ভবঘুরে পর্বঃ ২০

0
770

ভবঘুরে পর্বঃ ২০
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

মুহূর্তেই গা ছমছমে একটা ভাব ব্যাপ্ত হয়ে গেল চারপাশে। আবিদ বোধহয় খানিকটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
– কীসের শব্দ? আশেপাশে বাড়িঘর আছে নাকি?
উরবি ওর ভীরুতা দেখে মনে মনে আমোদিত হল। বলল,
– অশরীরী, চুপ করে মটকা মেরে পড়ে থাকেন। চিন্তা নাই,ক্ষতি করে না ওগুলা। এমনেই শয়তানী করে মানুষ দেখলে।…দুষ্টু!
‘দুষ্টু’ শব্দটা অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে শাসনের ভঙ্গিতে আওড়াল উরবি। আবিদের ভারি হাসি পেল ওর কাণ্ড দেখে। বাচ্চা বাচ্চা একটা ব্যাপার আছে মেয়েটার মধ্যে। খারাপ নাহ্! ছেলেটার কান্নার শব্দ থেমে গেছে তখন।
– ‘এসব ভূত-প্রেত আছে নাকি পৃথিবীতে? যত্তসব ভিত্তিহীন কথাবার্তা।’ উরবির কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল আবিদ।
উরবি ঝাঁঝালো গলায় বলল,
– তাহলে কীসের আওয়াজ শুনি এটা? বৈজ্ঞানিক মানুষ আপনি,ব্যাখ্যা দেন দেখি। এতটুকু বলে আবার নিজে নিজে বিড়বিড় করতে শুরু করল উরবি,’ হুহ্,আমার গ্রাম আর আমি জানি না এখানে কাহিনি? আসছে…’
আবিদ আর উরবির কথার উত্তর দিল না। এরকম উগ্র টাইপ মেয়েদের সঙ্গে কথায় পড়লেই বিপদ। একবার কথার অর্গল উন্মুক্ত হলেই আর রেহায় নেই, সারাদিন ভ্যাজরভ্যাজর করতেই থাকে। এখনো করেই যাচ্ছে। মিনিট কয়েক উরবির কল্পিত ভূত নানা উৎপাত করে অবশেষে বিদায় নিল। আবিদের বিশ্বাস, তার হেলোসিল্যাশন হচ্ছে একটু আগে মাথায় ভীষণ আঘাতের ফলে। আর সেই সুযোগে ধড়িবাজ উরবি তার সঙ্গে মজা লুটছে। এছাড়া কিছুই নয়! থেকে থেকে আবিদ অস্থিরতা বাড়ছে। একটা সাপ-বিছা ভরা জঙ্গলের ভেতরে এতক্ষণ অবধি অপরাধীর মতো লুকিয়ে থাকাটা তার আঁতে লেগেছে,লাগছে। অথচ এই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে মেয়েটা কেমন নির্ভারে বসে আছে একজন পরপুরুষের সাথে! উরবির কুঁড়েমিতে বিরক্তির পরিমাণটা বানের জলের মতো বাড়ছে আবিদের। এদিকে আবিদের মাথা যন্ত্রণাকালে উরবি মাথার চুল টেনে দেওয়ার ফলশ্রুতিতে মাথাভর্তি মাছের খর আঁশটে গন্ধ তার। উরবির শয়তানের পোকা কিলবিল করা হাত থেকেই লব্ধ এই বাজে গন্ধ। সেসময় তৎক্ষনাৎ মাথায় আসেনি যে উরবি ঘাসের মধ্যে হাত মোছার কথা বলে মাছের সব লালা আবিদের মাথায় মুছেছে বিনামূল্যে চুল টেনে দেওয়ার বদৌলতে। এতো বদ ও মানুষ হয়! আবিদের সমুদ্দুরসম বিরক্তিকে একপশলা রাগের বৃষ্টি হয় এবার। তবু সময়টাতে একটু আরাম পাওয়া গেছে ভেবে আবিদ আর বাগবিতণ্ডায় জড়াল না উরবির সঙ্গে। মেয়েটা আসলেই বদ। এই নিয়ে অহেতুক তর্ক করতে গেলে আবারো সেই গন্ধমাখা হাতটা আবিদের মুখের সামনে নিয়ে আসবে এতে সন্দেহ নেই।

আরো ঘন্টাখানেক পর যেন উরবির সন্দেহের মেঘ কাটল যে, নাহ্ আর বিপদের আশংকা নেই। তখন সে আবিদকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে পুনরায় মাঠ পেরিয়ে মেটে রাস্তায় উঠে রওনা দিল বাড়ির দিকে। ফিরতে ফিরতে সে গাঁইগুঁই করে অনেক হা-হুতাশ করল মৃগেল মাছটার হারানো শোকে। শালবনের একটা গাছের নিচে মৃত মাছটাকে রেখেছিল সে। বোধহয় কোনো সরীসৃপ প্রাণী রাতের ভুঁড়ি-ভোজন করার সুযোগটা নেহাত হাতছাড়া করেনি মাগনা মাছটা পেয়ে। এই ঘটনায় ভেতরে ভেতরে বেশ প্রফুল্ল হয়েছে আবিদ। কিন্তু প্রকাশ করেনি। কী দরকার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া?
…………………………………..
দুদিন পরের কথা। উরবির নামে তুখোড় এক কলঙ্ক রাষ্ট্র হয়ে গেল পুরো গ্রামজুড়ে। ঢিঢি পড়ে গেল চারিদিকে। লোকমুখে প্রচারিত হচ্ছে নানান রকমের কুৎসা। মজিদের চায়ের দোকানে, যুবকদের আড্ডায়, মুরব্বিদের ভারিক্কি মজলিসে, মেয়েদের হেঁশেলঘরে, মাঠে-ঘাটে, গাড়ি-ঘোড়ায়, বাজারে-গঞ্জে, সর্বত্রই আলোচনা-সমালোচনা চলছে ইশতিয়াক সাহেবের আদরের কন্যা তথাকথিত ‘বেয়াদব’ উরবিকে নিয়ে। এতোদিন প্রশ্ন উঠেছে তার চলাফেরা, আচারবিধি, আর পোশাক-আশাক নিয়ে;এবার প্রশ্ন উঠল সরাসরি তার চরিত্র নিয়ে। কারণও অবশ্যই আছে। কে যেন উরবি আর জিসানের ব্যাপারটা ঘোলা আর বিকৃত করে দুন্দুভি বাজিয়ে প্রচার করেছে। এযাবৎ লোকজনের ঠোঁটের আগায় যে গপ্পো বাস করছে তা পুরোটাই যে অতিরঞ্জিত তা গুটিকতক মানুষ ভিন্ন কেউ জানে না। জানার কথাও নয়। সবাই ভাবছে উরবির চরিত্রগত কোনো সমস্যা আছে নয়তো জিসানের সঙ্গে পিরিত করে আবার নিজের সম্ভ্রম নষ্ট করতে গিয়ে আত্মরক্ষার্থে মারামারি করবে কেন? এতো পাজি হবে কেন মেয়েমানুষ? বাবা মা বিয়ে দেওয়ার সময় দিল না,প্রেম করতে নেমে গেল? তবে সম্ভ্রমহানির ঘটনাটি আর এতো ছোট আর সাধারণ নেই। সেটাকে অত্যুক্তি করে রঙচঙ মেখে বেহায়াপনায় প্রকাশ করছে কিছু মানুষ। ক্রমান্বয়ে ঘটনাটা মহামারির মতে দ্রুত এবং বিকারপ্রাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দিকবিদিকে। এই কলঙ্কের ধাবমান বিশাল জলোচ্ছ্বাস রুখার সাধ্যি পৃথিবীর কারোর নেই। জিসান গ্রাম থেকে ফেরারি হয়েছে গত দুইদিনে। কোথাও চাপা শোনা যাচ্ছে, উরবির নামে কলঙ্ক রটিয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে অনাদিকালের জন্য পাড়ি জমিয়েছে সে। আর ফিরবে না এই জীবনে। ঘটনা সত্য কি মিথ্যা এতটুকুও বোঝার জো নেই। তার চাচা মনসুরের কালো ঐশ্বর্য আর পার্থিব ক্ষমতার অন্ত নেই। হলেও হতে পারে সত্য। মেয়েমানুষের কলঙ্ক বড় খারাপ জিনিস। এই রোগে যাকে ধরে তার কপাল পোড়ে। উরবির কপাল পুড়েছে এবার। কিন্তু উরবি? অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারিণী উরবি এই অবর্ণনীয় কলঙ্কে বিন্দুমাত্র মর্মাহত হল না। বরং কিছুটা থিতু হয়ে সে পরবর্তীতে জিসানকে পুনরায় আচ্ছামতো ঠ্যাঙানোর জন্য জোরালোভাবে বদ্ধপরিকর হল। কিন্তু বাবার চিন্তাক্লিষ্ট পাণ্ডুর মুখের দিকে তাকালে বুকের যেন কালান্তক ঝড়ে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যায়। বাবা যে এই ঘটনায় একশেষ কষ্ট পেয়েছে সেটা বুঝতে অনেকটা দেরি হয়ে যায় উরবির। দিন-রাত অষ্টপ্রহর স্বভাবিকভাবে ঘুরাফেরা করে কাটালেও পাকেচক্রে বাবার সামনে পড়লে মুখটা তার শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যায় লজ্জায়,ঘৃণা,অপমানে। হাজার হোক, সে নারী। নারীত্ব তার দেহের রক্তের কণায় কণায় মিশে আছে। মিশে আছে শরীরে পরতে পরতে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তবে ইশতিয়াক সাহেব বেশ জানেন পুরো ঘটনাটা বানোয়াট না হলেও যে খারাপ অংশটুকুর অপবাদ তার মেয়ের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে তা সুপ্ত শত্রুপক্ষের মনগড়া গাল-গপ্পো মাত্র। মেয়ের উপর বিশ্বাস আর আস্থা দুই-ই খুব বেশি পরিমাণে রয়েছে তাঁর। তাতে কী? পৃথিবীর কোনো বাবা-ই মেয়ের এমন পরিস্থিতিতে স্থির থাকতে পারবে না। তিনিও পারছেন না একদণ্ড! মেয়ের সুদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরতিশয় দুশ্চিন্তায় তার চোখের ঘুম যেন এই গ্রীষ্মের তপ্ত ধুলিতে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তাঁর রোগাক্রান্ত শরীর দিনে দিনে মর্মপীড়ায় আরো ভেঙে পড়তে লাগল। এ কয়দিনে বয়স যেন হঠাৎ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে চেহারায় বার্ধক্যের ছাপটা ফুটিয়ে দিলে পালিয়ে গেল।
বাবার শরীর খারাপ শুনে দুপুরে চুপিচুপি বাবার ঘরে এলো উরবি। তার চোখ মুখ স্বভাববিরুদ্ধ শান্ত-স্নিগ্ধ, তবে দুঃখ কষ্টের চিহ্নমাত্র নেই পুরো আননে। বাবার ঘরে গিয়ে উরবি দেখল বাবার পাশে বসে কি যেন রাজ্যির আলাপ জুড়ে দিয়েছে আবিদ। উরবিকে দেখেই একপলক তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। বলল,
– ‘আচ্ছা আংকেল, আজ যাই। আমার আবার কিছু কাজ আছে। চিন্তা করবেন না। আমি তো কয়দিন আছিই পাশের ঘরে।’
বলে ভদ্রতার হাসি দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল আবিদ। উরবি একনজর ওর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবিদের জায়গাটাতেই বসে পড়ল ধীরে-সুস্থে। লোকটা কি সব শুনেছে তার ব্যাপারে? কে জানে?
ইশতিয়াক সাহেব ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উরবির সঙ্গে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলেন,
– কী রে? আজকে খাওয়ার টেবিলে খেতে এলি না যে?
– ‘কত সময়ই তো আসি না। আজকেরটা নিয়ে এতো ঘাটাঘাটি কেন?… বাদ্দাও, তোমার শরীর খারাপ হল কেমনে?’ উরবির কণ্ঠে হালকা বেমানান শাসনের সুর৷
ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের নিস্পৃহতা দেখে যতটা না অবাক হয় তারচে বেশি প্রফুল্ল হয় মেয়ে এতো আবিল ঘটনা আমলে নেয়নি ভেবে। তবু বাবার মন সর্বদা আইঢাই করতেই থাকে যে!
– অসুখ কী আর বলে কয়ে আসে রে? কি জানি কেমনে কেমনে হয়ে গেলাম!
অকুতোভয় উরবি শেষমেশ আসল কথাটা বলেই বসল বাবাকে,
– দেখো বাবা, আমি চাইনা আমার জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হয়। তোমার মতো শিক্ষিত মানুষ যদি এভাবে ভেঙে পড়ে তাহলে তো হয় না বাবা।মানুষের কাজই তো এসব রটানো! কেন টেনশন করতেছ?
– উরবি,যেদিন অবিভাবক হবি কারো, সেদিন তোর সব বুঝে আসবে। এর আগে তোকে এসব বোঝানো বেগার খাটা।… এদেশের মেয়েরা এখনো নিগৃহীত। সেটা তোকে বুঝতে হবে। বাঁধাগৎ নিয়ম সব এখানে। তুই এই ঘোর গ্রামের ভিতর যখন যা খুশি তাই করে বেড়াতে পারিস না। কোনো সমাজে চলতে হলে সেই সমাজের রীতিনীতি চারিপাশের পরিবেশ বুঝে চলতে হয়। তুই একবার একলা বসে ভেবে দেখ, তুমি যা করে বেড়াচ্ছিস তা কি ঠিক? … রাগ করিস না। তোকে এসব আগেই বলে সতর্ক করা উচিত ছিল। আমারই ভুল৷ আজ লোকে নানা কথা বলে আমার মেয়ের নামে। আমার সহ্য হবে কেন বল?
উরবি চুপ করে শুনতে লাগল বাবার কথা৷ শেষ হলে বলল,
– আমার জায়গা থেকে আমি কোনো ভুল করি নাই। ছেলেটার মার খাওয়া উচিত ছিল আমার হাতেই। খাইছে। কিন্তু যারা বিষয়টাকে বাড়াবাড়ি করে অশ্লীল করে ছড়াইছে তাদেরও আমি ছেড়ে দিব না।
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে উরবির নাকের পাটা স্ফীত হল, কণ্ঠে ঝরল ভীম উত্তাপ! এরপর খেপা একপশলা বর্ষণের মতো আবার মুহূর্তেই শান্ত হল সে।
ইশতিয়াক সাহেব চুপ করে রইলেন অনেক্ষণ। ঘরময় বাবা মেয়ের ফোসফাস নিশ্বাসে উঠানামা আর উত্তরের দেয়ালঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার একঘেয়ে টিকটিক শব্দ বাদে আগাগোড়া নৈঃশব্দের ইথারে পরিপূর্ণ। মিনিট দুই পর নিস্তব্ধতার জাল গুটিয়ে বাবা এবার সাহস নিয়ে বলল,
-‘ উরবি,আমি ভেবেছি তোর বিয়ে দেব। তোর আর পড়াশোনা করা লাগবে না’
উরবি কি ভেবে যেন সন্দেহের চোখে বলল,
– লোকটার সঙ্গে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল?
ইশতিয়াক সাহেব উপরে নিচে মাথা নেড়ে স্বীকার করলেন,
– হ্যাঁ, আশেপাশের গ্রামে তোর বিয়ের কথা বলতেই মানুষ দা-বটি নিয়ে ধাওয়া করবে। যা রটেছে তোর নামে। এতটুকু বলে গলা ধরে আসে ইশতিয়াক সাহেবের। একটু স্বভাবিক হয়ে গোঁ ধরে বলল,
– এই গ্রামে বিয়ে দিব না আমার মেয়ের। মেহেরপুরের ঐদিকে ভালো ছেলে আছে কি না জিজ্ঞেস করলাম আবিদের কাছে। সে জানাবে বলেছে। দেখি কি হয়৷
উরবি উড়ে দাঁড়াল। সঙ্গে ফুসফুস হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো রংহীন ভীষণ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস। উরবি চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখ লুকিয়ে ফিরতে উদ্যত হল। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,
– যা মন চায় করো। আমার আর কিছু বলার নেই।
ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের সহজভাবে চলে যাওয়ায় পানে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইলেন।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


উরবির বেদম কষ্ট হচ্ছে। হৃদয়ের রৌদ্র-পোড়া উঠোনে একদল নীল বেদনার শ্রমিক জড়ো করা পাথর ভাঙছে নিশিদিন। টক টক টক টক…। তার বর্তমান হৃদয়বাড়িটা ভেঙে চুরমার করে সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষের নামে ভবন তৈরি হতে চলেছে সেখানে। বেদনার শ্রমিকের প্রতিটি হাতুড়ির আঘাতে যেন সে বারবার চৈতন্য হারাচ্ছে। উরবির বিয়ে! এই সদ্য কপালপোড়া উরবির কষ্ট প্রকাশ করার অধিকার নেই পৃথিবীতে। কার সে সদা উচ্ছল, চঞ্চল স্বেচ্ছাধীন। কষ্টগুলো যে তাকে পুষেই রাখতে হবে…।
ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের সহজভাবে চলে যাওয়ায় পানে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইলেন। চঞ্চল মানুষের আপন কেউ-ও মানুষটার ভেতরের কষ্টটা দেখতে পায় না।

বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল উরবি। এই সময়টাতে নিরু আসতো পড়ার জন্য। উরবির সঙ্গে মিশে উচ্ছনে যাবার ভয়ে নিরুকে আসতে দেওয়া হয়না এই বাড়িতে। শুরুতে নিরুকে অনেক জেরা করার পর সে ফোনে এই বিষয়ে মুখ খুলেছে যে,তার বাবা-মা তাকে এদিকে আসতে বাঁধা দেয়। উরবি কিছু মনে করেনি,ডোন্ট কেয়ার ঢংয়ে ম্লান হেসে বলেছিল,” ঠিক আছে, নিজের খেয়াল রাখিস৷ ভালো মানুষদের সাথে চলাফেরা করিস রাখি”
এমনটাই হবার ছিল। অদৃষ্টের লিখন খণ্ডানোর সাধ্য কার? সেসব দুই-তিন দিন আগের কথা। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি নিরুর সঙ্গে। অবশ্য বেশ কয়েকবার ওদিক থেকে ফোন করে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল নিরু। উরবি দেখেও রিসিভ করেনি। অভিমান কিংবা রাগ নয় সত্যি সত্যিই তার সঙ্গে এড়িয়ে নিরুকে ভালো পথে আগানোর সুযোগ করে দিচ্ছে উরবি। কিন্তু তবুও দুপুরে এই ঘরটা খালি দেখলে অযাচিত একটা শোকাবহ জাপটে ধরে উরবিকে। অনেক্ষণ অবধি সেই নিঃসঙ্গতার পুরু রেশ লেগেই থাকে তার দেহমনে।
দুতলার আমবাগানের পাশাপাশি বিচিত্রময় আসবাবে ঠাসা ঘরটা উরবির। জৈষ্ঠ্যমাসের শেষ সপ্তাহ। দুই কি তিনদিন বাকি আছে। এরপর প্রকৃতির পোড়া তামাটে রঙে স্নিগ্ধতার আভা লাগাতে আসবে আষাঢ়ে বরিষন। উরবি জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল এদিকটার আম গাছের প্রায় আমই নিঃশেষ হয়েছে। অজানা কারণে আম খেলে মন ভালো হয় উরবির। ছাদের ওপর গাছটাতে পাকা আম পাওয়া যাবে ভেবে বিছানা ছেড়ে সেদিকে রওনা দিল সে। তার পরণে সবসময়ের মতো প্লাজু আর টিশার্ট। চুল বিন্যস্ত কবরী বাঁধা। এর বাদে বাড়তি কিছু নেই। দুতলার সিঁড়ি ভেঙে ছাতের দরজার সামনে যেতেই একটু তটস্থ আর কুণ্ঠিত হল সে। আমগাছের ছায়াতলে ছাতের প্যারাপেটে পিঠ ঠেকিয়ে আবিদ বসে আছে মেঝেতে। তার দুই পা জোড় করে একটির ওপর অন্যটি নিপুণভাবে চড়ানো। হাতে সেই ক্যামেরা আর চোখ লেন্সে বসানে। ফট ফট করে উরবির সংকুচিত থমথমে মুখের ছবি তুলে নিল সে। এরপর আঙুলের ইশারায় সম্ভাষণ জানিয়ে বলল,
– ‘আসুন, স্যরি অনুমতি না নিয়েই তুললাম। এমন এক্সপ্রেসন সচরাচর মিলে না।’
উরবি যেন মর্মে মরে গেল৷ তবু সে নিজেকে স্বভাবিক রেখে আবিদের একটু দূরে গিয়ে বসল। বসার আগে গাছ থেকে ছিঁড়ে নিল একটা আধাপাকা আম। আমটা হাতে নিয়েই সে গুমোট বদনে অন্যদিকে চোখ মেলে বসে রইল। আবিদ আরো কিছুক্ষণ ক্যামেরা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে বলল,
– যা হবার হয়েছে,ডিপ্রেস হয়ে কী হবে?
উরবি আবিদের কথা শুনে ঘাড় ঘুরাল। তাকাল অন্তর্ভেদী শীতল দৃষ্টিতে। এরপর ভ্রুকুটি করে অবাক গলায় বলল,
– কে ডিপ্রেস?
উরবির বুকের ভেতর একটা প্রগাঢ় আন্দোলন ঘনীভূত হয়ে এলো৷ তার মানে আবিদ সব জানে! না জানা’রই বা কী আছে? পাঁচ গ্রামের সবাই জানলো আবিদ জানতেই পারে! মনকে প্রবোধ দিল উরবি।
– ‘আপনি।’ আবিদের দ্ব্যর্থহীন জবাব।
– আমি ডিপ্রেস না। আমাদের মাতব্বর সমাজ আমাকে নিয়ে যেভাবে ভাবতেছে আমি নিজেকে নিয়ে সেভাবে ভাবি না। এসব বিষয় আমি কানে তুলি না। আর আপনি কীভাবে বিশ্বাস করলেন যে আমি এসব করছি? সত্য মিথ্যা যাচাই—
উরবির কথার মধ্যিখানে বাঁধা দিল আবিদ,
– আমি কিন্তু একবারও বলিনি যে আপনিই ওসব করেছেন। ভেবেছি আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। দেখো হলো। বললাম। এতটুকুই। এটা নিয়ে আমি মাথা ঘামানোর কেউ নই।
উরবি চুপ করে রইল। একটু পর বলল,
– জিসান করছে এসব? তার কি কোনো খোঁজ পাওয়া গেল? আমি ওকে দেখে নিতাম একটু!
– শুনেছি সে পালিয়েছে৷ বর্তমানে ঢাকাতেই আছে।
– ‘ঢাকার কোন জায়গায়? ক’দিন থাকবে?’ উরবির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা আর প্রতিশোধের ফুলকি।
আবিদ বুঝতে পেরে শান্ত গলায় বলল,
– ছেড়ে দিন। কেন একটা বিষয় নিয়ে জলঘোলা করছেন?
– ‘জলঘোলা আমি না সে করছে। আমি তো কিছুই করি নাই। তাহলে কেন এতো কথা শুনতে হচ্ছে আমাকে?’ শেষের দিকে উরবির গলা ধরে এলো। অপ্রতিরোধ্য কান্নার ডেলা গলার সামনে এসে আটকে রইল। উরবি সহজে কাঁদতে পারে না কোনোকালেই। তার কষ্টগুলোর নল চোখের জলের থই পেতে দেরি হয় ভীষণ। আজ কান্নার বদলে তার এতক্ষণ শান্ত দু-চোখ রক্তিম হয়ে এলো৷ অনেক কসরতে বোধহয় দুই বিন্দু জল চোখের কোলে ঠাই পেলে দ্রুত সরিয়ে নেয় সে। আবিদ বিহ্বল হয়ে একদৃষ্টে দেখতে থাকে হৃদয়হীনা মেয়েটার হৃদয় ভাঙার গল্প। কোনো অখণ্ডনীয় সান্ত্বনার বাণী খুঁজে পায় না সে। উরবি মেঝের দিকে তাকিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে ক্ষীণ গলায় বলল,
– বাবা আমার বিয়ে ঠিক করছে৷ আমার বিয়ের আগে আপনি কোথাও যাবেন না যেন।
আবিদ ওর মতি ফিরেছে ভেবে খুশি হয়ে বলল,
– দাওয়াত কবুল করলাম। এখন সব ঠিক থাকলেই হয়।
উরবি অশ্রুভারাক্রান্ত টকটকে লাল চোখ-দুটো উঁচু করে তাকাল আবিদের দিকে৷ আবিদের হাসি হাসি মুখ পলকে মলিন হয়ে গেল। জাঁহাবাজ মেয়েটার চোখে বারিধারা? এই বারিধারা কি কলংকের বেদনার নাকি অন্যকিছুর? আবিদ প্রশ্ন করতে গিয়েই থেমে গেল।

চলবে…