ভালোবাসা অন্যরকম পর্ব-১৮(শেষ পর্ব)

0
1645

#ভালোবাসা অন্যরকম
[১৮ ও শেষ পর্ব ]
লেখক – আবির চৌধুরী

একটু পরে এম্বুল্যান্স চালাতে শুরু করে দিল।আমি আর আম্মুর রাইসার পাসে বসে আছি। আমি রাইসার একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে বসে রইলাম। রাইসা একটু পর পর চিৎকার দিয়ে উঠছে।

— রাইসা আর একটু অপেক্ষা করো হাসপাতালের কাছে চলে আসছি আমরা।

কিন্তু রাইসাকে কোনো ভাবে সান্ত্বনা দেওয়া যাচ্ছেনা। আম্মু একটু পর পর রাইসার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা হাসপাতালে পৌছে গেলাম। তারপর রাইসা কে নিয়ে একটা কেবিনে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার চলে আসল। ডাক্তার রাইসার সব কিছু চেক করে বলল — ওনার সিজার করতে হবে অবস্থা খুব খারাপ।

— যা ইচ্ছে করেন ডাক্তার আমার রাইসা যেনো সুস্থ হয়ে যায় আমি এটাই চাই।

ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল — বললেই তো আর হয়ে যাবে না অনেক রিক্স আছে হয়তো দুজনকে বাঁচাতে পারবো না রোগীর কন্ডিশন অনেক খারাপ। তবে আমরা চেষ্টা করবো দুজনকেই বাঁচানোর।

— ডাক্তার আপনি আমার রাইসাকে ঠিক করে দিন। রাইসার যেনো কিছু না হয় প্লিজ ডাক্তার।

তখন রাইসা বলে উঠলো — ডাক্তার আমার যা কিছু হয়ে যাক আপনি আমার সন্তান কে বাঁচিয়ে দিন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

ডাক্তার — আমাদের হাতে সময় খুব কম আমি গিয়ে সব রেডি করছি আপনার কথা বলুন।

এই কথা বলে ডাক্তার বের হয়ে গেলো। এবার আম্মু রাইসার দিকে এগিয়ে আসলো।

আম্মু — মা তুই চিন্তা করিস না দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

আম্মু রাইসার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম রাইসার দিকে তাকিয়ে। কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। এইবার আমি রাইসা আমাকে ইশারা করে তার দিকে ডাক দিল।আমি ধিরে ধিরে রাইসার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। আমি গিয়ে রাইসার পাসে বসলাম।

রাইসা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল — ঈশান শোন! আমি যদি মারা যায় তা হলে কিন্তু তুমি আর বিয়ে করতে পারবেনা বলে দিলাম। তুমি শুধুই আমার এই পাড়েও আমার এপাড়েও আমার।

আমি রাইসার মুখে এমন কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। শুধু চোখ থেকে অজড় ধারা পানি ঝড়ছে।

— রাইসা কিছু হবে না তোমার দেখবে তুমি ঠিক হয়ে যাবে আল্লাহর উপরে বিশ্বাস রাখো দেখবে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব বলতে পারো?

— আমি জানি না ঈশান কেন জানি মনে হচ্ছে আমার সময় আর বেশি নাই।

— একদম চুপ কিছু হবে না তোমার তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

— আমার বাচ্চাকে দেখে রেখো তুমি তাকে কখনও কষ্ট পেতে দিয়না। আমাকে শেষ বারের মতো একটু বুকে জড়িয়ে নিবে তোমার?

— এই ভাবে কেন বলছ তুমি। আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে রাইসা। এই ভাবে বলবে না প্লিজ। কিছু হবে দেখো।

— আমাকে বুকে জড়িয়ে নাও তোমার। হয়তো আর কোনো দিন সেই সুযোগ আমি আর পাবো না।

এইবার আমি রাইসে খুব শক্ত করে আমার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। আমাদের দুজনের চোখ থেকে অশ্রু জুড়ছে। বুকের ভিতর টা আমার দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। এবার রাইসার কপালে একটা ভালো বাসার পরশ একে দিলাম। আর রাইসাকে শুইয়ে দিলাম। হঠাৎ করে আমার ফোন বেজে উঠল। আমি পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি রাইসার আম্মু কল দিয়েছে। আমি সাথে সাথে ফোন রিসিভ করলাম। কান্না মাথা গলায় হ্যালো বললাম।

— বাবা কি হইছে এতো রাতে কল দিলে? আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। আর তোমার গলা এমন লাগছে কেন রাইসার কিছু হয়ে যায়নি তো?

— রাইসাকে নিয়ে কাল রাতে আমরা হাসপাতালে এসেছি৷ আপনার একটু তাড়াতাড়ি চলে আসুন।

— ঠিকানা পাঠিয়ে দাও আমি এক্ষনি আসছি।

তারপর আমি ঠিকানা দিয়ে দিলাম। রাইসার আম্মু কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এলো। আমি তখনও রাইসার পাসে বসে ছিলাম।

রাইসার আম্মু ভিতরে এসেই রাইসার দিকে এগিয়ে আসল। আর রাইসাকে বলতে থাকল — এখন কেমন লাগছে মা তোর? আর চিন্তা করিস না কিছু হবে না তোর।

রাইসা কিছু না বলে কান্না করেই যাচ্ছে।

– ঈশান বাবা ডাক্তার কি বলছে?

তারপর ডাক্তার যা যা বলল আমি সব কিছুই বললাম। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার চলে আসলো।

ডাক্তার — সব কিছু রেডি করা আছে। এখানে আপনি সিগনেচার করুন।

আমি — কিসের সিগনেচার?

— আল্লাহ না করুক যদি রোগীর কিছু হয়ে যায়। তখন এর দ্বায় বার আমরা নিতে পারবোনা। কারণ রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। বাচ্চা ঘুরে গেছে।

— ডাক্তার প্লিজ আমার রাইসার যেনো কিছু না হয়।

— আল্লাহ কাছে দোয়া করুন। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করব। মা ও সন্তান দুজনকেই যেনো বাঁচাতে পারি। বাকিটা আল্লাহর হাতে।

তারপর আমরা সবাই সিগনেচার করে দিলাম। একটু পরে রাইসাকে অপারেশন রুমে নিয়ে গেলো। আমরা সবাই গিয়ে অপারেশন রুমে সামে দাঁড়িয়ে রইলাম। আল্লাহ কাছে বললাম। হে আল্লাহ আমার রাইসাকে তুমি সুস্থ করে দিয়। ওর যেনো কিছু না হয়।আমি দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বের হচ্ছে।

হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমার ঘাড়ের ওপর হাত রেখেছে। তাকিয়ে দেখি আম্মু।

— ঈশান তুই একটু শক্ত হ বাবা তুই এমন করলে কি ভাবে হবে বল?

— আমি পারছিনা আম্মু।

এই কথা বলেই আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। আম্মু আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে৷

অনেক্ষন হয়ে গেলো ডাক্তার এখনও বের হচ্ছে-না। এখন খুব চিন্তা হচ্ছে। সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে। অনেক্ষন পরে ডাক্তার বের হয়ে আসল।ডাক্তার কে বের হতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি ডাক্তার রের দিকে এগিয়ে গেলাম।

— ডাক্তার আনার রাইসা কেমন আছে?

ডাক্তারে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।কিছু বলছেন না দেখে আমার খুব ভয় হচ্ছে।

— ডাক্তার কথা বলুন চুপ হয়ে আছেন কেন আপনি? কিছু তো বলুন আমার রাইসার কিছু হয়ে যায়নি তো?

এবার ডাক্তার একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল — কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার ঈশান আপনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই মা ও সন্তান দুজনেই সুস্থ আছে।

ডাক্তারের কথা শুনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে ঠোঁটের কোণে ডাক্তার কে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বললাম — আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ ডাক্তার অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

— আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমি তো সামান্য উছিলা ধন্যবাদ উপর ওয়ালাকে দিন। তিনি না চাইলে কিছুই হতো না।

তারপর আমি আল্লাহ কাছে হাত তুলে কুক্রিয়া আদায় করলাম।

— ডাক্তার আমারা কখন দেখা করতে পারব?

— একটু পরেই পারবেন। রোগীকে একটু পরেই কেবিনে শিপ্ট করা হবে তখন দেখা করতে পারবেন

এই কথা বলেই ডাক্তার চলে গেলো। এবার আম্মু আমার দিকে এগিয়ে আসলো। এতক্ষণ পরে সবার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আম্মু আমার কাছে আস্তেই আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। আর কান্না করে দিলাম। কান্নাটা কষ্টের নয় বরং সুখের কান্না।

— বোকা ছেলে আবার কান্না করছিস কেম তুই?

— জানি না আম্মু।

কিছুক্ষণ পরে রাইসাকে কেবিনে শিপ্ট করা হয়েছে। সবাই রাইসাকে দেখে বের হয়ে চলে আসছে। এবার আমি কেবিনের ভিতরে চলে গেলাম। দেখি রাইসা আর আমার বাচ্চা শুয়ে আছে। রাইসা আমাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিল। আমি রাইসার পাসে গিয়ে বসলাম। আর রাইসার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললাম — এখন কেমন আছো তুমি?

— ভালো আছি।

তারপর পর চোখ পড়লো আমার বাচ্চা মেয়েটার দিকে। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে ঠিক তার মায়ের মতো। আমি আমার মেয়েকে কোলে তুলে একটা চুমু খেলাম। তারপর আবার রাইসার পাসে শুইয়ে দিলাম।

–ঈশান জানো আমার খুব ভয় হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো আমি আর কোনো দিন তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবনা।

— পাগলি একটা। আল্লাহর উপরে আমার বিশ্বাস ছিল আমি জানি আল্লাহ আমাদের সাথে এমন কিছুই করতে পারেনা।

আমি আবার রাইসার কপালে একটা চুমু খেলাম। তারপর থেকে শুরু হলো দুজনের মাঝে আবার ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়। তাদের ভালো বাসা টিকে থাকুক আজীবন। আর গল্পটা এখানেই শেষ করে দিলাম।

___________সমাপ্ত________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে