ভবঘুরে পর্বঃ০৯
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
– আমার মতো? আমি আপনার মতো খারাপ না বুঝলেন?
আবিদ পুনরায় ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে ছোট করে বলল,
– বুঝলাম।
উরবি আবার তাড়া দেয়,
– এবার চটপট বলে ফেলুন তো কেন এসেছেন?
আবিদ বেকায়দায় পড়ে একবার চোখ বুজে বিরক্তসূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল,
– হঠাৎ আপনি এতো জেরা করছেন,কারণটা কী? কে আপনাকে আমার নামে প্যাঁচ লাগিয়েছে?
চকিতে উরবি বিস্ময়াভিভূত হল। যেন এহেন অদ্ভুত কথা এর আগে শুনেনি এমন গলায় বলল,
– কে লাগাবে?। আমি শুধু জানতে চাইছি৷ তাছাড়া আপনি আমার ঘরে আছেন,আমিতো আপনার এখানে আসার কারণটা জানতেই পারি।
আবিদ এবার বিরক্তিমাখা কঠিন গলায় বলল,
– আপনি ফের পড়ে আছেন ঘরের অহঙ্কার নিয়ে। বললাম তো চলে যাব। আর শুনুন। আলুবাজ আমি কোনোকালেই ছিলাম না। আমি মেয়েদের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করি না বরং মেয়েরা আমার সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে আমার জীবনটাকে নরক বানিয়েছে।
বলে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে লম্বা পা ফেলে আলোআঁধারির জ্যোৎস্নালোকে পলকেই হাওয়া হয়ে গেল সে। উরবি মাথা নিচু করে আড়চোখে তার চলে যাওয়া দেখল; এবং চলে যেতেই সে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ জিব বের করে মুখ ভেংচে, বিড়বিড় করে খিস্তি প্রয়োগ করে তবে ক্ষান্ত হল। তবে তার চঞ্চল মস্তিষ্কে আবিদের বলা শেষ কথাটি একমুহূর্তের জন্যও ভিন্ন ভাবনার উদ্রেক করল না।
পরেরদিন। আবিদ আজ বোরোয়নি ঘর থেকে। সকাল থেকেই শরীরটা ভালো ঠেকছে না তার। আবহাওয়া অফিসও ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না। কাজেই সকালের নাশতাটা করে চিরাচরিত নিয়মে বক্ষস্থলে একখানা রঙিন ছবি রেখে শুয়ে পড়ল সে।
আজ সকাল থেকেই আকাশটা বেশ তকতকে ছিল। সূর্য তার আপন গতিতেই আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়েছিল বিশাল একখণ্ড অগ্নিপিণ্ড নিয়ে। এসেছিল প্রতিদিনকার মতোন আজও ধরণীর মানুষগুলোকে নিজ উত্তাপে ঝলসে দেবার নিদারুণ উপলক্ষ নিয়ে। কিন্তু বেলা গড়িয়ে যখন দুপুর হল তখন, স্বচ্ছ নির্মল আকাশে ঈষান কোণ থেকে দ্রুত বেগে ধেয়ে এলো রাশি-রাশি নিবিড় কালো মেঘপুঞ্জ। মুহূর্তেই বসুন্ধরা ছেয়ে গেল ঘন তমসায়। সূর্য যেন বিনাযুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা লুকাল মেঘেদের আড়ালে। শুরুতে বরফ-ছুটা শীতল বাতাস শোঁ শোঁ শব্দে বইতে লাগল এবং ধীরে ধীরে তা নব উদ্দীপনায় পাল্লা দিয়ে উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। তীব্র গতিতে ঝাপটা দিতে শুরু করল তল্লাটের প্রতিটি রন্ধ্রে। বাতাসের সঙ্গে চক্রাকারে উড়তে লাগল গ্রীষ্মের তপ্ত ধুলো। ক্ষীণদেহী গাছগুলো বাতাসের তীব্রতা সইতে না পেরে মাটির ওপর উপুড় হয়ে নুয়ে পড়ছে। কালেভদ্রে গাছপালার শিকড় থেকে মগডাল পর্যন্ত মচমচ করে কেঁদে উঠছে। প্রাণীকুল নিজ প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে দিক্বিদিকে। খানিক পরই বাতাস কাটিয়ে নামবে ভারী বরিষণ।
খোলা জানালায় আবিদের ঘরময় শিথিল বাতাসে টইটম্বুর হতেই তার ঘুম ছুটে পালাল। যেই চোখ খুলল সঙ্গে সঙ্গেই কটাস করে দরজা খুলে গেল। হুড়হুড় করে প্রবেশ করল উরবি আর কিশোরী কাজের মেয়েটি। আবিদ অভিভূতের মতো ঘুম জড়ানো চোখে তাকাল উরবির দিকে। চোখেমুখে তার উদ্বেগ আর অবিমিশ্র খুশির ছটা। দেখে মনে হল,এই দুর্যোগকালে যেন সে পালাতে উদ্যত সাপ থেকে মনি ছিনিয়ে নিয়েছে! আবিদ আড়ষ্ট গলায় কিছু একটা বলতে যাওয়ার আগেই উরবি খপ করে আবিদকে বিছানা থেকে টেনে তুলতে তুলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে কি-সব বলল ঠিক বোঝা গেল না। আবিদ পায়ের পাতা দিয়ে শক্ত করে দাঁড়িয়ে গিয়ে মাতালের মতো করে বলল,
– কী আজব! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
উরবি বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। সে আগের মতোই উল্লাসের সঙ্গে প্রাণপণে আবিদকে টানতে টানতে বলল,
– আরে বাইরে তুফান হচ্ছে। বাগানে আম পড়তেছে। আসেন আম কুড়াব।
আবিদ ততক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে কিছুটা। উরবির অসীম উদ্দীপনার মুখে আবিদের একটুখানি অনিচ্ছা যেন কাটা পড়ে গেল। সে বুঝল, যেতে তাকে হবেই। খামোখা ঘাঁড়ত্যাড়ামি করে বিশেষ কোনো ফল হবে না। কাজেই সে হাল ছেড়ে দিয়ে উরবির যেদিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগাল স্রোতস্বিনীর মতো সেদিকেই চলতে লাগল। ফ্লাটের দরজার সামনে এসে নিরুকে পাওয়া গেল। সে এই ঝঞ্ঝার মধ্যে আম কুড়াতে যাবে না দেখেই উরবি এতো ব্যস্ত হয়ে আধ-ঘুমন্ত আবিদকে হিঁচড়ে এনেছে।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
বাইরে তখন বেগে বাতাস বইছে। কাঁঠালবাগানের একটি গাছ এরিমধ্যে উৎপাটিত হয়ে পড়েছে মাটিতে। তার বিপরীতের আম বাগানে বৃষ্টি ঝরার আগে থপথপ করে পাকা-কাঁচা আমের বৃষ্টি হচ্ছে। পিপাসায় ছাতি-ফাটা পাখীরা এবার ঝড় থেকে রক্ষা পেতে বুক – বিদীর্ণ করে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। বাগানে পৌঁছে উরবি আবিদকে বাগানে ছেড়ে দিল আম কুড়াতে। ঠিক যেমন চিড়িয়াখানায় বন্য পশুকে খাঁচায় পুরে ছেড়ে দেওয়া হয় তেমনি! আবিদ আর নিষ্ফল বাক্যব্যয় না করে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আম কুড়াতে মনোযোগ দিল৷ উরবির হাতে ধরা চটের থলেতে একে একে আম পুরতে লাগল দুজনে।
দমকা বাতাসে আবিদের কাধ আবধি ঝরঝরে লম্বা চুল এলোমেলো হওয়া সুঁতোর মতো সামনে পিছনে উড়তে লাগল। দেখে উরবি নিজের চুল থেকে রাবারের ব্যান খুলে আবিদের দিকে বাড়িতে দিল। উরবির পিঠ-ছোঁয়া খোলা চুল অশরীরীর মতো উড়তে শুরু করল বাতাসে। সে খর বাতাসের কারণে বধিরকে চিৎকার করে বলার মতো করে বলল,
– এটা চুলে বেঁধে নেন তাড়াতাড়ি। ছেলেদের চুল উড়লে লেডিস্ ভাব চলে আসে। বাজে দেখায়।
আবিদ বাতাসের ঝাপটায় চোখ কুঁচকেছে। হাতে নিল উরবির বাড়িয়ে দেওয়া রাভার ব্যানটা। মৃদুহাস্যে চুলগুলো গুচ্ছ করে ধরে দক্ষের মতো বেঁধে বলল,
– থ্যাংক্স।
উরবি সেদিকে কান দিল না অবশ্য। সে লাফিয়ে লাফিয়ে সদ্য-চ্যুত আমগুলো কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুখে তার আপ্লুত হাসি লেগেই আছে। কালবৈশাখী ঝড়টা এবার বড্ড অসময়ে এসে পড়েছে। ধীরে ধীরে বাতাসের গতি বাড়তে লাগল। সেই সঙ্গে কালো মেঘ চুঁইয়ে বড়বড় ফোঁটা বৃষ্টি নামতে শুরু করল। ইতোমধ্যে ঠাসা আমে দু’টো থলে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে আবিদ ঘরে ফিরতে তাড়া দেয়। কিন্তু আম-পাগল উরবি সে সেকথা কানেই তুলে না। শিষ বাজিয়ে, খুশিতে হোঁঃ হোঁঃ চিৎকার করে, উন্মাদিনীর মতো বাতাস গায়ে মেখে বাগানময় ঘুরে ফিরতে থাকে। একটা আম গাছ থেকে স্খলিত হতে দেরি সে দৌড়ে গিয়ে সেটা পুরে নিতে দেরি করে না। ওদিকে নিরু পাকা স্লাবের ওপর নিরাপদে দাঁড়িয়ে তাঁর কাণ্ড দেখতে লাগল আর মুখ টিপে হাসতে লাগল। ক্রমে বৃষ্টির প্রতাপ বাড়তে লাগল;সঙ্গে উন্মত্ত হাওয়ার গতিবেগও। ভিজতে শুরু করল উরবি। ভিজতে লাগল আবিদ। বাগানে অবস্থিত পক্ষীকূল কোথায় গিয়ে মরে পড়ে রইল কোনো হদিস মিলল না। হঠাৎ একটা বিষম কাণ্ড ঘটল। ঘটনা যে একেবারে অপ্রত্যাশিত তাও কিন্তু নয়। উরবির অজ্ঞাতে যখন তার ওপর একটি প্রকাণ্ড ডাল ভেঙে পড়তে লাগল আড় হয়ে, আবিদ তখন খুব একটা দূরে নয়৷ সে সচকিত হয়ে দ্রুত সরে এলো উরবির দিকে। উরবি তখনো মনের আনন্দে আম কুড়াচ্ছে। আবিদ ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে উরবিকে তার বিশালদেহে বিনা-ক্ষয়ে আগলে ঘুরে গেল বটে;কিন্তু গাছের সুচিক্কণ একটা বিচ্ছিন্ন ডাল ফস করে আবিদের ডানপেশী গভীরভাবে চিড়ে দিয়ে ভূপতিত হল। চিড়িত্ করে টকটকে নির্জলা রক্ত বেরিয়ে এল হাতের পেশি চিড়ে। বৃষ্টির পানিতে মিশে রক্তস্রোত যেন মনিবের শরীর-ছাড়া শোক নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বয়ে যেতে লাগল। শুরুতে সুক্ষ্ম বেদনায় আবিদ একটু শিউরে উঠে উরবিকে বাহুবন্ধনীতে চেপে ধরল অজান্তেই। আর স্বার্থপর উরবি ভেবে নিল লোকটা এই সময়ে সুযোগ পেয়ে ইচ্ছেকৃত একাজ করেছে। কিন্তু পরক্ষণেই হাতের রক্ত-অশ্রুর দিকে চোখ যেতেই সে ভয়ে,আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। সেই ভয়ার্ত চিৎকারে বোধকরি বাতাসও জ্ঞান ফিরে পেয়ে একটু সংযত হল। দৌড়ে এলো নিরু সঙ্গে অন্দর থেকে সালমা।
………………………….…………………
বাইরে প্রকৃতি যখন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নিস্তব্ধ হল ঘরের ভেতরের পরিবেশটাও তখন থমথমে। আক্রান্ত আবিদকে ঘিরে আছে বাড়ির উৎসুক সদস্যরা। ইশতিয়াক সাহেব, উরবি,নিরু, সালমা,কিশোরী কাজের মেয়েটা-সহ সকলে যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আবিদকে। উরবি অধোমুখে বসে আছে একদম পাশ ঘেঁষে। সবার মুখে আতঙ্কের ছাপ থাকলেও উরবির চোখেমুখে খেলছে চাপা অপরাধবোধ! হয়তো আবিদের কথায় কান না দেয়ার ফলেই এখন নিজেই অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হচ্ছে। খানিক আগেই নানাবিধ উপায়ে চিল্লাপাল্লা-দৌড়াদৌড়ি করে রক্তপাত বন্ধ করা হলে সালমা নিজেই ফার্স্ট এইড বক্স এনে কোনমতে সেভলন্ দিয়ে ধুয়েমুছে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরখ করেই বোঝা গেল ক্ষতস্থানে সেলাই পড়বে দু’তিন ফোঁড়;কাজেই ঘন্টাখানেক পর ঝড় পুরোপুরি থামতেই ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। ডাক্তার আসতে বেশ বিলম্ব হল পথের নানা ঝক্কি-ঝামেলায়। অর্ধমৃত তল্লাটে সন্ধ্যা নামার আগে আগেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে ডাক্তার এসে পুনরায় আবিদের ডান হাতের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে সেলাই করে বিবিধ পরামর্শ পেশ করে একগাদা ঔষধ–পথ্য লিখে দিয়ে গেল। বস্তুত একজন শক্ত-সামর্থ্য পুরুষের জন্য এই আঘাত যৎসামান্যই মনে হবে। আবিদেরও তাই মনে হচ্ছে! কিন্তু আঘাতে দৈর্ঘ্যের চেয়ে গভীরতা একটু বেশি হওয়ার দরুন যাতনাটাও একটু বেশিই বোধ হচ্ছে । যদিও এরকম কত আঘাতে তার শরীর শতচ্ছিন্ন হয়েছে তার হিসেব-অন্ত নেই। তবে সে পড়েছে এক ভীষণ জ্বালায়! সবাই এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে যেন বিপন্ন কোনো প্রাণী কালবৈশাখী ঝড়ে বন থেকে উড়ে এসে তাদের ঘরের সামনে পড়েছে, আর তারা সেটা মহানন্দে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে! অনেক্ষণ এভাবে চলার পর এবার একটু বিরক্ত হল সে। তবে সে মনের বিরক্তিটা মনেই চেপে রাখল। বোধহয় কোনো ফাঁকফোকর পেয়ে একটুখানি বেরিয়েও গেল। সেই সূত্র ধরেই হয়তো উরবি তার সুপ্ত বিরক্তির আঁচ পেল। সে চকিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে সবাইকে একপ্রকার জোর করে ঠেলে ঘরছাড়া করল। নিরু তখনো যায়নি নিজের বাসায়। সে ঠায় বসে রইল আগের মতো। ঘর থেকে বেরোনোর প্রয়োজনবোধও করল না। উরবি তাকে একটু সংকোচ নিয়ে বলল,
– তুই যাবি না বাসায়?
নিরু খাট-সংলগ্ন সিঙেল সোফায় নিষ্পলক চোখে বসে কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ ধ্যান ভেঙে মাথা তুলে অপ্রস্তুত গলায় বলল,
– নাহ, আজ এখানেই থেকে যাব।
– কেন? না মানে… বাসায় চিন্তা করবে না? ফোন দিছিস?
নিরু মাথা নাড়ল,
– নাহ নেট নাই তো!
উরবি পুনরায় আবিদকে ঘেঁষে বসতে বসতে বলল,
– আচ্ছা ঠিক আছে, তুই পড় গিয়ে।
বলে সে নিজেই বোধকরি নিজের অবান্তর কথায় একটু মুশকিলে পড়ে গেল এবং নিজের ভুলের মাশুল হিসেবে চোখ আধো-বন্ধ করে গালের ওপর ঝুলে পড়া চুলের আড়ালে ছোট করে জিব কাটল। সেই জিব কাটা নিরুর আড়ালে ঘটলেও আবিদের স্পষ্ট দৃষ্টি-গোচর হল।
নিরুর ভীষণ হাসি পেল উরবির আনাড়িপনায়। তবু সে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– একটু একা থাকতে চাস সেটা বললেই হয়!
