#ভালবাসার এক রাত ❤
#লেখিকাঃ নাবিলা আহমেদ রোজ
#পর্ব- ১
আজকের তারিখটা মনে পড়তেই ভাবনায় ডুব দিলাম। এমন সময় কারো রোজ বলে ডাকায় সেদিকে তাকালাম। কন্ঠটা খুব বেশী পরিচিত আমার। মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। কিন্তুু তাকিয়ে মানুষটাকে না পেয়ে আবার ভাবতে লাগলাম। আমি কত বোকা মানুষ। উনি কি করে আমাকে ডাকবে? উনি তো আমাকে ফাকি দিয়ে চলে গিয়েছে। আজকের দিনটা আমার জন্য একটা কালো দিন। কারন আজকের এই দিনেই ২বছর আগে আমি সব হারিয়েছি। আমার জীবন থেকে আমি ভালবাসার মানুষ হারিয়েছিলাম। এসব ভাবতেই চোখদুটো জ্বালা করতে লাগলো। চোখদুটো হয়তো কান্না করতে চাইছে। তবে আমি চাই না চোখদুটো আর কান্না করুক। আর কত কান্না করবে চোখদুটো? যেই কান্না কেউ শুনতে পাবে না। যার কষ্ট কেউ বুঝবে না। তার কাঁদতেও নেই কষ্ট পেতেও নেই। এসব ভাবতে, ভাবতে একটা সাদা থ্রি পিচ পড়ে নিলাম। আমি নাবিলা আহমেদ রোজ। আপাতত আমার পরিচয় এতটুকুই। আজকাল আর নিজের কাছে নিজেকে ভাল লাগে না। কেমন যেন মনে হয় আমি পচে গিয়েছি। থ্রি পিচটা পড়ে নিচে নেমে এলাম। ড্রয়িংরুমে এখন কেউ নেই তাই ভালই হলো। বাইরে এসে ড্রাইভার চাচাকে বললাম।”
—-” চাচা মাজারে চলো,
ড্রাইভার চাচা আমাকে দেখে বললো।”
—-” তুমি আজকে আবার সাদা পড়েছো রোজ মা? স্যারতো আজকে আবার রেগে যাবে,
তাচ্ছিল্য হেসে বললাম।”
—-” এটাই আমার নিয়তি চাচা তুমি চলো,
এরপর আমি মাজারে চলে এলাম। মাজারে এসে ভেতরে এসে কতক্ষণ বসে রইলাম। মাজার থেকে বেরিয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে সামনে থাকা গাড়িতে উঠে বসলাম। এরপর ড্রাইভার চাচাকে ডেকে বললাম।”
—-” চাচা আজিমপুর চলো,
ড্রাইভার চাচা আমার কথামত আজিমপুর কবরস্থানের সামনে নিয়ে এলো। কারন উনি জানে আজিমপুর মানেই আমি কবরস্থানে আসার কথা বলি। গাড়ি থেকে নেমে পা টিপে, টিপে আমি একটা কবরের সামনে এসে দাড়ালাম। কবরটার সামনে আসতেই আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা পানি। এক হাতে আমি সেটা মুছে কবরটার চারপাশে একবার হেটে নিলাম। হাটা শেষে কবরটার উপর একটা গোলাপ ফুলের তোরা রেখে। এরপর দু হাত তুলে মোনাজাত করে। এবার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলাম। এখন হয়তো আমার হাউ, মাউ করে কান্নার কথা ছিলো। কিন্তুু গত ২বছরে আমি নিজেকে স্ট্রং করে নিয়েছি। আমি গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি আসতেই আমার পড়নে সাদা থ্রি পিচ দেখে সামির এক প্রকার রেগেই বললো।”
—-” তুমি আবার কবরস্থানে গিয়েছিলে?”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম। সামির রেগে বোম হয়ে বললো,
—-” কেন গিয়েছিলে?”
আমি ভীতু ভাবে বললাম।”
—-” সেটা তো তুমি জানোই,
সামির আমার সামনে এসে বললো।”
—-” তোমার সাহস বেড়ে গিয়েছে তাই না? ওকে কোন ব্যাপার না বেইব। আমি আছি তো আমি তোমার সাহস কমিয়ে দেবো,
__________________
আমি ভয়ে, ভয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। রুমে এসে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বিছানায় বসে পড়লাম। এক হাত দিয়ে চোখের পানি মুচছি। আরেক হাত দিয়ে একটা ছবি নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছি। এরমাঝে সামির আমাকে ডাকতে লাগলো। কিন্তুু আমি শুনেও সারা দিলাম না। সামিরের রাগটা সপ্তম আকাশে পৌছে গেলো। হনহন করে উপরে চলে এলো। এসেই দরজা ধাক্কা দিয়ে বললো।”
—-” রোজ এক্ষুণি দরজা খোলো বলছি,
আমি ভয় পেয়ে ছবিটা লুকিয়ে ফেলে। এরপর দরজা খুলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম। সামির রেগে আমার হাত চেপে ধরে বললো।”
—-” এই মেয়ে তোমার সাহস বেড়ে গিয়েছে? কখন থেকে ডাকছি শুনছিলে না কেন?”
আমি মিনমিন করে বললাম,
—-” সরি শুনতে পাইনি।”
সামির আরো রেগে বললো,
—-” কানে কি তুলো দিয়েছো?”
বলে আমাকে টেনে নিচে নিয়ে এলো। সামিরের মা সেটা দেখে সামনে এসে বললো।”
—-” সামির কি করছিস তুই? তুই ওকে এভাবে টেনে আনছিস কেন?”
সামির ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-” আমার বউয়ের সাথে আমি কি করবো। সেটা আমাকেই ভাবতে দাও আম্মু।”
আমি চোখ মুছে বললাম,
—-” আন্টি তুমি কিছু বলো না।”
সামির আমাকে টেনে নিয়ে। খাবার টেবিলে বসিয়ে বললো,
—-” এই সব খাবার খাবে। প্রতিদিন নাটক ভাল লাগে না আমার।”
আমি ভয়ে, ভয়ে করে বললাম,
—-” দেখো সামির আমি কিন্তুু তোমার।”
সামির চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,
—-” কি বলবে তুমি?”
আমি আর কিছু বললাম না। চুপচাপ খেতে শুরু করলাম। যদিও খাবার গলা দিয়ে নামছে না। তবুও ভয়তে শুধু গিলে যাচ্ছি। খাওয়া দেরী দেখে সামির চেঁচিয়ে বললো।”
—-” এত দেরী হচ্ছে কেন?”
সামিরের বাবা পাশ থেকে বললো,
—-” নিজের বউয়ের সাথে কেউ এমন করে?”
সামির হুংকার ছেড়ে বললো।”
—-” সেই কৈফিয়ত কি তোমাকে দেবো?”
আমি চুপ করে খেয়ে নিয়ে। খাওয়া শেষে রুমে যেতে গেলেই সামির বললো,
—-” আর কোনদিন তুমি কবরস্থান যাবে না ওকে?”
আনি তাকিয়ে বললাম।”
—-” কেন?”
সামির রেগে বললো,
—-” আমি বারন করেছি তাই। আমি তোমার স্বামী তাই। আমি যা বলবো তুমি তাই শুনবে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম,
—-” হাহ স্বামী হায়রে নিয়তি।”
এরপর আমি মাথা নিচু করে রুমে চলে এলাম। পরেরদিন সকালে আমি একটা সাদা থ্রি পিচ পড়েছি। ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে আসতেই সামির দেখলো। আর দেখে ভীষণ রেগে গেলো। একটানে ওড়না কেড়ে নিয়ে বললো,
—-” কোথায় যাচ্ছো?”
আমি আমতা, আমতা করে বললাম।”
—-” কবরস্থানে,
সামির ঠাটিয়ে আমাকে এক থাপ্পর মেরে বললো।”
—-” তোমাকে বারন করেছিলাম না আমি?”
আমি মাথা নাড়লাম। সামির গর্জন দিয়ে বললো,
—-” তাহলে কেন যাচ্ছো?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম।”
—-” কবর জিয়ারত করতে,
সামির আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো।”
—-” তোমাকে আর কতবার বলতে হবে? ওই ছেলের কবর জিয়ারত করবে না তুমি,
আমিও এবার রেগে বললাম।”
—-” কেন করবো না হ্যা? ওই ছেলেটা আমার ভরসা ছিলো। তাহলে কেন করবো না আমি?”
সামির আবারও আমাকে থাপ্পর মেরে বললো,
—-” ভরসা ছিলো তাই না? চলো তুমি আমার সাথে।”
বলে টানতে, টানতে রুমে নিয়ে এলো। আমি বারবার হাত ছাড়তে বলছি। কিন্তুু সে সব সামিরের কানে যাচ্ছে না। সামির আমাকে রুমে এনে ফেলে দিয়ে বললো,
—-” ওই ছেলের ভুত মাথা থেকে না নামা পর্যন্ত। তুমি এখানে এই রুমে আটকা থাকবে রোজ।”
আমি উঠে দাড়িয়ে বললাম,
—-” আমাকে জানি আটকে রাখলে। কিন্তুু আমার মন? আমার মন থেকে তুমি ওকে কি করে সরাবে?”
সামির হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো। আমি ফুপিয়ে, ফুপিয়ে কাঁদতে, কাঁদতে বললাম।”
—-” কেন হলো এমন? আমার সাথে এটা কেন হলো? আমিতো এমন কিছু চাইনি। ভাগ্য আমার সাথেই কেন বারবার খেলে? মাঝে, মাঝে মনে হয় ভাগ্যর একমাএ খেলার বস্তুু আমি। কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন?”
সামির এভাবে ২দিন আমাকে আটকে রেখেছে। ২দিন পর আমি একটা রিং পড়েছি। সামির এসেছে আমাকে ডাকতে। এসে দেখলো আমি ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়েছি। সামির এটা দেখে মুচকি হেসে বললো,
—-” পাগলি একটা।”
__________________
বলে আমাকে ডাকতে এলো। আর এসেই মাথা গরম হয়ে গেলো। আমার আঙুলে রিংটা দেখে সামির হনহন করে কিচেনে গেলো। এরপর টগবগে গরম এক মগ পানি নিয়ে এলো। আমার রুমে ঢুকে আমার হাত ধরে গরম পানির মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিলো। আমি চিৎকার করে উঠে বসলাম। আঙুল একদম ঝলসে গিয়েছে। সামিরের মা দৌড়ে এসে বললো,
—-” কি হয়েছে রোজ?”
সামির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।”
—-” যেটাই হোক তুমি যাও,
আমি কান্না করে যাচ্ছি। সামির ওভাবেই রিংটা খুলে বললো।”
—-” যে নেই তার দেয়া আংটি কেন পড়েছো?”
আমি মাথা নিচু করে আছি। সামির আংটি নিয়ে চলে গেলো। আমি মুখ চেপে কান্না করতে লাগলাম। সামির বাড়ি থেকে যেতেই আমি বেরিয়ে এলাম। সোজা সেই কবরস্থানে চলে এলাম। ওখানে এসে হাটুগেড়ে বসে কাঁদতে, কাঁদতে বললাম,
—-” ভাল লাগছে আমাকে এভাবে দেখতে? কেন চলে গেলেন আপনি আমাকে ফেলে? আপনাকে এত ভরসা করতাম। আপনিই তো আমাকে উইক না হতে বলেছিলেন। বলেছিলেন আমাকে সবার থেকে আগলে রাখবেন। তাহলে কেন চলে গেলেন? বলতে পারেন আর কত সহ্য করবো আমি? কেন আমার সাথে এমন হলো?”
এখান দিয়ে একটা কাজে সামির যাচ্ছিলো। আমাকে দেখে চিনতে সময় লাগলো না। গাড়ি থামিয়ে হনহন করে নেমে এলো। এসেই আমার চুলের মুঠি ধরলো। ব্যথায় আমি কুকিয়ে উঠলাম। সামির আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে এলো। নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো।”
—-” আজকে তোমার এমন হাল করবো। এখানে আসার কথা কল্পনাও করবে না,
আমি ভয়ে কাঁপছি রীতিমত। বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে সামির আমাকে টেনে নামালো। এরপর আমাকে টেনে উপরে নিয়ে এলো। আমার রুমে এসে দরজা আটকে নিজের প্যান্ট থেকে বেল্ট খুলতে লাগলো। এটা দেখে আমি ভয়ে বললাম!”
—-” আমাকে প্লিজ মেরো না,
সামির সে সব না শুনে। আমাকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো। আমি পাগলের মতো কান্না করছি। আমাকে মেরে সামির চলে গেলো। আমি অনেক কষ্টে খুড়িয়ে উঠে। সেই লুকানো ছবিটা বের করলাম। সেটাতে হাত বুলাতে, বুলাতে বললাম,
—-” কেন এভাবে চলে গেলেন? আমাকে একা করে দিয়ে কেন চলে গেলেন শুভ্র? আমি যে বড্ড একা হয়ে গিয়েছি। আমাকে ফেলে কেন সবাই চলে গেলো? আমি আর পারছি না এভাবে থাকতে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে শুভ্র।”
বালিশে মুখ লুকিয়ে কান্না করছি। জানি কেউ চোখের পানি মুছে দিতে আসবে না। কিন্তুু আজকে খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে। আর উপরওয়ালাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে,
—-” হে আল্লাহ কেন করলে এমন? আমার থেকে কেন সবাইকে কেড়ে নিলে? আমার ফুলের মতো জীবন ছিলো। ছিলো না কোন কষ্টের ছোঁয়া। তাহলে কেন আমার ফুলের মতো জীবনে বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দিলে? তোমার ভান্ডারে তো কোনকিছুর অভাব নেই। তাহলে কেন আমাকে এত বঞ্চিত করলে আল্লাহ কেন?”
চলবে…!
#ভালবাসার এক রাত❤
#লেখিকাঃ নাবিলা আহমেদ রোজ
#পর্ব- ২
শুভ্র তো আগেই ছেড়ে গিয়েছে। এরপর এক, এক করে সবাইকে হারালাম। কেউ থেকেও আমার কাছে নেই। আমি কাঁদতে, কাঁদতে সত্যিই এখন ক্লান্ত। কারণ এই ২বছরে তো আর কম কাঁদিনি। কেউ আসেনি আমার চোখের পানি মুছে দিতে। নিজেই কেঁদেছি আবার নিজের চোখের পানি নিজেই মুছেছি। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আজও কাঁদার পর নিজের চোখের পানি নিজেই মুছলাম। সারা শরীর ব্যথা করছে খুব। খাটের এক কোনা ধরে বিছানায় বসলাম। হাতে দাগ হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে আগের মারের দাগগুলোও বোঝা যাচ্ছে। কোনরকম দাড়িয়ে ওয়াসরুমে চলে এলাম। ঝর্ণা ছাড়তেই প্রচন্ড জ্বলতে শুরু করলো শরীর। মনে হচ্ছে আঘাতের দাগগুলোগে কেউ লবন ছিটিয়ে দিয়েছে। জানিনা এভাবে আর কতদিন এসব সহ্য করবো আমি। কিন্তুু আমি যে চাইলেও কিছু করতে পারবো না। শাওয়ার নিয়ে রুমে চলে এলাম। আয়নার সামনে দাড়িয়ে থ্রি পিচের চেইন লাগাতে গেলেই পিঠের দাগগুলো চোখে পড়লো। সামিরের মারের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পিঠে কালসিটে দাগ হয়ে গিয়েছে। চেইনটা লাগিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। আজ কেউ নেই আমার সাথে। আম্মু, বাবাই, ভাইয়া কেউ না। বড্ড মিস করি ওদের আমি। মানুষের জীবনের মোর যে এক নিমিষে পাল্টে যায়। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই আমি। হ্যা আমার জীবনটা এমন ছিলো না। আমিও সবার মতো খুব ভাল ছিলাম। সবার মতো আমারও একটা ফ্যামিলি ছিলো। ভালবাসার মতো সবাই ছিলো। আর ছিলো শুভ্র কিন্তুু আজ কেউ নেই। যে আমি শরীরে একটা পিপড়া কামড়ালে সারা বাড়ি মাথায় তুলতাম। সেই আমি এখন প্রতিদিন মার খাই। যেই আমি কখনো কান্না করিনি। সেই আমার এখন কান্নারা নিত্যদিনের সাথী হয়ে গিয়েছে। সত্যিই জীবন বড়ই বিচিত্র। এসব নিয়ে ভাবতে, ভাবতে আপনাআপনি চোখদুটো বুজে এলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালই করিনি। ঘুমের মাঝে মনে হচ্ছে কেউ ডাকছে।”
—-” রেড রোজ ওঠো আর কত ঘুমাবে? তুমি এত ঘুম পাগলি কেন?”
ধপ করে উঠে বসলাম। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কাউকে পেলাম না। আমার স্পষ্ট মনে হলো উনি আমাকে ডাকলো। একমাত্র উনিই তো আমাকে রেড রোজ বলে ডাকে। বিছানা থেকে নেমে পুরো রুম খুজতে শুরু করলাম। তন্ন, তন্ন করে খুজেই যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমার কোনকিছুর হুশ নেই। রুম, ব্যালকনির প্রতিটা কোনা খুজছি। হঠাৎ আমার মনে পড়লো উনি কি করে আমাকে ডাকবে? উনিতো আর আমার কাছে নেই। উনিতো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। কাঁদতে, কাঁদতে চেঁচিয়ে বলছি,
—-” আপনি কেন চলে গেলেন? আপনি এমন কেন করলেন আমার সাথে? আমার কি দোষ ছিলো? আপনি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আমার পুরো জীবন নরক হয়ে গেলো। আর যখন চলেই গেলেন তাহলে এভাবে কেন আমাকে জ্বালান? কেন আমার মনে হয় আপনি আমার কাছে আছেন? আর কেনই বা আমি আপনাকে দেখতে পাই না?”
______________
আমি কাঁদতে, কাঁদতে বসে পড়লাম। এমন সময় সামির আমার রুমে এলো। এসে আমাকে এক ধমক দিয়ে বললো।”
—-” এসব কি হচ্ছেটা কি?”
সামিরের ধমক শুনে ভয়ে কুকিয়ে গেলাম। সামির এসে আমার সামনে দাড়িয়ে বললো,
—-” তোমার কি আবার মার খেতে ইচ্ছে করছে?”
আমি ভয়ে কেঁপে উঠে বললাম।”
—-” না আমাকে আর মেরো না,
সামির শয়তানি হেসে বললো।”
—-” তাহলে চুপচাপ থাকো। আর আমি যা বলবো সেটাই করো ওকে?”
আমি ভয়ে মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। সামির আমার পাশে বসে বললো,
—-” আমি তোমার স্বামী বেইব। কিন্তুু তুমি আমার একটা কথাও শোনো না। জানো তো আমার কথা না শুনলে আমি রেগে যাই। তাহলে কেন আমার কথা শোনো না বলো। আর আমিও রেগে গিয়ে তোমাকে মারি। ইউ নো হোয়াট বেইব? তোমাকে মারতে আমার ভাল লাগে না। কিন্তুু তুমি তো জানো আমার রাগ কত বেশী। তাই তুমি এমন কিছু করো না যাতে আমি রেগে যাই ওকে? স্বামীর কথা শোনো বেইব।”
সামির রুম থেকে চলে গেলো। আর আমি তাচ্ছিল্য হেসে ভাবছি,
—-” যাকে ভালবেসে পেতে চেয়েছিলাম সে চলে গেলো। আর যাকে এত ঘৃনা করি আমি সে কি না নিজেকে আমার স্বামী বলে। অথচ তার সাথে আমার বিয়েই হয়নি। জাস্ট নিজের রাগে আমাকে পেতে আমাকে বউ বলে সবার কাছে। আর আমি কাউকে কিছু বলতেও পারিনা। তাহলে যে আমি বেঁচেও জিন্দা লাশ হয়ে যাবো। হ্যা বাঁচবো কারণ আত্মহত্যা যে করতে পারবো না সেটা যে পাপ। তাই তো আমি মুখ খুললে জিন্দা লাশ হয়ে বাঁচতে হবে। যার জন্য দু দুটো বছর এতকিছু সহ্য করছি। আমার সেই সব আশা ভেস্তে যাবে। আর আমি এটা হতে দিতে পারিনা।”
পরেরদিন বিকেলে একটা লাল ওড়না হাতে নিয়ে বসে আছি। যদিও ওড়নাটা ছেড়া কিন্তুু আমার কাছে এটা অনেককিছু। এরমাঝে সামিরের ভয়েস শুনে ওড়নাটা লুকিয়ে ফেললাম। কোথাথেকে সামির এসে বললো,
—-” রোজ রেডি হয়ে নাও আমরা বের হবো।”
আমি বইটা রেখে বললাম,
—-” কোথায় যাবো আমরা?”
সামির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।”
—-” তোমাকে কি এখন কৈফিয়ত দিতে হবে?”
আমি ভয় পেয়ে বললাম,
—-” আমি রে্ রেডি হয়ে আসছি।”
সামির হনহন করে নিচে নেমে গেলো। আমি রেডি হয়ে নিচে এলাম। এরপর সামির আমার হাত ধরে নিয়ে গাড়িতে বসালো। গাড়ি এসে থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সামির আবার আমার হাত ধরেই ভেতরে এলো। এখানে কয়েকজন লোককে দেখতে পেলাম। দেখে মনে হচ্ছে সামিরের অফিসের ক্লায়েন্ট হবে। সামির ওনাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললো,
—-” মিট মাই ওয়াইফ রোজ।”
আজকে আমার রাগটা কন্ট্রোল হলো না। আমি রেগে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
—-” নো আই এম নট ইউআর ওয়াইফ।”
সবাই আমার দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি এবার সবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-” ইয়েস আপনারা ঠিকই শুনেছেন। আমি সামির খাঁনের ওয়াইফ নই। ইনফ্যাক্ট আমি কারোর ওয়াইফ নই আই এম আনম্যারিড।”
হঠাৎ সামির হু হা করে হেসে দিলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সামির হাসতে, হাসতে বললো,
—-” সিরিয়াসলি বেইব তুমি দারুন মজা করেছো।”
______________
সবাই অবাক হয়ে বললো,
—-” মজা মানে?”
সামির হাসি বন্ধ করে বললো।”
—-” আসলে আমি ওকে এই মজাটা করতে বলেছিলাম। আমার বউ খুব মজার মানুষ। আমার সাথে এত ফান করে কি বলবো? তাই বললাম ক্লায়েন্টদের সামনে পারলে ফান করে দেখিও। ও যে এমন একটা ফান করবে ভাবিনি,
সবাই হেসে বললো।”
—-” আসলেই উনি মজার মানুষ। বাট আমরা কিন্তুু চমকে গিয়েছিলাম,
আমি শকড হয়ে বললাম।”
—-” কিন্তুু আমি কোন মজা,
এরমাঝে সামির আমার হাত ধরে বললো।”
—-” আজ আসি,
বলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। আমাকে টেনে এনে গাড়িতে ফেললো। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গিয়েছে। বলে তো দিলাম সত্যিটা এখন কি হবে? সামির কি আমাকে মেরে ফেলবে? মেরে ফেলুক তবুও শান্তি পাবো। এমন নরকময় জীবন থেকে মুক্তি পাবো। কিন্তুু ও তো আমাকে মারবে না। না জানি আজকে কি করবে আমার সাথে? এমন সময় গাড়ির দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ভাবনা থেকে ফিরলাম। চারদিক তাকিয়ে চমকে গেলাম। একদম নির্জন একটা রাস্তায় সামির এসেছে। আর এখন রাতও হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সামির আমাকে ধাক্কা মেরে বের করে দিলো। আমি ব্যালেন্স রাখতে না পেরে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়লাম। সামির গাড়ির দরজা বন্ধ করে বললো।”
—-” আজ যা করেছো ঠিক করোনি। আর এটার শাস্তি হচ্ছে আজ রাত তুমি এখানেই থাকবে,
ভয়ে আমি শিউরে উঠে কেঁদে বললাম।”
—-” না আমি এখানে থাকবো না সামির,
তারআগেই সামির গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। আমি কাঁদতে, কাঁদতে রাস্তায় বসে পড়লাম। ইচ্ছেমতো কাঁদছি আমি এ ছাড়া কি করার আছে? এখানকার কিছু চিনিনা আমি কোথায় যাবো? তবুও উঠে হাটা ধরলাম। এরমাঝে বৃষ্টি শুরু হলো। ভয়ে মনে হচ্ছে জান বেরিয়ে যাবে। কারণ সামনেই কতগুলো ছেলে আসছে। আমি এখন কি করবো? ওরা যদি খারাপ হয় তখন? এদিকে আমার থ্রি পিচটা ভিজে গিয়েছে। ভাবনার মাঝেই ছেলেগুলো আমার সামনে চলে এলো। ওদের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওরা খারাপ। আমি পাশ কাটিয়ে চলে আসতে গেলেই একজন বললো।”
—-” কোথায় যাচ্ছো সুন্দরী?”
ভয়ে আর ঘৃনায় গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। আমি না থেমে চলে আসতে গেলেই ওরা সামনে চলে এলো। আমার চারপাশে ঘুরছে আর বাজে কথা বলছে। আমি আবার দৌড় দিতে গেলেই একজন আমাকে ধরে ফেললো। আমার সাথে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করছে। আমি মনে, প্রানে আল্লাহকে ডাকছি। একমাত্র আল্লাহই পারে আমাকে বাঁচাতে। হঠাৎ পায়ে কিছু বাজলো। তাকিয়ে বুঝলাম ইট বা পাথর হবে। নিচু হয়ে তুলেই ছেলেটাকে বারি মেরে দৌড় দিলাম। রাস্তা দিয়ে প্রানপনে দৌড়াচ্ছি। ছুটছি আর ছুটছি কোথায় যাচ্ছি জানিনা। শুধু জানি আমার ইজ্জত বাঁচাতে হবে। জামার হাতা ছিড়ে ফেলেছে জানোয়ারগুলো। ওড়নাটা গায়ে পেঁচিয়ে আবার দৌড় দিলাম। কোথায় চলে এসেছি জানিনা। সামনে তাকিয়ে অনেক মানুষ দেখলাম। একটু দুরেই একটা ৫তলা বিল্ডিং। যেটাতে লেখা আছে গ্রাউন্ড নাইটক্লাব। আর পুরো ক্লাবটা ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো। তাছাড়াও নানান ধরনের লাইটিং করা। আর কি নাম দিয়ে যেন ওয়েলকাম লেখা। নামটাতে এখনো লাইট জ্বলেনি তাই বোঝা যাচ্ছেনা। এরমাঝে কয়েকটা গাড়ি এসে ক্লাবে ঢুকলো। আর সাথে, সাথে ক্লাবের সবাই বেরিয়ে এলো। মাঝের গাড়িটা থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এলো। যার পিঠ দেখা যাচ্ছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভিআইপি কেউ। ছেলেটা সবাইকে সরিয়ে ভেতরে গেলো। আমি অন্যদিকে ফিরে দাড়িয়ে আছি। ভেতর থেকে সবার চিৎকার আসছে। সবাই মিলে চেঁচিয়ে বলছে রকস্টার এসআর। আর ওখানেও লেখা ওয়েলকাম এসআর। কিন্তুু এই এসআর কে?”
________________
ধীর পায়ে হাটতে গিয়েও থেমে গেলাম। আর শরীরে শক্তি নেই আমার। ক্লাবের বাইরে গাছের নিচে ধপ করে বসে পড়লাম। তখনি কানে এক মিষ্টি আওয়াজের গান ভেসে এলো,
🎶হোওওও, হোওওও, হোওওও, হোওওও🎶
🎶না রে নান না রে নান না রে না না না🎶২
🎶একাকী মন আজ নিরবে🎶
🎶বিভাগী তোমার অনুভবে🎶
🎶ফেরারী প্রেম খোজে ঠিকানা🎶
🎶আকাশে মেঘ মানে বোঝো কি না🎶২
🎶বিরহ নীলে, নীলে বাধে বাসা অজানা ব্যথা🎶
🎶অধরা তারাগুলো কাঁদে বেদনা খেয়ালী তুমি কোথায়🎶
🎶না রে নান না রে নান না রে না না না🎶২
🎶হোওওওও, হোওওও, হোওওও, হোওওও🎶
এদিকে ক্লাবের ভেতরে সবাই হা করে গান শুনছে। মেয়েরা তো রীতিমত ছেলেটাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। ছেলেটার পড়নে ফুল ব্লাক ড্রেস। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। ডার্ক রেড ঠোটের নিচেই কালো তিল। তিলটা থুতনির নিচে। কপালে একটা রেড কালার কাপড়ের মতো কিছু বাধা। তার উপর দিয়ে সিল্কি চুলগুলো পড়ে আছে। চোখদুটোর কালার হালকা ব্রাউন। গলায় গিটার ঝোলানো স্টেজে ঘুরে, ঘুরে গান গাইছে। ঘায়েল করা লুকে মেয়েরা তো ফিদা সাথে ছেলেরাও হা করে তাকিয়ে আছে।”
🎶দিনের আলো শেষে যখন রাত নামে🎶
🎶তোমাকে খুজে পাই আধারের শিরোনামে🎶
🎶বিরহ নীলে, নীলে বাধে বাসা অজানা ব্যথা🎶
🎶অধরা তারাগুলো কাঁদে বেদনা খেয়ালী তুমি কোথায়🎶
🎶না রে নান না রে নান না রে না না না🎶২
ছেলেটা চোখ বন্ধ করতেই কিছু চোখের সামনে ভেসে এলো। সাথে, সাথে চোখ খুলে জোড়ে গিটার বাজাতে লাগলো। যার জন্য সিল্কি চুলগুলো কপালে আচড়ে পড়ছে,
🎶নিথর চোখের কোনে অথৈ শূন্যতা🎶
🎶ভাবনার বন্দরে রাত জাগে অপূর্ণতায়🎶
🎶বিরহ নীলে, নীলে বাধে বাসা অজানা ব্যথা🎶
🎶অধরা তারাগুলো কাঁদে বেদনা খেয়ালী তুমি কোথায়🎶
🎶না রে নান না রে নান না রে না না না🎶২
এদিকে আমি অস্থির হয়ে উঠতে চাইছি। কারণ এই সুর যে আমার চিরচেনা সুর। কিন্তুু শরীরে এক বিন্দু শক্তি কাজ করছে না। একবার আমি গিয়ে দেখতে চাই আমি ঠিক ভাবছি কি না? উঠতে না পেরে হেচড়ে যেতে লাগলাম। একটা পিলার ধরে উঠে দাড়ালাম। এরমাঝে দেখলাম সেই ছেলেটা বেরিয়ে আসছে। আর তার সাথে অনেকগুলো কার্ড। ছেলে-মেয়েরা অটোগ্রাফ নিচ্ছে। লোকটা বের হতেই মিডিয়ার লোক ঘিরে ধরলো। এটা, ওটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে লোকটাকে। কিন্তুু লোকটা কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। শেষে একজন বলে উঠলো।”
—- স্যার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আজ পর্যন্ত আমরা আপনার যতগুলো শো দেখেছি। সেটা বাংলাদেশে হোক বা বিদেশে। প্রত্যেকটা শোতেই আপনার কপালে এই কাপড়টা বাধা দেখেছি কিন্তুু কেন? এই প্রশ্নটা শুধু আমাদের না আপনার সব ফ্যানসদের। এটা কেন আপনি নিজের সাথে রাখেন? প্লিজ স্যার এই প্রশ্নের উত্তরটা দিন,
লোকটা হালকা হেসে বললো।”
—-” এই প্রশ্নের উত্তরটা তোলা থাক। যখন টাইম আসে আমি নিজে উত্তরটা দিয়ে দেবো। নাউ এক্সকিউজ মি,
আমি লোকটাকে ডাকতে চাইছি। কিন্তুু আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। আমি খুব করে তাকে ডাকতে চাইছি। আমার একটু সামনে দাড়ানো। পিলারটার জন্য হয়তো আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। একটু শক্তি জোগাড় করে ডাকতে গিয়েও থেমে গেলাম। মনে পড়লো এ কাকে ডাকছি আমি? যে কি না ২বছর আগে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তাকে? ডাকতে গিয়েও থেমে গেলাম। পিছন ফিরে চলে আসতে চাইলাম। কিন্তুু সেই শক্তিটুকু আর নেই আমার মাঝে। মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগলো। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি। দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু নেই আমার। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মাথা ঘুরে নিচে পড়ে গেলাম। মাথায় খুব ব্যথা অনুভব করে চেঁচিয়ে উঠলাম। খেয়াল করলাম লোকটা গাড়িতে উঠতে গিয়েও থেমে গেলো। এরপর চোখদুটো বন্ধ হয়ে এলো।”
#চলবে…