ভালোবাসার উষ্ণতা ১১ম পর্ব

0
1796

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#১১ম_পর্ব

– এখন আমার হাতে সকল ভোটের গণনা রয়েছে, সিকদার কোম্পানির নতুন সি.ই.ও হলেন আবীর সিকদার।

আবীরের মুখে বিজয়ের হাসি, কিন্তু অয়নকে বড্ড শান্ত লাগছে যেন কিছুই হয় নি। হঠাৎ পেছনের প্রজেক্টেরটা অন হয়ে যায়। কিছু ভিডিও র‍্যান্ডমলি চলতে থাকে। তাতে আবীর যে যে বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের ঘুষ দিয়েছে সেটার মূহুর্তগুলি রয়েছে। আবীরের মুখে বিষ্ময় আর ভয় দেখা যাচ্ছে, মুখটা রক্তশূন্য লাগছে। এর পর আরেকটি অডিও ক্লিপ শুরু হয় যাতে আবীরের কন্ঠ স্পষ্ট,
– আমি ১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। আবরার সিকদারের লাশ দেখে আরো এক লাখ টাকা পেয়ে যাবে।

আবীরের যেন কিছুই মাথায় আসছে না। এগুলো এতোটা সুন্দর করে কিভাবে যোগাড় করলো অয়ন? এর পর কিছু ভিডিও অন হয় যাতে স্পষ্ট, সিকদার কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কাছে বেঁচে দিচ্ছে আবীর। এসব ভিডিও দেখে আবীর ধপ করে চেয়ারে বসে পরে। অয়ন রিয়াদকে ইশারা দিলে পুলিশরা রুমে ঢুকে। হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে আবীরকে নিয়ে যাওয়ার সময় অয়নকে ডেকে বলে,
– আবীর ভাই, তুমি যদি চলো ডালে ডালে, আমি চলি শিরায় শিরায়। তাই তোমার এই বানানো খেলাটা শেষ অনেক আগেই করতে পারতাম। কিন্তু আমি দেখতে চাচ্ছিলাম, তুমি কতোটা নিচে নামতে পারো। এখন জেলের ঘানি টানো।

কথাটা শেষ হবার পর আবীরকে নিয়ে যায় জেলে। অয়ন এবার বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের সোজা ভাষায় বলে দেয়,
– এখন আপনাদের সি.ই.ও জেলে, এবার ডিসাইড করেন আমাকে কি সি.ই.ও হিসেবে মেনে নিবেন নাকি জালিয়াতির জন্য আপনাদেরও জেলে পুরতে হবে?
– না না, আপনি যা বলবেন তাই হবে (সবাই)

বড় একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয় অয়ন। আবীর নামক ঝামেলাটি এতোদিন পর একেবারেই ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে সে। এখন হয়তো তাদের জীবনে কোনো বাঁধা আসবে না। কিন্তু আবরার সেদিন কেনো বের হয়েছিলো এটা জানাটা খুব দরকার। আবার রাইসার জীবনটাও নতুন করে সাজানোটা জরুরি।

হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর জানতে পারে, বাচ্চাটার অবস্থা এখন স্ট্যাবল। ডাক্তারের সাথে কথা বলে আই.সি.উ তে যায় অয়ন। বাচ্চাটি যে এতো সুন্দর, দেখে মনে হচ্ছে একটা শিউলি ফুলের গোছা। ধবধবে সাদা বাচ্চাটির ছোট ছোট চোখগুলো যেন এক অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে অয়নকে। আচ্ছা, ওর আর প্রাপ্তির জীবনেও কি এরুপ সুখ আসবে? আসবে না কেনো? অবশ্যই আসবে। আল্লাহ যদি তাদের এক সুতোয় বাঁধতে পারে তবে এই সুখটিও অয়নের ভাগ্যে ঠিক লিখবেন। একদিন হুট করে হয়তো জানতে পারবে, প্রাপ্তি আর ওর ভালোবাসা প্রাপ্তির ভেতরে ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রাপ্তির যত্নে কোনো কমতি রাখবে না সে, দিন শেষে মেয়েটাকে সুখের টুকরি সপে দিবে সে। হয়তো দেখতে দেখতে নয় মাস পেরিয়ে ডেলিভারির সময় হবে। তাদের ও একটি ছোট্ট মেয়ে হবে। যাকে কোলে নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হবে সে। রাইসার ছোট্ট শিশুটিকে দেখে কল্পনার সুখের রাজ্যে হারিয়ে গেলো অয়ন। চোখ থেকে খুশির নোনা জল গাল বেয়ে পড়ছে। চোখ দুটি মুছে রাইসার রুমে গেলো সে। রাইসা প্রচুর দূর্বল হয়ে পড়েছে। এই সময়টায় ভালোবাসার মানুষটি সাথে থাকলে হয়তো আজ মেয়েটাকে এতো কিছু সহ্য করতে হতো না। ভালোবাসা নামক জিনিসটি কারো কারো কাছে অমৃত তো কারো কারো কাছে বিষ।
– কেমন আছো আপু?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই?
– এইতো ভালোই আছি। বাবুর নাম কি রাখলে?
– আব্রাহাম,, কেমন হয়েছে নামটা?
– ভালো। ওর বাবা কি জানে আদৌ ওর ব্যাপারে?
– বলেছিলাম, তাতে তার বাক্য ছিলো এটা একটা ভুল। সে আমার সাথে দেখাও করতে চেয়েছিলো। হয়তো সেদিনই এবোরশন করিয়ে ফেলতো। পরে আর আসলো না সে। আমি অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি, এখন তো শুনেছি বিয়ে করে সুখেই আছে।
– আমাকে ওই পাষন্ডের নামটা কি বলবে?
– কি করবি জেনে? কিছুই করার নেই তোর।
– প্লিজ রাইসা আপু, আমাকে নিজের ভাই ভাবো তো নাকি? প্লিজ একটিবার বলো? চ্যাম্পের ও অধিকার আছে তার বাবার নাম জানা। আর সত্যি বলতে, ওই লোকের জানা উচিত সে যেটাকে ভুল বলে এড়িয়ে গেছে আজ সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। তার এক রাতের ভুল তোমার জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে। প্লিজ নামটা বলো আমাকে।
-…..
– প্লিজ আপু, আজ চুপ করে থেকো না। প্লিজ নামটা বলো। আব্রাহামের ভবিষ্যতের ব্যাপার রাইসা আপু। প্লিজ
– কি করবি জেনে? তোর ভাই কোনোদিন ওকে পিতৃ পরিচয় দিবে না অয়ন। সে আমাকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলো আমাদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা একটা ভুল ছিলো। ইমোশনাল হয়ে না ভেবে সে ভুল করে ফেলেছে। এবার তুই বল, আমার কি করার আছে?
– তুমি শিওর ভাই আব্রাহামের বাবা?
– জানতাম তুই ও বিশ্বাস করবি না। আমাকে কি ভাবিস তোরা? এতোজনের সাথে বিছানায় গিয়েছি যে আমার সন্তানের বাবা কে সেটাই জানবো না?
– না না, তুমি আমায় ভুল বুঝো না। কিন্তু ভাই দায়িত্ব এড়ানোর মতো লোক নন। আমি শিওর কোথাও ভুল হয়েছে। আমাকে কি পুরো ঘটনাটা খুলে বলা যায় আপু?
– হুম

তারপর সাড়ে আট মাস আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো রাইসা অয়নকে বলতে লাগলো।

সাড়ে আট মাস আগে,
সন্ধ্যা ৭টা,
স্থানঃ- ল্যাকভিউ রেস্টুরেন্ট এন্ড বার, উত্তরা।
হঠাৎ ফোন আসায় সেখানে উপস্থিত হয় রাইসা। আবরারের ফোনে যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেনো রাইসা নিজেকে আটকাতে পারে না নিজেকে। মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে সে। কিন্তু আফসোস এই মানুষটা কোনোদিন তার ভালোবাসা বুঝা তো দুর চেষ্টা ও করে নি। বরং যখনই রাইসা তাকে মনের কথা বুঝাতে চেয়েছে হয় সেটাকে উড়িয়ে দিয়েছে নয় এটাকে বয়সের দোষ বলে রাইসাকে বুঝাবার চেষ্টা করেছে। তাই রাইসাও হাল ছেড়ে দিয়েছে। কি দরকার, ভালোই তো আছে বন্ধু হিসেবে। কিন্তু আজ তার এনগেজমেন্টের কথাবার্তার ভেতরে যখন আবরার তাকে ফোন দিয়ে জানায় সে তাকে চায় রাইসা নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি। এখানে এসে দেখে একের পর এক ভটকার গ্লাস শেষ করে যাচ্ছে আবরার। আবরারকে আটকানোর জন্য যখন তাকে বাঁধা দেয়, তখন আবরার বলে উঠে,
– রাইসু, তুই এসেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম তুই আসবি না। আচ্ছা আমার সাথেই এমন কেনো হয় বলতে পারবি? আচ্ছা আমি তো মেয়েটাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলাম, যখন যা চেয়েছি দিয়েছি তাও কেনো আমার সাথেই এমন হলো? জানিস ওইটা একটা ফেক আইডি ছিলো। আমি মানতেই পারছি না।

বলে রাইসাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের প্রলাপ করতে লাগলো। আজ রাইসার থেকে অসহায় হয়তো কেউ নেই। নিজের ভালোবাসার মানুষটি তার কাছে নিজের ব্যার্থ প্রেমের কথা বলছে অথচ এই মানুষটা একবার যদি বুঝতো রাইসা তাকে কতটা ভালোবাসে। রাইসা খুব কষ্টে তাকে সামলায়। এখন আবরারকে কোথাও নেয়া সম্ভব নয় বিধায় একটা হোটেলে খুব কষ্ট করে নিয়ে আসে। বিছানায় আবরারকে শুইয়ে উঠে যেতে নিলেই রাইসার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনে সে। রাইসা কিছু বলার আগেই তার কানের মুখ লাগিয়ে বলে,
– আজ তোকে বড্ড মায়াবী লাগছে, যেনো এক ফালি চাঁদের টুকরো আমার হাতে কেউ এনে দিয়েছে। খুব আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে তোকে।
– আবরার তুই নেশায় যা তা বলছিস। ছাড় আমাকে আমি উঠবো।
– নেশা কেটে গেলে তুমিও কেটে যাবে। আজ রাতটা বড্ড বেহায়া হতে মন চাচ্ছে। আমি সত্যি অন্ধ, আমার সামনে পিকাসোর পেইন্টিং থাকতে আমি ছেড়া কাগজের আঁকিবুকির পেছনে ছুটেছি। তোর মাঝে এতো মায়া আমার অন্ধ চোখে পড়লোই না। আজ এ মায়ায় ডুবে যেতে মন চাইছে, দিবি আমাকে সে সুযোগ?
– আবরার কাল সকালে সব ভুলে যাবি তুই, আমি চাই না আমাদের সম্পর্ক এই নেশার বশে একটি ভুলে পরিণত হোক।
– হবে না, আমি তোর গায়ে কোনো আঁচ আসতে দিবো না। তোকে মনের কোঠরে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো। আজ আমার তোকে খুব করে চাই রাইসু। অন্যদের মত আমায় একা করে দিস না প্লিজ। আমি থাকতে পারবো না। আমার এসব ভালো লাগছে না রাইসু। অয়ন বাদে, কাছের মানুষ কেউ নেই। তুই আমাকে একা করে দিস না প্লিজ। আমি হয়তো মরেই যাবো।
– কখনোই না, এসব কথা মুখেও আনবি না। তুই সবসম্য আমাকে পাশে পাবি, যত ঝড় আসুক না কেন আমি কখনো তোকে ছেড়ে যাবো না কথা দিলাম।

কথাটা শেষ হতেই রাইসাকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নেয় আবরার। কিছু আর্তনাদ, কিছু বেদনা ধীরে ধীরে কতটা সুখময় হঅয়ে যায় সেটা সেদিন রাইসা অনুভব করতে পারছিলো। ভেবেছিলো এটা সুখের মিলন হবে কিন্তু এই সুখটা যে ক্ষণিকের অতিথি ছিলো সেটা কল্পনাতেও আনে নি রাইসা। এই কালরাত যে কেবল নেশার ঘোরে করা সামান্য ভুল হবে যা তার জীবনকে ৩৬০ ডিগ্রীতে ঘুরিয়ে দিবে সেটার আঁচও তার ভালোবাসায় অন্ধ হৃদয়টি পায় নি।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখতে পায় আবরার শক্ত মুখে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদরটা পেছিয়ে দাঁড়াতেই যা শুনলো তাতে মাটির নিচের জমি খসে পড়ে রাইসার।
আবরার এমন কিছু বলবে তা কল্পনাতেও আনে নি। আবরার তখন বলে…..

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে