আজ আমাদের ৩য় বিবাহবার্ষিকী। তিনটা বছর একসাথে কাটিয়েছি আমরা।আজও মনে পড়ে ৩ বছর আগের সেই দিনটি।বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছিলাম শ্রাবণ এর হাত ধরে।
সবে মাত্র অনার্স ৩য় বর্ষে উঠেছি তখন।বাবা ছিলেন খুব রাগী। হুট করেই একদিন বিয়ে ঠিক করে বসলেন তার বন্ধুর ছেলের সাথে।বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পাওয়া স্বত্বেও সেদিন শ্রাবণ এর কথা বাবাকে জানিয়েছিলাম।বাবা একেবারে না করেন নি।শ্রাবণ কে আসতে বলেছিলেন।একদিন সন্ধ্যায় শ্রাবণকে ডেকেছিলাম আমি।শ্রাবণ এসে দাড়িয়েছিল বাবার সামনে।
-আসসালামু আলাইকুম আংকেল।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।নাম কি তোমার?
-জ্বি শ্রাবণ মাহমুদ।
-কি করো?
-জ্বি মেঘের (আমি) সাথে পড়ি।
-বাড়িতে কে কে আছে?
-আমি এতিম। একটা এতিমখানায় বড় হয়েছি।আর এখন টিউশনি করে পড়ারর খরচ চালাই।
-তার মানে জন্মের ঠিক নাই।আর তোর এত বড় সাহস আমার মেয়েকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিস!!!এক্ষুনি বের হ আমার বাড়ি থেকে।আমার মেয়ের ত্রিসীমানায় আসবি না।
সেদিন শ্রাবণ বের হয়ে যাওয়ার পরে বাবা জীবনে প্রথমবার আমার গায়ে হাত তুলেছিলেন।বাবার একটাই কথা ছিল যে ছেলের জন্মের ঠিক নাই,পরিবার নাই সে সম্পর্কের মুল্য দিতে পারে না।কিন্তু আমি ছাড়া যে শ্রাবণ এর কেউ ছিল না।আমি জানতাম ও আমাকে ছাড়া বাঁচবে না।তাই পালিয়ে এসেছিলাম বিয়ের দিন ওর সাথে। তারপরের দিনগুলো সহজ ছিল না।অনেক কষ্টে পড়াশোনা শেষ করেছি দুজন।টিউশনি করেছি একের পর এক,রাতে না খেয়ে থেকেছি।কিন্তু আমাদের ছোট্ট সংসারে ভালবাসার অভাব ছিল না।তারপর দুজন চাকরি পেয়েছি।স্বচ্ছলতা ফিরেছে।তবে আজকাল শ্রাবণ কেমন যেন পালটে গেছে।আমার দিকে ভালভাবে তাকায় না।অফিসে খুব ব্যাস্ত থাকে।এখন আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় কল দিয়ে বলে না জানপাখি খেয়েছো?
তবে আজ ওকে এমন একটা খুশির খবর দিব যে ও লাফাবে।হ্যা আমাদের মাঝে একটা ছোট্ট সদস্য আসছে।আমাদের ভালবাসায় উপহার।বেল বাজচ্ছে।এই বুঝি ও এল।
-happy marriage day mr.
-আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল?
-তোমার মনে নেই??আচ্ছা ব্যাপার না।অনেক রান্না করেছি। চলো খাবো একসাথে।
-আমি খেয়ে এসেছি।
-মজা করছো?
-না। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে মেঘ।
-আমারও।
-আচ্ছা বলো।
-আগে তুমি।
-দেখো মেঘ আমি জানি তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে।যা বলছি রিয়াক্ট না করে ভেবে দেখো।
-কি এমন বলবে?
-আমি ডিভোর্স চাই।
-মানে?
-সোজা ভাবেই বলি। আসলে আমার মনে হয় আমরা দুজন দুজন এর জন্য না।সম্পর্কটা বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে।
-এটাই কারণ?
-না মানে আমার অফিসের স্টাফ প্রিয়া।ওকে আমি ভালবাসি।প্রিয়া বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।তাই আর কি।
-ঠিক আছে।পেপারস নিয়ে এসো।
-না মানে এই যে পেপারস।
-সই করে দিয়েছি।
-থ্যাংকস। বলছি তুমি যেন কি বলবে।
-না কিছু না।
মুক্তি দিয়ে দিয়েছিলাম এক কথায়।জোর করে আটকে রাখায় আমি বিশ্বাসী নই।
পরের দিনই বের হয়ে এসেছিলাম এর জীবন থেকে আর বাড়ি টা থেকে।একদিন ওকে ভালবেসে বাবার অবাধ্য হয়েছিলাম।আজ ও প্রমাণ করে দিল বাবার কথাগুলোই ঠিক।বাবা মা মিথ্যা বলে না।আমি মা হয়ে আমার অনাগত সন্তান এর বাবাকে ওর আসার খবরটাও দিতে পারিনি।সত্যি আমি ব্যার্থ সন্তান আর মা হিসেবেও ব্যার্থ।তাই তো পালিয়ে যেতে হলো দুরের শহরে।
৫ বছর পর আজ আবার পা রাখছি সেই চেনা শহরে।যেখানে রেখে গেছিলাম আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার।সে সংসার আজ প্রিয়ার।আমার ভালবাসার মানুষ সেও তো প্রিয়ার।
উহু ফিরতে চাইনি এ শহরে।নিয়তি আমাকে টেনে এনেছে।অফিস থেকে এখানেই পোস্টিং হয়েছে।একদিন বিকেল বেলা আমার মেয়েকে নিয়ে বের হয়েছি। পার্কের বেঞ্চে বসে গল্প করছি মা মেয়ে।হটাৎ দেখলাম দূর থেকে কেউ এগিয়ে আসছে।মুখটা বড্ড চেনা।এ যে শ্রাবণ। আমার সন্তানের বাবা।
-কেমন আছো মেঘ?
-ভাল তুমি?
-ভাল নেই।সেদিন তোমাকে ছেড়ে দিয়ে যে ভুল করেছিলাম মাসুল গুনছি।প্রিয়া বিয়ের এক বছরের মাথায় পালিয়েছে।পরে জানতে পারি ও টাকা পয়সা হাতানোর জন্য আমাকে প্রেমের ফাদে ফেলেছিল।তা এই পিচ্চি টা কে?
-আমার মেয়ে।
-যাক শুনে ভাল লাগলো তুমি সংসারী হয়েছ।তা ওর বাবা কই?
-মারা গেছে।
-ওহ।মেঘ।
-বলো।
-আমাকে আর একটা সুযোগ দেবে?ফিরবে আমার কাছে?
-উহু যা একবার ফেলে এসেছি তা আর আমার নয়।অধিকার ছেড়ে দিয়ে অধিকার গ্রহণ করার চেয়ে বড় বিড়ম্বনা আর নাই।ভাল থেকো। আসি।
হ্যা আর ফিরে তাকাই নি পেছনে।যে একবার ঠকায় সে বারবার ঠকায়।বিশ্বাস কাচের আয়নার মত।একবার ভাঙলে কার সাধ্যি জোড়া লাগায়!!!
(সমাপ্ত)
#তামান্না_ইসলাম