ভালোবাসার টানে

0
733

‘বাবা, কেমন আছো তুমি?’ প্রায় পঁচিশ বছর পরে ফোনের ওপারে নিজের সবচেয়ে পছন্দের কন্ঠ শুনে কতোটা আপ্লুত হবেন আব্বাসী সাহেব তা যেন ঠাহর করতে পারেননা। শুধু বলেন,’ ভালো আছি।’টুকটাক কথার ফাঁকে মেয়ে জানায় তার মেয়ে দিহান দেশে আসতে চায় একটা কাজে। আব্বাসী সাহেবের আপত্তি না থাকলে এ সময়টুকু সে তার নানা নানীর সাথে থাকতে চায়। পঁচিশ বছরে একটু একটু করে দূরে ঠেলে দেয়া মেয়ের উত্তরসূরীকে বুকে জড়িয়ে এক নিমিষেই নিজের মনের ভার হাল্কা করবেন বলেই বুঝি জানিয়ে দেন তার কোন আপত্তি নেই। মেয়ে দিবার অপরাধ ছিল বিদেশে পড়তে গিয়ে বাবা মায়ের অমতে এক ভীনদেশী যুবককে বিয়ে করে ফেলা।

লোকমুখে শুনেছিলেন মেয়ের ঘরে নাতনী হয়েছে। কিন্তু নিজের ইগো নাকি জেদের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে সংযত রেখেছেন এতোটা বছর নাতনীর কোন খবর রাখা থেকে। মেয়ের সাথে কথা বলার দুদিনের মাথায় একদিন সকাল বেলায় যখন কলিংবেল বেজে ওঠে ব্যস্ত হয়ে দরজা খুলতেই দেখেন অবিকল তার ছোট্টবেলার দিবা যেন দরজার বাইরে দাঁড়ানো।

– কি নাম?

দিহান। কেমন আছেন নানাভাই? নানুমনি কোথায়?

– তুমি এতো তাড়াতাড়ি আসবে তা তো তোমার মা বলেনি।

আমিই সারপ্রাইজ দেবো বলে বলতে নিষেধ করেছি।

তারপর কিছু বলা কথা আর কিছু না বলা কথার মধ্যে দিয়ে অল্প সময়ে যেন নেমে এসেছিল পঁচিশ বছরের অদেখা মূহুর্তগুলো ভুলিয়ে দেবার অশ্রুধারা।

হিউম্যান সাইকোলজীর ওপর একটা রিসার্চ প্রজেক্টের কাজ নিয়ে দেশে এসেছে দিহান। বড় কোম্পানীগুলোতে একজন নতুন কর্মীর ব্যাপারে তার কলিগদের সহযোগী বা অসহযোগী ব্যবহার হচ্ছে এই রিসার্চের অংশ। প্রজেক্টের অংশ হিসেবে বিশ্বের দশটা দেশের নামকরা কোন কোম্পানীর স্টাফদের ওপর জরীপ করবে সে ওদের অজান্তে। অফিসে খুব নীচু পদের কোন পোস্টে নামমাত্র কাজের বিনিময়ে সেখানকার স্টাফদের মনস্তাত্বিক দিকের ওপর গবেষনা করাই তার উদ্দেশ্য। চায়না আর জাপান শেষে সে এসেছে বাংলাদেশে কাজ করতে। কোন অফিসে কাজ করবে তা রিসার্চের অধীনে আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। তার নিজের মায়ের দেশ, রোজ রাতে যেদেশের গল্প শুনিয়ে মা ঘুম পাড়াতো সে দেশ নিয়ে তার মানুষদের নিয়ে এক অন্যরকম জানার আগ্রহ ছিল তার প্রথম থেকেই। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেই সে এসেছে।

অফিসে ঢুকতেই প্রথম গেইটে নাম লেখাতে হয়।

– কি নাম? কার কাছে যাইবেন?

দিহান নেফারতিতি। ওয়াজেদ সাহেবের কাছে যাবো।

– কি নাম কইলেন? কি তিতি?

নাম লিখিয়ে সামনে এগুতে এগুতে দিহান শুনতে পায় পেছনের লোকটা বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে, কি সব নাম ধাম যে বাপ মায়ে রাখে আইজকাল, বুঝিনা বাপ।

দিহানের রিসার্চের কাগজে প্রথম লেখা হয়, কারো সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করে ফেলা।

বিগ বস ওয়াজেদ সাহেবের সাথে ইমেইলে কথা হলেও সামনাসামনি প্রথম দেখা আজ। প্রাথমিক আলোচনা সেরে নিজের রুমের দিকে রওয়ানা দিতেই পেছন থেকে ওয়াজেদ সাহেব বলেন, এদেশে আপনার ওপরের কাজ যারা করেন তাদের স্যার ডাকাই নিয়ম। নাম ধরে কাউকে ডাকবেননা প্লিজ। নিজের কাজের ডেস্কে এসে বসতেই তার সেকশনের সুপারভাইজার কামাল সাহেব এসে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করেন যখন জানতে পারেন দিহান এসে আগে তার সাথে দেখা না করে ওয়াজেদ সাহেবের সাথে কেন দেখা করেছে তাই। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে দিহানের কাজে তেমন একটা চাপ নেই বললেই চলে। কিন্তু প্রথমদিনে তেমন কেউই এগিয়ে আসেনা তার সাথে কথা বলতে। বরং দিহান লাঞ্চের সময় বা পানি বা চা খেতে আসা যাওয়ার সময় শুনতে পায় তার সহকর্মীরা কেউ তি তি করে শব্দ করতে।

আর তাই দিন শেষে দিহানের রিসার্চের খাতায় জমা হয় কিছু শব্দ যার সবগুলোই নেগেটিভ চরিত্রের। চেইন অব কমান্ডের অংশ হিসেবে সবাইকে জোর করে স্যার ডাকানো, তার কারণে হয়তোবা কারো কারো নিজের নামটাই হারিয়ে যেতে পারে। নিজের পোস্টের জোর অধীনস্ত কর্মচারীদের ওপর খাটানো। প্রাপ্তবয়স্ক কলিগদের নতুন কাউকে নিয়ে ঠাট্টার মনোভাব। অথচ মায়ের কাছে শুনেছিল এ দেশের মানুষ বড় আন্তরিক। তবে কি এতো বছরের ব্যবধানে মানুষের চরিত্র পাল্টে গেছে বেমালুম?

সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তেমন কারো সাথেই সখ্যতা গড়ে ওঠেনা দিহানের। নিজের অপারগতা নাকি বাকী কলিগদের অনিচ্ছা সেটাই শুধু সে ভেবে পায়না। অথচ এ ধরনের সমস্যায় সে অন্য দুদেশে কাজ করার সময় পরেনি সেভাবে। আর তাই নিজের রিসার্চ পেপারে জমা হয়না কোন পজেটিভ শব্দ।

এতো নীচু পদে কাজ করা কেউ কিভাবে গাড়ি নিয়ে কাজে আসবে, এ নিয়ে যদি কেউ কোন সন্দেহ পোষণ করে তাই অফিস থেকে হেঁটে পাশের গলিতে যেয়ে তবেই নানাভাইয়ের পাঠানো গাড়ি করে বাড়ি যেতো দিহান। কিন্তু আজ অফিস থেকে বেরুতে বেরুতেই শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকেও একটা রিক্সা বা অন্য কোন বাহন ম্যানেজ করতে পারেনা সে।

– আপনি ডাটা এন্ট্রি সেকশনে নতুন জয়েন করেছেন, তাইনা?

জ্বি।

– আমি সাদাত। আপনার ওপরতলায় বসি। আপনার কাছে ছাতা নেই বোঝা যাচ্ছে। কোথায় থাকেন?

এইতো কাছেই। একটা রিকশা পেলেই চলে যেতে পারতাম।

– এক কাজ করেন আপনি আমার ছাতা নিয়ে চলে যান।

আপনি কিভাবে যাবেন?

– আমি সামনে যেয়ে বাস পেয়ে যাবো আশা করি।

না না আমি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। আমার সমস্যা নেই।

– আকাশের যা অবস্থা মনে হয়না আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষায় কাজ হবে। তবে আপনার ইচ্ছে।

দোটানায় পরে যায় দিহান, কি করবে? সাদাত একটু এগিয়ে যেতেই পিছু ডাকে সে ছাতার জন্য।

কথায় বলে, লোকে কারো সাথে কয়েকদিন থাকতে থাকতে তাদের মতো আচরণ শুরু করে। আর তাই সাদাতের ভালো ব্যবহারটুকুও প্রশ্ন রেখে যায় দিহানের মনে, ‘ভালমানুষী নাকি গায়ে পরা স্বভাব?’

পরদিন ছাতা ফেরত দিতে যেয়ে জানতে পারে সাদাত অসুস্থ। তৃতীয়দিন ও যখন সে কাজে আসেনা দিহানের খুব খারাপ লাগে, তার জন্যই বেচারা অসুস্থ হলো কি না কে জানে? আর তাই সাদাতের সেকশনের একজনের কাছে ঠিকানা জানতে চায়। মেয়েটা ঠিকানা ব না লে বরং কটাক্ষ করে কেন মেয়ে হয়ে ছেলে কলিগের ঠিকানা জানতে দিহান উদগ্রীব। যোগ হয় দিহানের খাতায় আরো একটি শব্দ, পরনিন্দা।

আরো দুদিন কাটিয়ে অবশেষে সাদাত অফিসে ফেরে।

– আপনার ছাতা। আমি খুব দুঃখিত আপনাকে এমন একটা ঝামেলায় ফেলে দিলাম।

হুম জ্বরটা ভীষণ ভুগিয়েছে। সে যাকগে, আপনি কেমন আছেন নেফারতিতি?

– ভালো। বিকেলে ফ্রি থাকলে কাজ শেষে আপনাকে কফি খাওয়াতে চাই।

শোধ দিচ্ছেন?

– ওরকম ভাবলে ওরকম। নয়তো শুধুই আড্ডা দেয়া।

কাজ শেষে বাসায় ফিরে রোজ বুড়ো মানুষ দুটোর সাথে আড্ডা দিয়ে বুঝি দিহান একটু ক্লান্তই হয়ে যাচ্ছিল। বয়সের ধর্মই যে নিজ বয়সী মানুষ খোঁজা। আর তাই অনেকদিন পর সমবয়সী সাদাতের সাথে গল্প জমে ওঠে দিহানের।

– আপনার নাম নেফারতিতি কে রেখেছে?

আমার বাবা।

– কার রাজ্য শাসন করেন?

নিজের রাজ্যই।

– রাজ্যে আর কে কে আছে? বেশী ব্যক্তিগত প্রশ্ন হলে জবাব না দিলেও চলবে।

আপাতত নানা নানুর কাছে আছি। বাবা মা দেশের বাইরে। আপনার রাজ্যে?

– মা আর আমি। দুজনেই কাজ করি। বেলাশেষে দুজনেই ঘরে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুম। আমরাই একে অপরের বন্ধু। চলেন একদিন আমাদের বাসায়। আমার মা ইতিহাসের ছাত্রী। মজা পাবেন আপনার নাম শুনলে।

অফিসে অনেকে পেছনে আমায় তি তি করে ডাকেন। নানার কাছে শুনেছি এভাবে নাকি মুরগীকে ডাকে?

– এদেশে মেয়েদেরকে ছোট করা অর্থেও মুরগী ডাকে। কেউ ওভাবে ডেকেছে জানলে যেয়ে রগড়ে দেবেন। না পারলে আমাকে বলবেন।

আপনাকে বললে কি করবেন? আমার হয়ে শাস্তি দেবেন তাদের? হা হা হা।

সাদাতের সাথে বন্ধুত্ব জমতে সময় লাগেনা তারপর। ছুটির দিনগুলোতে শহর থেকে একটু দূরে সবুজ কোন গাঁয়ের পথে, কখনো নয়তো জাহাজে চেপে নদীর বুকে ঘুরে আসা, পথের ধারের টং দোকানে বসে চা খাওয়া, কচুপাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টিভেজা, জোছনা রাতে ফোনের দুপাশে পছন্দের গান শোনা নয়তো অনেকটা পথ গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসা। বলা চলে বাংলাদেশের যে গল্পগুলো মায়ের মুখে দিহান শুনেছিল সেগুলোকে নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ করে দেয় সাদাত।

সাদাতের কাছে শুনেই কি না নাকি দিহানের নিজের আন্তরিকতায় সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে সম্পর্ক সহজ হতে শুরু করে বাকী কলিগদের সাথে। দিহান বিদেশ থেকে এদেশে কাজ করতে এসেছে এটাই তার পেছনে মুখ্য কারণ কি না তা অবশ্য সে বের করতে পারেনি। তবে দিহান যেটা চেষ্টা করেছে তা হলো যতোটা সম্ভব নিজের কাজ গুছিয়ে অন্যদের কাজে সাহায্য করা। তাতে করে কেউ কেউ তাকে দিয়ে ভুতের বেগার খাটিয়ে নিলেও ভালোমানুষীর পুরস্কার হিসেবে সবার সাথে একটা সহজ সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায় তার। প্রথমদিন গেটের মুখের মন্তব্যকারী দারোয়ান রহিম মিয়াও সমীহ করতে শুরু করে তাকে যেদিন দরজা খুলে বের হতে গিয়ে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পরে যাওয়া রহিম মিয়াকে দিহান হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনে তার পর থেকে।

তিনমাস শেষে যেদিন দিহান জানায় কাল থেকে আর সে কাজে আসছেনা আর তার জবাবে তার কলিগদের অভিব্যক্তিতে এই প্রথম সে টের পায় তার মায়ের বলা বাঙ্গালীর আন্তরিকতা শব্দটুকুর মানে। নতুন কাউকে এরা সহসা মেনে নেয়না। আর যখন মেনে নেয় তখন তাকে মনে নিয়ে নেয়। অফিস শেষ হওয়ার আগে আগেই ফুল, কেক আর উপহার দিয়ে দিহানের অজান্তেই তাকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে তার কলিগেরা। সবাই তাদের শুরুর দিকের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে জানায় ওরা দিহানকে কতটা মিস করবে। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে একটা কথাও বলেনা সাদাত। শুধু দিহান গাড়িতে ওঠার আগমুহুর্তে ফিসফিস করে বলে, ‘আমাকেও জানালে না কেন তুমি চলে যাচ্ছো?’

– তোমার এরকম নীরব অভিব্যক্তি দেখতে চাইনি বলে। আমি তোমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় চাই। আমার বাবা মা দুজন একে অপরকে ভালবাসলেও তাদের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম জাতিগত বিভেদ কাজ করতো সবসময়। আর তার মাঝে পরতে হতো সবসময় আমাকেই। আমি আমার মায়ের দেশের কারো সাথে মিশে দেখতে চেয়েছি আসলে তফাতটা কোথায়? তুমি খুব ভালো একটা ছেলে সাদাত। কাল বাদে পরশু হয়তো আমি আবার কাজের ভীড়ে হারিয়ে যাবো। কিন্তু আমি তোমাকে মিস করবো।

বাসায় ফিরে সব গুছিয়ে নিয়ে ঘুমাতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। এলার্ম দেয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিতেই দিহান দেখে অনেকগুলো মেসেজ এসেছে সাদাতের কাছ থেকে।

‘নেফারতিতি,
তোমাকে আমার বন্ধু ভেবেছি সেই প্রথমদিন কফি খাওয়ার পর থেকে। তারপর কখন যে তোমাকে আরো একটু বেশী কিছু ভাবতে শুরু করেছি তা বুঝি নিজেও বুঝতে পারিনি। কাল থেকে অফিসে কাজের ফাঁকে তোমার রিনরিনে হাসির শব্দ শুনতে পাবোনা সেটাই যেন ভাবতে পারছিনা। জীবন আসলে মানুষকে নিয়ে বড় অদ্ভুত খেলা খেলে কখনো কখনো। নয়তো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই আমার আজকাল কেন আখেনআতেন হতে ইচ্ছে করবে? নেফারতিতি আমি তোমার আখেনআতেন হতে চাই। অপেক্ষায় থাকবো একটা জীবন। তোমার কাজ ফুরোলে ফিরে আসবে তো?

মধ্যদীঘিতে নৌকায় বসে জোছনা দেখাবো কথা দিয়েছিলাম। তুমি ফিরে এলে একটা আস্ত দীঘিই নয়তো কিনে নেবো আমাদের দুজনের নামে। ভালো থেকো মেয়ে।
এক সমুদ্র ভালবাসা রইলো আমার নেফারতিতির জন্য।’

নানা নানীর কাছ থেকে বিদায় নিতে বড় কষ্ট পেতে হয় দিহানকে। ঐ মানুষ দুটোর যে নিজের বলতে আর কেউ নেই।
প্লেনের জানালা গলে আসা এক টুকরো চাঁদের আলোয় রিসার্চ পেপারের প্রয়োজনীয় লেখা টাইপ করার পাশাপাশি একটা রিজাইন লেটারও লিখতে শুরু করে দিহান।
ভালবাসার টানে দিহানরা কি আসলেই ফিরে আসে?

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে