ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব-০৬

0
1613

#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬

রোদ সেই যে মুখ ফুলিয়ে রাখলো। রাখলো তো রাখলোই। সবার সাথে এই মেয়ে কথা বলছে শুধু বাদ মাত্র আদ্রিয়ান। এতসবেও আদ্রিয়ান তেমন একটা রাগ না করলেও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল যখন দেখলো ফোনে রোদ হেসে হেসে ঐ ইয়াজ নামক বন্ধুর সাথে কথা বলছে। কই আদ্রিয়ান যে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে সে তো আদ্রিয়ানকে পাত্তা দিচ্ছে না। ছেলে-মেয়ে বন্ধু হতেই পারে। এটাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখবে এতটা কুরুচিশীল ব্যাক্তি আবার আদ্রিয়ান না কিন্তু এই একই ভুল তো সে দ্বিতীয় বার করতে নারাজ। ভয়ানক ভাবে ঠকেছে আদ্রিয়ান একই ভাবে নিশ্চিত সে দ্বিতীয় বার ঠকতে চায় না। কিছু একটা মনে পরতেই ফর্সা চেহারাটা নিমিষেই লাল হয়ে গেল। হাত মুঠ করে এগিয়ে এসে একটানে ফোন নিয়ে নিলো রোদের থেকে। ঘটনা কি ঘটেছে তা বুঝে উঠতে পারলো না রোদ তাই ভ্রু কুচকে বললো,

— ফোন দিন আমার।

আদ্রিয়ান ফোন না দিয়ে উল্টো কল কেটে দিলো যা দেখে রোদ মেজাজ খারাপ করে বললো,

— আজব কল কেন কাটলেন। ফোন দিন আমার।

আদ্রিয়ান নিজেকে শান্ত রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,

— কোন ছেলে ফ্রেন্ড রাখা যাবে না।

রোদের গেল এবার মেজাজ ভয়ানক খারাপ হয়ে৷ এমনিতেই আদ্রিয়ান বাসায় না যেতে দেয়ায় রোদের মুড অফ ছিলো এখন আবার এই আদ্রিয়ান টাল্টি ফাল্টি শুরু করেছে তাই রোদ একটু রেগে বললো,

— ইয়াজ কোন জিনিস না যে রাখা না রাখার কথা বলা হচ্ছে। ফ্রেন্ড ও আমার। সারাজীবন ই থাকবে।আর…

আর কিছু বলার আগেই জোরে এক ধমক দিলো আদ্রিয়ান। রোদ একটু পিছিয়ে গেল ভয়ে। আদ্রিয়ান রোদের বাহু ধরে টেনে সামনে এনে দাঁত খামটি দিয়ে বললো,

— কোন ছেলে ফ্রেন্ড না মানে না। একই ভুল এই আদ্রিয়ান দুই বার করবে না।

রোদের চোখ দিয়ে টুপ করে দু ফোঁটা পানি পরলো। এত জোরে ধরাতে ব্যাথা পেয়ে শুধু বললো,

— হাত ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি।

আদ্রিয়ানের যেন হুস এলো। কি করছিলো নিজেও জানে না এমন একটা ভাব। তারাতাড়ি রোদের হাত ছেড়ে অস্থির কন্ঠে বললো,

— রো..রোদ আমি..

আর কিছু বলার আগেই রোদ চোখ ভর্তি পানি নিয়ে বললো,

— আমি কোন দিনও আপনার সামনে আসবো না। কোনদিনও কথা বলব না।

বলেই দৌড়ে রুম থেকে চলে গেল। আদ্রিয়ান শুধু হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। আদ্রিয়ান তো মোটেও এমন করতে চায় নি। কিভাবে করলো এমন ব্যাবহার রোদের ব্যবহার সাথে? ভাবতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আজকে যেন অনেকদিন পর বুকে একটু ব্যাথা করছে। ডান হাত দিয়ে নিজেই বুকের মাঝ দিকে বুলাতে লাগলো। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সেই সকল কাটানো মুহূর্ত।

অতীত~

মাইশা বরাবরই ছিলো বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান। একদম বড় বোন সাবার বিপরীত। সেই অবাধ্যতার জোরেই মা-বাবার অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করে নিজের ভালোবাসার মানুষকে। ছেলেটা ছিলো রাফিন। আর্মির ক্যাপ্টেন। আর্মি বলেই মাইশার পরিবার রাজি ছিলো না। ১৯ বছর বয়সেই বাড়ী থেকে পালিয়ে বিয়ে করে মাইশা। দু’জনের কোন কমতি ছিল না শুধু মাত্র পরিবার ছাড়া৷ কোয়াটারেই থাকত তারা৷ মাইশা সেই বছরই কনসিফ করে। এ নিয়ে দু’জনের কতশত পরিকল্পনা, কত আশা। কিন্তু সে সবের কিছুই ছিলো না শেষে একবুক যন্ত্রণা ব্যাতিত। রাফিনের সেই সময়ই মিশনে যেতে হয়েছিলো। সে মিশনে যাবে সেই দিন সকালে জানতে পারলো তাদের ছোট একটা ছেলে বাবু হবে। ভরা পেট তখন মাইশার। রাফিন বলে যায় তার ছেলের নাম হবে, “মিশান”। বিকেল দিকেই বিদায় নিলো সে। অশ্রু সিক্ত নয়নে মাইশা তাকে বিদায়ও দিলো। রাফিন ওর কপালে আর পেটে চুমু খেয়ে বললো,

— শিঘ্রই আসব মিশানের আম্মু।

কিন্তু হায় আর কোন দিন সে ফিরে আসে নি হেটে। এসেছিলো কফিনে করে। দেশের লাল-সবুজ পতাকায় মোড়ানো ছিলো সেই কফিন। শহীদ বলে কত লোক এলো তাদের ক্যাপ্টেনকে দেখতে, সম্মান করতে। মাইশার হাতে শুধু তুলে দিলো তার স্বামীর ইউনিফর্ম। এই শেষ। শেষ ছোট্ট একটা সংসার, একটা ভালোবাসার জীবনের সমাপ্তি এখানে।

মাইশার পরে ছেলে হলো। তবুও যেন ওর পরিবার ওকে মানতে নারাজ। শুধু মাত্র মিশানের দিকে তাকিয়ে ওকে মেনে নিলো সবাই। টাকার সমস্যা না থাকলেও মাইশার ছিলো একটা ভালোবাসার বা বন্ধুর অভাব।সেই অভাব পূরণ করেছিলো আদ্রিয়ান একজন ভালো বন্ধু হয়ে। আদ্রিয়ান ছিলো মাইশা থেকে ৪ বছরের ছোট। তবুও তাদের বন্ধুত্ব বাড়তে লাগলো। সাবা আর আরিয়ানের বিয়ের পর তা আরো দৃঢ় হলো। আদ্রিয়ান তখন ভার্সিটির স্টুডেন্ট। নতুন মনে তখন ও বুঝতে পারলো না মাইশার প্রতি তার ছিলো বন্ধুত্ব ভালোবাসা নয়। একসময় সে প্রোপস করলে মাইশাও যেন কি ভেবে রাজি হলো। আসলে মাইশা তখন নিজের ছেলের জন্য একজন গার্ডিয়ান চাচ্ছিলো যে কি না ছেলেটাকে আগলে রাখবে আর আদ্রিয়ান বরাবরই মিশানকে অসম্ভব ভালোবাসত।
বাসায় জানাজানি হতেই আদ্রিয়ানের মা-বাবা রাজি হলো না। একেতো মেয়ে বড় তার ওপর মাইশা বরাবরই অবাধ্য। আদ্রিয়ান তখন বললো,

— মেয়ে যদি ছেলে থেকে ছোট হয় তখন আমরা উদাহরণ হিসেব দেখি হযরত মোহাম্মদ (স:) আর মা আয়শাকে তাহলে কেন মেয়ে বড় ছেলে ছোট হলে মুহম্মদ (স:) আর মা খাদিজার উদাহরণ দেই না।

একথার পৃষ্ঠে কেউ কিছু বলার সাহস পেল না। ভুলতো বলে নি আদ্রিয়ান। জোর করেই আদ্রিয়ান বিয়ে করে মাইশাকে। মিশানের প্রতি কোন দায়িত্ব ও কোন দিন অবহেলা করে নি সে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম কাজ করতো মিশানের খরচ চালাতে। আদ্রিয়ানের পরিবার ততদিনে মেনে নিয়েছিলো তাদের। মিশান ছিলো পরিবারের একমাত্র ছোট সদস্য যাকে সবাই অনেক আদর করতো। আদ্রিয়ানের বাবা খরচ দিতে চাইলেও আদ্রিয়ান নেয় নি কারণ এতে তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগতো। নিজের ছেলের খরচ আদ্রিয়ান নিজেই চালাতে পারতো। মিশানও ছিলো বাবার ভক্ত। মা থেকে বাবার প্রতি তার টান ছিলো বেশি।
একসময় শেষ হলো আদ্রিয়ানের পড়াশোনা। জব খুঁজতে ব্যাস্ত সে। এতসবেও দিন শেষে মিশানই ছিলো সব কিছুতে শান্তি আনতে। কিন্তু ততদিনে মাইশা কেমন যেন বদলাতে লাগলো। আদ্রিয়ানের সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুতেই আটকে রয়ে গেছে।
আদ্রিয়ান যেদিন জানতো পারলো মাইশা নিজের কোন বন্ধুর সাথে অন্য সম্পর্কে জড়ানো তখন যেন মরিয়া হয়ে উঠলো আদ্রিয়ান। নিজের ছেলের মাকে সে হারাতে দিবে না।

কিন্তু একটা রাত জীবনটাকে পুরো পাল্টে দিলো। মাইশার দিকে ঐদিন প্রথম হাত বারিয়েছিলো আদ্রিয়ান আর মাইশাও সাড়া দিয়েছিলো। সেই একরাতের একটা মিষ্টি ফলাফল আজ “মিশিয়ারা জোহান মিশি”। মাইশা যখন জানলো ও প্রেগন্যান্ট তখন এবোরশন করতে চাইলো শেষ উপায়ে তখন আদ্রিয়ান ওর পা ধরে বলেছিলো,

— প্লিজ ইশা। আমার সন্তানকে মেরো না। তুমি যা বলবে তাই হবে।

মাইশা তখন কিছু বলেই নি। কিন্তু মিশির জন্মের পর হসপিটাল থেকে সে আর বাসায় আসে নি। আদ্রিয়ান পাগল হয়ে ওর পা ধরে অনুরোধ করলো সবার সামনে। নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্য তাদের মাকে চাইলো কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছিলো মাইশা। সেই থেকে মিশান যেন মা’কে ঘৃণা করতে লাগলো কারণ তখন সে ততটাও অবুঝ নয়। আদ্রিয়ান তখন স্ট্রোক করে ফেলে৷ ছোট্ট মিশিকে সাবা আর আদ্রিয়ানের মা আগলে রাখে। মিশান সারাদিন বাবার বুকে লেগে থাকতো।
হসপিটাল থেকে ফিরে এসে আদ্রিয়ান মিশিকে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। কাউকে ওর দায়িত্ব নিতে দেয় নি কারণ নিজের সন্তান ও নিজে পালবে। কাউকে এর বোঝা বইতে হবে না। যতক্ষণ ও বাসায় থাকতো ততক্ষণ নিজেই বুকে করে রাখতো ছেলে মেয়েকে। অফিসে গেলে তখন কাজের লোক রেখেছিলো যাতে দেখাশোনা করে। কিন্তু আদ্রিয়ান জানে ও বাসায় না থাকলেই ওর মা আর সাবাই দেখে রাখতো মিশিকে। আর মিশান তো আগে থেকেই তাদের জান।
মা ছাড়া মিশিও বড় হতে লাগলো। মিশান পরে নিজের মায়ের জঘণ্য কাজ জানতে পেরে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নেয়। এই তো একবছর হতে চললো আদ্রিয়ানের বুকে থাকে না। জোর করে হোস্টেলে থাকে। নিজেকে সামলাতে আদ্রিয়ানও ছেলেকে একটু স্পেস দিলো। প্রতি মাসেই মিশান এসে থেকে যায়।
আদ্রিয়ান মাইশাকে খারাপ ভাবে না। ভালোবাসা দোষের কিছু না। আদ্রিয়ান আর ওর মধ্যে ভালোবাসা কোন দিন ছিলোই না। সেটা ছিলো বন্ধুত্ব শুধু মাত্রই বন্ধুত্ব। আর “ভালোবাসা আটকে রাখার নয় বরং আগলে রাখার জিনিস।”

বর্তমানে~

রাত প্রায় ১০ টা। আদ্রিয়ান উঠে বসলো। বুকের ব্যাথা কমেছে। রোদ এখনও রুমে আসে নি। মুখ ধুয়ে বাইরে গেল আদ্রিয়ান। এদিক ওদিক তাকালেও দেখলো রোদ নেই তাই সাবাকে জিজ্ঞেস করতেই সাবা জানালো,

— ও তো একটু আগেই মিশিকে খায়িয়ে জারবার রুমে নিয়ে গেল।

— রোদ খেয়েছে?

— না। বললাম তো খেতে কিন্তু খেল না। কিছু কি হয়েছে? কেমন মুড অফ ছিল।

আদ্রিয়ান কথা না বাড়াতে বললো,

— তেমন কিছু না।

বলেই জারবার রুমের দিকে গেল। জারবা ফোন টিপাটিপি করতে ব্যাস্ত সাথে একনাগাড়ে মুখও চলছে তার। রোদ মিশিকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজেও একটু চোখ বুজে নিয়েছিলো। আদ্রিয়ান সোজা ভেতরে ডুকে ডাকলো,

— রোদ?

রোদের কোন হেলদুল নেই তাই আদ্রিয়ান ওর একগালে হাত দিয়ে আলত চাপড় দিয়ে ডাকলো,

— রোদ? রোদ উঠো খাবে।

যেহেতু হালকা চোখ লেগেছিল তাই চোখ খুলে তাকালো রোদ। সামনে আদ্রিয়ানকে দেখেই মনে পরলো কি করেছিলো আদ্রিয়ান। এখানে জারবা দেখে রোদ আস্তে করে উঠে মিশিকে কোলে তুলে নিলো। জারবা ফট করে ফোন রেখে বললো,

— ছোট ভাবী মিশি থাক এখানে আমার কাছে।

— সমস্যা নেই জারবা।

— কিন্তু আম্মু তো বললো..

জারবাকে বলতে না দিয়ে রোদ বললো,

— আমার কাছে থাক।

বলে মিশিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রুমে এসে আস্তে করে বেডে শুয়িয়ে দিলো। নিজে ওয়াসরুমে ডুকে ওযু করে এসে এশারের নামাজ আদায় করে নিলো। আদ্রিয়ান রুমে ডুকে দেখলো রোদ নামাজ পরছে তাই নিজে মিশির পাশে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ছোট্ট মিশি বাবার আদর পেয়ে একটু আদরে গুটিয়ে শুয়ে পরলো। আদ্রিয়ান মেয়ের মাথায় চুমু খেল। রোদ নামাজ শেষ করে উঠতেই আদ্রিয়ান বললো,

— নিচে চল খাবে।

— খাব না।

সোজা করে উত্তর দিয়ে রোদ মাথা বাঁধতে ড্রসিং টেবিলের সামনে গেল কিন্তু ছাতার মাথা এতো বড় চুল ও কোন দিনও বাঁধতে পারে না। তবুও চেষ্টা করতে লাগলো। আদ্রিয়ান রোদের দিকে অসহায় চোখ করে তাকালো। একটু পর উঠে নিজেই চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে বেঁধে দিলো মাথা। পুরোটা সময় রোদ ছিলো একদম চুপ। এমনিতেও ও নিজে বাঁধতে পারতো না। আদ্রিয়ান লম্বা চুলে বেনী করে বললো,

— এবার চলো।

— যাব না।

— দেখ রোদ।

— দেখান।

রোদের এমন কাটকাট উত্তরে একটু ভেবাচেকা খেয়ে গেল আদ্রিয়ান। নিজেকে সামলে রোদের হাত ধরে নিজের কাছে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,

— আ’ম সরি রোদ। হঠাৎ কেন যেন রেগে গিয়েছিলাম।

বলে শুধু শুধুই কানের দিকের চুল গুলো ঠিক করার মতো হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করলো।
নরম মনের রোদের গলতে আর তেমন একটা সময় লাগলো না। টলমলে চোখে তাকিয়ে বললো,

— এমন কেন করেছিলেন?

— আর হবে না সোনা।

বলে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো। রোদও চুপ করে রইলো। এমন একটা মুহূর্তে জারবা বাইরে থেকে গলা ফাটিয়ে ডাকতে লাগলো,

— ছোট ভাইয়া? ছোট ভাইয়া। আম্মু তোমার আর ভাবীর খাবার দিয়েছে।

হঠাৎ জারবার আওয়াজে ছিটকে সরে গেল রোদ। লজ্জায় গাল, কান যেন লাল হয়ে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান নিজেও বুঝতে পারে নি কখন এতটা কাছে এলো। দরজা খুলতেই হুরমুরিয়ে রুমে ডুকে কাউচের পাশের টেবিলে ট্রে টা রেখে বললো,

— কখন থেকে ডাকছি। হাত থেকে যদি পরে যেত?

প্রশ্ন করে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই যেভাবে ঝরের গতিতে সেভাবেই ঝরের গতিতেই চলে গেল জারবা। মেয়েটা এমনই। আদ্রিয়ান রোদকে টেনে বসিয়ে দিলো কাউচে। নিজেই এক প্লেটে খাবার নিয়ে মেখে রোদের মুখের সামনে ধরলো। রোদ একটু লজ্জা পেতেই আদ্রিয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— আদর করছি না খায়িয়ে দিচ্ছি। হা কর লজ্জা পরে পেও।

আদ্রিয়ান এমন ঠোঁট কাটার ন্যায় কথাটা গম্ভীর স্বরে শুনে রোদ মুহূর্তেই যেন শক্ত হয়ে গেল। আদ্রিয়ান আবারও বলতেই মুখ খুলে চুপ করে খেয়ে নিলো। তেমন একটা খেতে পারলো না রোদ। তবুও আদ্রিয়ান জোর করে দু লোকমা বেশি খায়িয়ে দিয়েছে। নিজেও ঐ খাবারের উপরই খেয়ে নিলো। রোদকে পানি খায়িয়ে নিজেই হাত দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলো। আদ্রিয়ান জানে রোদ হলো বাবা-মায়ের এক আদুরে সন্তান যাকে কি না সবাই এক কথায় তুলুতুলু করে পেলেছে। এ হলো সেই মেয়ে যে কিনা ছোট ভাই থেকেও আদর পায়।

খাওয়া হতেই রোদের হাতের কফি পরা স্থানে আবারও মলম লাগিয়ে দিলো আদ্রিয়ান। লাইট অফ করে বিছানায় গেল। মাঝখানে মিশিকে নিয়ে রোদ ঘুমালো আপর পাশে। রোদ ঘুমিয়ে যেতেই আদ্রিয়ান আস্তে করে বুকে তুলে নিলো মিশিকে আর একহাতে টেনে বুকের একপাশে নিলো রোদকে। এখন শান্তি শান্তি লাগছে আদ্রিয়ানের। আদ্রিয়ান ভাবলো, “ইশ এখন যদি মিশানটা থাকতো একদম একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি হতো তাদের।”

#চলবে…..

#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬( বর্ধিতাংশ)

রোদ সুইসাইড এটেপ্ট করেছিলো। এনগেজমেন্ট ভাঙার পরের দিনগুগো মোটেও সহজ ছিলো না রোদের জন্য। এলাকার মানুষজন নানান সময় নানা ধরনের কথা বলতো। সবসময়ে আদরে বড় হওয়া রোদ যেন এসব সহজে সহ্য করতে পারলো না। ডিপ্রেশন নামক রোগে আক্রান্ত হলো আস্তে আস্তে। সারাদিন সবার সাথে তেমন একটা কথাও বলত না। নিজেকে অকার্জ মনে হতে লাগলো। বারবার মনে হতো কি দরকার ওর এই দুনিয়াতে? একা একাই গুমরে কেঁদে উঠতো রোদ। ডিপ্রেশন একটা ভয়াবহ রোগ যা সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আক্রান্ত ব্যাক্তিকে দেখলেও বুঝার উপায় নেই সে আসলে কতটা সাফার করছে। একসময় সেই ব্যাক্তি বেছে নেয় সবচেয়ে সহজ মাধ্যম নিজেকে মুক্তি দিতে আর তা হলো সুইসাইড।
ড্রিপ্রেস্ড যে রোদ ছিলো তা পরিবারের কেউ ভাবতে পারে নি। রোদের বড় চাচি আর মা রোদের গাইনি চিকিৎসার কথা তুলতেই রাদ কড়া করে নিষেধ করলো। বোনকে সামলাতে আগে সময় দেওয়া উচিত। পরে এসব নিয়ে ভাবা যাবে। আগে তো দেখতে হবে রোদ নিজে কতটা প্রস্তুত।
এলাকায় এক বড় বোনের বিয়ে বলে দাওয়াত করা হয় রোদের পুরো পরিবারকে। রোদ যাবে না বললেও ভাই-বোনদের চাপে পরে রাজি হলো। সব কাজিনরা গেল হলুদের অনুষ্ঠানে। বাসার সবাই চাচ্ছিলো রোদ ঐ সব থেকে বের হয়ে আসুক। অনুষ্ঠানে একে একে সবাই হলুদ লাগাচ্ছিলো। রোদ যেই না বসলো ওমনি পাশ থেকে এক মহিলা বলে উঠলেন,

— বিধবা আর বাজা মেয়েদের হলুদ লাগাতে নেই এতে কনের সমস্যা হয়।

“বাজা” কথাটা যেন রোদের কানে সুচের মতো বিধলো। টলমল করে উঠলো চোখ। বসে থাকা কনে রোদের হাত চেপে ধরে প্রতিবাদ করে উঠলো এসব অহেতুক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কিন্তু মহিলা দমে যান নি বরং আরো চেচামেচি শুরু করে দিলো। রুদ্র তারাতাড়ি রাদকে ডেকে আনলো। রোদের হাত ধরে সবার উদ্দেশ্য কিছু কড়া কথা শুনিয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসলো। কিন্তু ততক্ষণে রোদ যেন একদম চুপ করে গিয়েছিলো। রাদ বোনের হাত ধরে অনেকক্ষণ বুঝায় এসবে কান না দিতে কিন্তু একজন ডিপ্রেশনের রুগীর কাছে এসব সান্ত্বনা বাণী তুচ্ছ।
রাদ যাওয়ার পরেই দরজা বন্ধ করে দেয় রোদ। ভাবতে থাকে এতদিনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা। কত মানুষ কত কিছুই না মন্তব্য করে ওকে নিয়ে। মানুষ শুনতে কম এবং শুনাতে বেশি ভালোবাসে। সকল ঘটনায় যেন রোদ ভাবতে বাধ্য হলো এ জীবন তুচ্ছ। কোন দরকার নেই বেঁচে থাকার। ডিপ্রেশন হলো এমন একটি রোগ যা মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলে আর জীবন নামক জিনিসটা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। রোদ উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে ছুড়ি নিয়ে বা হাত বরাবর চালিয়ে দেয়। কিন্তু ভীতু রোদ একটু পরই র*ক্ত দেখে ঙ্গান হারানোর উপক্রম কারণ পরিবারের সাপোর্ট পেয়ে রোদের ডিপ্রেশন ততোটাও প্রখোড় ছিলো না। হঠাৎ করেই গলা ফাটিয়ে রোদ ডাকতে লাগলো,

— ভাইয়া! ভাইয়া!

মাত্রই চোখ লেগেছিলো রাদের। রোদের ডাক শুনে ধরফরিয়ে উঠে দৌড়ে এলো। বাকিরাও ততক্ষণে এসে পরলো। সেন্সলেস অবস্থায় মেঝেতে পরে ছিলো রোদ, হাত থেকে র*ক্ত পরছিলো। ভয় পেয়ে যায় সবাই। রাদ তারাতাড়ি কোলে তুলে হসপিটালে নিয়ে যায়। ততটাও গভীর ভাবে কাটে নি তাই ডক্টর ব্যান্ডেজ করে দিলো আর জানালো র*ক্তে ভয় থাকায় ঙ্গান হারিয়েছে।
রোদ এতদিনে ততটা ভয় না পেলেও নিজের কান্ডেই নিজে বেশি ভয় পেয়েছিলো। এরপর থেকেই বিগত ৬ মাস ধরে মায়ের কাছে ঘুমায় রোদ। মাঝে মাঝে রাদ আর রুদ্রও ঐ রুদ্রর মেঝেতে বা সোফায় ঘুমায়। কিন্তু তবুও পেনিক অ্যাটাক হয় রোদের যাতে করে ওর হা, পা কাঁপতে থাকে এবং অতিরিক্ত হলে ঙ্গান হারায়। কিন্তু পরিবারের সাপোর্টে রোদের সমস্যা অনেকটাই সুস্থের পথে।

________________

রাদ প্রায় প্রায় ঘুরতে নিয়ে যেত রোদকে। নিজের অফিসেও সাথে করে নিয়ে যেত প্রায়। রাদের অফিসের সামনেই বড় একটা পার্ক আছে। রোদ রাদকে বলেই সেদিন পার্কে যায়। রাদ ছিলো মিটিং এ। রোদ বসে বসে কটন ক্যানডি খাচ্ছিলো তখনই কারো কান্না শুনতে পেয়ে সামনে তাকায়। একটা মেয়ে পরে গিয়ে কান্না করছিলো। দুপুর টাইম হওয়ায় তেমন কেউ ছিলো না। রোদ উঠে তারাতাড়ি ধরে কোলে তুলে বেঞ্চে বসায়। সুন্দর ছোট মোট প্রায় সাড়ে তিন অথবা চার বছরের একটা মেয়ে। হাটুতে ব্যাথা পেয়েছে। রোদ ব্যাগ থেকে পানি বের করে হাটু ধুয়ে ছোট্ট একটা ব্যান্ডজ লাগিয়ে দিলো। মেয়েটা তখনও বুকের দিকে হাত গুজে অল্প স্বরে কেঁদে যাচ্ছে। রোদ ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললো,

— বাবু তোমার সাথে কে আছে?

ছোট মেয়েটা কোন উত্তর দিলো না। রোদ বুঝলো হয়তো ভয় পেয়েছে তাই আদর করে জিজ্ঞেস করলো,

— আচ্ছা ঠিক আছে তোমার নাম কি?

— মিশি।

মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো মিশি। রোদ একগাল হেসে নিজের কটন ক্যান্ডিটা একটু ছিড়ে মিশির মুখে দিয়ে বললো,

— মজা না?

মিশি ও মিষ্টি করে হেসে বললো,

— হু।

রোদ পুরোটা মিশিকে খায়িয়ে দিলো। ব্যাগ থেকে নিজের পানির বোতলটা বের করে মিশির মুখের সামনে ধরতেই মিশি খেয়ে নিলো। রোদ ওর মুখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— তোমার আম্মু কোথায় বাবু?

মিশি অবুঝ স্বরে বললো,

— আম্মু তো নেই।

রোদ একটু কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

— আব্বু?

মিশি খুশি হয়ে গেল বাবার কথা শুনে কারণ এই উত্তর ওর জানা তাই খুশি হয়ে বললো,

— বাবাই?

— হু হু তোমার বাবাই কোথায়?

মিশি কিছু বলার আগেই একজন সুদর্শন তাগড়া পুরুষ হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের সামনে এলো। মিশিকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে অস্থির কন্ঠে বললো,

— এখানে কখন এলা মা?

মিশি বাবার বুকেই লেগে রইলো। আদ্রিয়ান মেয়েকে চুমুতে আর আদরে ভরিয়ে তুললো। এতক্ষণ শ্বাসটা আটকে ছিলো যেন। রোদ আস্তে করে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,

— ভাইয়া পানি খাবেন?

আদ্রিয়ান একপলক তাকিয়ে পানিটা খেয়ে নিলো। খুবই দরকার ছিলো এটার। মিশি বুক থেকে উঠে রোদের দিকে তাকালো। রোদ একটু হেসে গাল টেনে দিলো। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— এদিকে পরে গিয়েছিল।

আদ্রিয়ান অস্থির হতেই রোদ বললো,

— আরে ভাইয়া হাটুতে একটু ছিলেছে।

তবুও যেন আদ্রিয়ান শান্তি পেল না। মেয়েকে নিয়ে অফিসে ডুকে পড়লো। এরপর থেকে অনেকবারই রোদের সাথে মিশির দেখা হয়েছে। আদ্রিয়ান তো যাকে তাকে মেয়ের সাথে মিশতে দিবে না তাই খোঁজ নিতেই জানতে পারলো, পাশের বিল্ডিং এর অফিসের মালিকের মেয়ে রোদ সাথে আরো কিছু জানতে পারলো রোদকে ঘিরে। ছোট এই মেয়ের সাথে এতকিছু ঘটেছে ভাবতেই একটু খারাপ লাগলো আদ্রিয়ানের।
রোদ তখন প্রায় প্রায় মিশির জন্য নুডুলস, পাস্তা রান্না করে আনতো। ঐ পার্কে বসিয়েই খায়িয়ে দিতো। রোদের সুস্থতা তখন সবারই চোখে পরলো। শুধু মাঝে মধ্যে প্যানিক অ্যাটেক হতো এই যা। আদ্রিয়ানের সাথেও প্রায়ই কথা হতো। মিশি ততদিনে রোদে অভস্ত্য হয়ে গিয়েছিলো। ও যেন কিছুটা মায়ের আদর পেত রোদ থেকে। রোদও মিশির মায়ায় আটকে গিয়েছিলো। যেখানে আমরা সাধারণ পশু পাখি পালতেই ওদের প্রতি কতটা মায়ায় জড়িয়ে যাই সেখানে তো রোদ- মিশি দুজনই মানুষ।
মিশি তখন প্রায় রোজই রোদকে চেতো কিন্তু চাইলেই রোদ আসতে পারছিলো না সামনেই ছিলো ওর মেডিক্যাল এক্সাম। মিশির মন খারাপ আর কান্না থামাতে রোদ ভিডিও কলে কথা বলতো তাতেও তেমন লাভ হয় নি। তখন আদ্রিয়ান কিছুটা স্বার্থপর হয়ে উঠলো। রোদের দূর্বল জায়গা ও জানতো তাই তো সোজা রোদের বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলো। রোদের বাবা এই প্রথম নিজের বড় ভাইয়ের অনুমতির প্রয়োজন মনে করে নি। তার মেয়ে যেখানে ভালো থাকবে সেটাই সে করবে। রোদের মাও না করে নি। রাদ না করলেও পরে বুঝে যে রোদ তো স্বাভাবিক হ’য়েছে মিশির সাথে থেকেই। আগের মতো হচ্ছে। তাহলে কেন নয়? এরকম হাজারো চিন্তার মাঝে রাজি হলো সবাই। তবুও রোদের অনুমতি ব্যাতিত তারা কিছুই করবে না। রোদকে জিজ্ঞেস করতেই রোদও কি ভেবে যেন হ্যাঁ করে দিলো। মেডিক্যালের এক্সামের পরদিন ই কাবিন করে নিলো আদ্রিয়ান। এতো তাড়াতাড়ি রোদের পরিবার না করলেও আদ্রিয়ান তাদের বুঝিয়েছে। রাজি করিয়েছে। নিজের মেয়ের জন্য যা দরকার সব করেছে আদ্রিয়ান। রোদের পরিবারকে আসস্ত করেছে রোদের খেয়াল রাখার।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে