#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৮ম_পর্ব
– রিয়াদ?
– জ্বী ম্যাম, অয়ন স্যারের ফোনটা অফ পাচ্ছি সকাল থেকে। আপনি কি জানেন উনি কোথায়? আমি কিছুতেই উনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। ম্যাম আপনি কি জানেন উনি কোথায় আছেন?
– না, আমি জানি না। উনি কি বাসায় জান নি?
– না ম্যাম, উনি বাসায় যান নি আর উনার সাথে যোগাযোগ ও করতে পারছি না।
– রিয়াদ, আপনি কি আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?
– জ্বী, কেনো বলুন তো ম্যাম?
– কিছু কথা আছে আপনার সাথে। আপনি ফ্রি হলে আমাকে জানিয়েন। রাখছি
– জ্বী ম্যাম।
ফোনটা রাখার পর থেকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো প্রাপ্তি। মাথা যেন বন্ধ বন্ধ লাগছে। কাজের লোকেরা জানিয়েছে কাল রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছে সে। কোথায় গেছে, কি করছে সেটা রিয়াদ যদি না জানে তাহলে আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। না চাইতেও বিষয়টা ভাবিয়ে তুলছে প্রাপ্তিকে। অয়নের সবথেকে খারাপ দিক ওর রাগ, রাগের বসে উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলে নি তো! উফফ আর ভাবতে পারছে না প্রাপ্তি। ভিলার ড্রাইভার প্রাপ্তিকে গাড়িতে করে অফিস পৌঁছে দেয়।
বিকেল ৫টা,
ক্যাফেতে মুখোমুখি বসা রিয়াদ এবং প্রাপ্তি। এখনো অবধি অয়নের কোনো খোঁজ পায় নি সে। না চাইতেও খারাপ চিন্তা ঘিরে রেখেছে প্রাপ্তিকে। রিয়াদ এবং সামি দুজন এমন মানুষ যারা অয়নের সকল গোপন তথ্য জানে। অয়নের লাভ লাইফ, বিজন্যাস লাইফ সবকিছু। মনের সাথে যুদ্ধ করে আজ ক্লান্ত প্রাপ্তি, তাই রিয়াদের কাছেই সকল প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পাবে।
– ম্যাম, আপনি আমাকে এখানে কেনো ডেকেছেন?
– অয়নের সাথে আমার বিয়ের সত্যতা জানতে। কেনো অয়ন আমাকে বিয়ে করেছিলো? আপনি ছাড়া কেউ আমাকে উত্তর দিতে পারবে না।
– স্যার আপনাকে বিয়ে করেছিলো তার পেছনে সেই মূহুর্তে একটা কারণ ছিলো তা হচ্ছে প্রতিশোধ। আপনার নামের ফেক একাউন্টের কারণে উনি ভেবেছিলেন আবরার স্যারের এক্সিডেন্টে কোথাও না কোথাও আপনার ও দোষ ছিলো। আর আপনাকে একটা গোলকধাঁধার ভেতরে রাখার কারণ দুইটি ছিলো একটি দাদীজান দ্বিতীয়টি ঐ প্রতিশোধ। ধীরে ধীরে স্যার আপনার প্রতি দূর্বল হতে থাকেন, তারপর জানতে পারেন আপনার সাথে আবরার সাহেবের কোনো সম্পর্ক কোনোদিন ই ছিলো না। আপনার চাচাতো বোন আপনার নামে ফেক আইডি চালাতো। ধীরে ধীরে ধোঁয়াশাগুলি কেটে গেলে উনি সিদ্ধান্ত নেন এই সম্পর্কটাকে আবার জীবন্ত করার। উনি বড় ম্যাডামের সাথে অনেক ঝগড়াও করেছেন। এরপর বড় ম্যাডাম এক শর্তে রাজি হন, সেটা হলো খুব দ্রুত আপনি যাতে কনসিভ করেন। স্যার এটাও মেনে নিয়েছিলেন। তারপর আপনি যে রাতে স্যারকে ছেড়ে চলে যান, সেদিন স্যার আপনাকে সব খুলে বলতে চেয়েছিলেন এবং আপনাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করতে চেয়েছিলেন। সে রাতে আমরা একটি লাশ পাই। আমরা তো ভেবেই নিয়েছিলাম সেটি আপনার লাশ, আপনি মারা গেছেন। কিন্তু স্যার সেটা বিশ্বাস করেন নি। স্যার যখন জানতে পারেন আপনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন পাগল প্রায় হয়ে পড়েন। ঢাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন তিনি। আমরা তাকে বুঝাবার চেষ্টা করেও লাভ হয় নি। বড় ম্যাডাম বারবার স্যারকে বিয়ের জন্য জোর করতে লাগেন। স্যারের লাইফে যাতে আপনার পরিবর্তে কেউ না আসে তাই স্যার সিকদার বংশে সম্পত্তির ভাগ ও ছেড়ে দিয়েছেন। এই চার মাস, স্যার কিভাবে জীবন কাটিয়েছেন তা কেবল আমরা জানি। যদি তার জীবনে কোথাও কোনো নারীর প্রবেশ থাকে সেটা শুধুমাত্র রাইসা ম্যামের ছিলো। রাইসা ম্যাম এবং তার বাচ্চাটিকে দেখাশুনার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন বলেই রাইসা ম্যামের সাথে তার কথা বা দেখা হতো। আমার মনে হয় ম্যাম আপনার যা জানার ছিলো আমি তার উত্তর ঠিকমতো দিয়েছি।
– অয়ন, এখন কোথায় আছে বলতে পারবে।
কথা গুলো আটকে যাচ্ছে প্রাপ্তির। না চাইতেও চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। হ্যা সে ভুল করেছে, খুব বড় ভুল করেছে। একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য নিজের সাথে সাথে অয়নকে এতোটা কষ্ট দিয়েছে। এখন অয়নের সামনে যাওয়াটা খুব দরকার। এসময় অয়ন কোথায় আছে তা একমাত্র রিয়াদ জানে। রিয়াদ উত্তরে বলে,
– না ম্যাম, উনি কোথায় আছে সেটা আমি আপনাকে জানাতে পারবো না। তবে উনি বেঁচে আছেন, তাই উনাকে নিয়ে অহেতুক চিন্তা করবেন না।
– প্লিজ, রিয়াদ আমার উনার সাথে দেখা হওয়াটা খুব জরুরি। আপনি ছাড়া কেউ আমাকে উনার খোঁজ দিতে পারবে না। আমি নিজের ভুলে চারটা মাস দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি করলে অয়ন আমার থেকে আরোও দূরে চলে যাবেন যা আমি মেনে নিতে পারবো না। প্লিজ রিয়াদ, আমাকে উনার সাথে দেখা করানোর একটি ব্যাবস্থা করে দিন।
– বেশ ম্যাম, তবে চলুন।
অপরদিকে,
মুখোমুখি বসা মহীমা সিকদার এবং আবরার। রাগে গা রি রি করছে মহীমা বেগমের। কিন্তু নাতি তার সিদ্ধান্তে অনড়, রাইসাকেই সে বিয়ে করবে। অনেক বুঝানো সত্ত্বেও সে রাজি নয়।
– আবরার, আমার আগেও যা সিদ্ধান্ত ছিলো এখনো তাই, তুমি যদি এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাও তবে আমার ঘরে তোমার কোনো জায়গা হবে না।
– বেশ তবে তাই হবে। রাইসা উনাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। এ বাড়িতে আমাদের কোনো জায়গা হবে না। আরেকটা কথা দাদীজান, আপনার সম্পত্তি কিংবা কোম্পানি ছাড়া আমি দিব্যি চলতে পারবো কিন্তু আমি কিংবা অয়ন ছাড়া সিকদার কোম্পানির কি হাল হবে তা হয়তো আপনি কল্পনাও করতে পারছেন না।
আবরার এক মূহুর্ত দেরি না করে রাইসাকে নিয়ে সিকদার ভিলা থেকে বেরিয়ে পরে। আগে থেকেই এটা তার জানা ছিলো বিধায় অয়নের সাহায্যে আগেই একটা নতুন কোম্পানি স্টার্ট করে আবরার। এখন বেশ ভালো পজিশনেই নিয়ে গিয়েছে সে কোম্পানিটিকে। তাই মহীমা বেগমের হুমকিতে তার কিছুই যায় আসছে না। রাইসা এবং আব্রাহামকে নিয়ে উত্তরার একটি দুই বেডরুম ফ্লাটে উঠে আবরার। এই ফ্লাটটা বিজনেস ক্যারিয়ারের প্রথমে কিনেছিলো আবরার। ফ্লাটটি তার নিজের নামে বিধায় এই ফ্লাটটি মহীমা সিকদার কখোনোই কেড়ে নিতে পারবেন না। আব্রাহামকে শুইয়ে দিয়ে বারান্দায় যায় রাইসা। আবরার তখন নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের চিন্তাগুলোকে উড়াতে ব্যস্ত। আবরারের দিকে নিপুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাইসা। আবরারের দৃষ্টি তখন বাহিরের দিকে। হালকা কেশে বলে উঠে,
– সিগারেট খাওয়া কিন্তু আমার পছন্দ নয়। আর আব্রাহামের জন্য সিগারেট খাওয়াটা উচিত হবে না।
আবরার মুচকি হেসে সিগারেটটা বাহিরে ফেলে দেয়। রাইসাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাধে থুতনি রাখে সে।
– বেশ, আজ থেকে নো সিগারেট। তবে নিকোটিনের নেশা যে বড় খারাপ, সহজে কাটানো যায় না। একটা নেশার বদলে এখন তো অন্য একটি নেশা করতে হবে
– অন্য নেশা বলতে?
রাইসাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে আলতো করে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বলে,
– তুই। জলজ্যান্ত নেশার তরী থাকতে এই নিকোটিনের নেশা আমাকে ছুতে পারবে না। আচ্ছা কাল সকালে কাজী অফিসে যাবো। অয়নকে জানিয়ে দিয়েছি। ওরাই সাক্ষী হিসেবে থাকবে।
– তাড়াহুড়ো করছিস না?
– অনেক দেরি হয়ে গেছে আর দেরি করবো না। বড্ড খিদে পেয়েছে। কি আনতে হবে বল, নিয়ে আসছি।
– তুই যাবি বাজারে?
– আর কেউ আছে?
– আচ্ছা, লিস্ট দিচ্ছি।
বলে রাইসা ভেতরে চলে গেলো। আবরারের মনটা মূহুর্তে ভালো হয়ে গেছে। আজ সত্যি নিজেকে পূর্ণ লাগছে, অবশেষে তার পরিবার পূর্ণতা পেলো।
রাত ৯টা,
অয়নের নিজস্ব গোপন আস্তানার সামনে এসে নামিয়ে দিয়েছে প্রাপ্তিকে রিয়াদ। অয়নের যখন খুব মন খারাপ লাগে তখন এখানে আসে সে। এই আস্তানার খোঁজ কেবল তিনজন জানে, আবরার, সামি এবং রিয়াদ। শহর থেকে দূরে অনাথ আশ্রম যেখান থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিলো তাকে। জায়গাটি মনের খুব কাছের অয়নের। কাল ভিলা ছেড়ে এখানেই ছুটে এসেছে সে। ফোন অফ করে নিজেকে এক রুমে আটকে রেখেছিলো। রিয়াদ ফোনে না পেয়ে বাধ্য হয়ে এখানে চলে আসে। অনাথ আশ্রমের দায়িত্বে যিনি আছেন তার নাম শমশের। শমশের সাহেব অয়নকে ছোট থেকে দেখে এসেছেন। রিয়াদ যখনই এখানে এসেছে তখনই তাকে রাতের সব কথা বলেন তিনি। তারপর দরজা ভেঙ্গে রুমে ঢুকলে দেখে জ্বরের ঘোরে বেহুশ হয়ে পড়ে রয়েছে। প্রাপ্তি ধীর পায়ে ভেতরে আসলে শমশের সাহেবের সাথে তার দেখা হয়৷ শমশের সাহেব তাকে দেখেই বলে,
– তুমি প্রাপ্তি, তাই না?
– আপনি আমাকে চিনেন?
– অয়ন তোমার ছবি দেখিয়েছিলো। সকাল থেকে ছেলেটার খুব জ্বর মা, জ্বরের ঘোরে তোমার নাম ডেকে যাচ্ছে। এখন তুমি এসে গেছো ওকে দেখে রেখো।
– আপনি চিন্তা করবেন না, কিছু হবে না।
রুমে প্রবেশ করে অয়নকে ঘুমন্ত দেখে পাশে বসে প্রাপ্তি৷ মানুষটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। নিজেকে অপরাধী লাগছে, সেদিন কেনো তার জন্য অপেক্ষা করে নি প্রাপ্তি। নিজের একটা ভুল আজকে তাদের এই দুজনকে এভাবে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। অয়নের পাশে বসে, হাতটি ধরে সারারাত সেভাবেই কাটিয়ে দেয় প্রাপ্তি।
সকাল ৭টা,
সূর্যের আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙ্গে অয়নের। মাথাটা এখনো ধরে আছে, জ্বর নেই কিন্তু দূর্বলতা কাটে নি। হাতটি ভার ভার লাগলে পাশ ফিরে দেখে প্রাপ্তি হাতটি দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওভাবেই ঘুমিয়ে আছে। প্রথমে স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো সব কিছু। প্রাপ্তির ঘুমন্ত মুখটি যেনো তার সকল অসুখের ঔষধ। অজান্তেই হাতটি মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলো। মুখে ছোঁয়া পেতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রাপ্তির। অয়নকে সজাগ দেখে প্রান্তি হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কিছু লাগবে?
– তুমি এখানে? ঠিকানা কোথায় পেলে?
– রিয়াদ দিয়েছেন। আপনার কিছু লাগবে?
– কেনো এসেছো? আমার মুখ যাতে না দেখতে হয় তাই তো এখানে চলে এসেছি। তোমার থেকে দূরে। তাহলে? আমি বলি কি চলে যাও।
– আপনার জ্বর এখন নেই। তবে আপনি ফ্রেশ হয়ে যান আমি খাবার নিয়ে আসছি।
– জ্বরে মরে যাবো না, তোমার সেবার আমার প্রয়োজন নেই। চলে যাও, আবার মায়ায় বাধবে আবার একা করে চলে যাবে। একাই তো থাকতে হবে, তবে এই মায়ার কি প্রয়োজন!
– বুঝে বলছেন তো? আমার একটা সামান্য ভুলে চার মাস আমাদের জীবন থেকে চলে গেছে। বাকিটা জীবন ও কি এভাবে একাকিত্বের অন্ধকারে কাটাবো আমরা? মানছি ভুল হয়েছে, ভুল বুঝে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ভালো নেই। আমার হৃদয়টা বড্ড ফাকা। এই বরফ শীতলে জীবনে আমিও ভালোবাসার উষ্ণতা চাই। আর সেটা কেবল আপনি দিতে পারবেন। ভালোবাসি আমি আপনাকে, জেদের বসে যে ভুল করেছি আবার সেটা করতে চাই না। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না আমাকে।
বলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অয়নকে। প্রাপ্তির স্পর্শে শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল পরশ বয়ে গেলো। নিজেকে কঠিন করে রাখা আর যে সম্ভব না অয়নের পক্ষে। তাই না পেরে সেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রাপ্তিকে।
– আর একা করে চলে যাবে নাতো
– না, মৃত্যু অবধি আপনার সাথে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিবো, আপনার ছায়া হয়ে, আপনার শক্তি হয়ে। ভালোবাসি অয়ন, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
– আমিও যে খুব ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া যে আমার চলবে না প্রাপ্তি, একদম ই না।
আজ তাদের ভালোবাসা যেনো পূর্ণতা পেলো, সকল ভুলবোঝাবুঝি মিটিয়ে ভালোবাসার উষ্ণতায় তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হলো। একই দিন অয়ন এবং প্রাপ্তি আর আবরার এবং রাইসা কাজী অফিসে আবার বিয়ে করলো। মহীমা বেগম শাস্তি স্বরুপ সারাজীবনের একাকিত্ব মেনে নিলো। আব্রাহামকে নিয়ে অয়ন, প্রাপ্তি, আবরার এবং রাইসা আবার নিজেদের মতো করে নিজেদের একটি সুখের আস্তানা সাজালো যেখানে বাহ্যিক ঝড় থাকলেও নিজেদের মাঝে কোনো দুঃখ, ক্লেশের স্থান নেই।