ভালোবাসার উষ্ণতা ২য় পর্ব

0
2027

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#২য়_পর্ব

অচেনা ব্যক্তিটি যখন পায়জামায় হাত দিতে নিয়েছে অমনি প্রাপ্তি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ব্যক্তিটিকে একটি ধাক্কা দেয়। লোকটি নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায়, ঝমঝম করে কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো প্রাপ্তি। এখনো ঘোরের মাঝেই রয়েছে সে। চোখে অন্ধকার দেখছে, বাস্তবতা আর স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে আলাদা করতে পারছে। খুব কষ্ট করে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে প্রাপ্তি। ভয় করছে খুব তার, এই লোকটা কি চাই! কেনো তাকে এভাবে মোলেস্ট করছে। তাই সবই তার কল্পনা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সে, বিছানাতেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলো প্রাপ্তি।

সকাল ৯টা,
ডাইনিং টেবিলে অয়ন আর প্রাপ্তি মুখোমুখি বসা। কাল রাতের ঘটনাগুলো বারবার নিজেকে ভাবাতে বাধ্য করছে প্রাপ্তিকে৷ রাতে কাঁচ ভাঙার শব্দ পেলেও সকালে কোনো কাঁচের টুকরো তো দূরে থাক কিছুর অস্তিত্ব পায় নি। তবে কি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে? নাকি আসলেই কেউ তাকে পাগল করার অদম্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। অয়ন মিটিমিটি হাসছে আর নাস্তা করছে। প্রাপ্তির গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না। সত্য মিথ্যার আড়ালে গুমড়ে গুমড়ে থাকছে সে। প্রাপ্তির অবস্থা দেখে মনে মনে বলতে লাগলো,
– আজ যাদের জন্য আমার ভাইয়ের এই হাল, তাদের সুদে আসলে ফেরত দিবো। তুই ও বাদ যাবি না। তোর মতো লোভী মেয়েদের কিভাবে শাস্তি দিতে হয় খুব ভালো করে জানা আছে।

প্রাপ্তিকে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে অয়ন টিটকারি সুরে বলে,
– আগে তো শুনেছি পচা গলা খাবার খাওয়া হতো, এই দামী খাবার বুঝি গলা দিয়ে নামছে না??
-……
– বলে না কুকুরের পেটে ঘি সয় না। এখন তো দেখছি ভিখারিদের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।

এবার নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না প্রাপ্তি। চোখ জ্বলছে, এখনই যেন অশ্রুধারাগুলো চোখকে মুক্ত হয়ে ঝরে পড়বে। চিৎকার করে বলতে লাগলো,
– হ্যা, ভিখিরি তো। আমি ভিখিরি, সব জেনে শুনে কেনো এই ভিখিরিকে নিজের ভাইয়ের জন্য পছন্দ করতে গেলেন? কেনো আনলেন এই বাড়িতে? যদি আমাকে আপনার ভালো নাই লাগে তাহলে কেনো আমার সামনে আসেন বলেন! আর আমি তো আপনার কেউ না, আমি ভিখিরি না বড়লোক তাতে কি যায় আসে আপনার? আর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিন, আমি ভিখিরি বলেই একটা পঙ্গু মানুষকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। পারলে আনুন তো কোনো বড়লোক খুজে, দেখি সে আপনার ভাইকে বিয়ে করে কিনা।

কথাটা শুনতেই অয়নের মুখের ভাব বদলে গিয়েছে, মুখ শক্ত হয়ে গেছে। তড়িৎগতিতে এসে প্রাপ্তির গলা টিপে ধরে সে। অয়নের চোখে মুখে পশুত্ব যেনো ফুটে উঠেছে। এক পর্যায়ে প্রাপ্তির দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। বাড়ির সব কাজের লোকগুলো দৌড়ে এসে অয়নের হাত থেকে প্রাপ্তিকে ছাড়ায়। আর কিছু সময় গেলে হয়তো ওখানেই দম আটকে মারা যেত প্রাপ্তি। অয়ন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ বড় বড় নিঃশ্বাস নেয় প্রাপ্তি। একটা কাজের মেয়ে দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় তাকে। পানিটুকু এক নিমিষেই ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। এখনো প্রাপ্তির গা কাঁপছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অয়নের অগ্নিদৃষ্টি এখনো শান্ত হয় নি। রাগের বসে দেয়ালে কিছুক্ষণ ঘুষি মেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

সন্ধ্যা ৭টা,
প্রাপ্তি আজ সারাদিন কিছুই খায় নি। এ বাড়ির খাবার যেনো বিশ লাগছে, পানি টুকু খেয়ে দিন কেটেছে তার। বারংবার অয়নের কথাগুলো মনে করে চোখ থেকে পানি পড়ছে। অয়নের প্রতি ঘৃণাটা যেনো আরো বেশি বেড়ে গিয়েছিলো, নিজের ব্যাগ থেকে মা-বাবার ছবিটা বের করে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো প্রাপ্তি।
– আমি কি অপদার্থ মা? কেনো আমায় ছেড়ে চলে গেলে? কি অপরাধ ছিলো আমার? আচ্ছা আমি কি জীবনে সুখ পাবো না? আল্লাহ বোধহয় সুখের বীজটা আমার ভাগ্যে দেয় নি। কষ্ট নিতে নিতে আমি যে আর পারছি না।

বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙে দরজায় ধামধাম করে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ। এতো জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে যেনো দরজাটাই ভেঙে ফেলবে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘড়ির দিকে তাকালে দেখে ঘড়ির কাঁটা ১১টার কাছাকাছি। এতো রাতে কে আসতে পারে! কৌতুহল নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় প্রাপ্তি। দরজা খুলতে না খুলতেই অয়ন ব্যালেন্স হারিয়ে প্রাপ্তির গায়ে ঢলে পড়ে। সারা গায়ে বিশ্রী গন্ধ, বোঝাই যাচ্ছে কোনো এলকোহল বাদ দেয় নি সে। মাতাল অবস্থায় এতো রাতে এই বান্দাকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না প্রাপ্তি। কাউকে ডাকতেও পারছে না এই ভেবে যে, মানুষ কি বলবে। দেবর রাত ১১টায় ভাবীর ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা পাঁচ কান হলে সবাই প্রাপ্তিকেই দোষাবে। চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। তাই না পেরে নিজেই কোনো মতে অয়নকে বিছানা অবধি নিয়ে যায় প্রাপ্তি। কোনো মতে শুইয়ে দিয়ে সরে যেতে নিলেই, প্রাপ্তির হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে অয়ন। মাতাল অবস্থাতেই বলতে লাগে,
– খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না? তোমাকে দেখলে মূহুর্তের মধ্যেই আমার ভেতরে আগুন দাও দাও করে জ্বলতে থাকে। আবার তোমার কাছে এলে আগুনটা কেমন শীতল হয়ে যায়। আমার যখনই মনে হয় তুমি আমার না, ইচ্ছে করে একেবারে খুন করে ফেলি তোমাকে। আবার যখন ভাইয়ের কথা মনে করলে পাগল পাগল লাগে৷
– কি বলছেন? শুনছেন? আমি তো বুঝতে পারছি না কিছু। কি করেছি আমি?
– আচ্ছা, ভালোবাসা মানেই কি কষ্ট। তুমি আমার ধীর বিষ, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমি পান করতে চাই। তোমার উষ্ণতার ছোয়ায় নিজেকে হারাতে চাই। পরমূহুর্তে তোমার আসল রুপটা মনে পড়লেই জ্যান্ত কবর দিতে ইচ্ছে হয়। তোমার মায়া চেহারার পেছনে কাল নাগিনীটা যে আমার চেনা।

অয়নের কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে প্রাপ্তির। অয়ন বিরবির করে আরো কিছু বললো যা প্রাপ্তির কানে আসলো না। প্রাপ্তি নিজেকে ছাড়িয়ে অয়নের গায়ে কম্বল দিয়ে দিলো। এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো প্রাপ্তি। মাথায় অয়নের বলা কথাগুলো মাথায় ঝেঁকে বসেছে। উফফ! এই লোকটা বিয়ের পর থেকেই শুধু বিরক্ত করছে। কি সমস্যা এই লোকের? কি বলে না বলে ঠিক নেই। প্রাপ্তির দৃষ্টি তখন বাইরের দিকে। সোডিয়ামের লাইটে রাস্তার ওই পাশে একটা মহিলা তার একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। উদবাস্তু হয়েও মা টা তার বাচ্চাকে আগলিয়ে রয়েছে। প্রাপ্তির মূহুর্তে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়তে লাগলো, একটা সময় তার মাও তাকে এভাবে আগলিয়ে রাখতেন। কিন্তু এটা তার পোঁড়া কপাল, কারোর হাতে কিছুই নেই।

ফজরের আযানের সময় ঘুম ভাঙ্গে প্রাপ্তির, নিজেকে বারান্দায় আবিষ্কার করে সে। ধীর পায়ে উঠে রুমের দিকে রওনা দেয় সে। বিছানার দিকে নজর যেতেই খেয়াল করলো অয়ন বেঘুরে ঘুমাচ্ছে। কতোটা নিস্পাপ লাগছে ছেলেটাকে, যেনো নিজের সাদা মনে ধুলিক্ণাটাও জমতে দেয় নি। এই সুন্দর নিস্পাপ চেহারার পেছনে একটা শান্ত পশু লুকিয়ে থাকে কখন যে সেটা কাউকে শেষ করে দিবে কেউ বলতে পারে না। ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নামায পড়তে যায় প্রাপ্তি।

সকাল ১০ টা,
মুখের উপর ছিটা পানি পড়ায় অয়নের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলতেই দেখতে পায় এক রমনী, পরণে বেগুনী শাড়ি, খুব নিপুনভাবে নিজের চুল মুছে যাচ্ছে। সকালের স্নিগ্ধতা যেনো চুয়ে চুয়ে পড়ছে। রমনীটা আর কেউ না, প্রাপ্তি। এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো, তারা স্বামী-স্ত্রী। প্রতিদিন সকালটা যদি এভাবে শুরু হতো। অজান্তেই ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি চলে এসেছে অয়নের। সুখের মূহুর্তটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারলো না। ফোনের শব্দে ঘোর কাটে অয়নের। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে কানে আসে,
– যা করার দ্রুত করতে হবে।

মূহুর্তেই অয়নের মুখ শক্ত হয়ে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে নিজের আর আবরারের ছবি আলোকিত হতেই, নিজের ভেতরের আশার কুড়িগুলোকে মেরে ফেললো অয়ন। নিজের মনকে নিজেই বলতে লাগে,
– ভাইয়ের আজকের পরিণতির জন্য ও দায়ী। ওর সম্মান নষ্ট করা আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। এক তীরে দুই পাখি মারাটাই আমার কাজ। আজ যেমন ভাই বাঁচার কোনো আশা খুজে পাচ্ছে না, এই কাল নাগিনীর জীবনেও এমন দিন আনাই আমার লক্ষ্য।

প্রাপ্তির তুড়ির আওয়াজে ঘোর কাটে অয়নের।
– শুনছেন?? কখন থেকে ডাকছি। উঠে যখন গেছেনই এখন নিজের ঘরে চলে যান। আমি চাই না, বাড়িতে আমাদের নিয়ে কোনো বাজে কথা উঠুক।
– যদি এতোই নিজের রেপুটেশন নিয়ে চিন্তা তাহলে, ঘরে ঢুকানো হলোই বা কেনো আর আমাকে রাখা হলোই বা কেনো। লোকমান কাকাকে বললেই হতো। সত্যি বলতে কি শরীরের চাহিদা মেটাতে হবে তো। এসব মেয়ে নিজের স্বার্থর জন্য কতো নিচে নামতে পারে না আমার ভালো করে জানা আছে।

বলেই গটগট করে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অয়ন। নিজের চোখে নিজেকে আরো ছোট মনে হতে লাগছে প্রাপ্তির। সত্যিই তো নিজেকে টাকার জন্য বিকিয়ে দিয়েছে সে। নয়তো এতো অপমানের পড়েও কেনো এই সিকদার বাড়িতে পড়ে রয়েছে। অয়নের বিকট চিৎকার শোনা যাচ্ছে বাহিরে। রুম থেকে বের হতেই দেখে সবাই ছোটাছুটি করছে, ডাক্তার ডাকা হচ্ছে। সবাইকে ব্যস্ত দেখে কলিজায় কামড় পড়ে প্রাপ্তির। আবরারের কিছু হয় নি তো!! ঠিক তখনই পাশ থেকে শুনে….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে