ভাবিনি ফিরে আসবে পর্ব-১৫

0
1073

ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১৫
রোকসানা আক্তার

রুমে এসে বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি।
ক্লিংব্লিং আমার ফোনে কল বেঁজে উঠে।নাম্বারটি দেখে আননউন মনে হলো।বুঝে উঠতে পারছি না কলটি রিসিভ করব কি করব না।
অতঃপর দ্বিধা নিয়ে কলটি রিসিভ করি।।
-হ্যা-হ্যা-হ্যালো?
-এই পুচকা, তাড়াতাড়ি গেইটের কাছে আয়।

কন্ঠস্বরটা শুনে আমি চমকে যাই।কতটা মাস পর আজ শিমলার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ভীষণ মিস করেছিলাম প্রিয় এই ভয়েসটিকে।।
-শি-শিমলা,তুই!?
-আরেহ,বাবা!!এত্ত ঢংবং না করে একটু এখানে এসে গেইটটা খুলবি??
-তুই আমাদের বাড়ি আসছিস,শিমলা??
-হ্যাঁ-রে হ্যাঁ।পা,হাত ব্যথা হয়ে গেছে গেইটের সামনে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে।।
-ম-মানে??দারোয়ান চাচা ওখানে নেই??
-কি জানি,দেখতে পাচ্ছি না।তুই নেমে আয়য়।।

আমি কলটি কেটে তড়িঘড়ি শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বেরিয়ে পড়ি।গেইটের কাছে আসতেই দেখি দারোয়ান চাচা নাক ঢেকে নির্বিঘ্নে ঘুমচ্ছে।আর সেইসঙ্গে উনার বিশাল ভুঁড়িটা উঠানামা করতেছে।
সোহানার হাতে রাঁধা ডিমের চড়চড়ি আর ইলিশের কোরমা খেয়ে পেটটা এখন হাতি।
উনার একটা দিক দেখলে খুব হাসি পায়।উনি যখন উনার সুস্বাদু খাবার কাছে পান,তখন গরুর মতো গিলতে শুরু করেন।আজও তাই করেছেন,তার উপর সোহানার হাতের রান্না,সেই!!এমন ঘুমে আচ্ছন্ন মনে হয়বা সকাল ছাড়া আর জাগবেন।যাইহোক,বেচারীকে আর বিরক্ত না করে আমিই গেইট খুলতে যাই।
গেইট খুলেই শিমলাকে দেখতে পাই।সাদাসিধে মুখটায় শিমলার মৃদু হাসি লেগে আছে। হালকা ছাই কালারের একটা শাড়ি পড়ে এসেছে,চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা পড়া।দেখে মনে হয়,কোনো এক যুবতী সহস্র যুগ পাড়ি দিয়ে প্রিয় কারো সাথে দেখা করতে এসছে।।
শিমলার থেকে চোখ সরিয়ে তার বাম পাশে দেখতে পাই সাথীকে।।

সাথীকে দেখে আমি অনেকটা ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যাই।সাথী আগ থেকে অনেকটা লম্বা হয়ে গিয়েছে এবং সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বেড়েছে,চোখে-মুখে লজ্জ্বার আভা,বড় ঘোমটা টেনে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে।মেয়েটির মাঝে চাঞ্চল্যকর কোনো আভাস দেখতে পেলাম না।আগে যেমনটি ছিল,এখন সম্পূর্ণ উল্টো।

-আমাদের দেখে মনে হয় ভীষণ অবাক হচ্ছিস??
আমি ধ্যাণ দেখে বেরিয়ে বলি,
-কেমন আছিস তোরা দু’জন??

শিমলা মুচকি হেসে বলে ভালো আছি।কিন্তু সাথী একটু টু শব্দ না করে শিমলার সাথে সম্মতি দিয়েই মাথা নাড়ে শুধু। শিমলার এই বিহেভে আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই!!এই দু’বছরে মেয়েটির মধ্যে এতটা চ্যান্জ সত্যি তা আমার ধারণার বাহিরে ছিলল!!পরে আর কিছু না বলে ওদের হাত থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিই।
সবাই বাড়ির দিকে পা বাড়াই। শিমলা হাঁটে আর শান্ত ধীরে বলে,
-যখন আন্টির থেকে শুনলাম তুই বাড়ি আসছিস,তখন এখানে আসার জন্যে আমার মন পাগলের ন্যায়।কখন আসবো,কখন আসবো এবং তোর সাথে কখন দেখা করবো।এমন একটা অস্থিরতা ছিল মনে।।না সাথী?

সাথী মাথানিচু করে হালকা মাথা নেড়ে শিমলাকে সম্মতি দেয়।
-আর হ্যা,শাওন শোন??আমি এখানে আসার জন্যে যতটা না হাইপার হলাম,এই সাথী ততটাই বিরক্ত!!বুঝলি??

আমি হতভম্ব শিমলার কথায়!!আসলেই শিমলা সত্য বলছে।সাথী এখন আর আগেই সেই ছুট্রি সাথী নেই!!আমি শিমলার কথায় উওর না দিতে পেরে মুঁচকি হাসি।সাথী শিমলার কথায় ক্ষাণিকটা রাগ হয়ে ভার গলায় বলে,
-আপু,তুমি না…?

এরইমধ্যে আমরা ঘরে প্রবেশ করি।মা,কাকিমা শিমলা এবং সাথীকে দেখে বুকে জড়িয়ে নেয়।।ওদিক দিয়ে সোহানাও ভারী খুশি ওরা আসাতে।
সবাই মিলে বসার ঘরে উৎফুল্ল মনে লাফিয়ে বসে পড়ে এবং নানান ধরণের গল্পগুজব,হাসি-ঠাট্টায় জমিয়ে বসে।আসলে,একে-অপরকে অনেক দিন পর দেখছে তো তাই মায়াটা একটু এইমুহূর্তে বেশিই কাজ করছে।আমি আর ওদের সামনে না দাড়িয়ে থেকে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই মা বলে উঠেন,
-এই শাওন,এখন কয়টা বাঁজে??
আমি ঘড়ির দিকে তাকাই এবং ছোট স্বরে বলি,
-এইতো ১০ টা।
-তো নিজ রুমে যাচ্ছিস কেন?ডিনার করবি না??
-হু।আচ্ছা তোমরা আগে কথা বলো পরে খাওয়াদাওয়া করবো সবাই।
-আরেহ না!!আন্টি প্লিজজ পেটটা পুরো ফাঁকা।৭৫০ কিলোমিটার পথ জার্নি করে নাউ সো ক্ষুধা।ডিনারটা শেষ করে তারপর গল্প,ওকে?(শিমলা)

শিমলার কথা শুনে আমরা সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠি।কাকিমা বলেন,
-গল্পতো অবশ্যই।ডিনারের পর আমাদের শাওনের জন্যে একটা দারুণ সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।সো ডিনারটা সেরেই সারপ্রাইজ। আমার আর তর সইছে না।প্লিজজ কাম অন অল ইন দ্য ড্রাইনিং??

-আগে তো ফ্রেশ আপু,তারপর খাওয়া।(সাথী)
-ওহ,হ্যাঁ হ্যাৃ।(শিমলা)
-শিমলা আপু ক্ষিধার ছোটে সব ভুলে গেছে। (চোখ টিপে সোহানা বলে)
শিমলা অভিমানের স্বরে বলে উঠে,
-সবাই আমার মুখটা আর রাখলে??চলরে সাথী আগে আমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।
-হিহিহি হিহিহি।
তারপর কাকা,বাবা,আঙ্কেল সবাই মিলে ডিনারটা করে নিই।কাকিমার আর্জি খাওয়া শেষ হলে কেউ যেন চেয়ার ছেড়ে না উঠে।
খাওয়া শেষে সবাই দৃঢ় প্রত্যয়ে চেয়ারে গা গেঁড়ে বসে থাকে।কাকা কাকিমাকে ইশারা করে বলে উঠেন,
-তুমি শুরু করবে নাকি আমি??

কাকিমা গলা ঝেড়ে বলেন,
-তুমিই বলো।।
-আজকে একটা উদ্দেশ্যেই সবাইকে গোল মিটিং এ ডাকা।সবাইতো মিসেস সোহানাকে চিনেন,রাইট??আমি,রিয়াজুল ভাই, আসলাম ভাই,আপা(আমার মা) এবং শাওনের কাকিমার সম্মতিতে শাওনের হাতে সোহানাকে তুলে দিতে চাই।।আমরা এ ব্যাপারে সবাই দৃঢ় আগ্রহী।শাওন?এটাই তোমার জন্যে সারপ্রাইজ।আর এই সারপ্রাইজটি পেয়ে তুমি উই থিংক ইউ আর সো হ্যাপী!(কাকা)

আমি কাকার কথায় কিছু না বলে চুপসে থাকি।অতি আনন্দে এখন আমি পাথর।সোহানা কিছুক্ষণ আগে কি ভয় টাই না আমায় পাইয়ে দিল!!
শিমলা খুশির তালে ধুকধুকি বাঁজাতে থাকে।
-ইয়েস,ইয়েস,অনেক ভালো একটা সারপ্রাইজ । অবশ্য,আমি গ্রিফট পাওনা আছি সোহানা এবং শাওনের থেকে।কারণ,ওদের এতটা পথ পাড়ি দেওয়া অনলি ফর মি।।

তারপর কাকিমা বলেন উঠেন,
-সেদিন সোহানার বেডরুমে শাওনের জন্যে লিখা ডায়েরী যদি চোখে না পড়ত,নাহলে দু’টো ভালোবাসাকে আমরা হত্যা করে ফেলতাম।আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সোহানার মনের অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করি তার আদৌ কি শাওনের জন্যে কষ্ট হচ্ছে???যখন সোহানাকে বধু সাঁজে একা রুমে বসে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতেছিল,তখনই আমার সন্দেহ ক্লিয়ার হয়।আর তখনই আমি আমার বোনের ছেলেকে বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে বিয়েটা ঠেকাই।অতঃপর রিয়াজুল ভাইও বুঝতে পারেন তার মেয়ে অন্যকাউকে ভালোবাসেন,তিনিও মেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আমার বোনদের বিয়ের লগ্নেই বিদেয় করেনন।অবশ্য,বিয়েতে একধরনের হট্টগোল ঘটে যায়,সাডেনলি বিয়ে বন্ধ করায়।নানান মানুষ সোহানাকে,রিয়াজুল ভাইকে নানান কথা বলেছিল।।তারপরও আমি আমরা যথেষ্ট চেষ্টায় অব্যাহত,স্বপ্নকে কখনো মরতে দিতে পারি না।।।

আমি কাকিমার মুখের দিকে তাকালে যেন উনাকে আমার দ্বিতীয় মা মনে হয়।নিজের বোনের ছেলের কথা না ভেবে আমার কথাই ভেবেছেন।কাকা-কাকিমা আমায় এত্ত ভালোবাসেন,সত্যি আগে জানতাম না।এ ভাবতেই আমার চোখে পানি চলে আসে।কেউ দেখবার আগেই মাথানিচু করে পানিটুকু মুছে নিই।।
কাকিমা আবারও বলে উঠেন,
-আমাদের বিয়ের পর আমরা দু’জন নিঃসন্তান।সন্তান বিহীন একজন মা অচল।তবে,সন্তান না হওয়ার বেদনা একটু ক্লান্তি করলেও আমি শাওনের মুখটি দেখলে তা ভুলে যেতাম।কারণ,শাওনের মুখটি একবার দেখলেই মনে হয় শাওন যেন আমার পেটের উদরেরই সন্তান।।জানি না ওর প্রতি কেন আমাদের এত টান।।

এ বলে কাকিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের পানি মুছে নেন।
আমি কাকিমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকি।।আর সোহানার দিকে দেখি।ও লজ্জ্বায় ভীষণ লালচে,এখনই যেন টেবিলের নিচে লুকিয়ে যায় এমন অবস্থা।আমি ওর দিকে একপলকে তাকিয়েই থাকি।দেখি মেয়েটির এত্ত লজ্জা কোথায় রাখে।যখনই ও কাকীর দিকে নজর দেয়,তখনই আমার চোখ বরাবর ওর চোখ পড়ে যায়।ও আর বসে থাকতে না পেরে তড়িঘড়ি বলে উঠে,
-আমি একটু আসছি।আর্জেন্ট কল আসছে একটা।।
এ বলে তরহর গো।সবাই খিলখিল করে হেসে উঠে।।কারণ,সবাই বুঝে যায় সোহানা যে লজ্জা পেয়েছে।আমিও ইদানীং সোহানার চলন-বলনে হতভম্ব !! দু’টো বছরের ব্যবধানে ও অনেকটা লাজুক হয়ে গিয়েছে।।

হুট করে সাথী কাউকে কিছু না বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। কাকা বলেন,
-আরেহ সাথী,কোথায় যাচ্ছ? এখনো তো আমাদের সভা শেষ হয়নি।
-আঙ্কেল আমার বাথরুমে যেতে হবে।।আসি।।

সাথীও উধাও!!তবে সাথীর মুখের চাহনী অন্যকিছু বলছে।ওর মুখে আমি বিষণ্নতার ছাপ খুঁজে পাই।যদিও তা সবার চক্ষু আড়ালে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে