#ভালবাসার এক রাত❤
#লেখিকাঃ নাবিলা আহমেদ রোজ
#পর্ব- ৩
হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠলো। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছি। দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও পাচ্ছি না। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মাথা ঘুরে ধপ করে নিচে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে চেঁচিয়ে উঠলাম। খেয়াল করলাম লোকটা গাড়িতে উঠতে গিয়েও থেমে গেলো। চোখ খুলে রাখারও শক্তি নেই আমার। না চাইতেও চোখদুটো বুজে এলো। এরপর কি হয়েছে কিছুই মনে নেই।”
আচ্ছা আমি কি মরে গিয়েছি? যা, যা হলো আজ আমার সাথে এরপর মরারই কথা। আমি কি সত্যিই মরে গিয়েছি? যদি মরে থাকি তাহলে এই কালো ড্রেস পড়া লোকটা কে? আর উনি আমার দিকে কেন এগিয়ে আসছেন। চোখ বন্ধ অবস্থায় এসব ভাবছি আমি। কিন্তুু আমি চোখ খুলতে পারছি না কেন? এমনকি হাত, পা বা শরীরও নাড়াতে পারছি না। তাহলে আমি মরেই গিয়েছি মনে হয়। এসব ভাবতে, ভাবতে লোকটা আমার কাছে চলে এলো। ইসসস কি ভয়ংকর দেখতে লোকটা। লোকটা এসেই আমাকে শিকল দিয়ে বারি মারলো। আমি সাথে, সাথে নিচে পড়ে গেলাম। লোকটা অনবরত আমাকে শিকল দিয়ে আঘাত করছে। আমি পাগলের মতো কান্না করছি। কিন্তুু এই অন্ধকার জায়গায় কেউ নেই আমার কান্না শোনার জন্য। লোকটা মারা বন্ধ করে চলে গেলো। আমি ফুপিয়ে কান্না করে যাচ্ছি। একটুপর সেই একই শিকলটা নিয়ে অন্য কেউ এলো। নিচে বসে আমি উপরে তাকালাম। তাকিয়ে আতকে উঠলাম এটা যে সামির। সামির জোড়ে, জোড়ে শব্দ করে হাসছে আর সামনে এগোচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। পিছাতে, পিছাতে কিছুর সাথে ঠেকে গেলাম। চিৎকার করে সবাইকে ডাকছি। কিন্তুু এখানে যে কেউ আসবে না। আর আসবেই বা কোথাথেকে? আমার যে কেউ নেই কেউ না। এবার আমি দায়ীমাকে ডাকতে লাগলাম। তখনি সামির শিকল দিয়ে আমাকে বারি দিলো। এবারও আমি চিৎকার করে কাঁদছি। আমার চিৎকারে হয়তো আকাশ, বাতাসও কেঁপে উঠছে। কিন্তুু এই পিশাচের হৃদয় কাঁপছে না। ওর হাত কাঁপছে না আমাকে আঘাত করতে। মার খেতে, খেতে আমি সেন্স হারিয়ে পড়ে রইলাম। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা। ভেবেছিলাম এত মার খেয়ে মরে যাবো। কিন্তুু না আল্লাহ আমাকে আরো কষ্ট দিতে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেন্স এলো শরীরে গরম পানি পড়ে। শরীরে গরম পানি পড়তেই চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তুু উঠে বসার শক্তিটুকুও নেই আমার। সামনেই সামির আর কালো ড্রেস পড়া লোকটা দাড়ানো। লোকটার মুখে বিচ্ছিরি একটা মাস্ক লাগানো। অন্ধকারে ভেবেছিলাম এটাই বুঝি ওনার আসল চেহারা। কিন্তুু এখন আবছা আলোতে বোঝা যাচ্ছে এটা মাস্ক। সামির শয়তানি হেসে আমার কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। ওমনি আমি চিৎকার করে উঠে বসে বলতে লাগলাম,
—-” না আমাকে আর মেরো না। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমাকে এভাবে আর মেরো না। আমি আর নিতে পারছি না প্লিজ ছেড়ে দাও।”
_______________
কেউ একজন সামনে থেকে কথা বলছে শুনতে পারছি। কিন্তুু এই মুহূর্তে কিছু খেয়াল নেই আমার। আমার নিজেকে বাঁচাতে হবে ওরা আমাকে মারছে। এদিকে লোকটা চেঁচিয়ে আমাকে ডাকছে। আমি অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছি। এবার লোকটা এক ধমক দিয়ে বললো,
—-” জাস্ট কাম ডাউন রোজ।”
এবার আমি একদম চুপ হয়ে গেলাম। এতক্ষণ হাটুতে মুখ গুজে চেঁচাচ্ছিলাম। লোকটার ধমক খেয়ে হাটু থেকে মুখ তুলে তাকালাম। এই তো সেই রকস্টার এসআর। উনি এখানে কি করে এলো? চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম এটা ওনার বাড়ি হবে। কিন্তুু আমি এখানে কি করে এলাম? তাহলে কি উনি আমাকে নিয়ে এসেছে? এক দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। কতদিন পর ওনাকে দেখলাম। না, না কতদিন পর না পুরো ২বছর পর। কেন যেন না চাইতেও মুখে হাসি ফুটে উঠতে চাইছে। পুরনো কথা মনে পড়তেই শক্ত হয়ে বললাম,
—-” আমি এখানে কি করে এলাম?”
উনি ভাবলেশহীন ভাবে বললো।”
—-” আমি নিয়ে এসেছি তোমাকে,
আমি কড়া গলায় বললাম।”
—-” কেন নিয়ে এসেছেন আমাকে এখানে?”
উনি সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে বললো,
—-” তুমি সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলে। আমি তখন গাড়িতে উঠছিলাম। হঠাৎ তুমি চেঁচিয়ে উঠলে। আর সেই আওয়াজ আমার কানে এলো। এগিয়ে গিয়ে দেখি তুমি পড়ে আছে তাই নিয়ে এলাম। তাছাড়া আমার শখ ছিলো না তোমাকে আনার।”
কথাটা যেন বুকে তীরের মতো বিধলো। নিজেকে সামলে হালকা চেঁচিয়ে বললাম,
—-” তাতে আপনার কি?”
এমন সময় মাথা ব্যথা করে উঠলো। হাত দিয়ে দেখলাম মাথায় ব্যান্ডেজ। খানিকটা চমকে উঠে বললাম।”
—-” এসব কি?”
উনি দাড়িয়ে বললো,
—-” তোমার কপাল কেটে গিয়েছে। ডক্টর এসে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গিয়েছে। আর কিছু মেডিসিন দিয়ে গিয়েছে।”
আমি বিছানা থেকে নেমে বললাম,
—-” আপনার মেডিসিন আপনি খান। আমি এক্ষুণি বাড়িতে যাবো।”
উনি এক গাল হেসে বললো,
—-” এখন যাবে বাড়ি? তুমি জানো এখন কত বাজে?”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম।”
—-” কত?”
উনি ফোন টিপতে, টিপতে বললো,
—-” রাত ১টা বেজে ৫৯মিনিট।”
আমি হা করে থেকে বললাম,
—-” হোয়াট?”
উনি রুম থেকে বের হতে, হতে বললো।”
—-” ইয়াপ এখন বসো আমি আসছি,
বিছানায় পা দুলিয়ে বসে আছি। উনি রুম থেকে সেই যে গিয়েছে এখনো আসেনি। এসবের মাঝে আবার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো। ভয়ে কয়েকটা ঢোক গিললাম। সামিরের অত্যাচার কম সহ্য করিনি। এখন তো ঘুমালেও সে সব মনে পড়ে। ২বছরে কম ওর মার খাইনি। জানোয়ারের মতো আমাকে মারতো। অবশ্য মারতো বললে ভুল হবে এখনো মারে। আর ওর সাথে যে আরেকটা লোক কে ছিলো। কালো ড্রেস পড়া লোকটা কেন মারতো আমাকে? সামিরও কারণ ছাড়াই মারতো আমাকে। একটু সেজে কোথাও গেলেই ধরে মারতো। যদিও ওর মা আমাকে সাজিয়ে দিতো। ওর অন্যায় আবদার পূরণ না করলে মারতো। বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে এলাম। জামার হাতা ফুল হওয়ায় হাতের মারের দাগগুলো ঢেকে আছে। ওড়না দিয়ে নিজেকে ভাল করে ঘিরে আবার বসলাম। একটুপর উনি এলো সাথে পানি আর জুস। আমি হালকা কেশে বললাম।”
—-” আপনি এখান থেকে যান,
______________
আমার কথায় উনি কপাল কুঁচকে বললো।”
—-” আমার বাড়ি এটা ওকে? আর এই রুমটাও এই বাড়ির সাথে যুক্ত। তো আমার যখন ইচ্ছে তখন যাবো,
আমি এবার গলা খাকারী দিয়ে বললাম।”
—-” আপনাকে আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছে না। তাই বলছি প্লিজ যান এখান থেকে,
উনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলো এরপর বললো।”
—-” আচ্ছা তারআগে এই জুসটা খাও। দ্যান এই মেডিসিনগুলো খেয়ে নাও,
আমি রাগ দেখিয়ে বললাম।”
—-” আমি জুসও খাবো না মেডিসিনও খাবো না,
উনি চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নিয়ে বললো।”
—-” দেখো আমার রাগটা বাড়িয়ো না। তুমি খুব ভাল করেই জানো রাগলে আমার মাথা ঠিক থাকে না,
হঠাৎ আমার কি হলো জানিনা। রাগটা প্রচুর বেড়ে গেলো আমার। বেড সাইড থেকে জুসের গ্লাসটা নিয়ে ফ্লোরে ফেলে চেঁচিয়ে বললাম।”
—-” আমি খাবো না শুনেছেন আপনি? আপনার হাতের এই জুস আমি খাবো না মিস্টার শুভ্র চৌধুরী,
শুভ্র ধমক দিয়ে বললো।”
—-” রোজ,
ওনার ধমকে আমি চুপসে গেলাম। শুভ্র হনহন করে আমার সামনে চলে এলো। এসেই মেডিসিন খুলতে শুরু করলো। আমি ভাবছি উনি কি জোড় করে মেডিসিন খাওয়াবে নাকি? ভাবনার মাঝেই শুভ্র আমার গাল চেপে ধরলো। আমি চোখ বড়, বড় করে তাকিয়ে আছি। শুভ্র জোড় করে মুখের মধ্যে মেডিসিন ঢুকিয়ে দিয়ে পানি দিলো। আমিও গিলতে বাধ্য হলাম। মেডিসিন খাইয়ে শুভ্র আমার দিকে তাকিয়ে বললো।”
—-” আমার সাথে একদম জেদ দেখাবে না,
বলে চলে যেতে গেলো। তখনি মনে পড়লো ওনাকে সবাই এসআর বলে। কিন্তুু এসআর কেন বলে? ওনার নাম শুভ্র চৌধুরী তাহলে এসসি বা সিএস বলার কথা। এসে না হয় ওনার নাম আরে কে? তাই আমতা, আমতা করে বললাম।”
—-” শুভ্র চৌধুরী আপনার নাম রাইট? তো আপনাকে সবাই এসআর বলে কেন?”
উনি চট করে দাড়িয়ে গেলো। পিছন ফিরে শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি মিনমিন করে বললাম,
—-” এসে আপনার নাম তাই এস। আরে কি আপনার জিএফের নাম?”
উনি হালকা হেসে বললো।”
—-” না ভালবাসার নাম,
কথাটা শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো। কেমন একটা অস্থিরতা বিরাজ করছি আমি। বুকের ভেতরটা যেন জ্বলে, পুড়ে যাচ্ছে। তাহলে উনি এখন অন্যকাউকে ভালবাসে? তাহলে কি রাহিকে ভালবাসে? হ্যা রাহির নাম তো আর দিয়ে শুরু। ২বছর আগে হলে হয়তো আমি নিজেকে ভাবতাম আরে। কিন্তুু এখন তো সব বদলে গিয়েছে সব। শুভ্র এখন রকস্টার শুভ্র। সাথে তার ভালবাসাও বদলে গিয়েছে। এখানে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো। তাই উঠে হাটা দিলাম। উনি সামনে দাড়িয়ে বললো।”
—-” কোথায় যাচ্ছো?”
আমি চোখমুখ শক্ত করে বললাম,
—-” আমি চলে যাচ্ছি।”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,
—-” এতরাতে তুমি কোথাও যাবে না।”
ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে হাটা দিলাম। উনি খপ করে আমার হাত ধরে ফেললো। আমি রেগে গিয়ে বললাম,
—-” কি করছেনটা কি আপনি? আমার হাতটা ছাড়ুন আমি চলে যাবো।”
উনি গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বললো,
—-” তুমি হাত ছাড়লেই চলে যাবে তাই তো?”
আমি হ্যা বললাম। উনি আমার হাত টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছি না। এমন বডি বিল্ডারের সাথে পারা যায়? উনি কাকে যেন ডেকে দড়ি নিয়ে আসতে বললো। আমি গোল, গোল চোখ করে বললাম।”
—-” মানে? দড়ি দিয়ে কি করবেন আপনি?”
শুভ্র আমার কথার উত্তর দিলো না। একটুপর একটা ছেলে দড়ি নিয়ে এলো। উনি দড়ি দিয়ে আমার হাত বাধতে লাগলো। আমি চেঁচামেচি করে বললাম,
—-” আরে আপনি কি করছেন? আমার হাত বাধছেন কেন?”
বলতে, বলতে উনি আমার পা ও বেঁধে দিলো। হাত, পা বেধে হালকা ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিলো। আমি হাত, পা ছোটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি। উনি সোফায় বসে বললো।”
—-” কোন লাভ নেই ছুটতে পারবে না,
এবার আমি ফুপিয়ে কেঁদে বললাম।”
—-” আপনি কেন এমন করছেন? আমাকে প্লিজ যেতে দিন,
উনি কোন কথা বললো না। আমি অনবরত কেঁদেই চলেছি। নিরবতা ভেঙে শুভ্র বলে উঠলো।”
—-” তুমি এই রাতেই যেতে চাইছো কেন? কারণ সামির যদি জানে তুমি এখানে আছো ও তোমাকে ঘৃনা করবে? সামির তোমাকে ভালবাসে না? তাহলে ও তোমাকে ঘৃনা করবে না ডোন্ট ওয়ারী,
আমি হাত, পা ছোটানোর চেষ্টা করে বললাম।”
—-” কে আমাকে ভালবাসলো আর কে ঘৃনা করলো। সে সব আর আমার উপর এফেক্ট ফেলে না। বিকজ আমি কারো ভালবাসাও চাই না। আর কারো ঘৃনাও চাই না। খুব সাধারণ হয়ে থাকতে চাই। যতটা সাধারণ হলে কেউ ভালও বাসবে না কেউ ঘৃনাও করবে না,
আমার কথা শুনে উনি শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।”
—-” চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো,
বলে রুম ত্যাগ করলো। আমার চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। বুঝে গিয়েছি এই দড়ি আমি খুলতে পারবো না। কাঁদতে, কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মাঝে মনে হচ্ছে কেউ আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটুপরই মনে হলো লোকটা আমার কপালে তার ঠোট ছোঁয়ালো। নড়েচড়ে উঠে চারদিকে তাকালাম। কিন্তুু সারা রুমে কাউকে দেখতে পেলাম না। তাহলে কি আমার মনের ভুল নাকি?”
#চলবে…
#ভালবাসার এক রাত❤
#লেখিকাঃ নাবিলা আহমেদ রোজ
#পর্ব- ৪
ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটুপরই মনে হলো লোকটা আমার কপালে ঠোট ছোঁয়ালো। আমি নড়েচড়ে উঠে চারদিকে তাকালাম। কিন্তুু না সারা রুমে কেউ নেই। তাহলে কি আমার মনের ভুল? নাকি শুভ্র এসেছিলো? আবার ভাবলাম উনি কেন আসবে? এখনো আমার হাত, পা বাধা আছে। তবে ছোটার ব্যর্থ চেষ্টা আর করলাম না। জানি কোন লাভ হবে না। এভাবেই বিছানায় পড়ে রইলাম। আস্তে, আস্তে অন্ধকার কেটে গেলো। আকাশে সূর্যি মামা উকি দিলো। জানালার পর্দাগুলো একপাশে টেনে রাখা। যার কারণে সূর্য্যর আলো মুখে এসে পড়ছে। এদিকে চুলও মুখে এসে পড়েছে। এই মুহূর্তে প্রচুর বিরক্ত লাগছে। হাতগুলো পিছনে বাধা সরাবো কি করে? কোনরকম চেষ্টা করে পিছনে এলাম। কিন্তুু চুলগুলো কিছুতেই সরছে না। সরাতে না পেরে এবার চেঁচিয়ে শুভ্রকে ডাকতে লাগলাম।”
—-” শুভ্র, শুভ্র আপনি কোথায়?”
একটুপর শুভ্র ঘুমঘুম কন্ঠে এসে বললো,
—-” হোয়াট হেপেন্ড রোজ? এভাবে চিৎকার করছো কেন?”
শুভ্রকে দেখে মনে, মনে ভাবছি।”
—-” ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে মাএ ঘুম থেকে জেগেছে। তারমানে রুমে কেউ ছিলো না। হয়তো আমার মনের ভুলই হবে এটা,
এরমাঝে শুভ্র এক ধমক দিয়ে বললো।”
—-” রোজ ডাকলে কেন আমাকে? সারারাত ঘুমাতে পারিনি এখন জাগিয়ে দিলে আমাকে,
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—-” সারারাত কেন ঘুমাননি?”
শুভ্র রেগে বললো।”
—-” সেটা তোমাকে বলবো না,
আমি হতাশ কন্ঠে বললাম।”
—-” সকাল হয়ে গিয়েছে আমি বাড়ি যাবো। আমার হাতের বাধন খুলে দিন,
উনি চুপচাপ আমার বাধন খুলে দিলো। বুঝলাম উনিও চায় আমি চলে যাই। অবশ্য কেনই বা চাইবে না? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নামলাম। ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম। খেয়াল করলাম উনি আমার পায়ের দিকে তাকাচ্ছে। একচুয়ালি উনি আমার পায়ের নুপুরের দিকে তাকাচ্ছে। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম।”
—-” এটা আপনার দেয়া নুপুর না। আপনার দেয়া নুপুর আমি ফেলে দিয়েছি। এটা সেম ডিজাইন হতে পারে বাট আপনার দেয়া নুপুর না,
শুভ্র আমার কথায় হাসলো। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে চলে এলাম। আসার সময় দেখলাম শুভ্র আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাটা দিলাম। এখন হয়তো ভাবছেন আমি ওনাকে দেখে শকড কেন হইনি। বা ওনাকে দেখে আমার জড়িয়ে ধরে কাঁদা উচিত ছিলো। কিন্তুু সেখানে আমি ওনাকে দেখে রেগে কেন গেলাম? যাকে কি না ২বছর মৃত ভেবে এসেছি। যাকে মৃত ভেবে কবরস্থানে গিয়ে এক হিসেবে প্রতিদিন মার খেয়েছি। তাকে দেখে কেন রেগে গেলাম তাই তো? আসলে আমি আগেই জেনেছি শুভ্র বেঁচে আছে। সামির গতকালই আমাকে বলেছিলো। যখন ও আমাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলো। তখন গাড়ির ভেতরেই আমাকে বলেছিলো। আর শুভ্র কেন নিজেকে মৃত সাজিয়েছে সেটাও বলেছিলো। কিন্তুু তখন আমি ওর কথা বিশ্বাস করিনি। আমি বিশ্বাস করিনি আমার শুভ্র এমন করতে পারে। কারণ শুভ্র যে তার রেড রোজকে ভীষণ ভালবাসে। সে আর যাইহোক আমার সাথে এমন করবে না। কিন্তুু না রাতেই আমার ধারনা পাল্টে গেলো। যখন আমি ওর গান ক্লাবে শুনলাম। ভয়েজ শুনেই আমি বুঝতে পারি ওটা শুভ্র। কিন্তুু কেন যেন মানতে পারছিলাম না। আর যখন শুভ্রকে ক্লাবে দেখলাম। আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। শুভ্র বেঁচে আছে দেখে যতটা খুশী হয়েছিলাম। ঠিক ততটাই কষ্ট পেয়েছিলাম ও আমাকে ঠকিয়েছে কথাটা ভেবে। তখন একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।”
_______________
—-” এই কি সেই শুভ্র? যে আমাকে না দেখে ১টা দিন থাকতে পারতো না। অথচ নিজের ক্যারিয়ারের জন্য নিজেকে আমার কাছে মৃত বলে বিদেশে চলে গেলো। যাতে আমি ওনাকে আর না খুজি। এই কি সেই শুভ্র? যার জন্য আমি সামিরের দেয়া এত আঘাত সহ্য করেছি ২টা বছর। শুভ্র আমার সাথে এটা কি করে করতে পারলো? আমার থেকে ওনার কাছে ক্যারিয়ার বড় হয়ে গেলো? উনি কি জানতো না আমার সেই সময়ে সবথেকে বেশী ওনাকে দরকার ছিলো। বাবাই, আম্মুকে হারিয়ে পাগল হতে বসেছিলাম আমি। তার কদিন যেতে না যেতেই শুভ্র গায়েব হয়ে যায়। এত ম্যাসেজ করতাম কল দিতাম ওনাকে পেতাম না। আমার তখন ঠিক কি অবস্থা হয়েছিলো একমাএ আমি জানি। প্রতিরাতে চিৎকার করে কাঁদতাম। কাউকে নিজের পাশে পাইনি। তাই ঠিক করলাম ওনাদের বাড়ি যাবো। মামনি জানলো এই ঘটনা তবুও কেন এলো না? তাই সকাল, সকাল ওনাদের বাড়ি চলে যাই। মামনি আমার সামনে আসেনি সেদিন এসেছিলো সাহেল আঙ্কেল। আমি সাহেল আঙ্কেলকে দেখেই জানতে চাই,
—-” আঙ্কেল শুভ্র ভাই কোথায়? তোমরা জানো আমার বাবাই, আম্মু মারা গিয়েছে? তাহলে তোমরা কেন দেখতে এলে না? আর, আর শুভ্র ভাই বা কোথায়?”
আঙ্কেল হঠাৎ বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়। আঙ্কেলকে কাঁদতে দেখে বুকটা ধুক করে উঠলো। মনের ভেতর এক অজানা ভয় কাজ করতে লাগলো। ভয় নিয়ে আঙ্কেলকে বললাম।”
—-” আঙ্কেল শুভ্র ভাই কোথায়?”
আঙ্কেল আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো। এসে আমাকে নিয়ে গাড়িতে বসালো। আমি কিছু বুঝতে পারছি না আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আবার এটা ভেবে চুপ করে রইলাম। যে আঙ্কেল আমাকে শুভ্রর কাছে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি এসে থামলো আজিমপুর কবরস্থানে। আঙ্কেল আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। আমি যত ভেতরে যাচ্ছি তত হাত, পা কাঁপছে। একটা কবরের সামনে এসে আঙ্কেল বললো,
—-” ওই দেখ রোজ তোর শুভ্র ভাই চিরতরে ঘুমাচ্ছে।”
সামনে তাকিয়ে আমি থমকে গেলাম। নতুন একটা কবর যেটাতে শুভ্র চৌধুরী নাম লেখা। তারিখ দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাবাই আর আম্মু যেদিন মারা গিয়েছে সেই তারিখ। অর্থাৎ ১৫দিন আগের কবর এটা। আমি চিৎকার করে বসে পড়লাম। পাগলের মতো হাউ, মাউ করে কান্না করছি। বুকের ভেতর কেউ যেন কেটে গুড়া মরিচ ছিটিয়ে দিয়েছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আল্লাহ আমারও মৃত্যু হোক। কাঁদতে, কাঁদতে আঙ্কেলকে বললাম,
—-” আঙ্কেল এটা কি করে হলো?”
আঙ্কেল চশমা খুলে চোখদুটো মুছে বললো।”
—-” ১৫দিন আগে তোর বাবাই আর আম্মুর কথা শুনে ও ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে যেতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়। আর এক্সিডেন্টে স্পট ডেথ হয়ে যায়,
আমি হাউ মাউ করে কেঁদে বললাম।”
—-” আমাকে কেন জানাওনি আঙ্কেল?”
আঙ্কেল উল্টো দিকে তাকিয়ে বললো,
—-” তোর বাবাই, আম্মু মারা গেলো। তোকে আর ঝামেলায় ফেলতে চাইনি।”
আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। এত কষ্ট হচ্ছে কাউকে বলতে পারছি না। এখন ভাইয়াও আমার কাছে নেই। জানিনা ২০দিন আগে ভাইয়া কেন আমেরিকা চলে গেলো। আমাদের কারো সাথেই যোগাযোগ ছিলো না। ভাইয়া বাবাই, আম্মুর কথা জানেও না। এদিকে আমি রাস্তা দিয়ে পাগলের মতো ছুটে বাড়ি এলাম। শরীরের কোন হাল নেই আমার। চুলগুলো একেবারে উস্কো, খুস্কো হয়ে গিয়েছে। আত্মহত্যা করতে গিয়েও পারিনি কারণ এটা যে মহাপাপ। তবে আস্তে, আস্তে আমি ডিপ্রেশনে চলে যাই। আমার কথা জানতে পেরে নানুমনি এখানে চলে আসে। নানুমনিও প্রায় সময় কাঁদতো। সবসময় আমার পাশে বসে এটা, ওটা বলতো। আমি পাথরের মতো শুধু সব শুনে যেতাম,
_______________
অতীত ভাবতে, ভাবতে রাস্তায় হোচট খেয়ে পড়ে গেলাম। হাতে, পায়ে ধুলোবালি জড়িয়ে গিয়েছে। একহাত দিয়ে সেগুলো ঝাড়ছিলাম। এমন সময় কেউ সামনে এসে দাড়ালো। উপরে তাকিয়ে দেখি সামির। আমি ঢোক গিলে বললাম।”
—-” ত্ তুমি?”
সামির আমার হাত ধরে ওঠালো। এরপর শান্ত গলায় বললো,
—-” এলে তাহলে? সারারাত কোথায় ছিলে?”
আমি এখন কি বলবো? যদি বলি শুভ্রর বাড়িতে ছিলাম। তাহলে আবার আমাকে মার খেতে হবে। এসব ভাবছিলাম এরমাঝে সামির বললো।”
—-” আচ্ছা ছাড়ো বলতে হবে না। কারণ গতকাল তো আমিই তোমাকে রাস্তায় ফেলে এসেছিলাম। এখন চলো বাড়িতে যাই,
বলে আমাকে টেনে গাড়িতে বসালো। আমি আজও বুঝতে পারিনা সামির এমন কেন হয়ে গেলো? শুভ্র আর সামির বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। ভার্সিটিতে নিরব ভাইয়া, সামির আর শুভ্রর বন্ডিংটা ছিলো অনেক স্ট্রং। সবাই ওদের ফ্রেন্ডশিপ নিয়ে হিংসা করতো। ভার্সিটির ক্রাশ ছিলো ওরা ৩জন। তবে শুভ্রর জন্যই মেয়েরা বেশী পাগল ছিলো। কিন্তুু শুভ্র বা নিরব ভাইয়া সে সবে পাত্তা দিতো না। সামিরও যে পাত্তা দিতো তেমন না। তবে ও একটু ফ্লার্ট করতো। আমরা সবাই একি ভার্সিটিতে পড়তাম। হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। নিরব ভাইয়াকেও এখন দেখা যায় না। দেখা যাবেই বা কি করে? সামির তো বাড়ি থেকে বেরই হতে দেয় না। আমি শুধু কবরস্থানে যেতাম। শুভ্র ভেবে না জানি কার কবর জিয়ারত করেছি এতদিন। কিন্তুু ওখানেও তো শুভ্র চৌধুরীই লেখা ছিলো। তাহলে ওটা কোন শুভ্র? আর সাহেল আঙ্কেল মিথ্যে কেন বলেছিলো আমাকে? নাকি শুভ্রই বলতে বলেছিলো? হয়তো শুভ্রই বলতে বলেছিলো তাই আঙ্কেল বলেছে। এতটা খারাপ কি করে হতে পারে শুভ্র? যে নিজের বাবাইকে দিয়ে নিজের মৃত্যুর মিথ্যে নিউজ দিলো আমাকে। ভাবনার মাঝেই হাতে টান লাগলো। তাকিয়ে দেখলাম সামির হাত ধরে রেখেছে। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম।”
—-” কি হয়েছে?”
সামির হাত টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে বললো,
—-” কানী হয়ে গিয়েছো নাকি? বাড়ি চলে এসেছি আমরা।”
আমি হাত ছাড়িয়ে ভেতরে চলে এলাম। আগে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। এরপর জানালার কাছে এসে ভাবলাম গতকালের কথা। আমি আর সামির গাড়িতে ছিলাম। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এরমাঝে সামির বললো,
—-” তুমি কার কবরে যাও তুমি জানো?”
আমার বুকটা ধক করে উঠলো। সাথে, সাথে চোখ ভরে এলো। মনে পড়ে গেলো আমার শুভ্র আর নেই। আমাকে কাঁদতে দেখে সামির বললো।”
—-” যাকে ভেবে তুমি কবরস্থানে যাও। এত মার খাও তার সত্যিটা তুমি জানো?”
আমি কাঁদতে, কাঁদতে বললাম,
—-” মানে?”
সামির তাচ্ছিল্য হেসে বললো।”
—-” এদিকে তুমি শুভ্রর কবরে যাচ্ছো কবর জিয়ারত করছো। আমার হাতে মার খাচ্ছো। আসলে তুমি জানো ওটা তোমার শুভ্রর কবর। যে কি না ২বছর আগে কার এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে এটাই জানো তুমি। ওদিকে তোমার গ্রেট শুভ্র রকস্টার হয়ে গান গেয়ে বেরাচ্ছে,
আমি অবাক হয়ে বললাম।”
—-” এসব কি বলছো তুমি?”
সামির গাড়ি ড্রাইভ করতে, করতে বললো,
—-” আমি ঠিকই বলছি রোজ। শুভ্র মারা যায়নি শুভ্র বেঁচে আছে। আর নিজের ক্যারিয়ার গড়তে ও ২বছর আগে লন্ডন চলে গিয়েছিলো। তুমি তো জানো ও কত ভাল গান গাইতো। আগে বাংলাদেশে প্রায় শো করতো ও। আর ওর গান শুনে লন্ডন থেকে ওর জন্য গানের অফার আসে। এরপরই ও লন্ডনে চলে যায়। আর সাহেল আঙ্কেলকে দিয়ে তোমার কাছে বলায় এক্সিডেন্টে ওর মৃত্যু হয়ে গিয়েছে। যাতে করে তুমি ওকে আর না খোজো। এতে তুমি ওকে ভুলও বুঝলে না আর ও দিব্যি নিজের ক্যারিয়ার গড়লো। আর এখন দ্যা গ্রেট ফেমাস রকস্টার এ।”
সামিরকে আর বলতে না রেগে বললাম,
—-” চুপ আর একটা মিথ্যে কথাও বলবে না। এতটা নিচে কি করে নামতে পারো তুমি? আরে উনি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো সামির। তার নামে এসব বলতে বাধছে না তোমার? একটা মৃত মানুষকে নিয়ে এসব বলছো?”
সামির আমাকে আর কিছু বলেনি কারণ আমরা রেস্টুরেন্টে পৌছে গিয়েছিলাম। আমি ওর কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তুু যখন দেখলাম সত্যিই শুভ্র বেঁচে আছে আর ও রকস্টার। তখন বুঝলাম সামির ঠিকই বলেছিলো। না চাইতেও আবার কেঁদে দিলাম। এরমাঝে সামির হুড়মুড় করে রুমে এলো। আমি ওকে দেখে ওর দিকে তাকালাম। ও এসেই আমাকে চর মেরে বললো।”
—-” রাতে কোথায় ছিলে তুমি? কোথায় ছিলে?”
বুঝলাম না তখন তো কিছু বললো না। হঠাৎ এখন রেগে গেলো কেন? আমি রেগে সামিরকে ধাক্কা মেরে বললাম,
—-” আমি আর এখানে থাকবো না। এতটা জানোয়ার তুমি কি করে হতে পারো?”
বলে দরজা পর্যন্ত এলাম তখনি সামির বললো।”
—-” ভেবে বলছো তো বেইব? এতদিন যার জন্য এখানে রইলে। এখন কি তার জন্য ভাববে না?”
আমি চট করে দাড়িয়ে গেলাম। সামির আমার সামনে এসে বললো,
—-” তাহলে কি তাকে শেষ?”
আমি সামিরকে থামিয়ে বললাম।”
—-” না তুমি এমন কিছু করবে না। আমি কোথাও যাবো না। তোমার মার খেয়েও এখানে থাকবো,
সামির শয়তানি হেসে বললো।”
—-” কামঅন বেবি এভাবে বলছো কেন? আমার কথা শুনলে আমি তোমাকে মারি নাকি?”
নিচ থেকে সামিরের ডাক পড়ায় ও চলে গেলো। আমি কাঁদতে, কাঁদতে বললাম,
—-” যাইহোক আমি এখানেই থাকবো। ওকে বাঁচাতে হলে আমাকে এখানে থাকতেই হবে।”
#চলবে…