ভালোবাসি তোকে পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
4462

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৪
.
সেই চরম অভিশপ্ত দিনটার কথা মনে পরলে আজও আমার বুক কেঁপে ওঠে। জীবণে প্রথমবার কোথাও ঘুরতে গেছিলাম বলে আমার আফসোস হয়। আজও আফসোস হয়। ভীষণরকমের আফসোস হয়। কলেজ থেকে টুর এ যাওয়ার কথা শুনেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে আমার। তাও সুন্দরবনে? পরিবারের সাথে বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরতে গেলেও সুন্দরবন যাওয়া হয়নি। তাই সুন্দরবন যাওয়া নিয়ে অনেক এক্সাইটেড ছিলাম। আব্বু আম্মুও বারণ করেননি আমায়। কলেজ থেকে সরাসরি বাসেই আমরা সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি।বেশ কয়েকঘন্টা জার্নির পর বাস থামলো নদীর এপারে। এখান থেকে পাঁচ মিনিটের মতো হেটে নদীর কাছে যেতে হয় আর নদী পার হয়ে সুন্দরবনের টুরিস্ট এরিয়াতে। কিন্তু ওখানে নামার সময় দুপুর ছিলো তাই স্যারেরা বলল আগে সবাই খেয়ে নাও তারপর কিছুক্ষণ এখানে রেস্ট করে আমরা ওপারে যাবো। সবার হাতে হাতে খাবারের প্যাকেট দিয়ে দিলো স্যারেরা। আমি আর ইশু এক কলেজেই পড়তাম তাই একসাথেই ছিলাম ওখানে এক বিরাট গাছের নিচের শিকড়ে বসে দুজন গল্প করতে করতে খেয়ে নিলাম। এরপর দুজনেই ওদিক দিয়ে হাটতে হাটতেই টুকটাক গল্প করছি। হঠাৎ আমারে সিআই স্যার ইশুকে কীজন্য জেনো ডাকল। ও ওখানে গেল আর আমি এদিক ওদিকের ছবি তুলছি। খেয়াল করলাম রাস্তার সাইডেও একটা জঙ্গল, জঙ্গলটা হয়তো ভেতরে আরও আছে। আমি ভাবলাম একবার ভেতরে গিয়ে হেটে কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে আসি। কিন্তু কিছু হবেনা তো? দূর কী আর হবে এটা রিস্কি নয় নিশ্চয়ই। তাহলে স্যারেরা নিশ্চয়ই আমাকে আগে থেকেই শতর্ক করে দিতো। আমি কিছুক্ষণ এসব ভেবে ভেতরে ঢুকেই গেলাম। সবকিছুই বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে অনেকগুলো ছবিও তুললাম হাটতে হাটতে। আর আমার মাথায় ছবি তোলার নেশা একবার ঢুকলে সেটা আর সহজে কাটেনা। তাই এই ছবি তুলতে তুলতে কখন যে বেশ ভেতরে চলে গেছি নিজেরও খেয়াল নেই। হঠাৎ করেই প্রচন্ড জোরে কয়েকটা গুলির আওয়াজ শুনে কেঁপে উঠলাম আমি। গুলি চলল কোথায়? আর কীকরে? এখানে গুলি কে চালাবে? আর গুলির আওয়াজটাও খুব কাছেই হয়েছে তাই আরও বেশি ভয় করছে। মস্তিষ্ক বলছিল ‘অনি ফিরে যা’, ‘চলে যা এখান থেকে এখানে থাকলে বিপদ হবে’। কিন্তু নিজের মনকে সে কথা বোঝাতে পারলাম না। এককদম দুকদম করে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ ওখানে কালো পোশাক পড়া লোক দেখেই গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম আমি। আর আড়াল থেকে যা দেখলাম তাতে রুহু কেঁপে উঠলো আমার। কয়েকজন লোকের রক্তাক্ত লাশ পরে আছে নিচে। আর দুজন কালো পোশাক পড়া লোক সেই লাশ টেনে সরাচ্ছে। ওখানে ছোট্ট একটা তাবুও আছে। বাইরে চারপাশে সব কালো পোশাকগুলো লোকগুলো পাহারা দেওয়ার স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে। আর মাঝখানে চারজন বসে আছে একজনের হাতে বন্দুক আছে। তবে তিনজনের মুখেই মাস্ক আছে। হয়তো সেই এখন এই খুনগুলো করলো। আমার হাত পা কাঁপছে। দুইজন মানুষের খুনের জলজ্যান্ত সাক্ষী হলাম আমি? এখন কী করব আমি পালিয়ে যাবো? এখানে থেকেও তো কিছু করতে পারবোনা আমি। এরচেয়ে ভালো আপাতত চলে যাই এখান থেকে। একপা পেছাতে নিলেই হোঁচট খেয়ে পরে গেলাম আর পায়ে ব্যাথা পেয়ে না চাইতেও চিৎকার করে ফেললাম। সাথেসাথেই ওদের সবার চোখ পড়ল আমার দিকে। আমি ভীত দৃষ্টিতে তাকালাম। মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের মধ্যে একজন বলল,

— ” আরে এটা কোথা থেকে এলো?”

আরেকজন বলল,

— ” ওই ধরে নিয়ে আয় এদিকে।”

আমি ভয় পেয়ে উঠে যেতে নিয়েও পা ধরে বসে পড়লাম। পায়ে বেশ জোরেই ব্যাথা পেয়েছি আমি। চোখ দিয়ে জল চলে এসছে। কিন্তু এরা ধরে ফেললে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। তাই কোনোরকমে গাছ ধরে উঠে দাঁড়িয়ে পালাতে চাইলাম কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলোনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই ওরা এসে ঘিরে ফেলল আমাকে। আমি কিছু বলার আগেই আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে ওদের কাছে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওই মাঝখানে ওই তিনজনের সামনে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলল। আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে সামনের লোকগুলোর দিকে তাকালাম। এরা যে কতটা নৃশংস সেটা একটু আগেই দেখেছি আমি। ভয়ে কেঁদেই চলেছি আমি। আমাকেও মেরে ফেলবে নাকি এখন এরা? মাঝখানে দাঁড়ানো লোকটা বলল,

— ” দেখেতো বাচ্চা মনে হচ্ছে। এখানে কেন এসছো?”

আমি মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। পাশের আরেকজন ধমক দিয়ে আমার পায়ের কাছে একটা শুট করে বলল,

— ” কী হলো বলো?”

আমি কেঁপে উঠলাম হালকা। একটা শুকনো ঢোক গিলে ভাঙা গলায় বললাম,

— ” ক্ কলেজ থেকে টুরে এসছিলাম।”

মাঝখানের লোকটা এগিয়ে এসে আমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে বলল,

— ” কলেজ টুরে এসে কলেজের সবার সাথে না থেকে এখানে কেন এসছো একা একা?”

আগেরবার উত্তর না দেওয়াতে যেই জোরে ধমক দিয়েছে আর শুট করেছে তাই এবার সাথেসাথেই বললাম,

— ” ছ্ ছবি তুলতে তুলতে চলে এসছি।”

লোকটা একটু হাসলো। যদিও মুখ দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু হাসির আওয়াজ ঠিকই শুনতে পাচ্ছি। হাসার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” এজন্যই বলে বাচ্চাদের বাচ্চার মতই থাকতে হয়। এবার তোমার সাথে যেটা হবে সেটার জন্য তৈরী তুমি?”

লোকটা কথাটা ঠান্ডা গলাতে বললেও কতোটা যে ভয়ংকর ছিল সেটা যে কেউ বুঝতে পারবে। আমি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললাম,

— ” প্লিজ যেতে দিন আমাকে। আমি ইচ্ছে করে আসিই নি।”

লোকটা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

— ” কেন এসেছো সেটা ফ্যাক্ট নয়। এসেছ এটাই ফ্যাক্ট। আর এখানে ভুল করে হোক বা যেতে শুনে হোক একবার যারা আসে তারা আর ফেরত যায়না।”

আমি বুঝতে পেরে গেছি যে এরা আমাকে এভাবে ছাড়বেনা বাঁচতে চাইলে নিজেকেই যা করার করতে হবে। আমি উঠে দৌড় দিতে গেলেই লোকটা আমার হাত ধরে ফেলল। আর ভীষণ জোরে মুচড়ে ধরল, ব্যাথায় চোখ মুখ কুচকে এলো আমার। বা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলল,

— ” বাংলা বুঝতে পারোনা ? এখানে তুমি নিজের ইচ্ছাতে আসলেও যাবে আমাদের ইচ্ছাতেই। তাও ওপরে!”

আমি ভয়ে এবার শব্দ করেই কেঁদে দিলাম। আমার হাত ধরে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” প্লিজ ছেড়ে দিন। বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই এখানে জাস্ট ছবি তুলতে এসছি।”

আমার কথা যেনো এরা শুনতেই পায়নি। ডান পাশের লোকটা আমার মাথায় বন্দুক তাক করে বলল,

— ” এটাকে উড়িয়ে দেই এখনই?”

— ” আরে না। এতো তাড়ার কী আছে। এটাকে তাবুর মধ্যে ফেলে রাখ বাকিটা পরে দেখছি।”

— ” এখানে তো দড়ি নেই।”

— ” চারপাশেই পাহারা আছে দড়ির প্রয়োজন নেই। জাস্ট একটু চোখ কান খোলা রাখতে হবে। নিয়ে যা।”

আমি যাবোনা বলে কান্নাকাটি করাতে মাঝখানে দাঁড়ানো সেই লোকটা এতো জোরে ধমক দিল যে আমি পুরো স্হির হয়ে গেলাম। লোকগুলো আমাকে টেনে তাবুর ভেতরে নিয়ে ফেলে রেখে চলে গেলো। আমি হাটু গুটিয়ে বসে নিরবে কান্না করে যাচ্ছি । হঠাৎ এসব ঘটনাগুলোতে আমি শকড হয়ে যাচ্ছি। কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। কেন এলাম এখানে? এখানে না এলে এরকম বিপদে পরতাম না। ওরাকী সত্যিই মেরে ফেলবে আমাকে? বাড়ির কাউকেই আর দেখতে পাবোনা কখনও আর। এসব ভাবতে ভাবতেই বাইরে ওদের কথার আওয়াজ পেলাম। ভালো করে শোনার জন্য তাবুর সাইড ঘেসে কান পাতলাম। ওরা বলছে,

— ” মেয়েটাকে ভেতরে রেখে এলে কিন্তু ভেতরে তো ফাইলটা আছে।”

— ” তো? ওই পুচকি মেয়ে আর কী করবে?”

— ” দেখো বোঝার চেষ্টা করো। ফাইলটা খুব ইম্পর্টেন্ট আমাদের জন্যে। কাউকেই হালকাভাবে নেওয়া উচিত না।”

আমি ভাবছি কীসের ফাইল? যেটা আমার হাতে পরলেও সমস্যা? কী করতে চলেছে এরা। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে কেউ একজন বলল,

— ” এক্সাক্টলি। ক্যামব্রিজের ফাইনাল ইয়ারের বেস্ট স্টুডেন্টদের দিয়ে বানিয়েছি মডেলটা। আর ওটার ভেতরের সেই পাসকোড কতটা ইম্পর্টেন্ট বোঝ? একবার এটা হারিয়ে গেলে এরকম আইডিয়া আবার কালেক্ট করতে কতো বছর লাগবে জানো?”

আমি ভাবছি ক্যামব্রিজ মানে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির কথা বলছে এরা? ওরা আবারও বলল,

— ” তাছাড়াও ওই সবকটা ইঞ্জিনিয়ার কে তো আমরা ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওদের দিকে আবারও বানাবো সেই উপায়ও নেই।”

আমার পিলে চমকে উঠলো পুরো। কতোটা ভয়ংকর এরা? কিন্তু ফাইলটা কীসের, কীসের মডেল আর কীসেরই বা পাসকোড যার জন্যে এরা এতো নৃশংস হয়েছে? আমি কান পেতে বাকিটা শোনার চেষ্টা করলাম। ওরা বলল,

— ” এই ফাইলের মাধ্যমেই সেই সফটওয়্যারটা তৈরী করা যাবে। সেই সফটওয়্যার এর মাধ্যমে আমরা একজায়গায় বসে একই সময়ে কয়েকজায়গায় ব্লাস্ট করাতে পারব।”

— ” হ্যাঁ এবার একবারে পাঁচটা হোটেলে ব্লাস্ট করাবো আমরা। সেসব হোটেলেই যেখানে ওই ইহুদি খ্রিষ্টানরা এসে ভীর করে। আর সামনে তো দুর্গা পুজোও আছে। আর এই জেনো করে ওরা দশমীতে। হ্যাঁ… রাবণ দহন। রাবণকে জ্বালায় ওরা। তবে এবার শুধু রাবণ জ্বলবে না সাথে ওরাও জ্বলবে। এরা ওইসব পুলিশ, সিবিআই, আন্ডারকভার অফিসারস আর ইনভেসটিগেটররাও কিচ্ছু করতে পারবেনা। কারণ ওরা একসাথে কটা জায়গা বাঁচাবে এবার আমরাও দেখতে চাই। সবগুলোকে শেষ করবো।”

ওরা সবাই একসাথে বলে উঠল ‘ইনশাআল্লাহ’।” আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তারমানে এরা সবাই টেরোরিস্ট? এরা সবাই মিলে এরকম ধ্বংসলীলা চালানোল চেষ্টা করছে? আর জেনেও আমি কিচ্ছু করতে পারবোনা। আমি তাড়াতাড়ি পুরো তাবুজুড়ে সেই ফাইলটা খুজলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েও গেলাম।ফাইলটা হাতে নিয়ে ভাবছি হয়তো সেই হোটেলগুলোতে আমি বা আমার পরিবারের কেউ থাকবেনা, সেই দশমীর উৎসবেও আমরা থাকবো না কিন্তু যারা থাকবে তারাও তো কারও বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী বা আত্মীয়? তারচেয়েও বড় কথা মানুষই তো থাকবে। আর এতো নিরীহ মানুষকে মারাটাকে এরা ধর্ম বলে দাবী করে? জিহাদ বলে? জিহাদ শব্দের অর্থ বোঝে এরা? জিহাদের আসল মানে তাৎপর্য জানে? এতো ঘৃণ্য এবং জঘন্যতম কাজকে এরা ইসলামের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। ইসলামের মত শান্তির ধর্মকেও এরা জঙ্গিবাদের ধর্মে পরিণত করতে চাইছে। জিহাদের নামে ইসলামের গায়ে দাগ লাগানোর জন্যে উঠে পরে লেগেছে।

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৫
.
আমি ফাইল টা একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে ভাবলাম যে সামনের দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়াটা পসিবল না। কারণ সামনে ওরা সবাই সামনেই আছে, আমি পেছনের দিক দিয়ে তাবুর কাপড়টা হালকা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম পেছনের দিকে শুধুমাত্র তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। যদি পালাতে হয় তাহলে এখনই পালাতে হবে। কিন্তু এই তিনজনকে টপকেই বা পালাবো কীকরে? কিন্তু পালাতে তো হবেই অন্তত এই ফাইলটা ওদের কাছ থেকে সরানোর জন্যে হলেও। চারপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ খোজাখুজির পর নিচে দেখলাম মাটির চাকা আছে কিছু। আর বাকি সব মাটিই গুড়ো, বালুমাটির মতো। কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবার পর আমি একহাতে একটা চাকা মাটি, আরেকহাতে ঝড়ঝড়ে মাটিগুলো হাতে নিলাম। জানিনা কতোটা কী কাজে দেবে কিন্তু এটা ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায়ও নেই। এখানে থাকলে এমনিতেই মরতে হবে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা কোথায়? আমি তাবুর পেছনের সেই অংশ হাত দিয়ে আস্তে আস্তে টেনে ছাড়িয়ে আমার বেড় হওয়ার উপযোগী করলাম। এরপর হাতে সেই চাকা মাটিটা একটু জোরেই এক কোণে ঝোপের ওপর ছুড়ে মারলাম। তিনজনই চমকে উঠলো। একজন বলল,

— “যাতো গিয়ে দেখ ওখানে কী হয়েছে?”

একজন ওদিকে গেলো। আমি ভাবছি দূর, মাত্র একজন গেলো? কিন্তু কী আর করার এভাবেই সামলাতে হবে। আমি ফাইলটা বগলের নিচে রেখে একহাতের মুঠোতে রাখা মাটিগুলো দুইহাতের মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে আস্তে করে বেড়িয়ে গেলাম ওদের দুজনের চোখ আমার দিকে পরার সাথেসাথেই আমি সেই মাটি দুহাতেই ওদের দুজনের মুখ দিকে ছুড়ে মারলাম, ফাইলটা মাটিতে পরে গেলো। ওরা দুজনের চোখ মুখ কুচকে মুখে হাত দিয়ে বাকিদের চিৎকার করে ডাকলো আমি সুযোগ পেয়ে ফাইলটা তুলে দৌড় দিলাম। কোনোদিকে যাচ্ছি নিজেও জানিনা আপাতত এদের হায থেকে বাঁচতে হবে। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয় গাছের একটা শেকড়ের সাথে আটকে পরে গেলাম। ওরা পেছনে থাকায় আমার কাছে আসতে সময় লাগলো না। আমি এতোটাই ভয় পেয়ে গেছি যে উঠার শক্তিও পাচ্ছিনা। ওরা আমার কাছে চলে এলো, সাথে ঐ মুখোশ পড়া তিনজনও। আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এইমুহূর্তে আমার। মৃত্যুকে এভাবে নিজের চোখের সামনে দেখলে যে কারো মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, আমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে, কিন্তু তবুও ফাইলটা বুকে জড়িয়ে ধরে রেখে দিয়েছি। ওদের মধ্যে একজন বলল,

— ” বলেছিলাম না তখন মেরে দিলেই ভালো হতো? দেখলেতো কী হতো এখন যদি পালিয়ে যেতো?”

আরেকজন বলল,

— ” হ্যাঁ সেটাই দেখছি। বাচ্চা হলেও মাথায় যে এতো বুদ্ধি সেটা বুঝিনি। এরকম বুদ্ধিজীবীদের বেশিদিন বেঁচে থাকাটা ঠিক না।”

বলে আমার দিকে বন্ধুক তাক করতেই কী হলো আমার জানিনা হয়তো বাঁচার একটা শেষ ইচ্ছা মাথায় চারা দিয়ে উঠল হাতের মুঠোয় এবার আর ধুলোমাটি পেলাম না কাদামাটি পেলাম খামছে সেটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ছুড়ে মারলাম যে বন্ধুক তাক করেছে তার দিকে। এরপর ফাইলটা সহই উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম কিন্তু বেশ কিছুটা যাওয়ার পরেই প্রচন্ড জোরে একটা গুলির আওয়াজ পেলাম, আর সাথে সাথেই আমার পিঠে ভীষন ব্যাথা আর জ্বালা অনুভব করলাম। কয়েক সেকেন্ডেই বুঝে গেলাম ঠিক কী হয়েছে আমার সাথে। হাটু ভেঙ্গে বসে পরলাম, সবটাই ঘোলা হয়ে আসছে, ঝাপসা লাগছে সবকিছু আস্তে আস্তে মাটিতেই লুটিয়ে পরলাম। নিশ্বাস সব আটকে আসতে চাইছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।

সাথে সাথেই চমকে উঠলাম আমি। হাতে চোট থাকায় ব্যাথা পেয়ে বেশ শব্দ করতে চেয়েও পারলানা গলায় ব্যাথা লাগছে। পাশ থেকে আদ্রিয়ান উঠে বসে বলল,

— ” কী হয়েছে অনি। কষ্ট হচ্ছে কোথাও? ব্যাথা করছে।”

আমি বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালাম, কথা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না কারণ গলা এখনও ঠিক হয়নি।আপির কোলে কখন ঘুমিয়ে পরেছি নিজেই বুঝতে পারিনি। আর ঘুমের মধ্যেও এসব। ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেছে আমার। গলা শুকিয়ে গেছে। আমি আদ্রিয়ানকে আঙ্গুলের ইশারায় পানি দিতে বললাম। আদ্রিয়ান দ্রুত জগ থেকে পানি নিয়ে আমার কাছে নিয়ে আমার ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে মুখ বরাবর ধরল। আমি পানিটা ডগডগ করে গিলে খেয়ে ফেললাম। আদ্রিয়ান হাত বাড়িয়ে টাওয়েলটা নিয়ে আমার শরীরের ঘামগুলো ভালোভাবে মুছে দিয়ে আমায় খাটে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিয়ে আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

— ” কী হয়েছিল?”

অামি শুকনো একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে বললাম কিছুনা। আদ্রিয়ান এবার আমার পাশে শুয়ে আলতো হাতে আমায় নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,

— ” খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। ও আমার মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলল,

— ” মাথা ব্যাথা করছে কফি খাবে?”

আমি এবারেও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। আদ্রিয়ান আমাকে আবার বালিশে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল,

— ” তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।”

বলে কফি আনতে চলে গেলো। আমি ওর যাওয়ায় দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এখন সন্ধ্যা। আজ আবার অনেকদিন সেই দিনটা এতো স্পষ্টভাবে আমার স্বপ্নে এলো। সেদিন গুলি লেগে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর জ্ঞান ফিরে নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করেছিলাম নিজেকে। তখন ফাইলটা আমার হাতে ছিলোনা। আমাকে নাকি পুলিশ ফোর্সেরই এক টিম হসপিটালে দিয়ে গেছে। আমি নাকি গুলি লাগা অবস্থায় ঐখানে পরে ছিলাম। টি?টিচাররা, বাবা-মা সবাই খুব বকেছিল আমায় ওখানে একা যাওয়ার জন্যে। কিন্তু আমিতো ধরেই নিয়েছিলাম যে ফাইলটা ওই টেরোরিস্টদের হাতেই আছে খুব কান্না পাচ্ছিল অাফসোসও হচ্ছিলো যেটার জন্যে এতোটা কষ্ট করলাম সেটাই হলো? কিন্তু সেদিন মেডিকেলে যখন আমাকে ঐ ফাঁকা রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল যে ফাইলটা কোথায়? সেদিনই শিউর হয়ে গেছিলাম যে ফাইলটা ওদের কাছে নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ফাইলটা আছে কাদের বা কার কাছে। পুলিশের হাতে পরলে অবশ্যই টিভি বা নিউসপেপারে দেখাতো। তাহলে আছেটা কার কাছে? আর যার কাছেই আছে তার উদ্দেশ্যটা কী? হঠাৎ আমার মুখের সামনে তুরি বাজাতেই আমি চমকে উঠলাম। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

— ” এইটুকু একটা মাথা নিয়ে কী এতো ভাবতে থাকো বলবে? ও সরি এখনতো আমাদের মিস বকবকানির সব বকবক ট্যামোরারি লক হয়ে গেছে। তাইনা?”

আমি এবার একটু রেগে তাকালাম ওর দিকে। ও হেসে দিয়ে বলল,

— ” আচ্ছা সরি। এবার কফিটা খেয়ে নাও ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

আমি ওর দিকে একটা বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেংচি কেটে কফির মগটি হাতে নিয়ে মুখ ফুলিয়ে কফি খেয়ে যাচ্ছি। ওও আমার পাশে বসে চুপচাপ কফি খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর আমার দিকে আড়চোখে দেখছে আর ততবারই আমি সুক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছি। হঠাৎ ও বলল,

— ” তুমি জানো প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন এই মুমেন্টটা বেশ এনজয় করছি। মানে আগে সারাদিন তুমি বলতে আমি শুধু শুনতাম। কিন্তু এখন আমি বলছি আর তোমাকে সব শুনতে হচ্ছে। রিপ্লে করার অপশনই নেই। এমন সুযোগ কজন হাজবেন্ডের কপালে জোটে বলোতো? যে যা বলবে চুপ করে শুনবে কোনো রিপ্লে করবে না।

আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম ওর দিকে। ও কফিতে একটা চুমক দিয়ে বলল,

— ” কারণ বউ নামক বস্তুটিকে চুপ করানো খুবই কঠিন কাজ। তাইনা?”

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে কফি খাচ্ছি। ব্যাটা বজ্জাত, এখন আমি কথা বলতে পারছিনা বলে তুমি আমাকে এরকমভাবে লেগপুল করছো তো? আপনা টাইম ভী আয়েগা। সেদিন বুঝবে। হুহ। আমি কফি শেষ করে বই নিয়ে পড়তে বসে গেলাম। আর ওও কোনো কথা না বাড়িয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল।

___________________

আজ সারাদিনই আদ্রিয়ানকে ভীষণভাবে জ্বালিয়েছি। কালকে আমার লেগপুল করেছিল না তাই আজও বদলা নিলাম। আসলে জ্বালানোর পদ্ধতিটাও ছিলো কিছুটা এরকম, আমি ওকে ইশারা করে কিছু একটা বলছি আর ওও সেটা বুঝে নিয়ে করছেও কিন্তু ঠিক তারপরেই আমি বলি যে আমি এটা করতে বলিনি ও ভুল বুঝেছে। সকালে পড়ার জন্যে বই চেয়েছিলাম ওর কাছে ইশারায় যেই বইটার কথা বলেছি ও কিন্তু আমাকে সেই বইটাই বেড় করে দিয়েছে কিন্তু দেওয়ার পর আমি বলেছি যে আমি এক্চুয়ালি অন্য বইটা চাইছিলাম। ও আমাকে কিছু না বললেও ওর চোখে মুখে একপর্যায়ে বিরক্তি দেখেছি আমি আর মনে মনে একদফা হেসেও নিয়েছি এসব দেখে। এখনও ওর ল্যাব থেকে আসার জন্যেই অপেক্ষা করছি আমি। ও এলে ওকে আরেকদফা বিরক্ত করা যাবে। এসব ভিবতে ভাবতেই মহান মহোদ্বয়ের আগমন ঘটল। ও আসার পর আমি চুপচাপ বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলাম। আদ্রিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের টাই শার্ট খুলছে আর আমি আড়চোখে ওকে দেখছি। ও একেবারে ফ্রেশ হয়ে এসে আমার পাশে বসে বলল,

— ” পড়া কম্প্লিট হয়নি? খাবে এখন?”

আমি ইশারা করে ওকে বোঝালাম যে অনেক লেট হবে বেশ খানিকটা বাকি আছে, পড়া শেষ হলেই খাবো। ও বলল,

— ” ওহ আমি তাহলে মনিকে বলে দেই ঘুমিয়ে পরতে আমিই গিয়ে নিয়ে আসবো পরে।”

বলে ফোন বেড় করে কল করে মনিকে বলে দিল ঘুমিয়ে পরতে। ঠিক তার দশ মিনিট পরেই আমি ওকে ইশারায় বললাম, আমার পড়া শেষ এখন খাবো। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

— ” একটু আগে না বললে দেরী হবে পরে খাবে? ”

আমি অবাক হওয়ার ভান করে আবারও ইশারাও বোঝালাম আমি এমন কিছুই বলিনি। ও আর কথা না বাড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে চলে গেল খাবার আনতে। আমার তো জোরে জোরে হাসতে ইচ্ছে করছে। খাওয়ার সময়ও বেশ অনেক্ষণ পর্যন্ত জ্বালিয়েছি ওকে। শুয়ে পরার পর শুতে যাবে তখনই আমি ওকে ইশারায় কিছু বললাম। কী বলেছি আমিও জানিনা জাস্ট ওকে কনফিউসড করে জ্বালানোর জন্যে বললাম। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও বুঝলোনা আমি কী বলতে চাইছি। বুঝবেটা কীকরে? আমি নিজেই তো বুঝতে পারছিনা আমি কী বলছি। ও এবার চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আমার দিকে। এরপর বেডে ওঠে আমার দুপাশ দিয়ে বেডের ওপর দুহাত রেখে খুব কাছে চলে এলো। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ও ভ্রু নাচিয়ে বলল,

— ” হোয়াট? এখন এভাবে দেখছো কেনো হুমম? তুমিই তো ইশারায় বললে অনেকদিন হলো তোমাকে আদর করিনা আজ একটু আদর করতে। তো বউয়ের রিকোয়েস্ট তো ফেলতে পারিনা তাইনা?”

আমি অাহম্মক হয়ে গেলাম। আমিতো নিজেই জানিনা আমি কী বলেছি। এ এত বেশি বুঝে গেল কীকরে। হাত পায়ে ব্যাথা আছে তাই নড়তেও পারছিনা। আমি মাথা নেড়ে বোঝালাম যে আমি এমন কিছু বোঝাইনি। ও আমার নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,

— ” এখন আর এসব বললে হবেনা জানপাখি। সারাদিন অনেক জালিয়েছো আমাকে এবার আমার পালা।”

আমি আসলেই ডাফার। বারবার ভুলে যাই এটা আদ্রিয়ান? একে জ্বালাতে গেলে উল্টৌ শেষে নিজেকেই জ্বলতে হয়। ও যে বরাবরই সবার এক কাঠি ওপরে থাকে এটাতো কমন সেন্স।সেটাও নেই আমার? ড্যাম!

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৬
.
আদ্রিয়ান এতোটা কাছে চলে এসছে যে আমার চোখে মুখে ওর নিশ্বাস আছরে পরছে। আমি আর নিজের চোখ খোলা রাখতে পারলাম না, চাদর খামছে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ছাড়ানোর চেষ্টা করতেও পারছিনা শরীরে ব্যান্ডজ তার সাথে এতো ব্যাথাও আছে। আর সেই সুযোগটা মশাই খুব ভালোভাবেই নিচ্ছে। আদ্রিয়ান আমার সামনে থাকা চুলগুলো সব আলতো হাতে সরিয়ে নিয়ে আমার কপালে চুমু দিলো। আমি পুরো শক্ত হয়ে আছি। হঠাৎ ও আমার মুখে ফু দিতেই আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। ও মুচকি হেসে আমার নাকে নাক ঘষে বলল,

— ” সুস্থ নও তাই আজ ছেড়ে দিলাম। বাট, এরপর কারো সাথে লাগতে আসার আগে এটা ভেবে নিও যে কার সাথে লাগতে আসছো? হুম?”

আমি একটা ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। ও হেসে বলল,

— ” তুমি বলোনা যে আমার ভ্রু বাঁকানোর স্টাইলটা বিখ্যাত? কিন্তু তুমি কী জানো তোমার মুখ ভেংচি দেওয়ার স্টাইলটাও বিখ্যাত?”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ও আমার নাক টিপে দিয়ে বলল,

— ” অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পরো।”

আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ও আমার ওপর হাত রেখে আমার গলায় মুখ গুজে শুয়ে রইল। আমি কিছু বললাম না কারণ হাত পায়ে ইঞ্জুরি থাকায় ওর বুকে শুতে পারিনা আমি। কিন্তু তাতে কী ইন্ডিয়া তে যেমন টিকটক ব্যান হওয়ার পর তার রিপ্লেসমেন্টে ইন্সটাগ্রাম রিল ব্যবহার করছে। ঠিক তেমনি আমায় বুকে নিতে পারছেনা তো কী হয়েছে? এটা ঠিক অন্যভাবে পুশিয়ে নেয়। তবে ওর এসব কাজ আমার ভালোই লাগে। চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে যেই হাতটা ভালো আছে সেটা দিয়েই আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।

__________________

দেখতে দেখতে দুইটা মাস কেটে গেছে। এখন আমি পুরোপুরি ভাবে সুস্হ। আর আমি এখন হাটতে চলতে কথা বলতে সব কিছুই করতে পারি। আমি যখন পুরোপুরি ক্লিয়ারলি কথা বলতে পারি তখন আদ্রিয়ান আমাকে হতাশ কন্ঠে বলেছিল, ” আমার শান্তির দিন শেষ হয়ে গেল।” আমি ওপর দিয়ে রাগ দেখালেও ভেতরে ভেতরে একটুও রাগিনি কারণ আমি জানি আমার ভয়েজ ফিরে আসায় সবচেয়ে বেশি ওই হয়েছিল।

আজ আপি আর ইফাজ ভাইয়ার ফার্স্ট ম্যারেজ এনিভার্সিরি। আপির বিয়ের সুত্রেই তো আদ্রিয়ান এই পরিবারের সাথে আমাদের পরিচয় কীভাবে একটা বছর পার হয়ে গেল ভাবতেই পারছিনা। সত্যিই সময় কত দ্রুত চলে যায়। আজ আপি আর ইফাজ ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্লান ছিল আমাদের। ও বাড়ি থেকে কাব্য, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, মলি আপু, মিলি আপু, দুলাভাইরা মানে প্রায় সবাই এসছে সাথে সৃষ্টি আপুও। এদিকে জাবিন, আদিব ভাইয়া, আদ্রিয়ান আর আমিতো আছিই। আজ ওদের দুজনকেই কাজের বাহানায় বাইরে পাঠিয়ে সবাই মিলে ছাদ সাজিয়েছি সুন্দর করে। এত সুন্দর করে সাজিয়েছি। ওরা এলেই ওদের সারপ্রাইজ দেবো সেটাই ছিলো প্লান। ওরা দুজন আসতেই আমরা সবাই মিলে একসাথে উইশ করে সব দেখিয়ে ওদের চমকেদিয়েছি। এরপর সবাই মিলে সেলিব্রেশন করলাম। সবাই যখন একসাথে খেতে বসেছি তখন দাদী দুষ্টুমি করে বলল,

— ” কীরে আমার একজনের একবছর পূর্ণ হয়ে গেলো আরেকজনের প্রায় হয়ে এলো ভালো খবর কবে দিবি তোরা?”

সবার সামনে দাদীর এমন লাগামছাড়া কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম, আপিও লজ্জা পেয়েছে নিঃসন্দেহে। আদ্রিয়ান আমার কাধে হাত রেখে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” বউমনির খবর ভাইয়া জানে। কিন্তু আমার বউ এখনও নিজেই বাচ্চা দাদী। বাচ্চা পালার বয়স ওর এখনও হয়নি। যখন হবে তখন দেখো একটা ক্রিকেট টিম বানিয়ে তবেই দম নেবো।”

আমার কাশি শুরু হয়ে গেল আদ্রিয়ানের কথা শুনে। বাকি সবাই যারা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনছিল তারাও এখন গলা ঝেড়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আমি কোনোরকম মুখে কটা গুজে ওপরে চলে এলাম। এভাবে সবার সামনে বলতে হয়? লজ্জায় মাটিতে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার।

এসবকিছুর মাঝে ভুলেই গেছিলাম ঐ টেরোরিস্টদের কথা। সবকিছুই তো স্বাভাবিকভাবেই চলেছে এতোদিন। জানিনা পরবর্তীতে কী হবে? কিন্তু যতদিন ভালো সময় যাচ্ছে সেটাকে ভালোভাবেই উপভোগ করতে চাই। তবে আজ আদ্রিয়ান এতো খুশি থাকলেও কালকের দিনটা নিয়ে ভয়ে আছি আমি। কালতো ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যু বার্ষিকী। কাল ওকে সামলাতে যে অনেক বেগ পেতে হবে সেটা জানি। আল্লাহর কাছে এটুকুই প্রার্থনা। ও যাতে নিজেকে সামলে নিতে পারে।

___________________

সকালে রোদের আলো চোখে মুখে পরতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান নেই। আজ ও আর আমি দুজনেই সকালে একসাথে ফজরের নামাজ পড়েছি। ইশরাক ভাইয়ার জন্য দোয়া করেছি। আমি বেড থেকে নেমে ধীরপায়ে ব্যালকনিতে গেলাম। গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান রেলিং ধরে একদৃষ্টিতে আকাশ দেখছে। আমি ওর চোখে হালকা ছলছলে ভাব আছে। আমি ওর কাধে হাত রাখতেই ও তাকিয়ে আমাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

— ” ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। আজ ও বাড়িতে যাবো। আর হ্যাঁ হালকা কালারের ফুল হাতা কোনো একটা স্যালওয়ার সুট পরো আজ।”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। একটা সাদা রং এর স্যালওয়ার সুট পরে।ভালোভাবে রেডি হয়ে নিলাম। আদ্রিয়ানও সাদা পাঞ্জাবী, টুপি পড়েছে। এরপর বাড়ির সবাই বেড়িয়ে গেলাম ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি আঙ্কেল গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আন্টি নিরবে চোখের জল ফেলছেন। আর নূর আপু ইসরারকে কোলে নিয়ে বসে চুপচাপ বসে আছে। হুজুররা আসেননি এখনও। আদ্রিয়ান আর আদিব ভাইয়া সব কিছু কতদূর ব্যবস্থা হয়েছে, হুজুররা কখন আসবে এসভ দেখতে গেলেন। আমি নূর আপুর পাশে গিয়ে বসলাম। ইসরার ঘুমিয়ে আছে তাই ওকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তারপর নূর আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” কান্না আটকে রেখোনা আপু। তোমার। আজকে নিজের মন মত কেঁদে নিজেকে হালকা করো।”

নূর আপু অসহায়ভাবে আমার দিকে একবার তাকিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলো। এমন কান্না যা শুনলে যেকারো হৃদয় কেঁপে উঠবে। আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টায় আছি।আমি ইশরাক ভাইয়াকে মাসখানেকের মতই দেখেছি। একমাসেরই পরিচয় আমাদের। কিন্তু আমাকে সবসময় বোন বলত। এত মিশুক, প্রাণচ্ছল মানুষ আমি জীবণে খুব কম দেখেছি। ওনার সেই অট্টোহাসি, আড্ডার মহল তৈরী করা সব ভীষণ মনে পড়ছে। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ের আমার এতো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ওদের কাছের মানুষদের মনের অবস্থা কতটা ভয়াবহ সেটা ভাবলেই আমার আত্মা কেঁপে উঠছে। সারাদিনটাই আজ এক নিরব হাহাকারে কেটেছে। আজ সবার মনটাই বিষন্ন। কিন্তু আমি শুধু আদ্রিয়ানকেই দেখেছি। বাইরে দিয়ে স্বাভাবিক থেকে সব সামলে যাচ্ছে কিন্তু মনের খবর তো আমি জানি। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে ওর। কীভাবে পারে একটা মানুষ মনে এত হাহাকার নিয়ে বাইরে দিয়ে নিজেকে সামলে রাখতে?

রাতে ওকে রুমে আসতে না দেখে আমি নিজেই ছাদে গেলাম ওকে ডাকতে। গিয়ে দেখি এক কর্ণারে চুপচাপ বসে আছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর পাশে গিয়ে বসে ওর হাত জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ঘুমাওনি?”

আমি ওর কাধে মাথা রেখে বললাম,

— ” তুমি জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসেনা।”

— ” ওহ।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,

— ” সব সময় আবেগ অনুভূতিগুলো চেপে রাখা ঠিক নয়। মাঝেমাঝে প্রকাশ করলে মন হালকা হয়।”

ও কিছু না বলে আমায় জড়িয়ে ধরে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর ঘাড়ে তরল কিছু অনুভব করে বুঝলাম কাঁদছে। এটাই ওর অনুভূতি প্রকাশের পদ্ধতি হয়তো। আমি থামাইনি ওকে শুধু আকড়ে ধরে রেখে বুঝিয়েছি ” আমি আছি তোমার সাথে।”

____________________

মাঝে আরও দুটোদিন কেটে গেছে মেডিকেলে তে এখন নিয়মিতই যাতায়াত করছি আমি। সামনে পরীক্ষাও আছে কিন্তু সমস্যা হলো এবার অসুস্থতা, ক্লাসমিস সব মিলিয়ে প্রিপারেশন খুব বেশি ভালো না। তবুও দেখা যাক কী হয় সামনে। বিকেলে বাড়ির সবাই মিলে স্নাকস খাচ্ছি আর আড্ডা দিচ্ছি। তখন বাবা বলল,

— ” আপাতত সব ঝামেলা তো শেষ? আর মামনীও এখন ঠিক আছে। তো তোমরা যাও গিয়ে কদিন ঘুরে এসো? বিয়ের এতোদিন হয়ে গেল। তুমি বা ইফাজ কেউই ওদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলেনা?”

সবাই কৌতূহলী চোখে আদ্রিয়ান আর ইফাজ ভাইয়াকে দেখছে। ইফাজ ভাইয়া বলল,

— ” আমি তো ওলওয়েজ রেডি ছোটআব্বু? বরং তোমার ছেলেকে বলো।”

আদ্রিয়ান খেতে খেতে বলল,

— ” নেক্সট মান্থ অনির এক্সাম। এক্সামের পর পরই ভ্যাকেশন পরবে তখনই যাই?”

বাবা বলল,

— ” ফাইনাল?”

আদ্রিয়ান খেতে খেতেই বলল,

— ” হ্যাঁ একদম।”

তো এটাই ডিসাইড হলো যে আমার এক্সামের পরেই আমরা ঘুরতে যাবো। যাকে বলে হানিমুন। কিন্তু বিয়ের এতোগুলোদিন পর কে হানিমুনে যায় সেটা আমার জানা নেই। আপি আর জাবিনের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুমে এসে দেখি আদ্রিয়ান ল্যাপটপ অন রেখে ওয়াসরুমে গেছেন। হঠাৎ একটা নটিফিকেশের আওয়াজ এলো। আমি একটু কৌতুহল নিয়েই চেক করার জন্যেই ল্যাপটপের সামনে বসে ওটা চেক করতে ক্লিক করলাম কিন্তু পেজ ওপেন হওয়ার আগেই কেউ আমার হাত ধরে এক টানে দাঁড় করিয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান রেগে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম ওর চোখ দেখে। কিছু একটা বলব তার আগেই আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলল,

— ” ল্যাপটপ তোমার খেলার জিনিস হ্যাঁ? কোন সাহসে হাত দিয়েছো এটায়? বলো?”

ওর আচরণে আমি অবাক এর সাথে ভয় ও পাচ্ছি এমন কেন করছে? আমি কাঁপা গলায় বললাম,

— ” আমিতো জাস্ট…”

ও আবারও থমকে বলল,

— “হোয়াট? কারো জিনিসে হাত দেওয়ার জন্যে তো পার্মিশন নেওয়া লাগে তাইনা? এটুকু ম্যানার্স তো থাকা উচিত তোমার। হ্যাঁ আ’ম ইউর হাজবেন্ড বাট তার মানে এটা না যে তুমি আমার সবজিনিসেই হাত দেবে। আমার নিজেরও ব্যাক্তিগত কিছু স্পেস থাকে। ইউ সুড আন্ডারস্টান্ড দ্যাট!”

বলে ল্যাপটপটা বন্ধ করে হনহনে পায়ে বেড়িয়ে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দিয়ে অবাধ্য একফোটা জল গড়িয়ে পরল। ল্যাপটপৈ একটু হাত দিয়েছি বলে এভাবে বলতে পারলো ও আমাকে? এমন কী করেছি আমি? একটাবার ভাবলো অবধি না ওর এই আচরণে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে