ভবঘুরে শেষ পর্ব
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
বাড়িতে এসে আবিদের ক্ষতস্থানে যত্নসহকারে ব্যান্ডেজ মুড়িয়ে দিল উরবি। তখন আবিদের মুখে তার চলে যাওয়ার কথা শোনার পর কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি উরবি। শুধুমাত্র একজোড়া ছায়াময় দৃষ্টি আবিদের অন্তর্দেশে পৌঁছে অবগাহন করে ভেতরের সব চাওয়া-পাওয়া,আকাঙ্খা, আরমান নিজের মস্তিষ্কে প্রকটিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সব আয়োজন বিফল। কিচ্ছুটি দেখতে পায়নি উরবি। না স্নেহের টান,না অল্পদিনের মায়া, আর না একফালি ভালোবাসা! আবিদের বিশাল বক্ষের ঐ হৃদয়দেশ সাহারা মরুর মতোন ধূ ধূ উজাড়, ঠনঠনে। কোথাও একবিন্দু ভালোবাসার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। সেই উচ্ছিষ্ট হৃদয়ে পৃথিবী ব্যাপি মানুষের কল্যানের হিতৈষী হলেও আলাদা কোনো মানুষ তার হৃদয়জমিনে আস্তানা গাঁড়তে সক্ষম হয়নি। উরবিও সেই হতভাগাদের দলে।
ইশতিয়াক সাহেব যখন এই ঘটনা শুনলেন,আনন্দ-আতিশয্যে তিনি পুলকিত হয়ে আবিদকে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। তার সারামুখে বিজলির মতো খেলে গেল গর্বের হাসি। যেন তাঁর নিজের কুঁড়ে ছেলে এমন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে ঘরে ফিরেছে বীরবেশে! তিনি আবিদকে ছেড়ে দিতে দিতে আনন্দ-গদগদ কণ্ঠে বললেন,
– আমি তোমাকে কখনোই জোর করিনি এখানে আসার কারণটা জানার জন্য। তোমাকে প্রথম দিন দেখেই আমার মনে হয়েছিল তুমি খুব ভালো ছেলে,নিশ্চয় কোনো ভালো কাজেই এসেছ। আল্লাহ তোমার ভালো করুক। খুব খুশি হলাম বাবা। গ্রামটা সাফ হল এবার। অশেষ কৃতজ্ঞতা!
জবাবে আবিদ এক চিলতে হেসে বলল,
– এটা আমার কর্তব্য আংকেল। আর এটাই আমার কাজ। আসলে, আমার কোনো পরিবার নেই। অনেকদিন যত্নআত্মি পাইনি বললেই চলে। জীবন কম জায়গায় ঘুরে ঘুরে এসব যুদ্ধ-বিগ্রহের কাজ করিনি। কিন্তু আপনাদের এখানকার মতো স্নেহ-ভালবাসা অন্য কোথাও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। হয়তো পাব-ও না। আমি পরশু সকালেই রওনা দিব এখান থেকে। অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাদের…।
ইশতিয়াক সাহেব প্রসন্ন হেসে বললেন,
– যাক,আমাদের ওপর তুমি খেদহীন শুনে ভালো লাগল। কিন্তু কষ্ট আমাদের একটুও হয়নি। বরং জনশূন্য বাড়িটা কিছুদিন একটু জমজমাট ছিল। আবার এখন এটা বোলো না যে,ভাড়া কত দিতে হবে বা কী দিতে হবে—হাবিজাবি! কষ্ট পাব কিন্তু!
আবিদ স্নেহ-বাৎসল্যে নুইয়ে পড়ে মাথা কাত করে সম্মতি দিল। ইশতিয়াক সাহেব আবিদের লম্বা চুলের মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হাসিমুখে প্রস্থান করলেন।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
একটা সম্মন্ধ শুরু করার আগেই টুটে যাওয়ার পর ইশতিয়াক সাহেব হাত গুটিয়ে বসে নেই। পরিচিত-অপরিচিত মানুষদের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য সুপাত্র খোঁজার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন সমানে…। আবিদের কাছ থেকে ফেরার পর তাঁর হঠাৎ মনে হলো,আবিদকে আরো কিছুদিন থাকতে বলা উচিত;অন্তত উরবির বিয়েটা সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত!পেছনে ফেরার লোক ইশতিয়াক সাহেব নন। তিনি উরবিকে ডেকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে, আবিদকে কথাটা পৌঁছে দেবার জন্য বললেন। উরবি মুখের ওপর জানাল, সে পারবে না। অগত্যা সালমাকে রান্নাঘর থেকে হেঁকেডেকে পাঠানো হলো আবিদের কাছে। সালমা দ্বিরুক্তি না করে গেল আবিদের কাছে। উরবি যেভাবে এসেছিল সেভাবে চলে গেল। আজকাল নিজের মেয়েকে চিনতে পারেন না ইশতিয়াক সাহেব। সারাক্ষণ কলহের আড়ম্বরে মেতে থাকা মেয়েটা তার হঠাৎ হঠাৎ কী দুর্নিরীক্ষ্য কারণে মেনিমুখো হয়ে যায় সে রহস্য যেন উদঘাটনের-ও উর্ধ্বে! পরক্ষণেই মেয়ের উপর ছেঁদো কলঙ্কটার কথা মনের জমিনে খেজুর কাঁটার মতো বিষাক্ত হয়ে প্রস্ফুটিত হয়। তখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ ভিন্ন কিছু করার থাকে না। আজ রেললাইনের কাছে জিসানকে দেখে ক্ষুব্ধা হবার কথাটাও অল্পবিস্তর কানে এসেছিল তাঁর। সে নিয়ে উরবিকে প্রশ্ন করা বৃথা। নিন্দিত কিছু ঘটে যাওয়ার পর সেটা নিয়ে অন্য কেউ নাড়াচাড়া করার মতো বিশ্রী ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি নেই। এতে হয়তো মনকষাকষি হয় আর নয়তো অভব্য কিছু ঘটে যায়। কারণে, তিনি মেয়েকে দ্বিতীয়বারের মতোন খ্যাপাতে চাইলেন না। সে থাকুক তার মতো করে।
ইদানিং নিরু আর বাবা-মায়ের বাঁধা মানে না। নিয়ম করে সেই আগের মতো দুপুরবেলায় উরবির কাছে চলে আসে৷ আজ ঘড়িতে তিনটে হতে না হতেই নিরু সশরীর উপস্থিত। উরবি উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। নিরু এসেছে বুঝতে পেরে উঠে বসে চোখে রগড়িয়ে জড়িত গলায় বলল,
– আসলি?
নিরু হ্যান্ডব্যাগটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল,
– হুম, ঘুমাইছিলি?
উরবি মুখে অদ্ভুত একটা মুদ্রা ফুটিয়ে বালিশটা নিজের কোলে নিয়ে তাতে কনুই ঠেকিয়ে বলল,
– নাহ, শুইছিলাম একটু। চোখে লেগে আসছিল৷
– ‘ওহঃ, দুইদিন পর তোর বিয়ে। তোর চোখমুখ এমন শুকনো কেন? দুপুরে খাস নাই?’ নিরুর সুশ্রী মুখে টলটলে উদ্বেগ।
– ‘না,’ মুখ ঘুরিয়ে উদ্বেগহীন গলায় বলল উরবি।
– কেন?
উরবি উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ ওভাবেই মুখ ঘুরিয়ে কি যেন আকাশপাতাল চিন্তায় আকণ্ঠ মগ্ন হয়ে রইল। একসময় ধ্যানচ্যুত হয়ে হুট করে নিরুর ডান হাত নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে ভারী বিমর্ষ-অসহায় গলায় বলল,
– নিরু, আবিদ চলে যাবে পরশু। বোন আমার, লক্ষ্মীটি, কিছু একটা কর প্লিজ। আমার কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রে…।
বলেই নিরুর হাত ছেড়ে নিজের সরু আয়ত করপুটে মুখ ঢাকে উরবি।
নিরু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উরবির দিকে। এর আগে নিরুর সামনে এভাবে কখনো হা হুতাশ করেনি উরবি। উরবির এই অনাহূত পরিবর্তন আর হা-হুতাশ নিরুকে আঘাত করল। সে উরবির কাছে ঘেঁষে বসল। উরবির মুখে ঢাকা দুইহাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের হাতের মধ্যে বন্দী করে বলল,
– এদিকে তাকা।
উরবি ভাষাহীন তাকাল৷ নিরু ওর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
– এরপরও বলবি যে,তুই ওকে ভালোবাসিস না?
উরবি নীরব নিরুত্তরে মাথা নুয়াল আবার। নিরু আবারো বলল,
– যা আজই সব বলে দে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর না।
– কী বলব? ‘ পুনরায় মাথা তুলে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকাল উরবি।
নিরু অবাক হওয়া গলায় বলল,
– বলবি, তুই ওকে ভালোবাসিস!
উরবি বিদ্যুৎ-বেগে উঠে দাঁড়াল। আশুগতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পা ফেলে বেরিয়ে এলো নিজের ঘর থেকে। নিরু পেছন থেকে কি কি যেন বলল। সে শোনার চেষ্টাও করল না৷
নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে উরবি সোজা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে বাম পাশের ফ্লাটে অর্থাৎ আবিদের ঘরে প্রবেশ করল। আবিদ তখন গুটিয়ে যাওয়া বিছানাপত্র ঝেড়ে-পুঁছে বহুদিন পর একটা নিষ্কণ্টক, আরামের ঘুম দেবার আয়োজন করছিল৷ ঠিক তখনি দরোজা ঠেলে শোকে বিধ্বস্ত উন্মাদিনীর মতো প্রবেশ করল উরবি। আবিদ ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে বিছানার চাদর টানটান করছিল,উরবিকে দেখে সটান দাঁড়িয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। উরবি মেঝের দিকে দৃষ্টি নিমগ্ন করে যন্ত্রের মতো বলে ফেলল,
– নিরু বলছে, আমি আপনাকে ভালোবাসি। উত্তর জানাবেন।
আবিদ হতবুদ্ধি হয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে উরবির ঘুম-ফোলা চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করে বলল,
– আপনার ঘুম হয়নি৷ আধঘুম থেকে জেগে উঠা মানুষ পাগলটা গারদ থেকে পালিয়ে আসা পাগলের সমান। যান ঘুমোন,আমিও ঘুমাই।
আবিদের কথা শুনে উরবি যেন চমকে চৈতন্য ফিরে পেল। দ্রুত সে পালিয়ে বাঁচল জায়গাটা থেকে।
ঘরে এসে নিরুকে সমস্ত খুলে বলে আবারো নৈরাশভরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল উরবি। নিরু তার আকস্মিক খ্যাপামির জন্য গঞ্জনা দিতে লাগল তাকে,
– ছাগল নাকি তুই? আমি বলতে বলছি বলে এভাবে বলবি নাকি? একটু আবেগ দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে বলবি। আবাল কোথাকার।
উরবি তার ক্ষীণদেহটা চট করে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসিয়ে বলল,
– সব দোষ তোর। তুই-ই তো আমাকে খ্যাপাইছস। তা না হলে—
বাকিটুকু না বলেই চুপচাপ নিজে নিজে ফুঁসতে লাগল উরবি। নিজের ওপর রাজ্যের রাগ ভর করেছে তার। ভাগ্য ভালো লোকটা ঘটনাটাকে অতোটা গুরুতরভাবে নেয়নি। উরবির সদ্য ঘুম চ্যুত আদুরে ফোলা চোখ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নয়তো কি যে তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটে যেতো সেটা ভেবেই উরবির মন বিষিয়ে উঠল। ভালো তো সে বেসেছেই জংলী লোকটাকে! আজ কিংবা কালের মধ্যে আবিদকে না জানালে চিরকাল আর দেখা পাওয়া যাবে না মানুষটার। তার ভবঘুরে নেশার দরিয়ার অতলে হারিয়ে যাবে চিরতরে। মনের ধূসর যবনিকায় লোকটা হারিয়ে যাওয়া আর তার নিজের হতাশার একটা দৃশ্য কল্পনা করতেই উরবির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিম শীতল রক্তের স্রোত বয়ে যায়। সে চাইতেও এসব অযাচিত ভাবনা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারছে না। না চাইতেও সেসব ভাবনার দুর্বহ জাল তার শরীরকে আচ্ছন্ন করে আবিদের মনোকূলে প্রবল বেগে আছড়ে ফেলছে। মন না মতি বুঝি একেই বলে!
সন্ধ্যার আগে আগে নিরু বিদায় নিল। সেই দিনটা সাদামাটাভাবেই ঘটনাবিহীন কেটে গেল।
বর্ষার মেদুর স্পর্শ লেগেছে প্রকৃতিতে। আকাশে অনুক্ষণ মেঘেদের গুড়ুম গুড়ুম যুদ্ধ চলে। কে যেন আকাশের সফেদ-সুনীল বুকে অগ্নিময় খড়গ চালিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। সেই যুদ্ধ-বেদনায় আকাশের বাসিন্দাদের অশ্রুজল পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে! গ্রীষ্মের তীব্র তাপদহনে পুড়ে প্রকৃতির তামাটে রঙে লেগেছে অনিন্দ্য রম সবুজের ছোঁয়া।
এই গ্রামে আজ আবিদের শেষ দিন। এরপর আর কখনো এমুখো হবে বলে আশা নেই কারণও নেই। ভোরবেলা উঠে সে নাশতা-পানি করে গ্রামের পরিচিত হয়ে ওঠা কিছু মানুষের থেকে বিদায় নিতে গেল। এই কিছুদিনেই অল্প কিছু মানুষের সঙ্গে তার ওঠাবসা হয়েছে। এঁদের দলে,ছেলে জোয়ান থেকে বুড়ো পর্যন্ত আছে। কিন্তু এতোদিনের আবিদের সঙ্গে আজকের আবিদের বিস্তর পার্থক্য। গ্রামের প্রত্যেকটি কাকপক্ষী পর্যন্ত জেনেছে আবিদের এই গ্রামের আসার উদ্দেশ্যটা। বাহবা দিচ্ছে সবাই। একইসঙ্গে মনসুরের মতো লোকের এমন কাজেও মর্মাহত কিছুসংখ্যক মানুষ। সবাই তাকে ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান হিশেবে প্রায় মেনেই নিয়েছিল। আবিদ বাজারের দিকে পৌঁছাতেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল। মজিদের দোকানে প্রবেশ করতেই একদল ছেলেপেলে হৈ হৈ করে ছুটে এসে অনেকগুলো ফুলের মালা আবিদের গ্রীবায় গলিয়ে দিল৷ চাপা আনন্দ-বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সে চুপ করে রইল অনেক্ক্ষণ। দোকানদার মানসুর তাকে ইনিয়েবিনিয়ে স্বাগত জানাল তার সফল অভিযানের জন্য৷ এরপর বেলা গড়াতেই একে একে পরিচিত সকলের সঙ্গে দেখা হল। বিদায়ও নেওয়া হল। কেউ কেউ ফি আমানিল্লাহ্ বলে বিদেয় দিল,আবার কেউ কেউ আরো দুইটা দিন বেড়িয়ে যাবার কথাও তুলল;আবার কেউ অনুনয় বিনয়ের পর্যায়ে চলে গেল…। কিন্তু আবিদ ছলে বলে কৌশলে সমস্ত এড়িয়ে গেল। গতকালও সালমা এসে ইশতিয়াক সাহেবের অভিপ্রায় জানিয়েছিল,কিন্তু আবিদ তাড়া আছে বলে বিষয়টা ধামাচাপা দিয়েছিল৷ জায়গায় জায়গায় গিয়ে মানুষকে আপন করে বুকের বাড়িতে স্থান দেওয়ার ইচ্ছে আবিদের নেই বলেই এমন নীরব অ-স্বীকারোক্তি । নতুবা ভালোবাসা কে না পেতে চায়? কিন্তু এই জীবনে আবিদের মায়ামমতা, যত্ন-আত্মি, ভালোবাসার শখ এক্কেবারে মিটে গেছে!
আবিদ নিজের গলায় ঝুলে থাকা ফুলেল মালাগুলোর দিকে তাকাল। দামি তরতাজা ফুল। এই বাচ্চা ছেলেগুলো এই মালা কেনার টাকা পেল কোথায় কে জানে!… দীর্ঘশ্বাসে ভাবনার গায়ে মাটিচাপা দিল আবিদ। তবে আবিদ একটু চিন্তা করলেই জানতে পারতো কিম্বা বুঝতে পারতো এসব উরবিরই পাগলামি। কিন্তু এতো উরবিকে ভাবনাচিন্তার সময়ই বা কোথায় তার? মনের ভেতর উরবি নামটা যতোই ঠেলেঠুলে একটুখানি জায়গা করে নিতে চাইছে আবিদ তখনই সেই অনুভূতিটাকে দূর দূর করে দম্ভভরে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুপুরে প্রারম্ভে আবিদ বাসস্টেন্ডের দিকে রওনা দিল। মেহেরপুরের টিকিট করতে হবে। বাড়ি থেকে খবর এসেছে বাবা তাকে দেখতে চেয়েছে একবার। আজ আকাশ ভয়ংকর মেঘলা। এই একটু আগেই এক পশলা ঝুম বৃষ্টিতে মুখরিত ছিল চারপাশ। এখন আবারো বৃষ্টিকণাদের দলবল বেঁধে জমিনের নামার পাঁয়তারা চলছে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে টিকিট করে বাড়িতে পৌঁছে আবিদ দেখল, বাড়িভর্তি অপরিচিত মেহমানে ভরপুর। সেদিনকার মতো কিছু আণ্ডাবাচ্চা ছোটাছুটি করছে এদিক-ওদিক, আর অন্দর থেকে কথাবার্তার গমগম শব্দ আসছে। সে আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকার সমীচীন মনে করল না। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে নিজের ঘরে ঢুকে দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে বাঁচল সে।
উরবির আজকের সম্মন্ধটা একপ্রকার পাকাপাকি হয়ে গেল। উরবি কিছু বলার সুযোগ এবং শক্তি কোনোটাই পেল না। আগামী শুক্রবার অর্থাৎ তিনদিন পরই আক্দ তার।এরপর যাবতীয় বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে। ছেলেটাকে আবারও ইশতিয়াক সাহেবের কলিগ গোফে তা দিতে দিতে ঠিক করেছে। নাম, নাঈম। একটি সরকারি হাইস্কুলের অংকের টিচার। দৃশ্যত ইশতিয়াক সাহেবের পাত্র পছন্দ হয়েছে বেশ। তবে সবকিছু একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে মনে হলেও এমন সুপাত্র হাত ফসলে বেরিয়ে গেলে আর পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। ভেবে, যা করার তাড়াতাড়ি করারই সিদ্ধান্ত নিলেন। এদিকে আজ সন্ধ্যায় মেহমান চলে যাওয়ার পর ইশতিয়াক সাহেব সশরীরে এসে হাজির হয়েছিল আবিদের কাছে৷ উরবির বিয়ে ঠিক হয়েছে কথাটি বেশ উৎফুল্ল হয়ে জানালেন তিনি,সঙ্গে ধরে পড়লেন যাতে উরবির আক্দ টা অন্তত দেখে যায়! কিন্তু আবিদ তার সিদ্ধান্ত গভীরভাবে অবিচল,অনড়। শেষমেশ আশাহত হয়ে ইশতিয়াক সাহেবকে ফিরে আসতে হল। যে স্ব যায় তাকে যেতে দিতে হয়, অতিরিক্ত জোর করার জন্য অধিকারের খুঁটিটাও মজবুত হওয়া চাই!
ইশতিয়াক সাহেব চলে যেতেই আবিদ বাঁধাছাঁদার কাজে নিযুক্ত হল। ঘরময় বিস্রস্ত কাপড়চোপড়, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ট্যুর ব্যাগটাতে পুরে নিল সে। কিন্তু তার শখের ক্যামেরাটা পাতিপাতি করে খুঁজেও পাওয়া গেল না কোথাও। এমনকি চার্জারটাও হাওয়া! সে ভারী আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সকালে বেরোনোর সময় নিয়েছিল কি না মনে করে দেখল। নাহ্ সকালে নেয়নি। তবে চোর-টোর ঢুকল না-কি! একটা কথার কথা আছে, জিনিস হারায় যায় ঈমান যায় তার। আবিদের মনে পড়ল, গেটের বাইরে কয়েকটা কমবয়সী ছোকরাকে অকারণ ছোঁকছোঁক করতে দেখা গিয়েছিল৷ তারাই কি—। হঠাৎ দরজার চকচকে নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল উরবি। তার হাতে ধরা আবিদের ক্যামেরটা। দেখে আবিদ স্বস্তি পেল খানিকটা। সে নির্ভারের ভান করে খাটের পাশে চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। উরবি ক্যামেরাটা বিছানার একপাশে রেখে আবিদের সুমুখে বসে পড়ল৷ এরপর ছোট করে বলল,
– নিরু নিয়ে গিয়েছিল ছবি তোলার জন্য।
তার আদুরে চেহেরাটা ভীম গম্ভীর। ছায়াচ্ছন্ন চোখের দৃষ্টি। আবিদ বোধহয় একটু বুঝতে পেরে শুধাল,
– ওহ, মন খারাপ?
উরবি নিরুত্তরে বসে রইল দেখে আবিদ চবার বলল,
– কাল ভোরে তো চলে যাচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে বলুন।
উরবি চোখ তুলে অদ্ভুত গলায় বলল,
– আছে অনেক অভিযোগ, সারাজীবন আপনাকে বেঁধে রাখার মতো অভিযোগ। গ্রহণ করবেন?
আবিদ কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল। এরপর বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে টেনে টেনে বলল,
– কিছুই তো বুঝলাম না।… শুনি কী অভিযোগ?
– তার আগে বলুন,আমি কি আগের চাইতে পরিবর্তন হইছি?
– ‘হ্যাঁ,হয়েছেন।’ স্বভাবিক স্বীকারোক্তি আবিদের।
– মানুষ কেন পরিবর্তন হয়?
আবিদ একটু ভাবুক গলায় বলল,
– মানুষ পরিবর্তন হয় পারিপার্শ্বিক কারণে। বয়সে বাড়ার সাথে সাথে ম্যাচিওরিটির কারণে। আর—
আবিদের কথার মধ্যিখানে বাধ সাধল উরবি।
– নাহ। মানুুষ হঠাৎ কেন পরিবর্তন হয়?
– উম, আমিই এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। মানসিক ধাক্কায় মানুষ হঠাৎ পরিবর্তন হয়।… এখন কি শুনতে পাই কি এতো অভিযোগ?
উরবি একটু থমকিয়ে ম্যাদা গলায় বলল,
– আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন?
– ‘কোথায়?কেন?’ ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করে আবিদ। উরবির মনে হয় আবিদ সব বুঝেও না বোঝার ভান করছে। খতিয়ে দেখছে তাকে। ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। সে খানিকক্ষণ নীরব আর্তি নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,
– ‘আঘাত পেয়ে আপনার মন পাষাণ হইছে জানতাম। কিন্তু আপনি অবুঝ বলে তো জানতাম না! মানুষের চাওয়া-পাওয়া বোঝার অক্ষমতা আছে তাও তো জানতাম না। আপনি কি বুঝেও বুঝতে পারতেছেন না কিছু? বেশ, শুনুন,আমি জানি আমি খুব সস্তা মেয়ের মতো আচরণ করি৷ কোনো বাঁধা মানি না,সমাজের রীতিনীতি মানি না। তাই বলে আপনার মতো হৃদয়হীনাও আমি না।আমার ব্যাক্তিগত জগৎ আছে,মন আছে।—’ আরো কিছু বলতে চেয়েও কণ্ঠরোধ হয়ে থমকে গেল উরবি।
আবিদের হৃদয়ের তলদেশের ব্যাথার সমুদ্র যেন বহুদিন পর আবর্তে ফেনিয়ে উঠল। সে ধৈর্যহীন হয়ে সামনে ঝুঁকে উরবির দুই হাতের আঙুলগুলো আলতো করে ধরে সান্ত্বনা-স্বরে বলল,
– উরবি, আমি বুঝি তোমার চোখ কী বলে, জানি মন কী চায়। তুমি মোটেও সস্তা নও। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। এরকম দুরন্ত মানুষ হাজার হাজার আছে। আমি জানি আমি পাষাণ, হৃদয়হীন,ভালোবাসার অযোগ্য। আর এজন্যই তোমার ইশারা আমার কাছে অধরা। তোমার অনুভূতি আমার আমার কাছে মৃত৷ এইযে তোমার চোখের পানি আমার পাথরের হৃদয়ে কোনো ক্ষত সৃষ্টি করতে পারবে না বলেই আমি তোমার কথা বুঝেও বুঝি না,বুঝতে চাই না। উপলব্ধি করেও মাটিচাপা দিই। তোমার চাওয়া আমার পক্ষে পূরণ করা অসম্ভব উরবি।…
উরবি মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল বলল,
– তোমার উপলব্ধির চাপা দেওয়া মাটি থেকে আমি নতুন চারার মতো গজিয়ে উঠব একদিন না একদিন। তোমার পাথরের হৃদয়ে আমার চোখের পানি ঝর্ণাধারা পড়তে পড়তে ক্ষত সৃষ্টি হবে কোনো একদিন। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকব। শুধু তোমার হৃদয়-পাথরটা যেন ঐ জায়গাতেই থাকে৷
বলতে বলতে চোখের বারান্দা বেয়ে গড়িয়ে আসা জল তর্জনী দিয়ে মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়াল উরবি। এরপর ভূতগ্রস্তের মতো ধীরে ধীরে আবিদের হাত থেকে নিজের আঙুল ছাড়িয়ে নিয়ে জায়গাটা ত্যাগ করল। আবিদ সেখানেই স্তব্ধ বিস্ময়ে নতমুখে বসে রইল। তার মুখে একটুকরো কথা সরল না আর।
রাতে আবিদকে ঘটা করে ডেকে নিয়ে খাওয়ানো হল শেষ দিন উপলক্ষে। উরবি খাবার টেবিলে আসি আসি করেও গড়িমসি করে এল না আর। আবিদ নিরুপদ্রবে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়ল। কিন্তু চোখে পাতায় ঘুমের বালাই নেই। অন্ধকার ঘরের সর্বত্রই যেন উরবির কথাগুলো ঝনঝন করে বেজে আবিদের কানে অনুরণিত হচ্ছে বারবার। উরবির চিত্তের অস্থিরতা অনেক আগেই টের পেয়েছিল আবিদ৷ কিছু বলেনি।ভেবেছিল, ক্ষণিকের মোহ সময় গড়াতেই কেটে যাবে। কিন্তু কাটেনি। বরং দিনকে দিন সেই মোহ দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হয়ে মহীরুহ আকার ধারণ করে দীর্ঘজীবী এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে অথবা এটাই ভালোবাসা। কিন্তু… প্রয়াত আদিবার অন্তরে কখনোই কষ্ট দিতে পারবে না আবিদ। তাছাড়া সে নতুন কোনো বাঁধনে জড়াতে চায় না। পৃথিবীতে বিচ্ছেদ কিংবা বিচ্ছিন্ন হবার ভয় থাকে বলেই ভালোবাসা এতো দামি। আবিদের আর ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। সব প্রয়োজন বাস্তবতার ধুলোয় লুণ্ঠিত!
চলবে,,
শেষ পর্বের (বাকী অংশ) দুই ঘন্টা পর পোস্ট করা হবে।
#ভবঘুরে
শেষ পর্ব (বাকি অংশ)
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
শেষ রাত্রে আবিদের চোখে শ্রান্তির ঘুম নেমে এলো। ঘন্টাখানেক ঘুমানোর পরই মুঠোফোনে এলার্ম বাজল। বাস ধরার তাড়নায় উঠে পড়তে হল তাকে। সদ্য পাক ধরা কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ার কারণে মাথার দুপাশে কেমন দপদপ করতে লাগল তার। শাদা গায়ের ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে তোয়ালেটা কাঁধে চড়িয়ে কচকচ করে ব্রাশ চালাতে চালাতে পুকুরঘাটের দিকে চলল সে। গেটের বাইরে বেরোতেই একটা নরম শীতল হাওয়া আবিদের গায়ে ধাক্কা দিল। পলকে সর্বাঙ্গের রোঁয়াতে সেই বাতাসে স্নিগ্ধতা পশে দূর হয়ে গেল রাতজাগার গ্লানি। ভোর রাতে বৃষ্টি হয়েছে। আকাশটা ঝকঝকে নির্মল। কয়েক খণ্ড শাদা মেঘের পাল চড়ে বেড়াচ্ছে আকাশময়। ভোরের পাখিরা আম গাছের ডালে ডালে গা ঝাড়া দিয়ে বৃষ্টির পানি দূরীভূত করছে। অন্যদিন হলে এই সাতসকালে উরবির দেখা মিলতো এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ কোথাও কেউ নেই। বৃষ্টিস্নাত শুকনো পাতা মাড়িয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে জবর একটা গোসল দিল আবিদ। এরপর ঘরে এসে কাপড়চোপড় পরে সাহেব হয়ে খাবার টেবিলে গেল। বলা বাহুল্য, আজ সকালেও আবিদকে সবার সঙ্গে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। আবিদ ও-ঘরে পৌঁছানোর আগেই ঘরের সবাই ঘুম থেকে উঠে সয়লাব। উরবি খাবারের অপেক্ষায় বসে আছে খাবার টেবিলে। মুখ শুকনো, রাত জাগার অবসাদ চোখের শাদা অংশে তার চিহ্ন রেখে গিয়েছে। আবিদ গিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই সে একটু নড়েচড়ে বসল। অকারণে কিচেনের দিকে গলা বাড়িয়ে চাঞ্চল্য প্রকাশ করে বলল,
– কই মামণি হলো তোমার? খিদে পাইছে তো!
ঠিক তখনি ইশতিয়াক সাহেব গামছায় মুখ মুছতে মুছতে হাসিমুখে এসে বসে বলল,
– তোমাকে বললাম আর দুইটা দিন থেকে যাও। শুনলে না!
আবিদ হেসে বলল,
– না আংকেল,সুযোগ থাকলে তো থেকেই যেতাম। আরো একটা ইনপর্টেন্ট কাজ পড়ে গেছে। না-হয় উরবির বিয়ে তো খেয়েই যেতাম।…
শেষের কথাটা বলে আড়চোখে উরবির দিকে তাকাল আবিদ। উরবি তার শ্লেষে কর্ণপাত করল বলে মনে হল না। সে চুপচাপ বুকে হাত গুঁজে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে রইল। খানিক পর সালমা এসে খাবার সেজে দিলে নির্বিকারে খাওয়া পর্বটা সম্পন্ন হল।
সকাল আটটার দিকে আবিদ রওনা দিল বাস-স্টেশনে। বাস-স্টেশন পর্যন্ত সঙ্গে এলো উবরি এবং ইশতিয়াক সাহেব স্বয়ং নিজে। আবিদ অবশ্য স্টেশনে কাউকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে কাঁইমাই করলেও ইশতিয়াক সাহেবে স্নেহময় অভিমানের ভর্ৎসনায় আর দ্বিরুক্তি করা গেল না। অগত্যা সবাইকে নিয়েই একটা টমটম ভাড়া করে স্টেশনে পৌঁছা গেল। গতরাতের পর এযাবৎ উরবির সঙ্গে আর কথা হয়নি আবিদের। বিদায় বেলার জন্য হলেও কিছু বলা প্রয়োজন ভেবে আবিদ উরবির সঙ্গে কথা বলার জন্য ইতস্তত করল সারাটা পথ। কিন্তু পাশে ইশতিয়াক সাহেব থাকাতে ব্যাপারটা জটিল হয়ে পড়ল৷ সুযোগটা পাওয়া গেল স্টেশনে এসে। তখন স্টেশনে আশেপাশে এলাকায় ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত যাত্রীগণ বিভিন্ন দোকানের ছাউনির তলায় আশ্রয় নিল আকস্মিক বৃষ্টির ওপর খোদোক্তি প্রয়োগ করতে করতে। এই সুযোগে ইশতিয়াক সাহেব ঠোঁট টেনে হেসে ওদের থেকে ছুটি নিয়ে গেলেন ওয়াশরুমে। উরবি কাউন্টারে বাঁকানো চেয়ারে চুপ করে বিষণ্ণ মুখে বৃষ্টিকণার পৃথিবীর বুকে অবিরাম ঝরে পড়ার পানে তাকিয়ে রইল৷ একদৃষ্টে। আবিদ ওর পাশে গিয়ে বসে কাঁধের লম্বা ব্যাগটা কোলে নিয়ে বসল। আবিদ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই উরবি আগেই সেই দৃষ্টি বজার রেখে ঠোঁট দুটো নাড়ল কেবল,
– এমনটা নয় তো, আমার বিয়ে নিজের চোখে দেখতে পারবেন না বলে পালিয়ে যাচ্ছেন! আপনার চোখ দুর্বোধ্য, আমার ভেতরটা আপনি পড়ে ফেলছেন। কিন্তু আমি পারি না। আপনার ভেতরে সব শূন্য দেখি আমি!
আবিদ কিছু একটা ধরা খাওয়ার ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেল একটু। সে আমতা আমতা ভাবটা কাটিয়ে স্পষ্টভাবে বলল,
– নাহ্! আমার বাবাকে দেখতে যেতে হবে। একটু অসুস্থ খবর পেয়েছি।
উরবি বলল,
– বাবার ন্যাওটা আপনি নন আমি জানি। বৃদ্ধ বয়সে ওনি সারাবছরই কমবেশি অসুস্থ থাকবেন। তাহলে কি আপনি আবার সংসারী হবেন?… শাক দিয়ে মাছ ঠেকে কী লাভ বলুন?
এই কথার জবাব বোধহয় আবিদের কাছে ছিল না,সে নীরব রইল। মেধাশূন্য মনে করা মেয়েটা এতো কথার মারপ্যাঁচ জানে সেটা কে জানতো? মানুষের স্বভাবে তার ভেতরের বিদ্বান মনটা কখনোই ফুটে ওঠে না। উরবিরও ওঠেনি। তাছাড়া আবিদও শুনেনি উরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ স্টুডেন্ট ছিল! উত্তর না পেয়ে উরবি কাতর গলায় বলল,
– যাক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আজ বাদে কাল আমার বিয়ে। এখনই এসব পাগলামি মানায় না। আপনি তো আমার হবেন না জানি। আজ শেষ দেখায় একটা কথা শুধু জানিয়ে যান আমাকে আর কিছু চাইব না, আপনি কি ভালোবাসেন আমাকে? একথা জানালে আপনার মান যাবে না নিশ্চয়!
শেষের দিকে উরবির গলা জড়িয়ে এল। কান্নার দলা আটকে বাষ্পীভূত হয়ে নীহারিকার মতো চোখের কোণে জমল টলমলে লোনা জল। অপরদিকে উরবির কথায় উত্তরোত্তর শ্লেষের ধাক্কা আবিদকে একেবারে হতবিহ্বল করে দিল। সে আড়ষ্ট গলায় বলল,
– হুমম, বাসি।
উরবির অশ্রুপূর্ণ মুখের ওপর একচিলতে হাসি বাইরের বৃষ্টিস্নাত রোদ্দুরের মতো ঝিলিক দিয়ে পরক্ষণেই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেল। তামাটে বর্ণের কনটাক্টর হাঁকল,
– মেহেরপুরের যাত্রীরা আসেন আসেন তাড়াতাড়ি। ন’টা পাঁচে গাড়ি ছাড়বো। মেহেরপুর মেহেরপুর…
আবিদ পকেটে টিকিটের উপস্থিতি যাচাই করে একটা দীর্ঘশ্বাস মুক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইশতিয়াক সাহেব হাত-মুখ ডলতে ডলতে এলেন ওয়াশরুম থেকে। আবিদ তাড়া দিতেই এগিয়ে এসে কোলাকুলি করে সাবধানে চলা ফেরা করার তাগিদ দিলেন। আবিদ নীরব হেসে সায় দিয়ে উরবির দিকে ছোট করে হাত নেড়ে বিদায় বার্তা জানিয়ে বাসে উঠে পড়ল দু তিন লাফে। দু’জনেরই বুকের নদী ভেঙে উদ্বেল ঠেউ আছড়ে পড়তে লাগল কূলে কূলে। কেউ দেখল না। কেবল যার যার অন্তর্যামীই টের পেল এই ভাঙনের উচ্ছ্বাসের নগ্ন নৃত্য। গাড়িতে উঠে জানালার পাশের সিটটাতে চেপে বসল আবিদ। আরো একবার কাউন্টারের দিকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় বার্তা জানাল সে। আবারো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল আকাশ ফুঁড়ে। মিনিটি দুই পর সাঁই করে গাড়ি ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে উরবির চোখে অদৃশ্য হয়ে গেল আবিদের চেহারাটা। একসময় বাসটাও দূরের বাঁকে হারিয়ে গেল, ঠিক যেভাবে আবিদের মনের বাঁকে হারিয়েছে উরবি। হায়, কোথায় গেল উরবির ডানপিটে স্বভাব? কোথায়! সেই গাড়ির রাবারের চাকার নিচেই যেন উরবির সমস্ত চঞ্চলতা পিষ্ট করে দিয়ে গেল আবিদ।
উরবি ধীরে ধীরে কাউন্টার থেকে নেমে গেল কাঁকর ঢালা রাস্তায়,ঝুম বৃষ্টিতে। বড় বড় ফোঁটার শিহরন জাগানিয়া বারি-সলিল উরবির ক্ষীণ দেহ ভিজিয়ে জবজবে করে তুলল নিমিষেই৷ ইশতিয়াক সাহেব বারকয়েক হাঁকুনি দিয়েও মেয়েকে বিচলিত করতে পারলেন না। সে এই ভীষণ বারিধারার মাঝে নিজের অশ্রুধারা বন্যা বইতে দিতে দিতে হেঁটে চলল দূর আজানায়।
.
.
.
পরিশিষ্ট অংশঃ
কয়েক বছর পর…।
বান্দরবানের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে আবিদ। আজ তার মা আর স্ত্রী আদিবার দশম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিবছর এখানটায় এই শেষ বর্ষায় এসে সেইদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে আবিদ। পাহাড় ধসের আশংকায় এবছর পর্যটকদের এদিকটায় আসা নিষেধ ছিল অবশ্য। কিন্তু গুমটিঘরে বসে থাকা প্রহরীকে মোটা অংকের টাকা গুঁজে দিয়ে আবিদ ঠিকই পৌঁছেছে এখানে। একইভাবে মূ্র্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকাল আর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা কড়া নাড়ছিল আকাশের গায়ে সে খেয়াল করেনি আবিদ। হঠাৎ চমক ভাঙল পায়ের নিচে ভূতলের মাটির প্রবল কম্পনে। আবিদের বুঝতে দেরি হল না, পাহাড় ধস হতে চলেছে। তবুও সে একচুল পরিমাণ নড়তে পারল না অজানা ভয় আর মা-স্ত্রীর কাছে চিরতরে নির্বাসিত হওয়ার অবিমিশ্র খুশিতে। ক্রমশ ভূ-কম্পনের মাত্রা ঘনীভূত হতে শুরু করল। আর ঠিক তখনি কেউ একজন নাটকীয়ভাবে তার হাত ধরে টানতে লাগল৷ অদ্ভুতভাবে সেও সেউ টানে সাড়া দিয়ে দ্বিধা না করে নিজেকে সঁপে দিল অজানা ব্যক্তিটির হাতে। মানুষটি টানতে টানতে তাকে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অংশ হতে দূরে নিয়ে এল। তখনো সাঁঝের আঁধার পুরোপুরি গ্রাস করেনি পাহাড়ের চূড়াকে। আবিদ আকস্মিক দৌড়ানোর ধকলটা বড় বড় নিশ্বাসে সামলে নিয়ে মানুষটার দিকে তাকাতেই বুকটা তার ধক করে কেঁপে উঠল৷ বিস্ময়-লুব্ধ কুঞ্চিত কপালে সে অস্ফুট শব্দ করল,
– উরবি?
আবিদের হাতটা তখনো উরবির হাতেই ধরা ছিল। সে ছেড়ে দিয়ে বলল,
– কাকে আশা করেছিলেন? নতুন কেউ জুটেছে?
উরবির কথার ধার আর ধরণ পরিবর্তনে আবিদ এবার দ্বিগুণ চমকে তাকাল। চমকালে আবিদের কেশগুচ্ছ লাফিয়ে উঠে কপালে ঝুলে পড়ে। দৃশ্যটা বরাবরই উপভোগ করে উরবি। আজও ঠিক তাই তাই হল। উরবির দিকে তাকিয়ে আবিদ অগাধ বিস্ময়ে মূক হয়ে রইল৷ উরবি আর আগের মতো ক্ষীণাঙ্গী নেই। গায়ে-গতরে পূর্ণ যৌবনের পরিপুষ্ট ভাব যেন কল্পলোকেও চোখ ধাঁধায়! আগেকার শরীরের অস্থিরতা, চোখের চঞ্চলতা,কথাবার্তার তুচ্ছ জবাব দেওয়া মেয়েটার বচনের ধারে টিকা যায় না এখন। আবিদের মানসভূমিতে একটা কথা খেলে মুহূর্তে, মেয়েটা শেষ কয়েকটা দিন এমনিভাবেই পরিবর্তন হচ্ছিল ধীরে ধীরে।… ভাবনার জাল কেটে গেল। বিকট এক গুম গুম শব্দে পাহাড়ের বড় একটা অংশ ধসে পড়ল হাজার ফুট উপর থেকে। সঙ্গে দূর দূরান্ত থেকে ভেসে এলো পাহাড়ি জনপদের মানুষদের আর্ত চিৎকার। যদিও আগেই ধসের আশঙ্কার হওয়ার কারণে মানুষজন সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। হয়তো-বা প্রাণে বেঁচে গিয়ে এই উল্লাস-চেঁচামেচির অবধি নেই তাদের। আবিদের চোখে তারায় দশ বছর আগের একই দৃশ্যটি ভেসে উঠল। আদিবা কি প্রাণে বাঁচতে আবিদকেই ডেকেছিল সেই সময়?… মনে পড়ে না। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস মোচন করে আবিদ সপ্রতিভ দৃষ্টিতে উরবির দিকে তাকাল,
– তারপর আপনি এখানে?
উরবি ভাঙা পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ ফিরিয়ে বলল,
– ভাগ্যের ফের। আমি গত একমাস ধরেই এখানে আছি। আমার একটা ভার্সিটির ফ্রেন্ডের বাসায়। আমার বিশ্বাস ছিল আপনি এই মাসের যেকোনো একদিন এখানে আসবেন। তাই প্রতিদিন এখানে এসে বসে থাকতাম।…
আবিদ স্বভাবিকভাবে বলল,
– ওহ। সাথে কে এসেছে?
উরবি মুখটা বিষাদ-মলিন হয়ে গেল,
– কে আসবে? আমার কেউ নেই। আমি আপনার মতো নিঃস্ব এখন।
শেষের কথাটা বলে একটু হাসার চেষ্টা করল সে।
আবিদ বলল,
– নেই মানে?
– নেই মানে নেই।
– আপনার হাজবেন্ড… বা আংকেল?
উরবি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
– আপনি দেখছি সত্যিই কিছু জানেন না। জানবেই বা কেমন করে… শুনুন তবে। সংক্ষেপে বলি, এসব বিষয় আমি আপনার মতো শক্ত হয়ে বলতে পারি না।
অজানা আশঙ্কায় আবিদের হৃৎপিণ্ডের হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। সে উর্ধ্বশ্বাসে বলল,
– আচ্ছা ছোট করেই বল,
উরবি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি মেলে শুরু করল,
– ‘আপনি যেদিন চলে আসার পর আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি বাবাকে রেখে হাইওয়ে ধরে যতদূর পারি হেঁটে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাসায় ফিরব না আর। কিন্তু বাবার কথা মনে হওয়ার পর আর থাকতে পারিনি। ঘরে ফিরে গেলাম। আমার বিয়ের আয়োজন শুরু হল। আমি কিছুই বলিনি। নিয়তির দিকে তাকিয়ে ছিলাম শুধু। আমার আক্দ হল। অনেক কষ্টে ‘কবুল’ বললাম। মনে মনে মেনেও নিয়েছিলাম নিজের নিয়তিকে। ভেবেছিলাম মন দিয়ে সংসার করে আপনার মতো পাষাণের দেওয়া দুঃখ ভুলব। কিন্তু কে জানতো আমি পোড়াকপাল নিয়ে জন্মেছিলাম? আক্দ এর পরদিন মেহেদী অনুষ্ঠান আর তার পরদিন বিয়ের অনুষ্ঠান করে ঘরে ওঠানোর কথা ছিল। কিন্তু মেহেদী অনুষ্ঠানের দিন বাড়িভর্তি লোকের সামনে আমার বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। কারণ জানতে চাইলাম, জিসান নাকি মাদকব্যাবসায়ীদের লিস্টে আমার বাবার নাম দিয়েছে শুধুমাত্র আমার ওপর ঝাল মেটানোর জন্য৷ অথচ আমার বাবা ভালো করে কিছু মাদকের নাম বলতে বললেও পারবে না এতোই সহজসরল মানুষ… ! পরে দুঃখ কষ্ট অপমানে বাবা জেলখানায় স্ট্রোক করল পরপর দুইবার। আমি অনেক কষ্টে দেখা করেছিলাম অসুস্থ বাবার কাছে। বাবা শুধু আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, ভালো থাকিস মা। আমি বাবাকে কেঁদেকেটে বলেছিলাম,আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা,আমার জন্যই আজ তোমার এতো অপমান। বাবা আমার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে জানালেন, আমি নির্দোষ। আমাকে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না। এরকিছুদিন পর বাবা তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোক করলেন। এবার আর পৃথিবী তাঁকে রাখল না। চলে গেল। এরপর আমাকে কোনোমতে শ্বশুরবাড়িতে উঠিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল আত্মীয়স্বজনেরা-নিরুর বাবা’রা। কিন্তু ছেলেপক্ষ জানাল তাদের পক্ষে সম্ভব না আমাকে ঘরে তোলা। একজন মাদক ব্যাবসায়ীর মেয়েকে ঘরের বৌ করতে তাদের আপত্তি। আমার মাথা ঠিক ছিল না। সবকিছুর মূলে নিসান। জেলের মধ্যে জিসানকে মারতে গিয়েছিলাম। প্রহরী ঢুকতে দেয়নি। রাগের বসে প্রহরীকে মেরে আধমরা করার জন্য জেলও খেটেছি। এরপরও আমি অপেক্ষা করেছিলাম এই পোড়া কপালটার গতি দেখার জন্য। কিন্তু দিনের পর দিন ঘরে থাকার পর মনে হল আমার গতি আমাকেই করতে হবে। আমার কপালটা যে পোড়া! একদিন সবাইকে জানিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আপনাকে তো ভালোবেসেছিলাম একটা সময় আপনার মতোই ভবঘুরে হবো বলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কে জানে কতদূর হতে পেরেছি।’
নিরু কণ্ঠস্বর বিষম কাতরতায় ভেঙে এলো। একটু থেমে দম নিল সে। বিস্ময়-বিহ্বল আবিদের দিকে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে বলল,
– ‘নিরু পোড়াকপালির কথা শুনবেন?’ আবারো দূর আবির মাখা মেঘেদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলা শুরু করল উরবি,’ নিরুর বিয়ে হয়েছিল ওর অনার্স শেষ হওয়ার ওর। ভালো স্কোর করেছিল ও। পড়ালেখার প্রতি ভীষণ সিরিয়াস ছিল । কিন্তু ঐ যে পোড়াকপাল! বিয়ের এক বছর পরই ওর দুশ্চরিত্র স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে নিরুর ওপর নানানরকম মানসিক-শারিরীক অত্যাচার করতে থাকে। শেষমেশ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসে বেচারি। মেয়েটা আমার পাগল ছিল পুরো। ছোটমামণির বেবি হয়েছে, এটাই কেবল ভালো খবর।
উরবি অকৈতবে সব ঘটনা খুলে বলে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল।কিছু মানুষ চাইলেও নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঝড়গুলোর বর্ণনা সংক্ষেপে দিতে পারে না। উরবিওর তাদের একজন। সব শুনে আবিদ নিজের আধা আঙুল সমান বড় দাড়িতে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে কি যেন আকাশপাতাল ভাবনায় ডুব দিল। বেশ কিছুক্ষণ পর উরবি ধাতস্থ হয়ে শুধাল,
– কী ভাবছেন ওতো করে?
আবিদ কপট ভাবনা-চ্যুত হওয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
– ভাবছি,আমার ভবঘুরে নিঃসঙ্গ জীবনে একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। দরকার ছিল অবশ্য। কিন্তু, অনুমতির অপেক্ষায় ছিলাম শুধু।
উরবি স্নিগ্ধ-হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আবিদের চোখে লুকিয়ে শুধু বলল,
– অনুমতি পেয়েছেন?
– পেয়েছি।
– বেশ তো… আমি তো জানতামই আদিবা খুব ভালো মেয়ে।
উরবির কথায় ওর আনন্দটা স্ফুরিত হয়ে টিকরে পড়ল। বুঝতে পেরে আবিদ উরবির করপল্লব নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুচকি হাসল।
আর কেউ কোনো কথা বলল না। দু’টি মনই নিজস্ব ভাবনার ব্যস্ত! উরবি তার মনোরাজ্যে পতপত করে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে চির-ভবঘুরে আবিদকে নিয়ে। আর আবিদের মনের ঘুলঘুলি গলে সেই ডানা ঝাপটানোর কুহক হাওয়া প্রবেশ করছে ফরফর করে। ইচ্ছে, এবার বিনাবাঁধায় দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবে দু’জন। আকাশে একাকিনী বাঁকা চাঁদটার পাশে সন্ধ্যাতারাটা জ্বলজ্বল করে উত্থাপিত হল। পাহাড়ের চূড়ায় নেমে এলো জোছনা-মলিন অাঁধার। ভবঘুরে আবিদ আর চঞ্চলা উরবি দু’জন দু’জনার কাছে এসেও যেন মন ভরল না, সব পেয়েও কি যেন অপূর্ণ রয়ে গেল। ছোট্ট জীবনে অগণিত প্রাপ্তির মাঝে কখনো-সখনো অপ্রাপ্তির মেলা বসে।
(সমাপ্ত)
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share