ভালোবাসি তোকে পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
4799

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৪
.
আদ্রিয়ান আমার কাধে হাত রাখতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলাম আমি। নিজেকে সামলে চোখের জলটা মুছে নিলাম। উনি চোখের ইশারায় আমাকে স্বাভাবিক হতে বললেন। আমি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলাম। উনি দরজায় হালকা নক করে বললেন,

— ” আসবো?”

নূর আপু হালকা চমকে উঠলেন। একধ্যানে কিছু একটা ভাবছিল তাই হয়তো। দরজায় তাকিয়ে আমাদের কে দেখে উনি নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের কোণ মুছে ফ্রেমটা টি-টেবিলের ওপর ছবির ফ্রেমটা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক ঠোঁটে একটু হাসি ঝুলিয়ে বললেন,

— ” আরে তোমরা? এসো ভেতরে এসো?”

আদ্রিয়ান এবার আমার হাতটা ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। নূর আপু এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আমিও আলতো করে ওনার পিঠে হাত রাখলাম। বেশ অনেকটা সময় আমায় জড়িয়ে ধরে ছিলেন। তারপর আমাকে ছেড়ে মুচকি হেসে বললেন,

— ” কেমন আছো?”

আমি একটা মলিন হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালাম। পাল্টা উনি কেমন আছেন প্রশ্নটা করার সাহস করে উঠতে পারলাম না। উনি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তোমায় কবে থেকে বলছি ওকে নিয়ে আসতে কিন্তু তুমিতো শুনছিলেই না। অবশেষে আজ আনলে।”

— ” আনলাম তো।”

— ” হ্যাঁ ধন্য করেছ আমায়।”

আদ্রিয়ান একটু হেসে বলল,

— ” আঙ্কেল আন্টি কোথায়? দেখছিনা যে?”

— ” ওনারা তো একটু গ্রামের বাড়ি গেছেন। কাল চলে আসবেন। তোমরা বসো আমি সার্ভেন্ট কে বলে কিছু আনাচ্ছি”

আদ্রিয়ান বেডে বসে বলল,

— ” আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হতে হবেনা। কিচ্ছু খাবোনা আমরা।”

— ” কী বলছো বলোতো? মেয়েটাকে নিয়ে এসছো কিছু না খাইয়ে ছেড়ে দেবো?”

আমি মুচকি হেসে নূর আপুকে ধরে বসিয়ে দিয়ে আমিও বসে বললাম,

— ” এমনভাবে ট্রিট করছো যেনো আমি মেহমান? নিজের লোকেদের সাথে এতো ফর্মালিটি করতে নেই। আমি তো তোমার ছোট বোন তাইনা?”

নূর আপু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

— ” দেখেছো আদ্রিয়ান কেমন মিষ্টি করে কথা বলতে পারে? ”

আদ্রিয়ান আমার দিকে একপলক তাকিয়ে একটু হাসলো কিন্তু কিছু বললনা। নূর আপু বললেন,

— ” জানো ইফাজ ভাইয়ার বিয়ের সময় যখন তোমাদের দুজনের ঝগড়া খুনশুটিগুলো দেখতাম। তখনই মনে হয়েছিল একদম মেইড ফর ইচ আদার। মনে মনে চাইছিলাম যে তোমাদের একটা জুটি হোক। আমার ইচ্ছেটা পূরণ হলো। জানো তোমাদের বিয়ের খবরটা শুনে কতো খুশি হয়েছিলাম আমি? আর এই আদ্রিয়ান তো আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পরের দিন সকালে ফোন করেছিলাম আসলে আমার শরীরটা ভালো ছিলোটা আর মা হঠাৎ করেই ওর জন্যে কান্নাকাটি শুরু করেছিল। আমিও কেঁদে দিয়েছিলাম। মাকে সামলাতে না পেরেই ওকে ফোন করেছিলাম ডক্টর যেনো বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু উনি নিজেই আসতে চাইলো আমি যখন বললাম নতুন বউ রেখে এসোনা ও বলে কী না তোমাকে বউ বলে মানেনা? এটা কোনো কথা হলো বলো? তারপর নিজে এসে মা কে হসপিটালে নিয়ে গেছে। ঐ দিন হসপিটালেই ছিল মা স্যালাইন দিয়ে সুস্থ হয়েছে। সারাক্ষণ আদ্রিয়ান ওখানেই ছিলো।”

আমি একটু অবাক হয়েই তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে। উনি নিজের মতো ফোন দেখছেন। তারমানে সেইদিন এইজন্যই বাইরে ছিলেন উনি। আর কীসব ভাবছিলাম আর বলছিলাম। নূর আপু আবার বললেন,

— ” তবে এখন আমি হ্যাপি যে ও তোর সাথে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ‘তুই’ করে বললাম বলে রাগ করিস না কিন্তু আমি তোকে তুই করেই বলব। আর তুই আমাকে আপনি আপনি না করে আপু বলেই ডাকবি।”

আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আপুর দিকে। কত ভালো মেয়েটা। নিজের বুকের মধ্যে পাহাড় সমান দুঃখ চেপে রেখে কতো সহজেই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে কথা বলছে আমার সাথে। আচ্ছা? ভালো মানুষগুলোর সাথেই সবসময় এমন কেনো হয়? তাদের সাথেই কেনো এতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে? আমি নিজেকে সামলে নিয়ে একটু হেসে বললাম,

— ” হুমম। সেটা ঠিক আছে কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

আপি একটু ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কী শর্ত?”

— ” আজ থেকে নিজের যত্ন নিতে হবে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে হবে, সময়মতো ঘুমোতে হবে। কারণ তুমি একা নও। একজন লিটল চ্যাম্প ও আছে তোমার ভেতরে তার কথাও ভাবতে হবে তাইনা? ভুলে যেওনা ও কিন্তু ইশরাক ভাইয়ার অংশ। যে মানুষটা তোমাকে এতো ভালোবাসতো তার অংশকে তুমি কষ্ট দিতে পারোনা। এতেতো ইশরাক ভাইয়াও কষ্ট পাবে তাইনা?”

নূর আপু এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলল,

— ” কেনো চলে গেলো এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে? কী দোষ ছিলো আমার? বলনা? জানিস ও সমসময় বলতো যে আমার প্রেগনেন্সির পুরোটা সময় আমার সব কাজ নিজের হাতে করবে আমাকে কিচ্ছু করতে দেবেনা। ও বলেছিলো ভবিষ্যতে বেবি যখন কিক করবে তখন ও নাকি আমার পেটে মাথা রেখে বাচ্চার উপস্থিতি অনুভব করবে। বেইবি হওয়ার পর বাচ্চার সব কাজ নিজে করবে। ও বলেছিল কখনও আমার হাত ছাড়বেনা কিন্তু ও ওর কথা রাখেনি চলে গেছে আমাকে ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেছে।”

আমাকে জড়িয়ে ধরেই শব্দ করে কাঁদছে। আমিও কেঁদে দিয়েছি। আমি আপুর পিঠে হাত রেখে করুণ চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালাম। আদ্রিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছলছলে চোখে ইশরাক ভাইয়ার ছবির দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম ইশরাক ভাইয়ার ছবিটার দিকে। এখনো ঐদিনটার কথা মনে পরছে কী পাগলামোটাই না করেছিলেন ভাইয়া সেদিন-

আমরা সবাই আপির বিয়েতে কীভাবে কী শপিং করবো তার প্লানিং করছি। তখন ইশরাক ভাইয়া এসে হাজির হলেন। এসে সোফায় বসে উৎসাহিত কন্ঠে বললেন,

— ” আচ্ছা আদ্রিয়ান বলতো বেবির জন্যে কী কেনা যায়?”

আমরা সবাই বেশ অবাক হয়ে তাকালাম। এখানে তো বিয়ের শপিং এর আলোচনা হচ্ছে উনি বেবি কোথায় পেলেন? আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কার বেবি? কীসের বেবি?”

ইশরাক ভাইয়া এমন একটা মুখভঙ্গি করলেন যেনো আকাশ থেকে টুপ করে নিচে পরেছেন সবে। অবাক হয়েই বলল,

— ” আরে এরমধ্যে ভুলে গেলি? আমি বাবা হতে চলেছি ইয়ার? কালকেই ট্রিট দিলাম আজকেই ভুলে গেলি?”

আমরা সবাই অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একসাথে শব্দ করে হেসে দিলাম। আদিব ভাইয়া হাসি থামিয়ে বললেন,

— ” আরে ভাই নূর সবেমাত্র একমাসের প্রেগনেন্ট তুই এখনই ওর জন্যে কি কিনবি ভাবছিস?”

ইশরাক ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বললেন,

— ” অবশ্যই। আমার বাচ্চা আমি ভাববোনা। ওকে একদম যত্ন করে বড় করব আমি। সবকিছু দেবো। ওর কোচি কোচি হাত ধরে হাটা শেখাবো মানে আমিতো ভাবতেই পারছিনা আমার বাচ্চা আমাকে আদো আদো কন্ঠে বাবা বলে ডাকবে।”

আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে ওনার কথা শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম ওনার সন্তান কতো লাকি হবে যে ওনার মতো একজন বাবা পাবে। আদ্রিয়ান একটু পিঞ্চ করে বলল,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ সেইতো দুনিয়াতে একমাত্র তোরই বেবি আসতে চলেছে, বাকি সবাই তো আকাশ থেকে চুপ করে পরেছে।”

ইশরাক ভাইয়াও হেসে বলল,

— ” এখন বুঝবিনা। যেদিন নিজে বাবা হবি সেদিন ঠিক বুঝবি।”

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল ইশরাক ভাইয়াকে ভাইয়ার টাইট করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল ওনাকে।

সেই হাস্যজ্জ্বল মুখটার কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে ভার হয়ে ওঠে। বড্ড কষ্ট হয় শ্বাস নিতে। কদিনের পরিচয়ে আমারই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে নূর আপু আর আদ্রিয়ান এর মানসিক পরিস্থিতিতো আমি কল্পনাও করতে পারছিনা। একজনের ভালোবাসা সন্তানের বাবা, আরেকজনের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু। ওনাদের দুজনের কষ্টের পরিমাপ করাটাও যে আমার কাছে অসম্ভব।

আমি নিজেকে সামলে নূর আপুকে ছাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললাম,

— ” প্রমিস করো আমাকে?”

আপু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দিয়ে আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

— ” প্রমিস।”

হঠাৎ আদ্রিয়ান মুখ ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলল,

— ” বাহ। এতোদিন আমি বলছিলাম হচ্ছিল না। যেই ও বলল ঠিক মেনে নিলে তো? মানে আমার কোনো ভ্যালুই নেই? চমৎকার! শুধু আমিই সবাইকে নিজের ভাবি। আমাকে কেউ নিজের ভাবেই না।”

কথাগুলো একদম একটা বাচ্চা যেভাবে অভিযোগ করে ঠিক সেভাবেই বলছিলো। আমি আর নূর আপু একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। নূর চোখ মুছে আপু বলল,

— ” আমার বোনের কথা আমি শুনেছি তোমার তাতে কী গো?”

আদ্রিয়ান মেকি হেসে বলল,

— ” হ্যাঁ সেই। আমার বাবা মায়ের কাছে ওই ওনাদের মেয়ে, আমার ভাই বোনের কাছেও ওই বোন, তোমার কাছেও ও বোন। গোটা রাজত্যই ওর, ওই রাণী আর আমিতো শুধু রাজ্যের বেতনহীন সেনাপতি মাত্র। পুরোটাই অপশনাল।”

নূর আপু আর আমি দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে দিলাম ওনার কথা শুনে। কিছুক্ষণ কথা বলে আপুকে স্বাভাবিক করে তারপর ওখান চলে এলাম আমরা।

উনি ড্রাইভ করছেন আর আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজনেই নিরব। আজ ইশরাক ভাইয়ার স্মৃতিগুলো চারা দিয়ে উঠছে। হয়তো আদ্রিয়ানের মধ্যেও ঝড় চলছে। মানুষটা অদ্ভুত। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট, চিন্তা, কথা চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকতে জানেন। হঠাৎ উনি বলে উঠলেন,

— ” থ্যাংকস।”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

— ” থ্যাংকস কেন?”

— ” নূরকে এভাবে সামলানোর জন্যে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম,

— ” উনি আমরাও বোনের মতো ভালোবাসি ওনাকে ভীষণ। তাই যেটা করেছি নিজের মন থেকে নিজের জন্যেই করেছি। থ্যাংকস এর প্রয়োজন নেই।”

উনি একটু হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না। আমি নিজেই বললাম,

— ” আচ্ছা নূর আপুও কী আপনাদের সাথে ইউ কে তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো?”

— ” না। ও আমার ইন্টার কলেজ ফ্রেন্ড। সেকশন আলাদা ছিলো আমাদের। ও আর্চ এ ছিলো।”

— ” আপনারা ইউ কে তে কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন?”

— ” কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি।”

আমি সাথে সাথে চমকে উঠলাম। শরীর হালকা ঘামতে শুরু করলো আমার। আমি দুই হাত কচলে যাচ্ছি আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। উনি পকেট থেকে রুমাল বেড় করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। উনি তো আমার দিকে তাকানও নি তাহলে বুঝলেন কীকরে যে আমি ঘামছি? উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

— ” ঘামটা মুছে ডিপ ব্রেথ নাও স্বাভাবিক লাগবে।”

#চলবে…

( রি-চেইক হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৫
.
আমি কাঁপাকাঁপা হাতে রুমালটা নিয়ে নিলাম তারপর মুখ, ঘাড়, গলা মুছে গভীরভাবে কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে ওনার দিকে রুমালটা এগিয়ে দিলাম। উনি রুমাল টা নিয়ে বললেন,

— ” ফাইন নাও?”

আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে। চুপচাপ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। আদ্রিয়ান ও কিছু আর জিজ্ঞেস করলেন না। সারারাস্তা আর চোখ খুলিনি আমি চোখ বন্ধ করেই রেখেছিলাম। গাড়ি থামতেই চোখ খুলে তাকালাম আমি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আদ্রিয়ান আমার সিটবেল্ট খুলে দিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন তারপর দরজাটা খুলে আমার হাত ধরে নিচে নামালেন। তারপর দুজনে একসাথেই ভেতরে ঢুকলাম। সবার সাথে কথা বলে রুমে চলে গেলাম। সেদিন সারারাত আমরা দুজন একে ওপরের সাথে কোনো কথা বলিনি। আসলে দুজনের মনটাই খুব খারাপ ছিলো। নূর আপুর এরকম অবস্থা দেখে, তারওপর ইশরাক ভাইয়ার সব স্মৃতি। সব মিলিয়ে আজ খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছিলো। আদ্রিয়ান আজ আর আমার ওপর হাত রেখে ঘুমান নি অন্যদিকে ঘুরে শুয়েছিলেন। আমিও কিছু মনে করিনি। কারণ আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম ওনার একটু স্পেস দরকার। তাই আমিও ওনাকে কোনোভাবে বিরক্ত করিনি।

_________________

আজ শুক্রবার। পার্টিতে যেতে হবে। শাড়ি পরে যেতে হবে। একটু আগে আদ্রিয়ান রেড একটা জরজেটের শাড়ি এনে দিয়েছে পড়তে। আপি আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে নিজেও শাড়ি পরেনিলো। আপির শাড়িটা নীল। দুজনেই খুভ হালকা সেজেছি। আমরা রেডি হয়ে বেড়িয়ে দেখি ইফাজ ভাইয়া আপির সাথে ম্যাচিং করে নীল সুট পরেছে, কিন্তু আমার খবিশ বরটা পরেছে কালো। হুহ। যদিও ঠিকই ঠিকই আছে লাল পরলে কেমন কার্টুন কার্টুন লাগতো। দুই ভাইকেই ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে।যদিও এরা ওলওয়েজ হ্যান্ডসাম। কিন্তু নিজের বর বলে বলছিনা আমার বরটা কিন্তু এক্কেবারে বেস্ট। জাবিনও রেডি হয়ে চলে এসছে এর মধ্যে ও একটা বেবি পিংক লং গাউন পরেছে। এরপর পাঁচজনেই রওনা দিয়ে দিলাম। সন্ধ্যা আটটার মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম পার্টিতে। খুব জাকজমক পরিবেশ, চারপাশে লাইটিং করে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। খুব ভালো লাগলো আমার। গাড়ি থেকে নেমে পাঁচজনেই ধীরপায়ে ভেতরে এগোতে শুরু করলাম। ভেতরে যেতেই ওনারা আমাদের সুন্দরভাবে ওয়েলকাম করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমরাও চুপচাপ ওনাদের কথামতো চলে গেলাম ওনার সাথে। আঙ্কেল খুব ভালো একজন মানুষ সেটা কেনো জানিনা কয়েক সেকেন্ড দেখেই বুঝতে পারলাম আমি। ওনার ওয়াইফকেও দেখে ভালোই মনে হলো। আমরা চারজনেই একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আদ্রিয়ান ফোন দেখছেন। আমি হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছি। আপি আর ইফাজ ভাইয়া কী বিষয়ে যেনো কথা বলছে। আর জাবিনও নিজের ভাইয়ের মতোই ফোনে ডুবে আছে।হঠাৎ করেই আদিব ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। আদিব ভাইয়াও এখানে ইনভাইটেড। আদিব ভাইয়া আমাদের কাছে এসে বললেন,

— ” কী ব্যাপার হ্যাঁ? পুরো জোড়ায় জোড়ায় হাজির না কী?”

জাবিন ফোন থেকে চোখ তুলে ভ্রু কুচকে বলল,

— ” অদ্ভুত? তুমি আমার জোড়া কোথায় পেলে ভাইয়া?”

আপি হেসে বলল,

— ” এখন নেই তাতে কী হয়েছে? দেখবে কখনো একদিন হুট করে এন্ট্রি নেবে তোমার হিরো।”

জাবিন আবার ফোনে চোখ দিয়ে বলল,

— ” দিল্লি এখনো অনেক দূর।”

আদ্রিয়ান ফোন থেকে চোখ তুলে জাবিনের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বলল,

— ” একদমি না। এখন প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে উড়ে চলে যাওয়া যায়। এইচ এস সি টা দে। ঘাড় ধরে বিদায় করবো বাড়ি থেকে।”

জাবিন মুখ ফুলিয়ে ইফাজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল,

— ” দেখনা দাভাই ভাইয়া কীসব ফালতু বকছে?”

ইফাজ ভাইয়া একটু রেগে যাওয়ার ভান করে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ঠিকই তো আদ্রিয়ান। এটা কেমন কথা হলো? এইচ এস সির পর বিদায় করবি মানে কী? তুই বুঝতে পারছিস না? ও এখনি যেতে চাইছে?”

বলেই শব্দ করে হেসে দিলো আদ্রিয়ানও হেসে দিল। হাসতে হাসতে দুই ভাই ই হাইফাইভ করল। জাবিন বিরক্ত হয়ে হাত ভাজ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি আর আপি মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছি। বেশ অনেকটা সময় আড্ডা দেওয়ার পর আদ্রিয়ান আর আদিব ভাইয়া কোথাও একটা গেলো। কেউ একজন ডাকতে আপি আর ইফাজ ভাইয়াও একসাথে গেলো একটু কথা বলতে। আমি আর জাবিন কথা বলতে বলতেই ওর এক ফ্রেন্ডের ফোন এলো। এখানে শোরগোল আছে তাই ও কথা বলতে একটু দূরে সরে গেলো। আমি বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। দূর ছাই! ভাল্লাগেনা। সবাই নিজের কাজে বিজি হয়ে গেলো আর আমি এখানে একা একা বোর হচ্ছি। এদিক ওদিক হাটছি কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ আমার খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আড়াল থেকে নজর রাখছে আমার ওপর। গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে। কেনো হচ্ছে এমন? হঠাৎ আমার পেছন থেকে মাথায় কেউ টোকা মারতেই তাকিয়ে দেখলাম একজন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে যখন এসছিলাম তখন দেখেছি। সম্ভব ওই আঙ্কেলের ছেলে। তখনও কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে আর এখনও? কী চায় কী উনি? উনি মুখে মুচকি হাসি রেখেই বললেন,

— ” হাই? একা একা বোর হচ্ছো বুঝি?”

কী লোকরে বাবা প্রথম দেখাতেই তুমি বলে দিলো? আমি মুখে সৌজন্যমূলক হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— ” না আসলে ফ্যামিলি ম্যামবাররা একটু ব্যাস্ত তাই..”

— ” ওহ তুমি মানিক আঙ্কেলের বাড়ি থেকে এসছো নিশ্চয়ই?”

— ” জ্বী।”

— ” খুব সুন্দর লাগছে কিন্তু তোমাকে দেখতে।”

আমি এবার বেশ অস্বস্তিতে পরলাম। লোকটা কী শুরু করেছে কী। একটু ইতস্তত করে বললাম,

— ” ধন্যবাদ।”

উনি হাত বাড়িয়ে বললেন,

— ” বাই দা ওয়ে চলো ডান্স করা যাক?”

আমি একটু অস্বস্তিতে পরে গেলাম। এতো পেছনেই পরে গেছে। কোনোরকমে হাসার চেষ্টা করে বললাম,

— ” সরি আই কান্ট ডান্ট।”

উনি আমার হাত ধরে বললেন,

— ” আরে কোনো ব্যাপারনা আমি শিখিয়ে দেবো চলো?”

আমার এবার বেশ রাগ হলো। চেনা নেই জানা নেই হুট করে এসে এভাবে হাত ধরবে কেনো? এখন কোনো ভদ্রতা দেখাতে ইচ্ছে করছেনা তবুও এখানে গেস্ট হয়ে এসছি তাই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,

— ” হাত ছাড়ুন আমি ডান্স করবোনা।”

তখনই কেউ আমার হাত ধরলো তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান। ওর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে বেশ রেগে আছে। চোখ মুখে সেই তীব্র রাগটা স্পষ্ট। ওই ছেলেটাও একটু অবাক হয়ে দেখছে। আদ্রিয়ান একটানে হাতটা ওনার থেকে ছাড়িয়ে নিলেন যার ফলে হাতে বেশ ব্যাথা পেলাম। কিন্তু উনি আমার হাতটা ছাড়েননি শক্ত করে ধরে আছেন। আদ্রিয়ান ওই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” তোমাকে আঙ্কেল ডাকছিলেন।”

ছেলেটা অবাক হয়ে একবার আমার দিকে একবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। ছেলেটা চলে যেতেই আদ্রিয়ান আমার হাত টান দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

— ” কী কথা বলছিলে ওর সাথে?”

আমি বেশ ভয় পেয়ে গেছি ওনার চোখ মুখ দেখে। এতোটা রেগে কেনো গেলেন উনি? আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” ন্ না আসলে উনি নিজেই এসছিলেন কথা বলার জন্যে।”

আদ্রিয়ান হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

— ” ও তারজন্যে হাত ধরে কথা বলতে হবে তাইনা?”

— ” আমি ধ্ ধরিনি উনি নিজে..”

কথাটা শেষ করার আগেই উনি ধমকের সূরে বললেন,

— “ধরতে দিলে কেনো?”

আমি কেঁপে উঠলাম ওনার ধমকে। তখনি সবাইকে ডাকতে শুরু করলো কাপল ডান্সের জন্যে। আপি আর ইফাজ ভাইয়াও এসছে। আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,

— ” খুব শখ না ডান্স করার? চলো তোমার এই শখটা আমি নিজেই পূরণ করে দিচ্ছি।”

বলে আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে নিয়ে গেলেন। সবাই সবাই জোড়ায় জোড়ায় নাচ করছে। মিউজিক শুরু হতেই একটানে নিজের কাছে নিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরলেন উনি। আমি একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কোমর খুব শক্ত করেই ধরেছে যার ফলে ব্যাথাও পাচ্ছি। উনি নাচের মধ্যে যেখানে স্পর্শ করছেন খুব রাফভাবে করছেন খুব বেশি ব্যাথা না পেলেও মোটামুটি ব্যাথা লাগছে আমার। মনে হচ্ছে নাচের প্রতিটা স্টেপে আমার ওপর থেকে নিজের রাগ মেটাচ্ছেন উনি। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কমে এলো ওনার স্পর্শগুলো ধীরে ধীরে কোমল হতে শুরু করলো। আমি এক দৃষ্টিতে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। এখন কেনো জানিনা সম্মোহীত হয়ে পরছি। হঠাৎ করেই আমার চোখ গিয়ে পড়ল একটু দূরের গাছটার দিকে আর গাছটার পেছনে যা দেখলাম তাতে আমার পিলে চমকে উঠলো, ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওদিকে, ধীরে ধীরে হাত পা জমে যেতে শুরু করলো। হয়তো হঠাৎ আমার এভাবে শক্ত যাওয়া আদ্রিয়ান বুঝতে পারলেন। তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে বললেন,

— ” অনি? হোয়াট হ্যাপেন্ড? কী হয়েছে?”

আমার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। আপি, ইফাজ ভাইয়া, জাবিন আদিব ভাইয়াও দৌড়ে এলেন। সবাই জিজ্ঞেস করছে আমার কী হয়েছে? কিন্তু আমি কোনো কথা বলতে পারছিনা শুধু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই দূরের ঐ গাছটার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেননা এখন আমিও দেখতে পাচ্ছিনা। ধীরে ধীরে সব ঝাপসা হয়ে এলো আমার কাছে। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি আদ্রিয়ান আমার গাল ধরে ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলছেন কিন্তু কী বলছেন সেটা শুনতে পাচ্ছিনা। একপর্যায়ে সবটাই অন্ধকার হয়ে গেলো আমার কাছে।

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৬
.
মুখে ঠান্ডা কিছু অনুভব করে ভ্রু কুচকে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। প্রথমে সবকিছুই ঝাপসা দেখছিলাম তারপর কোনোরকমে চোখ ঝাপটা দিতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম ইফাজ ভাইয়া, জাবিন, আদিব ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, সকলের চোখে মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আর বাকি অনেকেই আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাম পাশে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম আপি বসে আছে। আদ্রিয়ান কোথায়? উনি নেই কেনো? এসব ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলাম আমি কারো বাহুতে আবদ্ধ হয়ে আছি, কারো বুকে মাথা দিয়ে রেখেছি আমি। মাথাটা উঁচু করে তাকাতেই দেখতে পেলাম ওটা আদ্রিয়ানই। আমি ওনার দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান পকেট থেকে রুমাল বেড় করে আমার মুখ মুছে দিলেন। হয়তো পানির ছিটা দিয়েছিলেন মুখে। মুখ মুছে গালে হাত রেখে বললেন,

— ” ঠিক লাগছে এখন?”

আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে ওনার থেকে সরে বসলাম। ইফাজ ভাইয়া আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” দুঃখিত। বিব্রত করলাম আপনাদের।”

আঙ্কেল হেসে দিয়ে বললেন,

— ” আরে না না। কী বলছো বলোতো? তোমরা তো আমার নিজের লোকই। আর ও তো আমার মেয়ের মতোই। কিন্তু কী হয়েছিল বলোতো হঠাৎ এভাবে ভয় পেয়ে গেলে কেনো?”

ইফাজ ভাইয়াও বলল,

— ” হ্যাঁ তাইতো? কী হয়েছিল তোমার?”

আমি একবার অসহায় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। আর কেউ কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

— ” থাক এখন এসব কথা। এখন ও ঠিক আছে। আমরা উঠছি তাহলে আজ?”

আন্টি এসে বললেন,

— ” উঠছি মানে কী? না খেয়ে যাওয়া যাবেনা। আমরা তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা ভেতরেই করেছি চলো।”

আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

— ” আসলে ওর শরীরটা ভালো নেই তাই বলছিলাম..”

আদ্রিয়ানকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আঙ্কেল বললেন,

— ” আরে কিচ্ছু হবেনা। ও আস্তে আস্তে খেয়ে নিতে পারবে। তাইতো মামনী?”

আমি মুচকি হেসে বললাম,

— ” জ্বী।”

আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” আর ইউ শিউর?”

— ” হুম।”

এরপর আমরা সবাই ডাইনিং এ গেলাম। আমার সামনে প্লেট দিতে গেলেই আদ্রিয়ান বললেন,

— ” ওকে প্লেট দিতে হবেনা আন্টি। আমি খাইয়ে দিচ্ছি ওকে।”

আন্টি মুচকি হেসে প্লেটটা সরিয়ে নিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। নিজের হাতে খাইয়ে দেবেন উনি আমাকে? কিন্তু কেনো? আদ্রিয়ান নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে এক চামচ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি উনি গলা ঝেড়ে বললেন,

— ” আমাকে দেখছো ভালো কথা একটু হা করে তাকিয়ে দেখো তাহলে খাবারটা দিতে পারবো।”

আমি সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলাম। সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। জাবিন তো হালকা শব্দ করেই হেসে সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরলো। আমার এবার ভীষণ রাগ হলো ওনার ওপর সবসময় এভাবে সবার সামনে লজ্জায় ফেলেন আমাকে। আমি ভ্রু কুচকে বিরক্তি ওনার দিকে তাকালাম। উনিও ঠোঁট চেপে হাসছেন। আমি আবার মুখ ঘুরিয়ে নিতে গেলেই উনি আমার থুতনি ধরে মুখ নিজের দিকে নিয়ে খাবার খাইয়ে দিলেন। আমিও আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা সবাই ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আদিব ভাইয়া নিজের গাড়ি করে ওনার বাড়িতে চলে গেলেন। গাড়ির কাছে আসতেই আদ্রিয়ান বললেন,

— ” ভাইয়া আজ তুই ড্রাইভ কর। আমি ওকে নিয়ে পেছনেই বসছি।”

ইফাজ ভাইয়া মাথা নেড়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলেন। আপি বসেছে ফ্রন্ট সিটে। আমি, উনি আর জাবিন পেছনে বসলাম। আদ্রিয়ান এক হাত দিয়ে জরিয়ে ধরে রেখেছেন। আমি বললাম আমি ঠিক আছি কিন্তু উনি শোনেন নি। আপি এবার পেছনে ঘুরে বলল,

— ” সত্যি করে বলতো অনি কী হয়েছিল তোর? আর ঐ গাছটার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলি কেনো? কী দেখেছিলি?”

জাবিনও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” এক্সাক্টলি ভাবি কী হয়েছিলো বলতো? এভাবে রিঅ‍্যাক্ট করলে যে?”

ওদের প্রশ্ন শুনে সেই দৃশ্য আরো বেশি আমি করে মনে পরছে। আর ভয়ও বাড়ছে। আমি না চাইতেও ভয়ের জন্যে আদ্রিয়ানের হাত আর সুট এর সামনের একসাইড খামচে ধরলাম। উনি এবার বিরক্তিকর কন্ঠে বললেন,

— ” বললাম তো এই টপিকটা থাক। ও এখন ঠিক আছে। এমনিতে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনা তো। উইক লাগছিলো হয়তো তাই মাথা ঘুরে গেছে।”

জাবিন একটু গলা ঝেড়ে বললেন,

— ” তোদের বিয়ের তো মাত্র কটা দিন হলো রে ভাইয়া? এরমধ্যেই ভাবির মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেলো? তুইতো খুব ফাস্ট!”

আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকালো জাবিনের দিকে। আপিও মিটমিটিয়ে হাসছে। ইফাজ ভাইয়ার রিয়াকশনটা ঠিক বুঝতে পারছিনা। উনি সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছেন। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি জাবিনের দিকে নিজের বড় ভাইকে কেউ এভাবে বলতে পারে? আল্লাহ মালুম। আদ্রিয়ান জাবিনের মাথায় একটা চাটা মেরে বললেন,

— ” চুপ কর বেয়াদব। দিন দিন চরম অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস। বড় ভাই আমি তোর। বুঝে শুনে কথা বলবি।”

জাবিন মুখ ফুলিয়ে মাথা ডলতে ডলতে ভেংচি কাটল। ইফাজ ভাইয়া বললেন,

— ” কেনো আদ্রিয়ান? অস্বাভাবিক কিছুতো বলেনি তাইনা। কয়েকটা দিন তো হয়েই গেছে বিয়ের? গুড নিউস তো পেতেই পারি?”

ইফাজ ভাইয়ার কথায় এবার বেশ লজ্জা পেলাম। এভাবে বলে কেউ? সম্পর্কে তো আমার ভাসুর তাইনা। আরেক দিক দিয়ে যদিও দুলাভাই। কিন্তু তবুও আমায় এভাবে অস্বস্তিতে ফেলার কোনো মানে হয়? আর তাছাড়াও ওনার যা নিরামিষ মার্কা ভাই। তাতে কয়েক দিন কেনো কয়েক বছরেও কিছু হবে কি না আল্লাহ্ জানেন। ছিঃ কী ভাবছি আমি এসব? এই অসভ্যগুলোর সাথে থেকে থেকে আমিও অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। আদ্রিয়ান মেকি হেসে বললেন,

— ” আমারতো কয়েকদিন হলো কিন্তু তোর তো বিয়ের চারমাস হয়ে গেলো। প্রথম গুডনিউসটা তো তোর দেওয়া উচিত তাইনা?”

এবার আপিও লজ্জা পেলো। লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইফাজ ভাইয়াও গলা ঝেড়ে ড্রাইভিং এ মন দিলেন। সেদিন ইফাজ ভাইয়া ঠিকই বলেছিলেন আদ্রিয়ানের সাথে কেউ কথায় পারবেনা। কিন্তু এই তিন ভাইবোনই মারাত্মক লেভেলের অসভ্য। এক নম্বরের বেহায়া। কথাবার্তার কোনো লাগাম নেই। নিজেরা লাগাম ছাড়া কথাবার্তা বলে আর লজ্জায় পরতে হয় আপি আর আমাকে।

___________________

কোচিং এর ভাইয়া লেকচার দিচ্ছেন আমি আর ইশু দুজনেই একটু পর পর হাই তুলছি। একদমি বোরিং ক্লাস চলছে। কিছু কিছু ক্লাস এমনই হয় মাথার ওপর দিয়েও যায়না কপাল বরাবর এসে ইউটার্ন মারে। এটা ঠিক তেমনই ক্লাস। আমাকে এভাবে টলতে দেখে ইশু ভ্রু কুচকে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ” কীরে সমস্যা কী তোর বলবি? রাতে জিজু ঘুমাতে দেয় নি নাকি?”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,

— ” আমাকে না হয় তোর জিজু ঘুমাতে দেয়নি। আমি বিবাহিত সো ইটস নরমাল। কিন্তু তুই কেনো ঝিমছিস হ্যাঁ ? রাত জেগে বি এফ এর সাথে প্রেমালাম করেছিস?”

— ” অাস্তাগফিরুল্লাহ। তুই জানিস না আমি কতো ভদ্র মেয়ে?”

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো করেই জানি তাইতো বললাম।”

ইশু কনফিউসড হয়ে কিছু বলবে তার আগেই ভাইয়া ওয়ার্ন করে দিলেন আমাদের। আমরও ভদ্র মেয়ের মতো সাময়িকভাবে চুপ হয়ে গেলাম।

ক্লাস শেষ করে ইশু আর আমি গল্প করতে করতে বেড় হচ্ছি। বাইরে বেড়িয়ে আদ্রিয়ানকে দেখতে পেলাম না। কী ব্যপার উনি কী আসেন নি? কিন্তু উনি তো কখনও লেট করেন না। নিজে না আসতে পারলে গার্ড পাঠিয়ে দেন তাহলে? এসব ভেবে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই কালকের সেই ছেলেটাকে দেখতে পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ ছেলেটা উঠলেন,

— ” হেই।”

আমি শুনিইনি এমন একটা ভাব করে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু উনি আমার সামনে চলে এলেন। তারপর হেসে বললেন,

— ” হাই। তুমি এখানে? এই কোচিং সেন্টারেই ভর্তি হয়েছো নাকি?”

আমি মেকি একটা হাসি দিয়ে বললাম,

— ” হ্যাঁ।”

— ” ওহ আসলে আমি এখানে এক ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলতে এসছিলাম। আচ্ছা শুনলাম কালকে নাকি তুমি অসুস্থ হয়ে পরেছিলে? আমি ছিলাম না একটু বাইরে গিয়েছিলাম। ঠিক আছো এখন?”

— ” ঠিক না থাকলে তো আর কোচিং এ আসতে পারতাম না।”

উনি হেসে দিয়ে বললেন,

— ” তা ঠিক। কালতো পরিচয়ই হয়নি।আমি রূপ। তুমি?”

— ” অনিমা।”

— ” অনিমা? ওয়াও! কিউট নেইম। আচ্ছা উনি তোমার ফ্রেন্ড?”

— ” হ্যাঁ ও আমার বান্ধবী ইশরাত।”

ইশরাত মেকি হেসে হাই বলল। লোকটাও বলল। এখন খুব বিরক্ত লাগছে আমার তখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছে। উনি এবার একটু সংকোচ নিয়ে বললেন,

— ” আসলে কালকের জন্য সরি। ওভাবে হাত ধরাটা ঠিক হয়নি আমার। ”

— ” ইটস ওকে। বুঝতে পেরেছেন এতেই হবে।”

রূপ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,

— ” তো কী খাবে বলো?”

আমি হেসে বললাম,

— ” কিছুই খাবোনা আমরা। আমরা এখন বাড়ি যাবো।”

— ” আরে যাবেতো চলো দুজনকেই কিছু খাওয়াই। জাস্ট পাঁচ মিনিট নেবো।”

— ” না আসলে আমাদের ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে যেতে হবে এক্ষুনি।”

বলে ইশুর হাত ধরে ওখান থেকে চলে এলাম পেছন থেকে ডেকেছেন উনি কিন্তু শুনিনি। বেড়িয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পরলাম। ইশু সামনের একটা স্টান্ড থেকে বাস নেবে অতোটুকু আমার সাথেই যাক। বাড়িতে পৌছে ফ্রেশ হয়ে, নিচ থেকে কিছু খেয়ে তারপর উপরে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসে বসে দেখছি। হঠাৎই ধরাম করে দরজা লাগানোর শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার চুলগুলো হালকা এলোমেলো হয়ে গেছে, হালকা ঘেমেও আছেন, ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। আমি একটা ঢোক গিলে ফোনটা রেখে দিলাম। উঠে যে দাঁড়াবো সেই শক্তি পাচ্ছিনা। উনি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আমার দিকে আসছেন। আমি ভীত প্লাস অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আবার কী গন্ডগোল করেছি আমি? এতো রেগে গেলেন কেনো? এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো? কী করতে চাইছেন উনি?

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে