ভবঘুরে পর্বঃ১৮
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
– ‘ওরে আল্লাহ্। তুই এমন বাচ্চাদের মতোন করতেছিস কেন উরবি। উঠে বয়।’
উরবি নিরুর কথায় কান দিল না। কিন্তু শান্ত হয়ে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। এরপর সে আচমকা উঠে বসে চটপটে গলায় বলল,
– অনেক হইছে। এই টপিক অফ। এতো সস্তা না আমি। চল, পড়তে বস এবার।
নিরু কণ্ঠে একটা শ্লেষের ধাক্কা দিয়ে বলল,
– হুহ, এতক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে একশেষ! আর এখন ভালো সাজে।… আচ্ছা তোর সমস্যা কী বলতো? আংকেল নাকি তোর বিয়ে ঠিক করতে চাইছে কিন্তু তুই না করে দিছোস?
– না করব না তো কি নাচতে নাচতে বাসর ঘরে ঢুকে যাব?
– বাসর ঘরে ঢোকার বয়স তো তোমার হইছে। বিয়ে করে ঢুকে যা-না!
উরবি আঘাত করার ঢংয়ে ডানহাত উঁচিয়ে গনগনে গলায় বলল,
– একদম চটকানা মারব। তুর ইচ্ছে হয় তো-তুই ঢুকে যা-না। বাবার হয়ে গোয়েন্দাগিরী করতে কে বলছে তোকে?
নিরু উরবির রাগের তোয়াক্কা না করে বোকাটে হেসে আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
– আমার তো রেডিই আছে মামা। অনার্সটা শেষ হলেই চটাং করে কবুল আর ফুড়ুৎ করে শ্বশুর বাড়ি। তুমি আইবুড়ো হয়েই থাকো।
উরবি বিস্ময়ে মুখ হাঁ করে অনুচ্চ একটা শব্দ করল।
– ‘আমাকে তো কিছুই বলস-নাই…বেঈমান কোথাকার।’ শেষের কথাটা বলার সময় উরবির দাঁতে দাঁতে যুদ্ধ আর নাকের পাটা বর্ম হয়ে ফুলে উঠল।
নিরু ইচ্ছে করেই ফোঁড়ন দিল,
– তোর তো নজর ভালা না। আবার যদি আমার হবু বরটাকে…
উরবি হাঁকুনি দিয়ে নিরুর নাম আওড়ালো,
– নিরু…
নিরু এবার ভয় পেয়ে পানিতে ভেজা মুড়ির মতো চুপসে গিয়ে বলল,
– হে হে, মজা করছিলাম। রাগোস কেন? গতকালকেই তো এসব হইছে। তোকে তো যাইতো বলছি তুই যাস নাই, আমার কী দোষ? আংকেল গেছিল না?
উরবি খানিক নিবৃত্ত হয়ে বলল,
– ভালো হইছে, ছবি দেখা দেখি এবার।
নিরু খোশ হয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ফোনের লক খুলে হবু বরের ছবিটা উরবি সামনে তুলে ধরল।
উরবি কপাল কুঁচকে, অধর প্রসারিত করে ছবিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা শেষে মুখ বিকৃত করে বলল,
– ইশশ খাঁদা নাকে তিলক!
নিরু মুখ চুন করে বলল,
– এভাবে বলিস কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?
উরবি ত্যারচা চোখে নিরুর আপাদমস্তক পরখ করে এতক্ষণ পর একটু হেসে বলল,
– আমার চেয়েও সুন্দরী তুই।
বাস্তবিক কথাটি মিথ্যে নয়! নিরু উরবির চেয়েও সুন্দরী। উরবি ক্ষীনকায়া, আর নিরু পরিপুষ্ট দেহী নজরকাড়া রমণী। তার সর্বাঙ্গের পরতে পরতে যেকোনো পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষনের তুকতাক মন্ত্র-বীজ পোঁতা! কিন্তু উরবি সম্পূর্ণ বিচিত্র। তার চালচলন,আচার-ব্যবহার, রংঢং সবকিছুই বৈচিত্র্যময়। নিরুর মতোন অপ্রতিম সুন্দরী নিশিদিশি চোখে পড়লেও উরবির মতোন আদুরে অবয়ব হাজারে একটা মিলে। নিরুও সেই কথাটায় বলে,
– হয়তো-বা! কিন্তু তুই ইউনিক উরবি!
উরবি তার নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে শরমিন্দা হয়ে বলল,
– কীভাবে!
নিরু একটু নড়েচড়ে বসল। ভাবনা-দীপ্ত গলায় বলল,
– কীভাবে জানি না! তবে তোর আগাগোড়া ইউনিক সেটা তুই বুঝতে পারিস?
উরবি ভাসা-ভাসা নয়নে তাকাল,
– ইউনিক কেউ পছন্দ করার মতো ইউনিক?
কথাটা গূঢ় হলেও নিরু তার ভিন্ন অর্থ দাঁড় করিয়ে উরবিকে একটু আঙলে দেওয়ার চেষ্টা’টা করে গেল,
– করছে না? জিসান করছে তো! সেও তো ইউনিক, মদ-গাঁজা খায়…
নিরু আরো কিছু বলতে চাইল;কিন্তু উরবি সেই সুযোগ দিল না। সে খপ করে নিরুর চুল মুঠি করে ধরে বার দুয়েক টান দিয়ে কয়েক গাছি চুল বিচ্ছিন্ন করে; সাত-সতেরো অশ্রাব্য গাল পেড়ে তবেই ক্ষান্ত হল। পুরো ঘটনায় নিরু কোনো বাঁক- বিকার নেই বরঞ্চ সে হেসে কুটিকুটি হল তার কার্য সিদ্ধি হয়েছে ভেবে। হুটহাট চটে যাওয়া মানুষগুলোক রাগানোর আর রেগে যাওয়ার মধ্যে আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। ঢেঁকির কচকচি শেষে উরবি আর নিরু মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ এলেবেলে আলাপ-আলোচনা চলার পর নিরু সেদিনকার মতো বিদায় নিল। পড়তে বসা আর হল না। যাওয়ার বেলায় উরবি নিরুকে তীক্ষ্ণ কটাক্ষে সাবধান করে দিল যাতে আবিদের সুমুখে তার অতীত নিয়ে কোনো আলাপ না ওঠায়।
দোকানদার মজিদ নিখোঁজের খবর এসেছে আবিদের কাছে। কে বা কারা এর পেছনে দায়ী সেখবর সবারই অজানা। কিন্তু আবিদের পুরো বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। মজিদের সঙ্গে তার সখ্যতা এবং তার বাড়িতে গিয়ে প্রকাশ্যে দাওয়াত খাওয়ার বিষয়টা নিশ্চিয় চাপা নেই প্রতিপক্ষের নজরে! যেহেতু পূর্বে মজিদের ঐ আস্তানায় আনাগোনা ছিল সুতরাং আবিদের আস্তানার খোঁজ পাওয়ার জন্য মজিদকেই হয়তো দায়ী করেছে তারা। তাছাড়া সেদিন জিসানের চোখেমুখে যে স্পষ্ট ভীতি পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে আবিদ নিশ্চিত ছিল যে জিসানের হাত আছে এই পুরো ঘটনায়। তবুও কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া গেল না এই কারণে যে এই মাদক ব্যবসার সঙ্গে উপরমহলের গোপন যোগসাজশ রয়েছে; যার কারণে পুলিশ অনুকূলে থাকলেও পদক্ষেপ-গ্রহণকারীর জন্য বিষয়টি সুখকর হবে না। কাজেই বুদ্ধি খাটিয়ে এগোতে হবে আস্তে-ধীরে। তাই করা হল। আবিদের সঙ্গে আনকোরা পুলিশ অফিসার নিভৃতে কিছু বাতচিৎ করে নিল দোকানী মজিদকে খোঁজার ব্যাপারে। আবিদ এতোদিনের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানাল, মজিদকে যদি তারা বাঁচিয়ে রাখে তবে ঐ সীমান্তবর্তী আস্তানায় কখনোই রাখবে না। অযথা নিজের পায়ে কুড়াল মারতে কেউই চাইবে না৷ কারণেই,আপাতত আস্তানায় বাদে অন্য সব জায়গায় বেওয়ারিশ মজিদকে খোঁজার পরামর্শ দিলো আবিদ। আবিদের কথা অনুসরণ করে অফিসারের নির্দেশে অভিযান চালানো হল গ্রামের বিভিন্ন জায়গায়। নিখোঁজ হওয়ার দুইদিনের মাথায় মজিদকে পাওয়া গেল খালপাড়ের নির্জন জারুলতলায়; যেখানে উরবি জিসানকে উপর্যুপরি বেদন প্রহার করে প্রেমের বাতিক ছুটিয়েছিল। পাঠকের কি কানে বাজে জিসানের প্রেম-ক্লিষ্ট গলার মাতাল চিৎকার?
যাহোক, মজিদকে পাওয়া গেল; ঝামেলা গেল চুকে। আবিদের বুকের ওপর থেকে যেন একটা বিশাল বেদনাবিধুর পাথর নেমে গেল। স্বজন হারানো যাতনা সে বুঝে। এতোদিন মজিদের পরিবারের নীরব আহাজারি তাকে থেকে থেকে বিঁধেছিল ভীষণ। হাতে-পায়ে আর আঘাত করা ছাড়া তেমন গুরুতর আহত হয়নি মজিদ। ভুলেও যদি তার বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো নিজেকে ক্ষমা করতে পারতো না আবিদ। এরপর থেকে এসব বিষয়ে আরো বেশি সাবধান হওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হল সে।
…………….
গ্রামের ওপর পড়েছে সন্ধ্যার আঁধারের মিহি পর্দা। শ্রম-ক্লান্ত পাখিরা নীড়ে ফিরে বৈকালীন আড্ডা শেষে এখন ঘুমে বিভোর। কখনো-সখনো অল্পসময়ের জন্য অভিসারী পক্ষীযুগলের প্রেমময় কিচকিচ শব্দ হাওয়ায় হওয়ায় প্রেমের সুরভি রটায়। আজীবন কলহপ্রিয় ঝিল্লিপোকার দল শুরু করে বিরতিহীন একঘেয়ে মুখরতা। বাঁকানো চাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাশের সন্ধ্যাতারাটা দেদারসে দীপ্তি ছড়ায়। প্রকৃতির এই মোহময় ক্রান্তিলগ্নে আবিদ চুপিসারে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য, গেঁজেল আর মদখোরদের আস্তানার দিকে। কিন্তু এই এলাকায় আসার পর থেকে তার পোড়াকপালটা একেবারে ভস্ম হয়ে গেছে। একটা পদেও আর ভরসা নেই। ঘর থেকে বেরোনো মাত্র কোত্থেকে উরবি আমবাগানের ভেতর থেকে যেন উড়ে এসে দাঁড়াল আবিদের সামনে।এরপর দেঁতো হেসে বলল,
– এইযে, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
বড় আশ্চর্যের বিষয়! এই বিচ্ছু মেয়েটা সারাদিন আমবাগানে থাকে কেন? কে জানে আমবাগানের কোন্ শ্রীহীন ভূত তার প্রেমে পড়ে রসাতলে যাচ্ছে। এই যে এখনো তার হাতে একটা পাকা টসটসে আম। আমের তলায় ফুটো করে সেখানে ঐ চিকন দুই ঠোঁট ডুবিয়ে চুক চুক করে রসাস্বাদন করা হচ্ছে ভারী অভিজাত উপায়ে। আবিদ না দেখেও পারে না এই বয়সে উরবির এমন বাচ্চামো পদ্ধতিতে আম খাওয়া! একই সঙ্গে বিরক্তও হয় সে। কোনো প্রতি-উত্তর না পেয়ে উরবি নিজ থেকেই বলল,
– আমার না দুঃখ হচ্ছে খুব। আমের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। গরমকাল শেষ হয়ে গেলে আম খাব কেমন করে! গাছের আমও আর বেশি নাই।
শেষের কথাটা বলে ভীম রোদে মানুষ যেভাবে সূর্যের দিকে তাকায় সেভাবে আমবাগানের মাথায় কপালে হাত দিয়ে তাকাল সে। অবশিষ্ট আম-গণনার বিফলমনোরথ মাত্র!
আবিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
– এক আমের উপর মনে হয় আপনি বেঁচে আছেন? সারাদিন তো খাই খাই করেন। আম তো সারাবছর বসে থাকবে না আপনার জন্য। সময় অনুযায়ী আসবে আর যাবে। এতো দুঃখ হওয়ার কিছু নেই।
উরবি কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
– আপনি বুঝতে পারতেছেন না আমার মনের অবস্থা! এতো স্বাদের আম আমার।
– গাছের সব আম তো আপনি খেয়েছেন৷ এখনো স্বাদ গেল না আপনার। যাইহোক, পথ ছাড়ুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।
উরবি আমের ফুটোয় মুখ ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে রস টেনে নিয়ে বলল,
– কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এই সন্ধে বেলায়?
আবিদ মূল কারণটা এড়িয়ে যেতে চাইল,
– যাচ্ছি… একটা কাজে।
– ‘কী কাজ?’ উরবি চোখের ভাষা এমন যে এই কৈফিয়ত সে প্রায়শই আবিদের কাছ থেকে গ্রহণ করে! কিন্তু আবিদ তার মুখের ওপর বলল,
– আপনাকে বলতে হবে কেন?
– ‘অবশ্যই বলতে হবে। না বললে যেতে দিব না।’ উরবির কণ্ঠে দৃঢ়তা।
– উফ আপনি আমার পিছনে পড়লেন কেন ভাই? যান না আমগাছের ভূতের কাছে। কেন খামখা বিরক্ত করছেন?
– বিরক্ত করতেছি কারণ বিরক্ত করাই আমার প্রধান কাজ। জানতেন না বুঝি?
– ওপাড়ায় যাচ্ছি একটু। কিছু ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে।
উরবির কাছে কৈফিয়ত দিয়ে নিজেকে নিজের কাছে অসহায় মনে হল আবিদের। নিজের অসহায়ত্বে কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল তার।
উরবির লাফিয়ে উঠে বলল,
– আমায় নিয়ে যাবেন?
আবিদ বুঝল এই মেয়ে আজ তার পিছু ছাড়ছে না। মাত্র কিছুদিনে জাঁহাবাজ মেয়েটার আগাগোড়া স্বভাব সম্পর্কে জানা হয়ে গেছে তার। বিধায়,এখন দ্বিরুক্তি করলেও কোনো কাজে আসবে না।
– ‘যাব। গাঁজা খেতে পারবেন?’ শুধাল আবিদ।
উরবি মুহুর্তেকের জন্য আম চোষা ছেড়ে গোল গোল চোখে আবিদের দিকে তাকাল। এরপর মাথা দুলিয়ে বলল,
– ‘পারব’
– মদ?
– পারব
– ‘চলুন তাহলে।’ বলে পা বাড়াল আবিদ।
– আগে কখনো খেয়েছেন নাকি? হাঁটতে হাঁটতে আবিদের সরল অথচ কুটিল প্রশ্ন।
উরবি অন্যমনস্ক ছিল। আবিদের কথার প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপটা ধরতে পারল না সে। বলল,
– নাহ্… ওগুলা পাব কই।
– হুমম।
পথে আর কোনো কথা হল না তাদের। গোটা পথ দুশ্ছেদ্য নীরবতা যেন টহল দিয়ে ফিরল তাদের। কিছুক্ষণ পরেই কাঙ্ক্ষিত সেই বটমূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেল আবিদ আর উরবি। গোরস্থান আর দিঘির পাড় হয়ে সেই বটমূলে যেতে হয়। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারটা গাছপালা-তরুলতার নিবিড় আলিঙ্গনে দ্বিগুণ জেঁকে বসেছে গোরস্থানের পাশের রাস্তায়। দু’জনের কেউই ফোন কিংবা টর্চ লাইট আনেনি। বিধায়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আঁধারের মোটাচাদর বিছানো পথ মাড়াতে হল তাদের। আবিদ আগে থেকেই জানতো এখানে জিসান থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, এখানে সব উঠতি বয়সের ছোকরারা এসে নিজেদের উজাড় করে দিয়ে গাঁজা খায়। ধীরে ধীরে এগোবে ‘বোতল’ ধরার পথে! পাঁড় নেশাখোরদের আড্ডাখানা এ নয়। তাদের আড্ডা-স্থল অন্য। অবশ্য পাকেপ্রকারে যদি জিসানের সঙ্গে দেখা হয়েও যেতো সেই প্রস্তুতি নিয়েই বেরিয়ছিল আবিদ।
বটমূলের কাছে যেতেই একজন সদ্য স্বর-পরিবর্তন হওয়া গলায় প্রশ্ন করল,
– কে রে?
ছেলেটা হয়তো মনে করেছিল তাদের সঙ্গী-সাথী কেউ এসেছে। কিন্তু সাড়া না পেয়ে আবিদকে এগিয়ে আসতে দেখে ছেলেটা সন্ত্রস্ত হয়ে এক-পা দু’পা করে পিছিয়ে যেতে লাগল। একসময় ভোঁ দৌড় দিয়ে চিৎকার করে অন্যদের সতর্ক করল,
– ঐ ভাগ ভাগ,পুলিশ আইছে।
বটমূল ঘিরে আরো গোটা দশেক ছেলেপেলে বসে ছিল। পুলিশের কথা শুনে তারাও পলায়নোদ্যত হল। আবিদ আর দেরি না করে হাঁকল,
– থামো থামো, আমি পুলিশ না। আমি তোমাদের সঙ্গী হতে এসেছি। বসো তোমরা।
ছেলেগুলো পুনরায় বসল ধীরে ধীরে। কিন্তু তারা ভয় পুরোপুরি কাটিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারল না। সর্বাঙ্গে সার্বক্ষণিক একটা অধীরতা নিয়ে তারা ইতস্তত করল অনেক্ষণ যাবৎ।
উরবি এতক্ষণ অবধি কোনো কথা বলেনি। এবার সে ছেলেগুলোর দুরবস্থা দেখে ভীষণ আমোদে খিলখিল হাসি জুড়ে দিল। উরবির শাঁকচুন্নির মতো তল্লাট কাঁপানো হাসিতে ছেলেগুলো আরো ভীত হয়ে পড়ল। আবিদ এই প্রথম উরবিকে দাবড় দিল,
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
– আহা,চুপ করুন তো!
উরবি আবিদের কথায় কর্ণপাত করল না। আরো মিনিট কয়েক দুলে দুলে হেসে তারপর সে আপনি শ্রান্ত হয়ে চুপ করে গেল।
একটা ছেলে সাহস নিয়ে বলল,
– সঙ্গী হইবেন,…লগে আনসেন কিসু?
আবিদ পকেট থেকে অতি সাবধানে গাঁজা পুরা গুটিকতক সিগারেট ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– চলবে?
অন্ধকারেও যেন খুশিতে ছেলেটার চোখ বিড়ালের চোখের মতো চকচক করে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিতে নিতে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
– হইব মানে! জমবো একেবারে।
আবিদ আর উরবি বটমূলে বসে পড়ল। অল্প সময়ের মধ্যেই নির্ধূম পরিবেশটা গাঁজার বিশ্রী ধোঁয়ায় টইটম্বুর হয়ে গেল। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়! এলাকার এইদিকটা একেবারে বিরান বলা চলে। চারিদিকে শুধু ঘন গাছপালার অপূর্ব সমাহার। এই কলুষিত বটমূল না থাকলে বোধহয় দ্যুলোকের কোনো অংশ বলে ভ্রম হতো!
সবার হাতে হাতে গাঁজা-পাতায় ঠাসা জ্বলজ্বলে সিগারট। উরবি আর আবিদও বাদ যায়নি। কিন্তু আবিদ মুখে না দিয়ে হাতের আড়ালে নিয়ে মুখে পুরার ভান করছে একটু পরপর। উরবি কৌতুহলবশত ভয়ে ভয়ে একসঙ্গে দু’টো টান দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শিরায় উপশিরায় অদ্ভুত এক অভূতপূর্ব শিহরণ তড়িদ্দামে বয়ে গেল। ধকধক করে বেড়ে গেল হৃদস্পন্দন,জ্বালা করতে লাগল চোখে ছোট ছোট উপশিরা। ফুসফুস ছেদিয়ে খকখক করে বেরিয়ে এল জোর কাশি। আবিদ তখন ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। উরবির কাশি দেখে বুঝল সে গাঁজায় মুখ দিয়েছে! তৎক্ষনাৎ সে পাশে বসা উরবির উরুতে হালকা চালে চাপড় দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
– পাগল নাকি!মুখে দিবেন না।
অকস্মাৎ অন্ধকারে উরুতে আবিদের চাপড়ে উরবি শরমিন্দা হয়ে কুঁকড়ে গেল। সে জবাবে আর কিছু বলল না। কেবল মাথা নাড়ল।
আবিদ এবার ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলল,
– শুন তোমরা, আমি যা বলি সেগুলোর উত্তর দেবে যেকোনো একজন।… তোমরা কতদিন ধরে এখানে এসব খাও?
কে উত্তর দিবে এই নিয়ে ছেলেগুলো কিছুক্ষণ একে-অপরে ঠারাঠারি করল। বয়সে বড় আর শহুরে মালদার মনে করে ছেলেগুলো এরিমধ্যে আবিদের অনুরক্ত হয়ে পড়েছে তা বোঝা দুঃসাধ্য নয়। কাজেই কথার এদিকওদিক করার প্রশ্নই আসে না। আবিদ ইতোপূর্বে এবার তাদের বলে দিয়েছে যে, সে প্রতিদিন তাদের গাঁজার যোগান দিবে। অতএব এতেই বাজিমাত্!
ছোকরার দলের একজন বলল,
– ছয়-সাত মাস ধইরা খাই আরকি!
– ‘খেয়ে লাভ কী হয় তোমাদের?’ আবিদের প্রশ্ন।
– লাভ আর কি! নেশা অয়। মজা লাগে এই আরকি!
– আচ্ছা,… আবিদ একটু ভেবে টোপ ফেলল আবার।- ‘তো মদ-টদ খাও নাকি? খেলে ব্যবস্থা করতাম আরকি। বিদেশি!’
– ‘দুই-তিনবার খাইছিলাম। খাইয়া এইহানে পইরা থাকছি। সেই নেশা অয়। আপনে এত্ত মালদার?’ সবার চোখে বিস্ময় টিকরে পড়ছে।
টোপ কাজে লেগেছে। আবিদের চিন্তা বাড়ল। সে যদ্দুর ভেবেছিল তারচেয়ে বেশি দৌড় খেলেছে তারা এই বয়সেই। কীভাবে যে এদের ফেরানো যায়!
-হুমম, তোমরা এগুলা টানার টাকা কোথায় পাও?
– ‘টেহা! কাজকাম তো করি না কিচু। সবার একরম অবস্থা। যে যেহান থেইক্যা যেমন করে পায় লইয়্যা আয় আরকি! আমি দাদির লগে ঝগ্গা( ঝগড়া) করে লইয়া আসি ট্যাহা। বাপ মা দুইডাই মরছে সব আয়াত দাদিরে দিয়া।’
আবিদ একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল। বেচারি বৃদ্ধ দাদি! খুব বেশি মায়া হয় আবিদের। কেন কে বলবে! সে তো পাষাণ উপাধিপ্রাপ্ত মায়াদয়াহীন সর্বহারা প্রাণী!
– ওঃ… বলে একটু চুপ করে আবিদ। কী বলবে ভেবে পেল না সে। কী মনে করে বলল,
– একটা গল্প শুনবে? তোমাদের মতোন একটা ছেলের গল্প।
গল্প শুনতে ‘না’ করবে এমন মানুষ বোধকরি ত্রিলোকে নেই। এরা তবে কোন্ ছাই?
কয়েকজন সমস্বরে সায় দিয়ে বলল,
– আইচ্ছা হুনান।দেহি কী গল্প!
– গল্প না আসলে, সত্য ঘটনা। শুনো তবে…
বেজুত জায়গায় বসে থাকতে থাকতে উরবির পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গিয়েছিল। সে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– আপানারা গল্প শুনেন, আমি দিঘির পাড়ে হেঁটে আসি একটু।
আবিদ জানতো এই দুরন্ত মেয়েটা কোথাও বেশিক্ষণ হজম হবে না। একটা না একটা অনিষ্ট না করলে তার চলে না! এই অন্ধকারে যাবে দিঘির পাড়ে হেঁটে ফিরতে! বোধহয় তার আমগাছের জ্বিন-ভূতের তার পিছু নিয়ে চলে এসেছে বটতলায়, এবার অভিসারের ডাক পড়েছে! ফাজিল মেয়ে!
আবিদ ত্যারচা গলায় বলল,
– যান যান ঘুরে আসেন।
এতক্ষণ যে ছেলেটা আবিদের সঙ্গে বকবক করছিল সে বলল,
– ভাবি টর্চ লইয়া যান। ওদিকে জাগা ভালো না।
শুনেই নিমেষেই খ্যাঁক করে উঠল উরবি,
– ঐ বেয়াদবের বাচ্চা বেয়াদব। তোর কোনকালের ভাবি হই আমি? কোন জিহ্বা দিয়ে কথাটা বলছস। দেখি সেই জিহ্বাটা!
শেষোক্ত কথাটা বলে উরবি মারমুখি হয়ে ছুটতে চাইল ছেলেটার কাছে। আবিদ তার কাঁধ জোরে আঁকড়ে ধরে ঝগড়ায় বাধ সাধল।
ছেলেটা থতমত খেয়ে মিনমিন করে বলল,
– আপনে জিসান ভাইয়ের হবু বউ না?
এবার উরবি গলা সাংঘাতিক চড়ে গেল,
– চুপ, শালার অসভ্য, রাস্কেল। তোর জিসান ভাইকে পিটাইছিলাম মনে আছে কি-না জিজ্ঞেস করিস। বেশি বাড়াবাড়ি করতে তুরেও সেভাবে পিটাব। লাগবে না টর্চ। তোর টর্চ তোর মাথায় ভাঙ।…
হনহনিয়ে ঘুপচি গাছপালা ঘেরা মেটে রাস্তা ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল উরবি। এতক্ষণের কসরতে জমিয়ে তোলা পরিবেশটা তুড়িতে গুমোট করে দিয়ে চলে গেল মেয়েটা। আবিদ মুহুর্মুহু উরবির অতুলনীয় সাহস দেখে অবাক হয়। বড়সড় ঝঞ্ঝায় যার উড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল সেই মেয়ে আবার গেঁজেলের সঙ্গে লড়তে যায় কোন্ আরাধ্য সাহসে? এদিকে ছেলেগুলো জিসান আর উরবির পরিচিত! সবকিছু কেমন আউলা-ঝাউলা লাগছে আবিদের। সব ভুলে যখন আবিদ পুনরায় আড্ডাটা জমানোর চেষ্টা করে তখন দিঘির পাড় থেকে আবার উরবির চেঁচামেচি কানে বাজল বেঢপ হুংকারের মতোন। নাহ্ এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না। দলবল নিয়ে শব্দ অনুসরণ করে ছুটে গেল আবিদ।
চলবে