#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১১.
.
আদ্রিয়ানের হঠাৎ এই চেঞ্জ দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ইফিজ ভাইয়া, আপি আর জাবিন এবার একসঙ্গে আমার দিকে তাকালো। তিনজনই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কী ব্যপার? আমিও কাধ সংকোচিত করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বোঝালাম আমি কিছুই জানিনা। জাবিন আমাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে বলল,
— ” ভাবীমনি কী জাদু করেছ বলোতো? আমার ভাইয়াটা একদম আগের ফর্মে ফিরে গেলো?”
আপিও তাল মিলিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ সত্যিই কী করেছিস বলতো তুই?”
আমি বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” আরে আমিতো বলছি আমি কিছুই করিনি। তোমাদের ভাইয়ের কী হয়ে আমি কীকরে জানবো? আর তাছাড়াও তার মাথায় কখন কী চলে সেটা কী আমি জানি নাকি? আজব!”
ইফাজ ভাইয়া হেসে বললেন,
— ” তবে যাই হোক। আমাদের আদ্ররিয়ানটা যে আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে এটাই অনেক।”
আপি আর জাবিন দুজনেই সন্তুষ্টির একটা হাসি দিলেন। আমিও হাসলাম। তখনি রুমে ওনার আগমন ঘটলো। উনি বাবার রুম থেকে একটা উপন্যাসের বই নিয়ে এসছেন। ওনাদের রুমে দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” কী ব্যাপার তোরা এখনি যাসনি কেনো? বললাম তো আড্ডা পরে হবে এখন ওর পড়ার সময়।”
জাবিন মুখ ফুলিয়ে বলল,
— ” আরে বাবা যাচ্ছি তো। তোর বউকে নিয়ে যাবোনা আমরা তোর বউ তোরই থাকবে।”
আদ্রিয়ান জাবিনের মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলল,
— ” সেটা তুই বললেও আমার থাকবে আর না বললেও আমারই থাকবে। এখন যা ফট।”
আমি আবারও অবাক দৃষ্টিতে দেখছি ওনাকে। সবাই আবাক হয়েই রুম ত্যাগ করল।
ওদের আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,
— ” কী হলো তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো যাও পড়তে বসো।”
আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ পড়তে বসলাম। আর উনিও আমায় পড়া দিয়ে দিয়ে বেডে হেলান দিয়ে এক হাতে কফি আরেক হাতে উপন্যাসের বইটা নিয়ে বসলেন।
দুপুরে মামনী, বড় আম্মু মিলে খাবার সাজাচ্ছে টেবিলে আপিও একটু হেল্প করছে। আর আমি গালে হাত দিয়ে দেখছি ওনাদের। আচ্ছা? আমিওতো এই বাড়ির বউ তাইনা? তাহলে আমাকেও একটু টুকিটাকি কাজ করতে দিলে কী হয়? আপিকেতো তাও কম হলেও একটু কাজ করতে দেয় আমাকে কেনো দেয়না? এরমধ্যেই সবাই আস্তে আস্তে চলে এলো খেতে। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ানও নামলেন। আজ অফ ডে তাই বাড়িতেই আছে সবাই। উনি এসে আমার পাশের চেয়ার টেনে বসলেন। খাবার সার্ভ করার সময় ইফাজ ভাইয়ার পাতে যেই মাছ দিতে যাবে তখনি আদ্রিয়ান বলে উঠল,
— ” খবরদার আম্মু। ওই পিছটা আমিই নেবো?”
মামনী হা করে তাকিয়ে আছেন বাকি সবাইও বেশ অবাক হয়েছেন। সবাই যেন শক থেকে বেড় হতে পালছেননা। আমরা সকালে ওনার পরিবর্তন টা কিছুটা দেখলেও এখন আরও অবাক হচ্ছি।
— ” কী হলো দাও।”
আদ্রিয়ানের কথায় হুস এলো আমার। মামনীর চোখজোড়া ছলছল করছে। বাকি সবাইও অনেকটা ইমোশনাল হয়ে গেছেন। আন্টি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
— ” এই এতো হিংসুটে কেনো রে তুই? সবগুলোই তো একরকম।”
বলে ইফাজ ভাইয়ার পাতে মাছটা দিতে গেলেই আদ্রিয়ান মামনী হাত ধরে মাছটা নিজের পাতে নিয়ে নিলেন। ইফাজ ভাইয়া একটু রাগী গলায় বললেন,
— ” আরে এটা কী হলো? ছোট আম্মুতো এটা আমাকেই দিয়েছিলো তুই কেনো নিলি?”
আদ্রিয়ান ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে খাবার নাড়তে নাড়তে বললেন,
— ” কারণ আমি ছোট। আর লজিক্যালি ছোটদেরকেই বেশি করে দেওয়া উচিত। এটাও জানিস না গাধা।”
ইফাজ ভাইয়া তৃপ্তিময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। কেনোই বা তাকাবে না। খুব বেশিই অপেক্ষায় ছিলেন এই আদ্রিয়ানকে এভাবে দেখার জন্যে। তবুও রাগ করার ভান করে বলল,
— ” হ্যাঁ হ্যাঁ তোর ওসব লজিক তোর কাছেই রাখ। মানছি তুই ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু আমিও তো ডক্টর নাকি? ডক্টর হতেও মাথা লাগে আর সেটা যদি হয় নিউরো সার্জন।”
আদ্রিয়ান কপাল কুচকে বললেন,
— ” হ্যাঁ জানি তুই কী। দিনে দশবার করে বলে বলে সবাইকে মনে করাতে হবেনা। যদিও তোকে দেখলে একজন সার্জন সার্জন মনে হয়না। তবুও চলে!”
ইফাজ ভাইয়াও একই ভঙ্গিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” সেটাই তুই তো কপালে সিল লাগিয়ে ঘুরিস যে আমি ইঞ্জিনিয়ার।”
— ” আমার সিল লাগেনা এমনিতেই সবাই বুঝে যায়।”
আমরা সবাই খাচ্ছি আর মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে দুই ভাইয়ের ঝগড়া ইনজয় করছি। উনি খেয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” তাড়াতাড়ি খেয়ে ওপরে চলে এসো। নিচে বেশিক্ষণ থেকোনা।”
আমি ইতস্তত করে আশেপাশে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখি সবাই মিটমিট করে হেসে যাচ্ছে। উফফ কী জ্বালারে ভাই। এভাবে বলার কী ছিলো? নিশ্চয়ই ওপরে নিয়ে বই খাতা নিয়ে বসিয়ে দেবে। কিন্তু সবাইতো ভাবছে যে উনি কী না কী জন্যে ডাকছেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। উনি চলে গেলেন। উনি যেতেই সবাই আমার দিকে তাকালো। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মামনী এসে আমায় আলতো করে জরিয়ে ধরে বললেন,
— ” এমন অসাধ্য সাধন কীকরে করলি মা?”
বড় আম্মুও বললেন,
— ” হ্যাঁ। এই চারমাসেও যেটা হয়নি সেটা আজ হলো।”
আমি বেশ অনেকটা অবাক হয়ে বললাম,
— ” কিন্তু আমিতো…”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাবা বললেন,
— ” আমি জানতাম যদি কেউ পারে তাহলে একমাত্র ওই পারবে। দেখলে মিলল তো আমার কথা?”
সবাই আমার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে যাচ্ছে আর আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনাদের দিকে। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছেনা কেউ। কিন্তু আমিতো কিছুই করিনি। ওনাদের ঐ হাফ পাগল ছেলে কীভাবে,কখন, কী করে সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার এই ছোট্ট মাথাটার নেই। কিছু না করেই সব ক্রেডিট পেয়ে গেলাম? এভাবে যদি কিছু না পড়েই মেডিকেলে চান্সটা হয়ে যেতো কত্তো ভালো হতো তাইনা? কিন্তু সকাল থেকেই ওনার ব্যবহারে অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করছি। আচ্ছা উনি কী আমাকে নিজের ওয়াইফ হিসেবে মেনে নিতে শুরু করে দিয়েছেন? যদি তাই হয় তাহলে আমিও এতো সহজে সব মানবো না। বিয়ের রাতে তো খুব করে বলেছিলো “তোমাকে কোনোদিন বউ হিসেবে মানতে পারবোনা।” এখন দেখি এতো ভাব কোথায় যায়।
___________________
রাতে আমাকে গত লেকচারের পড়াটা কম্প্লিট করিয়ে দিয়ে উনি বললেন,
— ” আজকের টা ভালো ছিলো। জুওলজিতে যতোটা কনসেনট্রেট করো জিকে, ওরগ্যানিক কেমিস্ট্রি আর ফিজিক্সে এ এর অর্ধেক করলে আমার আর টেনশন থাকতোনা।”
আমি একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম,
— ” দূর। আমার ওইগুলো ভালোলাগেনা। ফিজিক্স যেমন তেমন কিন্তু জিকে আর ওরগ্যানিক ক্যামিস্ট্রি নাম শুনলেই মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়।”
উনি এবার বেশ রেগে ধমকে বললেন,
— ” মাথায় একটা চাটা মারলেই মাথা ব্যাথা পালিয়ে যাবে। এই দুটোই মেডিক্যাল এডমিশনের জন্যে কতো ইমপর্টেন্ট জানো? আর যাই হোক চান্স তো পেতে হবে তো?”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
— ” যদি না পাই?”
উনি শক্ত কন্ঠে বললেন,
— ” ঘর থেকে বেড় করে দেবো তাহলে।”
আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিলেন। তারপর বইগুলো গুছিয়ে টেবিলে রেখে একটা হেয়ার ব্যান্ড এনে আমার দিকে সামনে বসে বললেন,
— ” ঘোরো।”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি নিজেই ধরে আমায় ঘুরিয়ে বসিয়ে হাত দিয়ে খোলা চুলগুলো সব একজায়গায় এনে বেঁধে দিলেন। আমি একটু অবাক হলাম ঠিকই কিন্তু কিছুই বললাম না। উনি বালিশ ঠিক করে বললেন,
— ” শুয়ে পরো। সকালে কোচিং এ যেতে হবে তো।”
আমিও চুপচাপ শুয়ে পরলেন। আমাকে চরম অবাক করে দিয়ে উনি আজ আর আমার সতীনকে আজ মাঝখানে না রেখেই শুয়ে পরলেন উনি। এবং আমার অনেকটা কাছে এসেই শুয়েছেন। আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে তবে কী সত্যিই আমাকে উনি নিজের ওয়াইফ হিসেবে মেনে নিচ্ছেন? কিন্তু আমিতো এতো সহজে ছাড় দেবোনা, অনেক কষ্ট দিয়েছে আমাকে, অনেক জ্বালিয়েছে। এবার আমার পালা। আমি কোলবালিশটা আবার আমাদের মাঝখানে এনে রাখলাম। উনি ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে। আমি এমন ভাব করলাম যেনো কিছুই হয়নি। এবার দেখো কেমন লাগে। উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোলবালিশটা সরিয়ে দিলেন। আমি আবারও কোলবালিশটা মাঝখানে এনে রাখলাম। হা হা সবেতো শুরু খবিশরাম তোমাকে অনেক টাইট দেওয়া বাকি। উনি এবার কোলবালিশটা নিয়ে ছুড়ে ফ্লোরে ফেলে দিলেন। আমি চমকে গেলাম। উনি আমার হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আমার দুই হাত বালিশে চেপে ধরে শক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম। ওনাকে রাগাতে চেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু এতোটা রেগে যাবেন ভাবিনি। আল্লাহ্ রক্ষা করো।
#চলবে…
( রিচেইক করতে পারিনি আর দ্রুত টাইপ করতে হয়েছে। তাই দয়াকরে টাইপিং মিস্টেকগুলো নিজ দায়িত্বে বুঝে নেবেন)
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১২
.
আদ্রিয়ান এক্কেবারে খুব বেশি কাছে চলে এসেছেন আমার। হাত দুটো বেশ জোরেই চেপে ধরে রেখেছে। আমি ভীত চোখে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— ” সমস্যা কী? বারবার মাঝখানে এটাকে আনছো কেনো?”
আমি একটু অবাক হলাম। এতোদিন তো নিজেই কোলবালিশকে আমার সতীন বানিয়ে মাঝে রেখে দিতো আজ আমি দিয়েছি তাতে আমার দোষ হয়ে গেলো? আজব। না উনি যতই রাগ দেখাক আমি আমার জায়গা থেকে নড়ব না। কী আর করবেন উনি। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,
— ” অ্ আপনিও তো মাঝখানে ব্ বালিশ দিয়ে রাখতেন রোজ।”
— ” হ্যাঁ তো? আজতো রাখিনি।”
ওনার নিশ্বাস আমার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছেন। উনি এতোটা কাছে আসায় আমার শরীর কাঁপছে। তারওপর ওনার রাগ দেখে দেখে ভয় ও লাগছে। কিন্তু এখন উইক হলে চলবে না, শক্ত থাকতে হবে। আমি ইতস্তত করে বললাম,
— ” না আমি ভাবলাম আপনি হয়তো ভুল করে আজ কোলবালিশটা রাখেন নি।”
উনি এবার আরও শক্ত করে হাতদুটো চেপে ধরে বলল,
— ” ভাবলে? কেনো ভাবলে? এতো ভাবতে কে বলে তোমাকে? একদম বেশি ভাবতে আসবেনা। ভেবেছোই যখন তখন এতো উল্টোপাল্টা ভাবতে কে বলেছিল হ্যাঁ? এটাও তো ভাবতে পারতে যে..”
— ” যে?”
উনি এবার দুষ্টু হেসে ডান হাত দিয়ে আমার বেড়িয়ে আসা ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বললেন,
— ” তোমার এতো কিছু জানতে হবেনা। চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো। আর সেদিন বেচারা কোলবালিশটাকে খুব করে ঝাড়ছিলে যে আমাদের মাঝখানে কেনো আসে তাইতো সরিয়ে দিলাম। আর কী জেনো বলছিলে ও তোমার সতীন?”
বলে উনি আমাকে ছেড়ে পাশে শুয়ে শব্দ করে হাসতে লাগল। আমিও ওভাবে শুয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে ওনার হাসি দেখছি। উনিও হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” সিরিয়াসলি? মানে একটা কোলবালিশকে নিয়েও তুমি জেলাস?”
আমার বেশ লজ্জা লাগছে। তারমানে সেদিন উনি আমার ঐ সব উদ্ভট কথাবার্তা শুনেছেন? ইসস কী লজ্জা! আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। উনি হেসে বললেন,
— ” পরে ভেবে দেখলাম আমার এক বউয়ের জন্য আরেক কষ্ট পাবে এটাতো ঠিক না। আর তাছাড়া ঐ বউ কে নিয়েতো এতোগুলো বছর কাটালাম এবার একটু এই বউটাকে নিয়ে কাটাই?”
আমি এবার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। বউ? মানে কী? ওই কোলবালিশ ওনার বউ? আমার নাহয় ওটাকে দেখলে সতীন সতীন ফিলিংস আসে তাই আমি বলি। কিন্তু তাই বলে উনিও বলবেন? আমি কিছক্ষণ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থেকে মুখউঠে বসলাম। তারপর উঠে বসে বললাম,
— ” না থাক আপনি আপনার ফার্স্ট ওয়াইফ মানে প্রথম প্রেমিকিকে নিয়েই থাকুন।”
উনি মাথা একহাতে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে বললেন,
— ” যাহ বাবা। সেদিন তো এতো কথা শোনালে মাঝে আসে বলে? আজ কী হলো?”
আমি একটা মেকি হাসি দিয়ে বললাম,
— ” আসলে কী বলুনতো? এতদিন পাশে নিয়ে শুতে শুতে ওর ওপর মায়া পরে গেছে। এখন আমি ওকে ছাড়া শুতে পারিনা তাই এটা আমার পাশেই থাকবে।”
বলে আমি নামতে নিলেই ঊনি হাত ধরে টান দিয়ে আমায় বেডে শুইয়ে দিয়ে বললেন,
— ” হাজবেন্ট ছাড়া কারও প্রতি এতো মায়া দেখাতে নেই। ভালো দেখায় না ইউ নো।”
— ” হাজবেন্ট? আপনি তো আমাকে বউ বলেই মানেন না তাইনা?”
— ” বড্ড বেশিই কথা বলো তুমি। কিপ ইউর মাউথ শাট আল ঘুমোও।”
আমি ওনার কথার পাত্তা না দিয়ে ছাড়িয়ে উঠে যেতে নিলে উনি আবারও আমাকে টেনে শুইয়ে দিয়ে বললেন,
— ” একদম বেশি বাড়াবাড়ি করবেনা ঠিক আছে? আমি রেগে গেলে কী করতে পারি সেটা কিন্তু তুমি খুব ভালো করেই জানো। আর এখন তো তুমি আমার বউ। সো বুঝতেই পারছো?”
ওনার এই ঠান্ডা গলার ভয়াবহ হুমকিতে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। তাই আর কোনো কথা বলে চুপ করে শুয়ে রইলাম। উনি একটু হেসে শুয়ে পরলেন আমার দিকে ঘুরে আমার অনেকটা কাছে এসে আমার পেটের ওপর ওনার ডান হাত রাখলেন। আমি ফ্রিজড হয়ে আছি পুরো কিন্তু ওনার ওই হুমকির পর কিছু বলার সাহস পাচ্ছিনা। আজব! নিজের যেটা ইচ্ছে হয় সেটাই করে আমার কোনো ভ্যালুই নেই। ওনার যখন ইচ্ছা হয় তাই করেন আমার সাথে। আর আমাকে? অবোধ অসহায় শিশুর মতো সব মেনে নিতে হয়। তবে কেনো জানিনা খুব খারাপ লাগছে না ওনার এই সামান্য ছোঁয়াতেও অদ্ভুত কিছু আছে। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ ঘুমোনোর চেষ্টা করতে শুরু করলাম। তবে তুমি যতোই জোর খাটাও আমি এতো ইজিলি গলবোনা। কোনো দোষ না করেও অনেক কঠিন কঠিন কথা শুনেছি আপনার মুখে। এবার আমিও দেখি আপনি কী কী করতে পারেন।
__________________
বাড়ির সবাই ভীষণ রকমে খুশি কারণ বাড়ির প্রাণ বাড়িতে ফিরে এসছে। এই বাড়ির প্রাণ আদ্রিয়ান। আর ওনার আগের মতো হয়ে যাওয়াতে সবাই ভীষণ রকমের খুশি হয়েছে। আর সব ক্রেডিট দিচ্ছে আমাকে যেখানে আমি কিছুই করিনি। এমনিতেই বাবা মামনী আমাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু এখন পুরো চোখে হারায়। কোচিং সেন্টারে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট লাগাতে গেলেই উনি হাত ধরে আটকে দিয়ে নিজে সিটবেল্ট টা লাগাতে লাগাতে বললেন,
— ” এটা আমি করি, আর সমসময় আমিই করবো।”
— ” এটাও কী রেসপন্সিবিলিটি?”
উনি গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বললেন,
— ” বাচ্চাদের এতো কথা জানতে হয়না।”
আমি একটা ভেংচি কেটে কোনো কথা না বলে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই বলিনা আমি ওনার সাথে। আর বলবও না। হুহ।
কোচিং সেন্টারের ভেতরে ঢুকতেই চমকে গেলাম আমি। কারণ ইশরাত। ইশরাত জাহান। আমার কলিজার বেস্টিদের মধ্যে একজন। আমি ওকে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওর সাথে ফোনে কথা হয় ঠিকই কিন্তু ওকে এখানে দেখবো ভাবতেই পারিনি ও আমাকে দেখে হেসে দিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। আমি শকড হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ও আমাকে ছেড়ে আমার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
— ” কীরে বান্দরনী এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? কেমন দিলাম সারপ্রাইজ? ”
আমি চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” তুই না বলেছিলি যে তুই এডমিশনের জন্যে কোচিং করবি না?”
ইশরাত চোখ টিপ মেরে বলল,
— ” এটাই তো সারপ্রাইজ ছিলো বেইবি। কেমন দিলাম?”
আমি ওর কান টেনে ধরে বললাম,
— ” তোকে পিস পিস করে কেটে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার। শয়তান মেয়ে একটা। জানিস কত্তো মন খারাপ ছিলো? তুই নেই, অরু মেডিকো তে আর ঐশির ব্যাচ আলাদা। একা একা ভালো লাগে?”
— ” তাইতো চলে এসছি বেইবি। আচ্ছা ছাড়না জিজু কেমন আছে?”
— ” উনি ভালোই থাকেন।”
ইশরাত এবার মুখ ফুলিয়ে বলল,
— ” কাজটা তুই একদমি ঠিক করিসনি জানিস। তোর বিয়ের দিন জিজুকে দেখে কী হাই লেভেলের ক্রাশটা খেয়েছিলাম? কে জানতো একেই একদিন জিজু ডাকতে হবে? জিজু ডাঈতে গেলেই বুকের ভেতরে কেমন ব্যথা ব্যথা করে।”
আমি একটু রাগী চোখে তাকালাম ওর দিকে। ও একটু ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। ওর হাসি দেখে আমিও হেসে দিলাম। তারপর দুজনেই গল্প করতে করতে কোচিং রুমে ঢুকলাম। বন্ধু মানেই আস্তো ভালোবাসা। দুষ্টুমি, খুনশুটি, শেয়ারিং, কেয়ারিং সব মিলিয়ে জীবনের এক অমূল্য পাওয়া হলো বন্ধু।
__________________
আরো তিনটা দিন কেটে গেছে। এই তিনদিন খুব ভালোকরেই ইগনোর করেছি ওনাকে। রাতে রোজই দূরে সরে যাই কিন্তু উনি টেনে কাছে এনে আমার ওপর হাত দিয়েই ঘুমোন।
বিকেলে আমি বসে বসে বায়োলজি পরছি আর উনি আমার পাশে বসে ল্যাপটপে কী জেনো কাজ করছে। হঠা উনি বলে উঠলেন,
— ” অনি আমার জন্যে এক কাপ কফি নিয়ে এসো।”
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম ওনার দিকে। অনি “এককাপ কফি নিয়ে এসোতো?”। কেনো? আমি কেনো আনবো? সেদিন তো কফির মগটাই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র আমি নিয়ে এসছিলাম বলে এখন এতো পিরীত কোথা থেকে আসছে। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু নো।
আমি মুখ গোমড়া করে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
— ” আমি মনিকে বলে দিচ্ছি নিয়ে আসতে।”
উনি এবার ল্যাপটপটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে আমার বাহু চেপে ধরে বললেন,
— ” কদিন ধরেই এমন করছো। আমি কিছু বলছিনা তাই বলে যা খুশি করবে নাকি? কফিটা তুমিই আনবে। যাও!”
আমি ওনার দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কফি আনতে বেড়িয়ে এলাম। সাধে ওনাকে খবিশ রাম বলি? আমার জীবণটা ত্যানাত্যানা করে দিলো। মানুষটা এমন কেনো? গিরগিটি কেনো? আকাশও এতোবার রং বদলায় না যতোবার উনি বদলাম। উনি আর আকাশ দুটোই সমান। এক বিশাল বড় রহস্য। যেই রহস্যকে ভেদ করা এককথায় অসম্ভব।
#চলবে…
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৩
.
আদ্রিয়ানের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে কফি বানিয়ে ওনার কাছে কফির মগটা নিয়ে গেলাম। এসে দেখি উনি নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে আছেন। আমি গলাটা হালকা ঝেড়ে বললাম,
— ” আপনার কফি।”
উনি আমার দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে কফির মগটা নিয়ে কফি খেতে শুরু করলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,
— ” এক্সামের রেসাল্ট দিয়েছে?”
আমি ইতস্তত করে বললাম,
— ” হুম দিয়েছে।”
— ” মেরিট পজিশন কতো? আর মার্কস কতো এসছে?”
আমি চুপ করে আছি আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” কী হলো? বলো?”
আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— ” মার্কস ফরটি সিক্স। আর পজিশন একশ বারো।”
উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর অবাক কন্ঠে বললেন,
— ” একশ বারো? মানে কী? এতো কষ্ট করে দিন রাত এক করে পড়াচ্ছি তোমাকে এই পজিশনের জন্যে?”
আজব এতো হাজার স্টুডেন্ট এর মধ্যে একশ বারো তম হয়েছি এতে প্রবলেম টা কোথায় শুনি? বেশ ভালোই তো হয়েছে। সবকিছুতে বেশি বেশি। নিজে সবসময় টপ করতো বলে কী আমাকেও করতে হবে নাকি? উনি একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
— ” পজিশন আরও এগোতে হবে অনি নয়তো ডিএমসি তে চান্স হবেনা। অন্যান্য কোচিং সেন্টারে আরও ভালো ভালো স্টুডেন্ট আছে। সো হার্ডওয়ার্ক করতে হবে।’
আমার এবার খুব বিরক্ত লাগছে। আরে ভাই আমার হাজবেন্ট তুই। পড়াস ঠিক আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু রোমান্টিক ও তো হওয়া যায়। এতো চাপ দেওয়ার কী আছে। সবসময় এরকম করে। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে মুখ ফুলিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” আপনি এমন কেনো বলবেন? পুরোটা সময় শুধু বই খাতা নিয়ে বসিয়ে রাখেন। বউ আমি আপনার মাঝে মাঝে তো একটু রোমান্টিকও হতে পারেন। কী হয় একটু ..”
এটুকু বলেই থেমে গেলাম আমি। কারণ এতোক্ষণে হুস এলো যে কী বলছিলাম। এটাই আমার দোষ। যখন বলতে শুরু করি তখন ডানে বায়ে আশেপাশে তাকিয়ে কথা বলিনা, আর কী বলছি সেটা ভেবেও বলিনা। নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হচ্ছে এতো বোকা কেনো আমি? সংকোচ নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি ওনার এক ভীষণ বিখ্যাত স্টাইলে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মানে দুই ভ্রু কোণাকুণি এঙ্গেলে কীভাবে জেনো বাঁকান উনি। বিখ্যাত বলছি এই কারণে কারণ এরকমভাবে ভ্রু বাঁকাতে আমি উনি ছাড়া একমাত্র সুশান্ত সিং রাজপুত কেই দেখেছিলাম। যদিও উনি এখন আর এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আদ্রিয়ানের ভ্রু বাঁকানোর স্টাইলটা একদমই ওনার মতো। উনি কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে ল্যাপটপটা বন্ধ করে সাইডে রেখে মুখে হালকা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটু এগোলেই আমি পিছিয়ে গেলাম। উনি বাঁকা হাসি দিয়েই এগোচ্ছেন আমার দিকে। আমি পেছাতে পেছাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
— ” আপনি এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?”
— ” তুমি এভাবে পিছিয়ে যাচ্ছো কেনো? আফটার ওল তুমি আমার বউ আমিতো তোমার কাছে যেতেই পারি? অধিকার আছে।”
আমি কী বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওনার এরকম কথার উত্তরে ঠিক কী বলা যায় সেটা জানা নেই আমার। আমি শুধু একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমি যেদিক দিয়ে পেছাচ্ছি সেদিকে দেয়ালটা কাছে থাকার ফলে খুব বেশি দেরী হলোনা দেয়ালের সাথে লেগে যেতে। আমি দেয়ালের সাথে আটকে যেতেই উনি আমার ডান পাশ দিয়ে দেয়ালের ওপরে হাত রেখে একটু ঝুকে বললেন,
— ” তখন কী যেনো বলছিলে? তুমি আমার বউ। আমি এতো আনরোমান্টিক কেনো? এতো এতো অভিযোগ করলে আর এখন যখন আমি তোমার কাছে এলাম তখন তুমি পিছিয়ে যাচ্ছো? নট ফেয়ার!”
ওনার এতো কাছে আসাতে তো আমার অবস্থা ভীষন রকমের খারাপ হয়ে আছে। উনি ইচ্ছে করেই আমাকে টিজ করতেই যে এরকমটা করছেন সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি আমি। উনি আরেক হাতে আমার কপালের চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলেন আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। উনি ওনার চার আঙ্গুল দিয়েই আমার গালে আলতো করেই স্লাইড করে থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরলেন। আমি আমার জামা শক্ত করে ধরে আছি, চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছি, ঠোঁটও যে মৃদু কাঁপছে সেটা ফিল করতে পারছি। এটাও ফিল করতে পারছি যে ওনার নিশ্বাস আমার মুখের ওপর পরছে।
— ” ওহহ শিট! সরি সরি আমি কিছু দেখিনি।”
কারও আওয়াজ পেয়ে চমকে চোখ খুলে তাকালাম আমি, উনিও সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি জাবিন উল্টো ঘুরে চোখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর আদ্রিয়ান দূজনেই একে ওপরের দিকে তাকালাম। জাবিনের দিকে তাকিয়ে ওকে কিছু বলবো তার আগেই ও বলল,
— ” ভেরি সরি। আসলে দরজা পুরো খোলা ছিলোতো বুঝতে পারিনি। যাই হোক তোমরা কনটিনিউ করো আমি যাচ্ছি।”
এটা বলে জাবিন দৌড়ে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান বলল,
— ” ওয়ে ড্রামাবাজ দাঁড়া। কী বলতে এসছিলি বল?”
জাবিন পুরো পজ হওয়ার স্টাইলে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর ওভাবে দাঁড়িয়েই বলল,
— ” আম্মু তোদের ডাকছে। স্নাকস হয়ে গেছে।”
বলে দৌড়ে চলে গেলো। আমি নাক ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাকালাম ওপার দিকে। শুধু শুধু শুধু খবিশ বলি ওনাকে? ইজ্জতের পুরো ফালুদা দিলো আমার। কিন্তু ওনার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই জেনো যেটা হয়েছে সেটা তেমন কোনো ব্যাপারই না। হুহ। আমি ওনার দিকে একটা বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে এলাম ওখান থেকে। নিচে গিয়ে দেখি ইফাজ ভাইয়া, আপি, জাবিন তিনজনই মিটমিটিয়ে হাসছে। বেশ বুঝতে পারলাম জাবিনটা উপরে যা দেখেছে সব বলে দিয়েছে। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে সোফায় বসে পরলাম। জাবিব একটু গলা ঝেড়ে বলল,
— ” কী হলো ভাবী? ভাইয়া এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলো?”
আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম ওর দিকে। আমাকে ওভাবে তাকাতে দেখে জাবিন চোখ সরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাশয় নিচে চলে এলেন। উনি এসেই আমি যেই সিঙ্গেল সোফায় বসেছি সেই সোফারই হ্যান্ডেলের ওপর বসে পরলো। আমি ভ্রু কুচকে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলাম। বাবা এসে বসে আমাদের জয়েন করলেন। উনি ইফাজ ভাইয়া আর ওনার সাথে টুকিটাকি কথা বলছেন। একটু পর মামনীরাও স্নাকস নিয়ে চলে এলো। সবাই মিলে গল্প করছি। তখনই বাবা বলল,
— ” ইফাজ, আদ্রিয়ান।”
ওপারা দুজনেই বাবার দিকে তাকালেন। বাবা চায়ের কাপটা টি- টেবিলে রেখে বললেন,
— ” সামনের শুক্রবার একটা পার্টিতে আমার ইনভিটেশন ছিলো। কিন্তু আমাকে আর ভাইয়াকে একটু চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে দুদিনের জন্যে। ঐদিন আমরা থাকবোনা। তাই আমাদের হয়ে পার্টিটা তোমরা দুজন হিয়া আর অনিকে নিয়ে জয়েন করবে। জাবিন যেতে চাইলে যেতে পারে।”
ওনারা দুজনেই সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন। আমি শুধু আদ্রিয়ানকে দেখছি। লোকটা হঠাৎ এতো বদলে গেলো কীকরে? ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুতে ওনার এরকম পরিবর্তন অস্বাভাবিক ছিলো। হ্যাঁ এটা ঠিক যে প্রিয় বন্ধু ছিলেন ওনার কিন্তু চারটা মাস কেটে যাওয়ার পরেও সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখাটা যতোটা আস্বাভাবিক আর অদ্ভুত ছিল, তারচেয়েও বেশি অদ্ভুত হচ্ছে ওনার এই মুহূর্তে করা ব্যবহারগুলো। হঠাৎ এভাবে আগের মতো কীকরে হয়ে গেলো? না আর ভাববো না। ওনাকে নিয়ে ভাবতে বসলেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে আমার। উনি খুবই জটিল একজন মানুষ। ভীষণ জটিল।
___________________
আজ কোচিং নেই তাই রুমে বসেই বেডে হেলান দিয়ে বই দেখছিলাম। কোথা থেকে উনি এসে বললেন,
— ” অনি একটু তাড়াতাড়ি রেডি হও তো। বেড়োবো।”
আমি একটু অবাক হলাম। আমাকে নিয়ে এখন আবার কোথায় বেড়োবেন উনি? আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” এখন কোথায় যাবো?”
— ” গেলেই দেখতে পাবে। একটু তাড়াতাড়ি করো প্লিজ।”
আমি জানি এখন ওনাকে জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলবেন না তাই আর কোনো কথা বাড়ালামই না। চুপচাপ উঠে গিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। দুজনেই বেড়িয়ে পরলাম। গাড়িতে গোটা রাস্তা ওনার সাথে আর কথা হয়নি। গাড়ি থামতেই ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম এটা ইশরাক ভাইয়াদের বাড়ি। আমি একটু অবাক হলাম উনি এখানে কেনো আনলেন আমাকে? উনি আমার সিটবেল্ট খুলে দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আমার হাত ধরেই ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে নিয়ে গিয়ে আমার হাত ধরেই সোজা একটা রুমের দরজার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন। দরজার ভেতরে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে আমার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো। নূর আপু খাটে হেলান দিয়ে বসে একটা ফ্রেম বুকে জরিয়ে বসে আছে। নিশ্চয়ই এটা ইশরাক ভাইয়ার ছবি। কী হাল করেছে নিজের? সুন্দর ভাসা চোখ দুটো বসে গেছে, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, এইসময় নাকি মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো হয় কিন্তু উনি শুকিয়ে গেছেন। এমন মনে হচ্ছে শুধু বাঁচতে হবে তাই বেঁচে আছে। এতো চঞ্চল একটা মেয়েকে এতোটা প্রাণহীন দেখে নিজের চোখের জলকে আটকাতে পারলাম না। আমি ধীর চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালাম উনি একদৃষ্টিতে নূর আপুকেই দেখছেন। আচ্ছা সবচেয়ে কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কী এতোটাই গভীর হয়? নিজের স্বামী হারানোর যন্ত্রণা কী মানুষকে এভাবেই শেষ করে দেয়? এভাবে পাথরে পরিণত করে দেয়? ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুটা এক বিশাল বড় রহস্য। এখনও কেউ জানেনা ঠিক কেনো মরতে হলো ওনাকে। যদি কোনোদিন আমি আদ্রিয়ানকে এভাবে হারিয়ে ফেলি? যদি উনিও এইভাবেই আমাকে ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যায়? তখন কী করবো আমি? এভাবেই জীবন্ত একটা লাশ হয়ে বেঁচে থাকবো চিরকাল?
#চলবে…