিতে পারবে? বেশিক্ষণ নেবোনা।”
এর কথা শুনে আমি চরম অবাক অরু ওরাও একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। আমি ইতস্তত করে বললাম,
— ” সরি ভাইয়া। কিন্তু..”
— ” প্লিজ অল্প সময়। খুব ইম্পর্টেন্ট কথা বলার আছে তোমাকে। তোমার জানা দরকার।”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— ” সরি ভাইয়া। আপনার সাথে আমার এমন কোনো কথা থাকতে পারেনা যেটা আলাদা করে বলতে হবে। কিছু বলার থাকলে এখানেই বলুন।”
রূপ অধৈর্য হয়ে বললেন,
— ” অনিমা তুমি বুঝতে পারছোনা এটা খুব জরুরি কথা। তোমার সেফটির প্রশ্ন আছে এখানে।”
— ” তাহলে আপনি আমায় না বলে আমার স্বামীকে বলুন কারণ আমার সেফটির চিন্তা আমার চেয়ে অনেকগুন বেশি তার আছে। তাই তাকে বললেই বেশি কাজে দেবে।”
উনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
— ” প্লিজ। আপনি আসতে পারেন।”
রূপ চলে যেতে নিয়েও পেছন ফিরে বলল,
— ” যত কাছের লোকই হোক তাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করাও ঠিক নয়। ঠকে যাবে। আর হ্যাঁ প্লিজ আদ্রিয়ানকে বলোনা এসব কথা তাহলে ও আবার আমায় ভুল ভাববে। ইটস আ রিকোয়েস্ট।”
বলে রূপ চলে গেলেন। আমি ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি কী এমন বলতে চাইলেন উনি আমাকে? কী আছে যা আমার অজানা? আর বিশ্বাসের কথাই বা কী বললেন? কাকে অন্ধবিশ্বাস করছি? আমার কী একবার রূপের কথা শোনা উচিত ছিল? আর ঠকে যাবো এটাই বা কেন বললেন? কিছুতো হচ্ছে আমাকে ঘিরে যেটা অনেকে জানলেও আমি জানিনা? কী এমন আছে যেটা আমি জানিনা।
#চলবে…
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫০
.
সারাদিন রূপের বলা কথাগুলোই ভাবছিলাম। কী বলতে চাইছিলেন উনি? কী এমন আছে যেটা আমার জানা দরকার? আমার কী একবার ওনার কথা শোনা উচিত? কিন্তু আদ্রিয়ান? ও তো রূপকে পছন্দই করেনা। রূপ যেচে আমার সাথে একটু কথা বললেও রেগে যায়, সেখানে যদি আমি নিজে ওর সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে যাই নিশ্চিতভাবে ও ভীষণ রেগে যাবে। কী করবো সেটাই বুঝতে পারছিনা। আমি আগেই বলেছি আমার মন বরাবরই কৌতূহলী, আর রূপ কী বলতে চাইছিলেন সেটা জানার জন্যে আমার মন ছটফট করছে। যতক্ষণ না শুনব আমার মনের এই অস্হিরতা কিছুতেই কাটবেনা। আমার কী করা উচিত? হঠাৎ আমার গায়ে আলতো করে চাদর জরিয়ে দিয়ে চাদরের ওপর দিয়েই কেউ আমায় জড়িয়ে ধরল। এটা যে আদ্রিয়ান সেটা বুঝতে একটুও সময় লাগেনি আমার। আদ্রিয়ান আমার কাধে থুতনি রেখে বলল,
— ” একা একা দাঁড়িয়ে কী ভাবছো হুম?”
আমি ওর হাতের ওপর হাত রেখে মুচকি হেসে বললাম,
— ” তেমন কিছু না তুমি কখন এলে?”
— ” এইতো কিছুক্ষণ হলো, এতো রাত হয়ে গেল এখনও ঘুমাতে যাও নি কেন?”
— ” তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
ও আমার কাধে হালকা করে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বলল,
— ” দাঁড়িয়ে আমার কথাই ভাবছিলে বুঝি।”
আমি নিজের কুনুই দিয়ে ওর পেটে একটা খোঁচা মেরে বললাম,
— ” হুহ, বয়েই গেছে আমার।”
ও ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললেন,
— ” আচ্ছা?”
আমি ওকে ছাড়িয়ে ওর দিকে ঘুরে বললাম,
— ” জি হ্যাঁ। ফ্রেশ হয়েছেন?”
— ” হ্যাঁ ম্যাম। আপনি আপনাকে ভাবনাতে এতই মসগুল ছিলেন যে খেয়ালই করেননি আমি কখন চলে এসছি।”
— ” অ্ আচ্ছা এবার চলো আমি বিছানা করে দিচ্ছি ঘুমাবে তো? টায়ার্ড নিশ্চয়ই?”
ও আমার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। আমি খুব বেশি চমকালাম না। ওর এসব হুটহাট অদ্ভুত কাজে আমি অভ্যস্ত। ও আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে আমার চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিতে দিতে বলল,
— ” টায়ার্ড তো অবশ্যই। কিন্তু ঘুম না অন্য কিছু লাগবে।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
— ” কী লাগবে ?”
ও আমার কানের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ” তোমাকে।”
ওর অমন ধীর কন্ঠে আমার অবস্থা করুণ হয়ে গেছে। আমি লজ্জা পেয়ে ওকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে যেতে নিলাম, কিন্তু ও পেছন থেকে আমার হাত ধরে আবার নিজের কাছে টেনে কোলে তুলে নিলো আমাকে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ওর এরকম কান্ডে। আমি কিছু বলার আগেই ও ওর সেই নেশা ধরানো কন্ঠে বলল,
— ” তুমি নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দিয়েছিলে জানপাখি। এখন এতো পালাই পালাই করলে তো হবেনা? আর পালাতে চাইলেও আমি পালাতে দেবোনা।”
আমি লজ্জা পেয়ে সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিয়ে ওর টিশার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললাম। সবসময় এই কথাটাই বলে। অসভ্য ছেলে একটা। ও আমায় কোলে করে ভেতরে নিয়ে গেল।
___________________
পরের দিন দুপুরে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেটের কাছে এসে দেখি আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুশির সাথে অবাকও হলাম। অবাক হয়ে দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে বললাম,
— ” বাহ্বা। তুমি আজ আমায় নিতে এলে যে? বিশেষ কোন কারণ আছে নাকি।”
আদ্রিয়ান গাড়ির ডোর খুলে দিতে দিতে বলল,
— ” বাড়ি গেলেই দেখতে পাবে সুইটহার্ট আগে চলো তো?”
আমি গাড়িতে বসে পরলাম। ওও গাড়িতে বসে আমার সিটবেল্ট আর নিজেরটা বেঁধে নিলো। সারারাস্তা আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি ব্যপারটা কী কিন্তু মহাশয় বললেনই না। কিন্তু ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো ও ভীষণ খুশি। মেডিক্যাল থেকে ফিরে আমি টোটালি শকড। বাড়ির সবাই আজ এই দুপুরবেলা বাড়িতে? আপি সোফায় বসে আছে মুখে একরাশ লজ্জা নিয়ে। ইফাজ ভাইয়ার চোখেমুখেও ভীষণ খুশির ছাপ। এরপর মামনী যেটা বলল তাতে আমি শকড। আপি প্রেগনেন্ট! আমি এটা শুনে খুশিতে সবার সামনেই চিৎকার করে উঠলাম। আপিকে গিয়ে টাইটলি হাগ করলাম। বাড়ির সবাই নতুন অতিথি আশার খবরে ভীষণ খুশি হয়েছে। সারাদিনই সেলিব্রেশনেই কাটলো। আদ্রিয়ানের চোখে মুখেও চাচু হওয়ার আলাদারকম খুশি দেখছি আমি। সারাবাড়ি মাথায় করছে। মিষ্টি খাওয়ানো, ইফাজ ভাইয়াকে টিচ করা, আপিকে খোঁচা মারা। আচ্ছা যে চাচু হবে শুনে এতো খুশি হতে পারে সে যেদিন নিজের বাবা হওয়ার খবর পাবে কতটা খুশি হবে? আদ্রিয়ানের সেই খুশিগুলো কল্পনা করতে পারি আমি। দাদী হেসে বলল,
— ” এইযে ছোট বুড়ি। বড় বুড়ি কিন্তু সুখবর দিয়ে দিয়েছে। এবার তোমারটা কবে শোনাবে তা বলো?”
আমি বরাবরের মতই লজ্জায় কুকড়ে দাঁড়িয়ে আছি, বলার মত তো কিছুই নেই। কিন্তু আদ্রিয়ান বলল,
— ” দাদী? ভুলে গেলে কী বলেছিলাম? ক্রিকেট টিম?”
বলেই চোখ মারল। দাদীসহ সবাই মুখ টিপে হাসছে আমি লজ্জা পেয়ে ওপরে চলে গেলাম। সবগুলোই অসভ্যের হাড্ডি। আমি বেচারি মাঝখানে ফেসে যাই।
__________________
দেখতে দেখতে আরও দুটো দিন কেটে গেল। এই দুইদিনে অনেক চেষ্টার করেও রূপের বলা কথাগুলো মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলে দিতে পারছিনা আমি। আমার অধিক কৌতূহলী মনটাই আমায় ঐ কথাগুলোর দিকে আরও বেশি করে টানছে। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা আমি। আমি সকালে শাওয়ার নিয়ে চুল ঝাড়তে ঝড়তে এসব ভাবছি। আজ শুক্রবার তাই কোন তাড়া নেই। আদ্রিয়ান ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এসে চুল মুছতে মুছতে বলল,
— ” কী ব্যাপার বলোতো? দু-দিন যাবত দেখছি কিছু একটা নিয়ে ভেবেই চলেছো? এতো ভাবুক হলে কবে? কবি সাহিত্যিক হওয়ার প্লান করছো নাকি?”
ওর কথায় নিজের ভাবনা থামিয়ে মেকি হেসে বললাম,
— ” না আসলে এমনি..”
বলে টাওয়েলটা রেখে পাশ কাটাতে গেলেই আদ্রিয়ান আমার হাত ধরে নিলো। আমি তাকাতেই ও ওর সেই বিখ্যাত স্টাইলে মানে আড়াআড়ি ভাবে ভ্রু বাঁকিয়ে একপলক তাকালো আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” অনি এমন কিছু কী আছে যেটা তুমি আমায় বলনি বা বলতে চাও কিন্তু বলতে পারছোনা?”
আমি একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। আমি তো ওর কাছে দুটো জিনিসই এখনও বলতে পারিনি। ঐ টেরোরিস্টদের ব্যপারটা আর রূপের ঐসব কথা। কিন্তু রূপ তো রিকোয়েস্ট করল আদ্রিয়ানকে কিছু না বলতে আমার কী ঠিক হবে বলাটা? আচ্ছা রূপের কথা নাইবা বললাম। কিন্তু টেরোরিস্ট দের ব্যপারটা তো ওকে আমি খুলে বলতেই পারি। অন্তত একটা জিনিসতো ওকে জানানো হবে তাইনা? আদ্রিয়ান আমার সামনে তুরি বাজাতেই আমার হুস এল। ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— ” কী ভাবছো?”
আমি কিছু বলার আগেই দরজায় আপির নক পরল। আদ্রিয়ান কে আছে জিজ্ঞেস করতে, দরজার ওপাশ থেকে আপি বলল,
— ” আমি, খাবার সার্ভ হয়ে গেছে। খেতে যাবেতো নিচে? চলো?”
আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান ইশারা করে বলল নিচে যেতে। খাওয়ার জন্যে নিচে নেমে আমি আর আদ্রিয়ান দুজনেই চরম মাত্রায় অবাক হলাম। আদ্রিয়ান আর আমি অবাক দৃষ্টিতে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে আবার ডায়নিং টেবিলে তাকালাম। কারণ টেবিলে একটা চেয়ারে রূপ বসে আছে। ও এই বাড়িতে কীকরে এলো? হ্যাঁ ও ওর বাবার বন্ধুর ছেলে তাই বলে হঠাৎ এখানে? আদ্রিয়ান এর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ও অনেকটাই রেগে গেছে। আমরা দুজনেই টেবিলে বসলাম। বাবা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আদ্রিয়ান রূপ এর ফ্যামিলি লন্ডন গেছে ওর পার্সোনাল একটা কাজে। ওর কাজ আছে তাই এখানে আছে। ছেলেটা ও বাড়িতে একা থাকবে তাই ভাবলাম এই এক সপ্তাহ আমাদের বাড়িতেই থাকুন।”
আদ্রিয়ান শক্ত হয়ে বসে আছে। আমি জানি ও রূপের এই বাড়িতে থাকাটা মোটেও ভালোভাবে নিচ্ছেনা। কিন্তু বাবার মুখের ওপরে কিছু বলতেও পারছেনা। আমারও ব্যপারটা ভালো লাগছেনা কিন্তু কী করবো? আমি রূপের দিকে তাকাতেই ও আমার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যতার হাসি দিলো। আমিও উত্তরে তাই করলাম। আদ্রিয়ানও সৌজন্যতার খাতিরেই দু-একটা কথা বলল। আদ্রিয়ান কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে ওপরে চলে গেল। তাই আমিও ঠিকভাবে খেতে পারলাম না। ওর সাথে ওর রুমে চলে গেলাম। রুমে যেতেই ও বলল,
— ” রূপের থেকে দূরে দূরে থাকবে। খুব বেশিই দরকার না পরলে কথাই বলবে না। গট ইট?”
আমি উত্তরে শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়েছি। যা রেগে আছে, এখন কথা বাড়ালেই ধমক মারবে পাক্কা। আদ্রিয়ান গম্ভীর মুখ করে বেডে বসে আছে। আমি ওর পাশে গিয় বসতেই ও হুট করে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। জেনো ছেড়ে দিলেই আমি কোথাও একটা হারিয়ে যাবো। হঠাৎ এরকম কেন করছে ও? আমিও কীসব ভাবছি আমি কোনোদিন ওর কোন কাজ বা কথার মানে বুঝতে পেরেছি যে আজ বুঝবো? সব ইঞ্জিনিয়ার গুলোই এরকম হয়? ম্যাথস এর মতো জটিল আর কঠিন কিন্তু একবার বুঝে গেলে ভীষণ মজার। নাকি ও একাই এরকম সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হয় আমার।
__________________
তিনটা দিন কেটে গেছে রুপ এই বাড়িতে আছে। ও যদিও নিজেই আমার সাথে কথা বলতে চায় কিন্তু আমিই যথেষ্ট এবোয়েট করি ওকে। আদ্রিয়ান এমনিতে ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণই করে কিন্তু মনে মনে যে বিরক্ত হয় সেটা খুব ভালোকরেই বুঝতে পারি। কিন্তু বাড়ির বাকি সবাই রূপকে বেশ পছন্দ করে কারণ তিনদিনেই মিষ্টি মিষ্টি কথা আর মিশুক আচরণ দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছে। কাল থেকে আবারও আমায় সেই কথা বলতে চাইছে ও কিন্তু আমি এভোয়েট করে গেছি। আদ্রিয়ান জানলে ব্যপারটা ভালো হবেনা। আমি মেডিকেল থেকে বাড়িতে এসে দেখি আজ বাড়িতে কেউই নেই। আমি বেশ অবাক হলাম। এইসময় সব কোথায় গেল? মামনী, বড় আম্মু, আর আপির তো অন্তত থাকার কথা।বাড়ির এরকম নিরবতা খুব বেশি অস্বাভাবিক লাগছে। আমি ওপরে ঊঠে করিডর দিয়ে নিজের রুমে যেতে নেবো তখনই কেউ আমার হাত টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল আর তাড়াতাড়ি দরজা লক করে দিল। ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটলো যে অবাক হওয়ার মত পর্যাপ্ত সময়টাও পেলাম না। তবে ভয় যথেষ্ট পেয়েছি। তাকিয়ে দেখি রূপ।
#চলবে…