ভালোবাসার উষ্ণতা ৭ম পর্ব (দ্বিতীয় অধ্যায় )

0
1710

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৭ম_পর্ব

শুধু দুজনের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি আর প্রকৃতির মাতাল শব্দ শুনা যাচ্ছে। অয়ন প্রাপ্তির কাছে আসতেই জোরে আকাশ ডেকে ওঠে, প্রাপ্তিও ভয়ে অয়নকে জড়িয়ে ধরে। আকাশের গর্জনে প্রাপ্তির বরাবরই ভয়। বজ্রপাতের শব্দ যত বাড়ছে ততই ভয়ে অয়নের বুকে সিটিয়ে আছে সে। অয়ন মুচকি হেসে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে প্রাপ্তিকে, যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। আজ চার মাস পর তার খালি হৃদয় পূর্ণতা পেয়েছে। কিছুসময় পর প্রাপ্তির হুশ ফিরে, এতোক্ষণ ঘোরের বশে কি করছিলো সে। সম্বিত ফিরলে অয়নকে ধাক্কা মেরে চলে যেতে নিলে অয়ন হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে তাকে। কানে মুখ লাগিয়ে বলে,
– নেশা ধরিয়ে পালিয়ে যাচ্ছো?
– আ…আমি ইচ্ছে করে করি নি। ছাড়ুন
– ছেড়ে দিলেই তো পালিয়ে যাও। এই চার মাস একা একা জীবনটাকে বইতে বইতে আমি ক্লান্ত। আর পারছি না প্রাপ্তি।
– আমি শেষবারের বলছি আমি প্রাপ্তি নই, প্রাপ্তি নই। একটা কথা কতবার বলবো!! আমি খুশবু।

চেচিয়ে উঠলো প্রাপ্তি। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলে অয়ন বলে উঠে,
– আমি সব জানি প্রাপ্তি, আমার সামনে অন্তত তোমার এই নাটকগুলি করতে হবে না। তুমি প্রাপ্তি তার সম্পূর্ণ প্রমাণ আমার কাছে আছে। তোমার মিসক্যারেজ হয়েছে, প্রাপ্তি যখন আমাকে ছেড়ে যায় তখন সে প্রেগন্যান্ট ছিলো। এ থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না। তাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ তোমার হ্যান্ডরাইটিং। না হয় তুমি প্রাপ্তির মত দেখতে তোমার সাথে ওর হ্যান্ড রাইটিং ও মিলে যাবে?? তাই অহেতুক চেষ্টা করো না। আর এবাড়িতে তুমি প্রথম এসেছো, তুমি এবাড়ির প্রতিটা জিনিস এতো ভালো করে কি করে চিনো!! কারণ এই বাড়ির সব কিছু আমার প্রাপ্তির গোছানো। মানে তোমার গুছানো। প্রাপ্তি আমার দোষটা কোথায়? আমি জানি না, এতোটা ঘৃণা তুমি কেনো করছো? খুনের আসামীকেও একটা শেষ সুযোগ দেওয়া হয় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার। অথচ তুমি বিগত চার মাস ধরে আমাকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছো, আমি জানিও না আমার দোষ কোথায়! তাও তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নিবো প্লিজ আমাকে একা করে চলে যেও না।

এতোক্ষন চুপচাপ প্রাপ্তি সব শুনে যাচ্ছিলো। চোখ থেকে ক্রমাগত অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। প্রাপ্তির রেসপন্স না পেয়ে অয়ন তার কাছে যায়। নিজের দিকে ঘুরিয়ে আলতো করে তার গাল দু হাত দিয়ে ছুয়ে বলে,
– প্লিজ প্রাপ্তি আমি ক্লান্ত, এবার তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে মরে যাবো। সত্যি মরে যাবো।
– আমি আপনার বলির বাকরা, আপনি কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেন নি। আমি জাস্ট একটা বংশ বৃদ্ধির টুল। আপনি কি ভেবেছেন আমি কিছুই জানি না?? আপনি কোনোদিন আমার কথা ভেবেছেন? প্রথমে ভেবেছিলেন আমি আপনার এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী, তাই আমাকে বিয়ে করেন। আমার সম্মান নষ্ট করা ছিলো আপনার মূল উদ্দেশ্য। আমাকে পাগল প্রমাণ করার কোনো ওয়ে বাদ রেখেছিলেন? তারপর যখন প্রুভ হলো আমি নির্দোষ তখন আপনি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে এজন্য মেনে নেন নি যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনি আমাকে শুধুমাত্র আপনার উত্তরাধিকারিকে জন্ম দেবার জন্য আপনার বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন।
– না, প্রাপ্তি তুমি যা ভাবছো তা ঠিক নয়।
– তাহলে? দাদীর সাথে আপনার ডিল হয় নি? বাচ্চা হবার পর আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। বলুন?
– হ্যা, তখন মহীমা সিকদারকে ঠান্ডা করার জন্য আমি হয়েছিলাম কিন্তু
– কিন্তু কি? কোথায় ছিলেন আপনি যখন আমি আই.সি.উ তে পনেরো দিন পড়েছিলাম? কোথায় ছিলেন যখন আমার বাচ্চাটিকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি? আমি বলি? আপনি তখন আপনার নারী সঙ্গীদের সাথে ব্যস্ত ছিলেন। আমি আজও অনুতাপ করি কেনো আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিলো। আপনি আমার জীবনে না আসলে আমার লাইফে এতো কষ্ট থাকতো না। আমি আপনার মুখ ও দেখতে চাই না।
– বেশ তোমার ইচ্ছে যেনো পূরণ হয়। আমি তোমার সামনে কোনোদিন আসবো না। তবে একটা কথা জেনে রেখো এই অয়ন সিকদারের জীবনে শুধু একজন নারীই এসেছিলো সে হলো কেবল তুমি। প্রাপ্তি ব্যাতীত কোনো নারী আমার জীবনে আসে না। আর সিকদার পরিবারের সম্পত্তিতে আমার কোনোফিন কোনো অধিকার ছিলোই না। আমি সব কিছু ছেড়ে দিয়েছি শুধু তোমার জন্য। জানি তোমার বিশ্বাস হবে না, তবুও বলছি আমি তোমাকে কোনোদিন ঠকাই নি। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসে এসেছি। যাক, আমার মুখ যেন উপর ওয়ালা তোমাকে কোনোদিন না দেখায় এই কামনাই করি। যদি দেখো সেটা যেন আমার মরা মুখ হয়।

বলেই অয়ন সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। প্রাপ্তির কান এখনো বাজছে, অয়নের বলা প্রতিটি কথা যেন কলিজাতে লেগেছে৷ যেন কেউ ভোঁতা ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে রক্তক্ষরণ করছে। রাগের বশে যা নয় তাই সে বলে তো দিয়েছে না জানি ভাগ্য তাদের কোন নতুন মোড়ে এসে দাড় করাবে।

সকাল ৬টা,
রাতের মেঘ কেটে ভোরের মিষ্টি সকাল প্রকৃতিকে নতুন রুপে সাজিয়েছে। কিন্তু মেঘের ঘনঘটা প্রাপ্তির জীবনে এখনো চেয়ে আছে। সারারাত চোখের দু পাতা এক করতে পারে নি, সত্যি কি সে অয়নকে ভুল বুঝছে! বারবার অতীতকে মনে করে নোনাজল গাল বেয়ে পড়ছিলো। মনটা যে বড্ড বেহায়া, কিছুতেই স্থির হচ্ছে না। কাল রাতের পর থেকে অয়ন একবার ও তার সামনে আসে নি। হয়তো তাদের সম্পর্কের ইতি এখানেই। এটাই তো চেয়েছিলো প্রাপ্তি তবে আজ কেনো মনটা খালি খালি লাগছে। কেনো বেহায়ার মতো অয়নকে আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে।

সকাল ৯টা
স্থানঃ- চিটাগং
আজই ঢাকার পথে রওনা দিবে আবরার। দাদীর সম্মুখীন তার হতেই হবে। আব্রাহামের রিপোর্ট চলে এসেছে, হার্টে ছোট ব্লক ধরা পড়েছে। ডক্টর সিদ্দিক মেডিসিন দিয়েছেন। যখন ৭-৮ বছর হবে তখন যদি ব্লকটা থাকে তবে বাহিরে নিয়ে ছোট একটি অপারেশন করতে হবে। বাবা হিসেবে ছেলের কোনো অযত্ন সে হতে দিবে না। তাই আজই ঢাকা নিয়ে যাবে রাইসা আর আব্রাহামকে। রাইসা যদিও আপত্তি করেছিলো, কিন্তু কোনো কথাতেই রাজি হয় নি আবরার। রাইসার সাথে তার মনের দূরত্ব এখনো তেমনই আছে। ক্ষতটা অনেক বেশি তাই হয়তো দেরি হবে সেটা পূরনে। ঢাকা যেয়ে প্রথম কাজ নিশির সাথে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া আর রাইসাকে তার যোগ্য স্থান দেওয়া। মেয়েটাকে আর কোনো অসম্মান সহ্য করতে দিবে না আবরার। রাইসার ডাকে হুশ ফিরে আবরারের।
– কি ভাবছিস?
– কিছু না, প্যাকিং শেষ?
– হুম, আবার ও ভেবে দেখ আবরার, আমার মনে হচ্ছে আমাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়াটা হয়তো ভালো ডিসিশন নয়।
– নিজের পরিবারকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়াটা আমার মনে হয় না অন্যায়। আর কাল রাতেই আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি তোদের ছাড়া ঢাকা ফিরছি না।
– কিন্তু
– চুপ, আর যেন একটা কথা আমি না শুনি।

রাইসার কাছে এসে দুহাত দিয়ে তার গালকে আলতো ছুয়ে কপালে উষ্ণ ছোয়া দেয় আবরার, তারপর বলে,
– ভালোবাসি তোকে, এই শেষবার বিশ্বাস করে দেখ। তোদের নিরাশ করবো না আই প্রমিস। হয়তো তোদের বিলাসিতা দিতে পারবো না, কিন্তু তোদের কোনো কিছুর কমতি হতে দিবো না। শুধু তুই আমার পাশে থাকিস
– সবসময় থাকবো, আমি জানি তুই ঠিক একজন আদর্শ বাবা হয়ে উঠবি।
– উহু আমি শুধু আদর্শ বাবা নয় আদর্শ স্বামীও হতে চাই। জানি তোর ক্ষত হৃদয়টায় আবার জায়গা করে নিতে সময় লাগবে কিন্তু আমি হার মানছি না। আমাকে এই শেষ সুযোগটা দিবি রাইসা?
– ভেবে বলিস, এইবার কিন্তু আমি কোনো ছাড় দিবো না। এই রাইসা কিন্তু অনেক গভীর, তলিয়ে যেতে পারিস।
– সব চলবে। শুধু তোর মাঝে নিজেকে হারাতেও রাজি আমি।

রাইসা মুচকি হেসে আবরারকে জড়িয়ে ধরে। আবরার ও পরম আদরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যতটা শক্ত করে ধরলে একে অপরের সাথে মিশে যেতে পারে।

সকাল ১১ টা,
প্রাপ্তি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে কিন্তু অয়নকে কোথাও পায় না। কাজের লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারাও কিছুই বলতে পারে না। কিছুক্ষণ পর অচেনা নাম্বার থেকে প্রাপ্তির ফোন আসে। ফোন ধরতেই গলাটা বেশ পরিচিত লাগে,
– হ্যালো
– হ্যালো প্রাপ্তি ম্যাডাম
– রিয়াদ?
– জ্বী ম্যাম, অয়ন স্যারের…..

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে