ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১৩
রোকসানা আক্তার
তারপর আমি নিবু নিবু পায়ে হেঁটে জেলের বাহিরে চলে আসি।থানার দারোগা কাকা হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন আমার সামনে দাড়িয়ে থাকা কিছু প্রাণীকে।। আমি উনাকে অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখতে পাই আমার সেই আদুল মাখা মায়ের মুখখানা।মা আমাকে দেখে মুঁচকি হেঁসে দেন।মায়ের চোখদুটো ঝলঝলে যেন শতযুগ পর ছেলেকে তার কাছে পেয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, বাবাকে দেখতে পাই।বাবা মৃদু হেঁসে হাতদুটো ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছেন।তারপর, দেখতে পাই আমার সেই উকিল সাহেবকে যিনি আমায় এই বিমর্ষ জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছেন।।
দৌড়ে গিয়ে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরি।অতি খুশির তালে আমার চোখদুটো পানিতে ভরে যায়।।
-বাবা,আজ এই উকিল ভাইয়ের জন্যে তোকে আমাদের কাছে ফিরে পেয়েছি।(মা)
বাবাও মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে আমার পিঠে হাত বুলান।পরে,আমরা সবাই মিলে বাড়িতে আসি।বাড়িতে আসতেই চারদিকটা চোখ বুলাই।পুরো বাড়ি মানুষ বিহীন শূণ্য খা খা লাগছে।কোথা থেকে ছকিনা খালা দৌড়ে এসে বলেন,
-ছোট সাহেব, আপনে আইছেন?অনেকদিন পর দেখলাম আপনেরে।
-কেমন আছেন,খালা??
-হ সাহেব ভালা আছি।
মা? সাথী,শিমলা,পাবাজ,ফাহাদ ভাই কাউকে যে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় সবাই??
মা আমার কাছে এসে বলেন,
-বাবা,শিমলার ঢাকায় সোনালী একটা ব্যাংকে চাকরি হয়েছে।সাথীও শিমলার সাথে। সাথী শিমলার সাথে ওখানে থেকে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তেছে।আর পাবাজ বিদেশ চলে গিয়েছে।।
-আর ফাহাদ ভাইয়া??
ফাহাদ ভাইয়ার কথা বলাতে মা অনেকটা এড়িয়ে যান।পরে বলেন,
-বাবা, তুই এখন খুব ক্লান্ত।আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,
-সবাইকে ছাড়া শূন্য এই বাড়িটিতে একা একা লাগতেছে।।এমন একটা খুশির দিনে প্রিয় মানুষগুলোই দূরে!!দ্যাৎ।
মন খারাপ করে আমার রুমে চলে আসি।আর, বাবা এবং উকিল আঙ্কেল বসার ঘরে বসে পড়েন।মা রান্না-বান্নার জন্যে কিচেনে তদারকি করতে যান।
রুমে ঢুকতেই একটা সুগন্ধি ঘ্রাণ বআমার নাকে আসে।রুমটা আজ অনেক সুন্দর করে গুছানো হয়েছে।দেখে মনে হয়,কোনো নিপুণ কারিগরের হাতের সজ্জিত এই রুমটা।ছকিনা খালা এমনভাবে রুম কখনোই গোছাতে পারবেন বলে মনে হয় না।তাহলে কে হতে পারেন….!!
মাথা কোনো ভাবনা না আসতেই এসব মাথা থেকে ঝেড়ে তাওয়াল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি।ময়লা শরীরটা আজ সাবান দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে ধুঁয়ে নিই।কারণ,জেলের জীবনে নিয়মিত গোসল করাই ভুলে গিয়েছি।
তাওয়াল পেঁচিয়ে বিছানার সামনে আসতেই দেখি কেউ আমার জন্যে একটা ব্লু কালার গেন্জি,একটা জিন্স রেখে দিয়েছে।জামাকাপড়গুলো হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই,কিন্তু রুমে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।।ব্যাপারটা সত্যি অবাক হওয়ার মতো।এরকমটা কাজ কে করতে পারে আমার রুমে!?সাথী তো বাসায় নেই,তার উপর শিমলাও!!
নাকি ওই শিপ্রা ডাইনী!?নাহ নাহ।তওবা, তওবা। ভুলেও যেন ওই মহিলা না হয়।।
তাড়াতাড়ি জিব কাটি।জামাকাপড় গুলো হাতে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাড়াতেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠে,
-আজকে আমার পছন্দের ড্রেস পড়তে হবে,ওকে??
আমার রুমে মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে অনেকটা ভড়কে যাই।তড়িঘড়ি পেছনে তাকিয়ে দেখি–সেই চেনা পাতলা সিমসাম মুখটি,সেই চেনা সিল্কি চুলগুলো,সেই চেনা মুখে লেগে থাকা হাসি, সেই চেনা টানাটানা চোখগুলো।এখন ব্লু কালার শাড়ি পরিহিত আমার মন কেড়েছে।রমণীর রূপে মুগ্ধ হওয়াটা বড় বিষয় নয়,বিষয়তো হল এই রমণী আমার এখানে কি করে!!আমার মুখ দিয়ে যেন কথা আসছে না।তোতলে তোতলে বলি,
-স-স-সোহানা, তুমি??
-হুম আমি।কেন? অবাক হচ্ছ?
দু’পাশে মাথা নাড়ি।
-কেমন আছো, শাওন??আজ অনেক দিন পর তোমায় দেখলাম!!
-ভা-ভা-লো, আজ অনেকদিন পর “কেমন আছো, শাওন” কথাটি শুনতে পেলাম। কতটা বছর পর মেয়েটিকে আজ দেখলাম।এখনো সেই আগের মতোই আছে সোহানা। মানুষ বলে,সময় বাড়লে মানুষগুলোও বদলে যায়,কিন্তু সোহানাকে দেখে এমন কোনো ভাবান্তর আসলো না মাথায়।প্রিয় সে সুচিস্মিতা হাসির মাঝে চাঞ্চল্য অনুভূতি।
স্মৃতির পাতা হুট করে সবকিছু জীবন্ত করে ফেলে যা বিশ্বাস করা যায়না!বলতে খুব ইচ্ছে হয়,সোহানা তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?এখনো কি আমায় ভালোবাসো?নাকি ভুলে গেলে!কিন্তু ঠোঁট নড়লেও মুখ বলে না!
-হ-হঠাৎ করে আমাদের বাড়ি?তাও এ সময়??!!
সোহানা সাদামাটা একটা হাসি দিয়ে ফেলে,আর বলে,
-সারপ্রাইজ!! আচ্ছা শুনো?আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।পরে কথা বলছি।
-ওহ,হ্যাঁ হ্যাঁ।
এতক্ষণ পর আমার ধ্যান ভাঙ্গলো।
সোহানা সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুঁচকি হেসে রুম থেকে চলে যায়।পরে,আমি জামাকাপড় পরিধান করে নিই।
ছকিনা খালা আমার রুমে আসেন ডাকতে দুপুরের লাঞ্চ করতে যেতে।।
আমি গেন্জির কলার ঠিক করতে করতে সিড়ি বেয়ে নিচে নামি।সবাই ড্রাইনিং এ বসে পড়ে দুপুরের লাঞ্চে।মা আমায় দেখামাএই চেয়ার টেনে দেন।চেয়ারে বসতেই সোহানার মুখোমুখি চোখ পড়ে।অনেকটা লজ্জা অনুভূত হয়।সোহানা বুঝতে পেরে মাথানিচু করে মিটিমিটি হেসে উঠে।।
মা সবার প্লেটে ভাত বেড়ে দিচ্ছেনউ।এরইমধ্যে বাবা উকিল আঙ্কেলের উদ্দেশ্য বলেন,
-তো পরসু চলে যাবেন বলে ডিসাইড করলেন,রিয়াজুল সাহেব??
-জ্বী ভাই।আমার আরো কিছু ক্লাইন্টের কেইসগুলো এখনো লটকে আছে।তাই যাওয়া খুবই তাড়া।
-আপনি আমার ছেলের জন্যে দেড়টা বছর যা করলেন,সত্যি তা ভুলার নয়।
-এসব কেমন কথা বলছেন,আসলাম চৌধুরী ভাই?শাওন আমার মেয়ের সবথেকে ভালো বন্ধু।তাই মেয়ের বেস্ট মানুষের জন্যে একটু-আধটু করা তেমন কিছু না।।
আমি হকচকিয়ে উঠি উনার কথায়।অবাক দৃষ্টি দিয়ে সোহানার দিকে,মায়ের দিকে,বাবার দিকে এবং উনার দিকে তাকাই।উনার কথার অর্থ না বুঝতে পেরে উকিল আঙ্কেলকে বলে উঠি,
-আমি আসলে কিছু বুঝতেছি না।কে কার বন্ধু!?
-শাওন,তুমি না আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে?
-জ্বী আঙ্কেল।
-আমি সোহানার বাবা এডভোকেট রিয়াজুল সাহেব।তুমি হয়তো আমার নামটি অবশ্যই জানো।
-জ্ব,জ্বী আঙ্কেল।সোহানার থেকে আপনার নামটা শুনেছিলাম।কিন্তু আপনি যে এডভোকেট তা জানি না।
-ওহ আচ্ছা,ওহ আচ্ছা।বায় দ্য ওয়ে,এখনতো জানলে।
-জ্বী।।
সোহানা আমার জন্যে এতকিছু করলো!আচ্ছা,ও জানলো কিভাবে আমি যে জেলে ছিলাম!ও-ই ওর বাবাকে সবটা বিষয় জানিয়েছে।কিন্তু সোহানার সাথে তো প্রায়ই কন্টাক্ট অফ ছিল কখনো ভাবতেই পারিনি ও আবার ফিরে আসবে।।
-কি হলো শাওন??খাচ্ছিস না কেন?ভাত খুঁটছিস কেন??
-ওহ,হ্যাঁ,হ্যাঁ মা এইতো খাচ্ছি।
তারপর আমি খাওয়াদাওয়া করে নিজের রুমে চলে আসি।এসেই ল্যাপটপটা একটু ঘাটাঘাটি করতে থাকি।হুট করে কেউ আমার দরজায় কড়া নাড়ে।তাকিয়ে দেখি সোহানা আসছে।
-আসতে পারি??
-হ্যা,হ্যা অবশ্যই আসো,আসো।
সোহানা আমার রুমে আসে।সোহানা আসা মাএই আমি বিছানা থেকে উঠে দাড়াই।তারপর একটা চেয়ার টেনে সোহানে বসতে দিই।আমি অনেকটা ইতস্ততাবোধ করতে থাকি।হুটহাট ওকে কি বলবো মাথায় কিছুই আসছে না!তারপর বলে ফেলি,
-সোহানা?তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ কেন??
-এইযে আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে নিয়ে আসলে?
-এটা কেমন কথা, শাওন।এসব কিছু না।।যাইহোক,তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিল।বাড়িতে যাওয়ার জন্যে পাপ্পিতো ধাওয়া করতেছে,তাই পরে বলার আর সময় পাবো না।
-আচ্ছা বলো, সোহানা।
-শাওন??তোমাকে নিয়ে যে এত্তকিছু হলো।এইযে তুমি জেল খাঁটলে সবটা তোমার ভাইয়া এবং ভাবীর জন্যে।
খুবই অবাক হচ্ছ, না?হুম অবাক হওয়ার ই কথা।কারণ,ভাই যদি শএুতা করে সত্যিই কিছু আর বলার থাকে না।
-সোহানা আমায় একটু ডিটেলস ক্লিয়ারলি বলবে??
-ওয়েট শাওন,বলতেছি।
-তুমিতো দিবানিকে চেন,না??
-হুম, সোহানা।
-দিবানির চক্রে শিপ্রা তোমার উপর ক্ষেপে উঠেছিল।কারণ,দিবানি তোমায় অনেক ভালোবাসতো তাতো তুমি জানোই।তুমি দিবানির প্রপোজাল রিজেক্ট করায় দিবানি অনেকটা বিষণ্নতায় পড়ে যায়।দিনকে দিন তোমার কথা ভাবতো,একমুহূর্তের জন্যেও তোমায় ভুলতে পারতো না বাসায় ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতো না,কারো সাথে মিশতো না।একা একা সময় কাটাতো।এই নিয়ে বাসার সবার অনেকটা সন্দেহ হতো,তবুও ওতোটা মাথায় নেয়নি।
একদিন দিবানিকে বন্ধ দরজায় সবাই দেখতে পায়।শত কড়া নাড়ার শব্দেও দিবানি দরজা খুলে নি।সবাই ভয় পেয়ে দরজা ভেঙ্গে পেলে।আর দরজায় খোলার পর দেখে দিবানি ফ্যানে ওড়না ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছে।আর এই আত্মাহত্যার কারণও কেউ জানতো না যদি না তোমার নামে একটা চিঠি না লিখা হতো দিবানির।
-চিঠি??
-হুম, চিঠি।চিঠিটা এখন আমার কাছেই আছে।তোমাকে আমি দিব,পড়ে নিও।তারপর,ওই চিঠির মাধ্যমে শিপ্রা তোমার পরিচয় জানতে পারে।এই চিঠিটা কাউকে বেহুশ না করলেও সবথেকে জর্জরিত করে শিপ্রাকে।যে দিনের পর দিন রাগ ফুঁসতে থাকে মনে আগুন ধরানো প্রতিশোধের।তারপর যখন তুমি ভার্সিটিতে এডমিট হও,তখনই তোমায় খপ্পরে পেয়ে যায়।আর তখন থেকেই তোমার প্রতি লক্ষ রাখতে থাকে।তোমাকে কি থেকে কিভাবে ঘায়েল করবে।তার মিশন স্টার্ট টু ইউ।ও তোমায় পাওয়ার জন্যে অনেকদিনের সাধনা করে বেড়ায় যেখানে তোমার বন্ধুদের মাধ্যমে তোমাকে ড্রিংক পার্টিতে নিয়ে যায়।হয়তো তুমি এসবের কিছুই জানো না।
-সোহানা?দিবানি যে এমনটা করে ফেলবে আমি কখনোই ভাবতে পারিনি।তাছাড়া,আত্মাহত্যাকে হত্যায় রূপান্তর করলো কেন??হোয়াট ইজ দিস?আর এটা সম্ভব কিভাবে!??
-শিপ্রা বাসার সবাইকে থামিয়ে দেয় তার হিংস্র থাবায়।সবাইকে গোপন রাখতে বলে ওর আত্মাহত্যার কথা।সে তার ফ্যামিলওকে বুঝায় যে দিবানি কারো যন্ত্রণায় আত্মাহত্যা করেছিল।এতে তার ফ্যামিলিরনল তোমার প্রতি ঘৃণা জন্মায়।সবাই একটা প্রস্তুত নেয় তেমাকে ফাঁসানের জন্যে।যেহেতু,তোমার কারণে দিবানি মারা গিয়েছিল।।
-তারপর….???
-শিপ্রা ওদিনের জন্যেই অপেক্ষা করেছিল এবং পূর্ণও হয়েছিল।তোমায় হোটেলে নিয়ে যেই ভিডিও রেকর্ড করেছিল,তা নিজের কাছে রেখে তোমাকে প্রতি বার বার ওর শিকারী বানিয়ে রাখবে যাতে তুমি ওর প্রতিটা হুকুমে অস্বীকার না যাও।
-হুম।তোমার সাথে যে আমার ব্রেকাপ হয়েছিল তার কারণ কি জানো??
-জানি,শাওন।আমি সবটা খোলাসা জানি।
চলবে….