ভবঘুরে পর্বঃ২৩

0
800

ভবঘুরে পর্বঃ২৩
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

আজ মিশন। র‌্যাবের একটি ইউনিট আবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সকাল সকাল মিশন পরিচালনা জন্য প্রস্তুত হল। আগেই জেনেছি অন্যান্য সাধারণ আস্তানা থেকে এই আস্তানার রীতিমতো বড়ো উদ্ভট রকমের যাতে সাধারণ জনগণ সন্দেহ না করে। সকাল সকাল এই আস্তানার বাসিন্দারা নিরিবিলি পরিবেশ সীমান্ত দিয়ে মাদকদ্রব্য আনয়ন করে আবার কালেভদ্রে সবাই বসে সেই মাদকে মত্ত হয়ে গিলে,টানে,শুঁষে…। ইত্যাদি। ঠিক কোন্ সময়ে মাদকদ্রব্যগুলো এই আস্তানা হতে দেশাভ্যন্তরে ‘সাপ্লাই’ করা হয় সেই হাঁড়ির খবর এই কয়দিনে বের করা সম্ভব হয়নি আবিদের। আমরা বোধহয় আগেও জেনেছি যে এই আস্তানা শুধু মাদকদ্রব্যের আখড়া নয় বরং সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র-সস্ত্রও ‘রিসিভ’ করা হয় এখানে। কাজেই সেভাবেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। বড় রাস্তার কিনারে র‌্যাবের ইউনিটটি আবিদের অপেক্ষায় ইতস্তত আনাগোনা করছে। আবিদ এলেই তার দেখানো পথে এগোবে তারা। ঘোর মেটে রাস্তার গ্রামের মধ্যে এই আস্তানা তৈরি হওয়ার কারণে সবকিছু একটু সহজ আবার কিছুটা কাঠখোট্টাও হচ্ছে!

তখন পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র অঞ্চলে তোফা ভোরের আলো আকাশ বিদীর্ণ করে ফুটেছে সবে। চারিদিকে প্রফুল্ল প্রকৃতির ভাষাহীন নিস্তব্ধতা বড়ো উপভোগ্য। বড় রাস্তার কাঁকর বিছানো মসৃণ পথ জনশূন্য। গতদিনের সমস্ত শারীরিক-মানসিক অবসাদ ঝেড়ে আবিদও উপস্থিত হয় যথাসময়ে। এরপর আবিদের দেখানো পথ ধরে গাড়িবহরে চড়ে ভাঙা পুল পর্যন্ত আসে দলটি। এরপর একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে পথ ধরে। কে জানতো এই অজপাড়াগাঁয়ে এমন অতর্কিত ভয়ংকর আখড়া থাকবে! ভাবতেই অসহায় গ্রামবাসীর জন্য বুকটা হাহাকার করে ওঠে। এবার সবকিছুর নিষ্পত্তি হবে। আবিদ-সহ দলটি এবার পথের দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য মেটে রাস্তা থেকে খালের পাশ ঘেঁষে ঘুপসি মাটির রাস্তা ধরে নেমে পড়ে। শরীর বাঁকিয়ে ঝুলে পড়া বেত গাছের আঁচড় উপেক্ষা করে এগোয় দুঁদে বাহিনীরা। পার হয় ফসল-শূন্য বিলের পর পর বিল, দুর্গন্ধযুক্ত পাঁক— অমানিশার রাতের মতো কালো জলের জলাশয়ে কখনো বা নয় পদস্খলন। এরপর অনেক কষ্টেসৃষ্টে ‘শর্টকাট’ পথে আস্তানার পেছনের দিকটাতে এসে পৌঁছায় তারা। প্রথমটা একটু সময় স্থির থেকে ভেতরে লোকজনের সরগরম মত্ততা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা চালায় সদস্যরা। প্রধান মিশন পরিচালকের দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবাই,অপেক্ষায় সামান্য ইশারার। আবিদ চুপিচুপি জানায়, “সবাই হয়তো এখন মিটিং’এ ব্যস্ত। আবার হতেও পারে তারা কোনো গোপন সুত্রে সংবাদ পেয়েছে। একচুল বিশ্বাস নেই তাদের। অনেক চালাক তারা। যতটুকু শুনেছি আজকেই এখানে সবার একটা গোপন মিটিং হবার কথা ছিল।” প্রধান মিশন পরিচালক চিন্তিত হাতের ইশারায় আবিদকে থামতে বলে। আর কালক্ষেপণ না করে অভিযান শুরু করার ইঙ্গিত দেয় তীক্ষ্ণ ধারালো চোখে। তবুও আবিদ আরো একটা গুহ্য ইঙ্গিতের অপেক্ষা করে নিজের কোমরে গুঁজা পিস্তলে আলতো হাত দিয়ে। চোখের সঙ্গে আঁটা কালো চশমার অন্তরালে মিশন পরিচালকের চোখের ভাবমূর্তি বুঝতে পারে না আবিদ। তিনি ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে ঢিমে হেসে আবিদের কাঁধে দুটো মৃদু চাপড় দিয়ে হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,তোমার জন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে পারমিশন আছে। ইউ কেন সুট্!… বলা বাহুল্য, র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে অনন্যোপায় হয়ে আবিদকেও সুরক্ষা বস্ত্র গায়ে গলাতে হয়েছে।

তরতর করে র‌্যাব সদস্যের দলটি ঢুকে পড়ে আস্তানার পেছনের ঘন ঝোপঝাড় মাড়িয়ে-উপড়িয়ে, ছিন্নভিন্ন করে…। সঙ্গে সঙ্গে ঠা ঠা করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে আস্তানার ভিতর থেকে। গুলিবর্ষণের মাত্রা দেখে বোঝা যায় গুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষ একবিন্দু ব্যায়কুণ্ঠ নয়, বরং অগাধ অস্ত্র-সস্ত্র তাদের। নিয়ম মোতাবেক যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গাছপালার আড়ালে শরীর বাঁচিয়ে ‘পজিশন’ নেয়। এবার সশস্ত্র সদস্যরা এবার নিটোল নিশানায় থেকে থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। আবিদ আর মিশন পরিচালক এগোয় সবার আগে আগে। এর আগে বেশ কয়েকবার লুকিয়ে এই আস্তানায় আসার কারণে আবিদের সমস্ত পথ সড়োগড়ো করে নিয়েছে। বিধায়,খুব একটা অসুবিধে হয় না।

কয়েক মিনিটের মাথায় ঘাত-প্রতিঘাতের অনবরত গুলি ছোঁড়ার শব্দে পরিবেশটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। আস্তানার আশেপাশে অর্ধমাতাল আর কিছু অস্ত্র হাতে মানুষও ছোটাছুটি শুরু করল যে যার মতো। দূরে শস্য-শূন্য বিলের মধ্যে একটা হেলিকপ্টারের দেখা মিলে। এবার কারো বোধগম্য হতে দেরি হয় না যে এখানে কারা কারা থাকতে পারে! র‌্যাবের কিছু সদস্য বাঁশের বেড়া-নির্মিত ঘরগুলো ভাঙতে শুরু করে মড়মড় করে। আরো কিছু সদস্য এগোয় অর্ধপাকা ঘরটার দিকে। শুরুতে এই ঘরটা ঘিরেই যথেষ্ট নিরাপত্তা পরিলক্ষিত হলেও অতর্কিত আক্রমণে বেশির ভাগ শত্রু নিরাপত্তাকর্মীই খেই হারিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে দিকবিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। র‌্যাব সদস্যরা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলো ঘরটিকে। বারবার করে হ্যান্ডমাইকে সতর্কবার্তা পাঠানো হলো অনেকটা এভাবে, ” ভেতরের ঘরে যারা আছেন তারা সসম্ভ্রমে বেরিয়ে আসুন, নতুবা গুলি চালাতে বধ্য হব।” আকার-আয়তনে বেশ বড় ঘরটা। খুব সম্ভব এই ঘরটিতেই মাদক ব্যবসায়ীদের মিটিং বসেছে। এই ঘোর গ্রামে তারা সবার চোখে ধুলো দিয়ে হেলিকপ্টারে করে যাতায়াত করেছে তারা দিনের পর দিন। অন্যদিকে বাকী সদস্যরা অন্যান্য ঘরগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে কাড়ি কাড়ি মাদকদ্রব্য উদ্ধারকার্য শুরু করে দিয়েছে।
আবিদ তখন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্ত্ররাখা ঘরটার খোঁজে বেরোল। তার পিস্তলের জন্য ‘স্টক’ করা গুলিগুলো প্রায় শেষের পথে। বিপদ হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। এই পরিস্থিতিতে কারো কাছ থেকে চাওয়ার জো নেই। নিজেকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
অবশেষে ঘরটার দেখা পেল আবিদ। এখানটায় আসতে অবশ্য দু তিন জনের সঙ্গে হস্ত-যুদ্ধ চালিয়ে কুপোকাত করে তবেই আসতে হয়েছিল। এদিকটা স্তূপীকৃত দেদার মদের ফাঁকা বোতলের সমাহার। রুদ্ধ কাঠের দরজায় পা দিয়ে আঘাত করতেই দরজাটা ঠাস করে খুলে গিয়ে বারকয়েক ধাক্কা খেতে খেতে, কেঁপে কেঁপে স্থির হল সেটি। আবিদ ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই পেছন থেকে পাঁচ সদস্যের একটা দল আবিদের দিকে মারমুখী ভঙ্গিতে এগিয়ে এল। আবিদ পাল্টা ছুটে এসে দুজনের নাকেমুখে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল দুরন্ত বেগে। ওমনি অন্য দুইজন আবিদের দুইহাত আঁকড়ে ধরে অন্যজন আবিদকে একইভাবে আঘাত করল৷ ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরে। কিন্তু এই ধস্তাধস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অকস্মাৎ র‌্যাব তাদের গুলি চালাল পিছন থেকে। দুইজন তড়পাতে তড়পাতে লুটিয়ে পড়ল। অন্যজন পালাতে গিয়েও আবিদের রোষানলে পড়ে আরো কয়েক ঘা ঠ্যাঙানি খেল। বাকি দুইজন সেখানে মরার অভিনয় করে পড়ে রইলে র‌্যাব তাদের পাকড়াও করে নিল। নিয়ে গেল অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে আটকাতে। আবিদ দ্রুত এগোল ঘরটার দিকে৷ আরো পাঁচ থেকে সাতজন লোক চাপাতি হাতে ছুটে এলো তার দিকে। তাইরে নাইরে না করে পিস্তল বের করে সরাসরি সংবেদনশীল জায়গায় গুলি চালাল আবিদ। পরপর ছ’টা গুলি নিঃশেষ করে পাঁচজনকে কুপোকাত করে রিলোড করে নিল সে। পাঁচজন সদ্য বর্শিতে ধরা পড়া পুঁটিমাছের মতো মাটির ওপর তড়পাতে তড়পাতে পটল তুলল! বাদ-বাকি দুইজন পালিয়ে বাঁচতে চাইলে আবিদ তাদের উত্তরোত্তর বজ্রকঠিন মুষ্টাঘাতে আধমরা করে গ্রেফতারকৃতদের দলে নিয়ে ভিড়ালো। এভাবেই সে একেরপর এক বীরত্বের পরিচয় দিয়ে পুরো অভিযান জুড়ে।

অর্ধপাকা বড় ঘরটা থেকে কেউ সাড়া দিল না। রয়ে রয়ে অসহ্য হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অদূরে পড়ে থাকা গাছের গুড়ি বেগে ঠেলে দরোজার বুক ভেঙে টরটর করে চালানো হল গুলি। মহাশূন্যের বাতাসে কিছুক্ষণের জন্য ভেসে বেড়াল ভয়ঙ্কর এক শব্দ তরঙ্গ— আর্তনাদ, রক্ত চলকে পড়ার শব্দ। ছলাৎ! এরপর সব স্তব্ধ। ভয়ংকর এই আস্তানার ত্রিসীমানা জুড়ে পিনপতন নীরবতার সুক্ষ্ম কণা এমুড়োওমুড়ো করে। দল সব সদস্যরা যখন এক হলো আবিদ তখন এসে অস্ত্রের ঘরটা র কথা বলল। কিছু সদস্য তার সঙ্গে গিয়ে অস্ত্রগুলো উদ্ধারের কাজে তৎপর হল।

মিশন সমীকরণ হলো এই, পনের জন ছিঁচকে সদস্য সহ মোট তিরিশ জনের মতো মাদকাসক্ত এবং মাদকব্যবসায়ী নিহত হয় এই অভিযানে। গ্রেফতার হয় সংশ্লিষ্ট শ’খানেক লোকজন। দুর্ভাগ্যক্রমে র‌্যাবের দুইজন সদস্যও গুলিতে আহত হয়। তাদের হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক! খাস খবর হল জিসান আর মনসুরকে ঐ মিটিং-বসা ঘরটা থেকেই গ্রেফতার করা হয়। এতেই কাকচক্ষু জলের মতো পরিষ্কার জিসানের ঢাকা যাওয়া সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট! তবে চাচা-ভাইপোর উল্লেখযোগ্য কিছুই হয়নি। মনসুরের পায়ে গুলি লেগেছে। জিসানের কিছু হয়নি৷ এছাড়াও আরো বাঘা বাঘা মাদক ব্যবসায়ী আর নেতাকর্মীকে পাওয়া যায় ঐ আস্তানায়। দেশের আনাচে-কানাচে ঢিঁ-ঢিঁ পড়ে গেল বিশ্বাসযোগ্য নেতাকর্মীদের এই অসাধু আচরণে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত হল ৮০ হাজার পিস ইয়াবা, ১৩ কেজি হেরোইন, ১ কেজি কোকেন, ১৯ কেজি আফিম, ১০ হাজার ৫৫ বোতল ফেনসিডিল, ৫ শত ১২৪ কেজি গাঁজা, ১৮১ বোতল বিদেশি মদ ও ৩০ হাজার ২০৩ লিটার দেশি মদ জব্দ করা হয়েছে।
……………………..

আস্তানার কাছাকাছি রেললাইনের ওপারে শত উৎসুক জনতার ভিড়। গ্রেফতারকৃত লোকগুলোকে আস্তানা থেকে টেনে বের করে আনছে র‌্যাব সদস্যরা। সেই দৃশ্য বড়ো উৎসাহ সমেত উপভোগ করছে গ্রামের অতি রুচিশীল ছেলে বুড়ো। শুরুতেই কাকডাকা ভোরে গোলাগুলির শব্দ শুনে কেউই আতংকে এদিকটা আসতে চায়নি। ক্রমশ গোলাগুলির শব্দ লঘু হয়ে এলে গ্রামের কিছু লোক সাহস করে এমুখো হয়। এরপর ধীরে ধীরে লোকসমাগম বাড়ে। ঘুম ভাঙার পর উরবিও আর একদণ্ড বাড়িতে স্থির থাকতে পারে না। কোনো রকমে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। আস্তানার সামনের দিকে রেললাইনে ওপর নারী-পুরুষের কালো মাথার এবড়োখেবড়ো ভিড়ের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে ভিতরে কী হচ্ছে তা উত্তেজনা ভরে দেখার চেষ্টা করে উরবি। কিন্তু কিছুতেই যেন নাগাল পাচ্ছে না সে। এদিকে ভেতরে ভেতরে একটা অনাসৃষ্টি গোপন ব্যথা লাই পেয়ে পেয়ে ভীষন বেদনার দুন্দুভি বাজিয়ে চলেছে তার সমস্ত দেহমনে। লোকটার জন্য নিদারুণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। ভেতরে সব ঠিকঠাক আছে তো? সে কোনো আঘাত পায়নি তো? বড় কিছু! ছিঃ ছিঃ কীসব অলক্ষুণে কথা ভাবছে সে! লোকটা বীর! এসব মাতালদের ধরা তার হাতের ময়লা! মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে আবারো শাদা বকের মতো গলা বাড়িয়ে অসংখ্য অপরিচিত লোকের মাঝে আবিদের পুষ্ট চেহারাখানা খুঁজে ফিরে সে। পায় না। আবারো ভাবনালোকে তলিয়ে যায় সে। লোকটা যে একটা মানসিক তুষানলে দীর্ঘদিন ধরে পুড়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে পারে উরবি। গতকাল রাতের অনভিপ্রেত ঘটনাটার পর থেকে তার নিজের মনটাও ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল। আর লোকটা এই বেখাপ্পা মন নিয়ে মিশনে নেমেছে? ভাবনার জগৎ আর প্রসারিত হয় না উরবির৷… হঠাৎ র‌্যাব সদস্যদের হাতে লোহার কড়া পরানো জিসানকে চোখে লেগে গেল তার। ক্ষণেই তার ভাবুক অসহায় দু’চোখ ধারালো হয়ে এলো। সে প্রকট চোখে দেখে, দলবল নিয়ে বন্দি হয়ে আস্তানামুখী ঢালু পথ হয়ে উঠে আসছে সে। তার পাশে আছে অহর্নিশ তারই কানভারী করা চাচা বুড়ো মনসুর। মুহূর্তে সে ভুলে গেল আবিদের কথা, ভুলে গেল আশেপাশে এতোগুলা মানুষের কথা, ভুলল পরিবার,ভুলল সমস্ত জগৎ-সংসার—যেন তার জন্ম শুধু প্রতিশোধের জন্য! জিসানের মুখটাকে দেখামাত্রই তার মস্তিষ্কে যেন ছলাৎ করে দুর্নিবার ক্রোধের রক্তে বানভাসি গেল…। তৎক্ষনাৎ নিজের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে দম্ভভরে দৌড়ে গেল জিসানের দিকে। এক পা…দুই পা… তিন পা…। খপ করে পেছন থেকে জিসানের শার্টের কলার ধরে তাকে ঘুরিয়ে কিল, ঘুষি, চড়-থাপ্পড় দিতে শুরু করল অনবরত। সঙ্গে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো অসংখ্য শ্রাব্য-অশ্রাব্য ক্রোধ সূচক শব্দ। জিসানকে ধরে রাখা র‌্যাব সদস্যটি কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে ব্যাপারটা বুঝে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝে যথাসম্ভব উরবিকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘাতক নারী হওয়ায় খুব একটা সুবিধে করতে পারল না। পরিস্থিতি সালাম দিতে আরো একজন সদস্য গপগপ করে ছুটে এলো৷ উরবিকে একপর্যায়ে জিসান থেকে আলাদা করা গেলেও, পুরোপুরি ক্ষান্ত করা গেল না। সে সবকিছু উৎরিয়ে বারংবার জিসানকেই আঘাত করতে ফিরে আসার চেষ্টা করছিল। এমন সময় কোত্থেকে যেন সুবার্তা বাহকের মতো আবিদের আবির্ভাব হল। সে আসামি পাকড়াও’র ভঙ্গি করে উরবিকে একাই সেইস্থান হতে দূরে টেনে নিয়ে এলো,হেঁটে। সবাই তব্দা মেরে, হাঁ করে তাকিয়ে দৃশ্যটি দেখল। এরপর আবার নিজ নিজ কাজে রত হল সবাই।

টেনে নেওয়া লোকটি যে আবিদ তা বুঝতে পেরে উরবির রাগ ধীরেসুস্থে দানা ছাড়িয়ে তুবড়ে গেল। বোধ করি জীবনে এই প্রথম নিজের কৃতকর্মের জন্য একটু সন্তপ্ত হল সে। এতোদিনে আবিদও বোধহয় বুঝতে পেরেছে যে, মেয়েটা তার ন্যাওটা হয়ে পড়েছে এবং উক্ত পরিস্থিতিতে তাকে শান্ত করার মতো একজনই ছিল,সে আবিদ ভিন্ন আর কেউ নয়! কিছুদূর এসে একটা বিজন জায়গায় আবিদ থমকে দাঁড়াল। উরবি তেমনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধতার পর আবিদ আস্ফালন করে উঠল,
– কী করছিলেন কী এতোগুলা লোকের সামনে? আক্কেল জ্ঞান নেই নাকি! আপনি এতোগুলা লোকের সামনে জিসানের সঙ্গে গণ্ডগোল করা, আপনার নামে রটানো সব কথার সত্যতার প্রমাণ দেয়। এটা বুঝতে পারছেন? এখন তো যারা এই ঘটনা বিশ্বাস করেনি তারাও বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে,হ্যাঁ ঘটনা সত্য!
লোকটা তাকে নিয়ে এতোকিছু চিন্তা করছে দেখে ভীষণ অবাক হয় উরবি। একটু বোধহয় খুশিও হয়! এরপর কি এক নবীভূত অভিমানে উরবির বুক ভার হয়ে আসে। সে অভিমান ঢালা কণ্ঠে বলল,
– আমার আপনাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
আবিদ উরবির এই কথায় একটু বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। গত সন্ধ্যার ঘটনার জন্য কোনো ক্লেশ তার মনে নেই বললেই চলে। যা হয়েছে তা নিয়ে জলঘোলা করার পাত্র নয় আবিদ। কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় বাটন ফোনটা তারস্বরে বেজে ওঠে তার। জরুরি হিসেবে এই ফোনটা সাথে রেখেছিল সে। প্রধান মিশন পরিচালকের ফোন,
– হ্যালো স্যার, বলুন
ওপাশ থেকে কী বলল শোনা গেল না। আবিদ মুখটাকে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলল,
– ‘না স্যার,আমি যাব না থানায়।…নাহ্ আমার কোনো ক্রেডিট চাই না। আপনারা সাংবাদিকদের ম্যানেজ করুন। বেশি বকরবকর করলে তাদেরও গুলি করে দিন। আচ্ছাহ রাখি। ভালো থাকবেন।’
শেষের কথাগুলো মৃদু হেসে বলল আবিদ। উরবি কখন যে আবিষ্টমনে চোখ তুলে আবিদের দিকে তাকিয়ে ছিল তা নিজেই টের পায়নি। আবিদ ফোন রাখতেই ঘোর কাটল তার। এতক্ষণ খেয়াল করল,আবিদের ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে এবং সেই পুরোনো ডান হাতের পেশির ক্ষতটাতে পুনরায় ঝরঝর করে রক্ত ঝরে চলেছে। পলকেই সে সচকিত হয়ে খানিক কাছে এসে বলল,
– একি আপনার তো রক্ত পড়ছে…
আবিদ কাষ্ঠ হেসে দূরে সরে গিয়ে বলল,
– ‘আদিখ্যেতা!’ একটু থেমে আবার বলল, ‘আপনারো আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। বাসায় যান।’
উরবি অবিচলিত স্বরে বলল,
– আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
আবিদ হাতের ছোট ফোনটা পকেটে ছেড়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল,
– জাহান্নামে।
উরবি বিত্রস্ত-অসহায় চোখে একবার আবিদকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল। মনে মনে ভাবল,লোকটা আজ এতো রেগে আছে কেন? রাগ তো তার দেখানো উচিত! কালকের ঘটনার জন্য!’ সেটা ভেবেই সে কপট রাগ নিয়ে জব্দ করা বলল,
– আপনার তো বিচার আছে! কালকে কী করছেন ওটা, হুম? মেয়ে দেখলেই বুকে টেনে আদর করে ইচ্ছে করে? আলুবাজ!
উরবির ধারণা মতোই আবিদ নাকাল হল এক নিমেষে। সে ভারী অপ্রস্তুত হয়ে কী যেন বলতে চেয়েও আটকে গেল। উরবি আঙুল নেড়ে বলল,
– হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন বলুন।
আবিদ কিছু বলতে পারল না। ঘোলা চোখে পাথরের বিষন্ন মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
উরবি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে হাতটা ধরে বলল,
– বাসায় চলুন,ব্যান্ডেজ করে দিব।
আবিদ ম্লান হেসে বলল,
– আমি পরশু চলে যাব।

চলবে…