বলে সে আর উরবির দুরুত্তরের অপেক্ষা না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
পেছন থেকে উরবি একলাফে দৌড়ে গেল। পেছন থেকে নিরুর ঘাড়ে দুইহাত জাপটে ফিসফিস করে বলল,
– রাগ করিস না লক্ষ্মী। তুইও খেয়ে আয় আর আমাদের জন্যও নিয়ে আয়। লোকটা মনে হয় দুপুরেও খায় নাই। আমিও তো না খেয়ে আছি!
বলে এবার সে আর নিরুর উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুতবেগে ছুটে এসে আগের জায়গা দখল করে বসল।
ততক্ষণে আবিদ আধশোয়া হয়ে বসল। চোখ দুটো বন্ধ করে আছে সে। এই মেয়েটার কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকারবারে লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। এভাবে সবাইকে বের করে দিয়ে নিজে গেঁড়ে বসে রইলে লোকে কী ভাববে!
অনেক্ষণ সসংকোচে বসে থাকার পর উরবি প্রশ্ন করল,
– আপনি কি রেগে আছেন?
– ‘না’ সঙ্গে সঙ্গেই গুরুগম্ভীর গলায় জবাব দিল আবিদ।
উরবি একটু জোর দিয়ে বলে,
– তাহলে এভাবে মুখ ভোঁতা করে আছেন কেন্।
আবিদ জ্বলন্ত চোখ দু’টো মেলে তাকাল। বলল,
– তো আমাকে কি এখন নাচতে বলেন এখন? নাকি আবার আম কুড়াতে নিয়ে যাবেন? না ভাই,সেটা আমি পারব না। অনেক জ্বালাতন করেছেন আমাকে।
আবিদের কথার ঝাঁঝে উরবি মিইয়ে গেল একেবারে। সে নিভন্ত দুখী গলায় সুর করে বলল,
– না… আম কুড়ানো দরকার…অনেক আম পড়ে আছে… কিন্তু… আচ্ছা, আপনার কি খুব বেশি ব্যথা করতেছে?
আবিদ বুকভরে দম নেয়। আবার দু-চোখ বন্ধ করে। কি যেন এক হতাশা ছেঁকে ধরে তাকে। দুচোখ পুনরায় উদ্ভেদ করে শান্ত চোখে চেয়ে বলল,
– আপনি আমার সাথে এই টোনে কথা বলবেন না।
– তাহলে? প্রগাঢ় বিস্ময় নিয়ে শুধায় উরবি।
– আগের মতো ঝগড়াটে গলায় বলবেন। স্বাভাবিকভাবে। সামান্য অসুস্থ হয়েছি বলে সিমপ্যাথির দরকার নেই। এসব আমি বিসর্জন দিয়েছি অনেক আগে।
উরবি একটু নরম হল। অবনত মাথায় আনমনে বিছানার চাদর খুঁটতে খুঁটতে বলল,
– উঁহু সবসময় হয় না। চাইলেও হয় না। আমার একগুঁয়েমির জন্যই তো আপনার এই দশা! এটুকু বলে একটু দম নিয়ে চোখ তুলে বলল,
– আপনাকে আপসেট দেখাচ্ছে…এর ভেতরে কোনো কাহিনি আছে নাকি? বলা যাবে?
আবিদ বেশ শক্তভাবেই বলল,
– স্যরি, আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনোই কাউকে বলি না। তাছাড়া আমি আপসেট নই।
– ওহহ খিদে পাইছে বুঝি? সেই সকালে খাইছেন। চিন্তা নাই খাবার চলে আসবে এখনি। আমারো খিদে পাইছে খুব। একসাথেই খাব আর আপনাকেও খাওয়াব— কই রে নিরু? তাড়াতাড়ি আয়। লোকটা এদিকে খিদেয় মরা মরা অবস্থা।
আবিদ বিরক্তিমিশ্রিত খটোমটো দৃষ্টিতে তাকাল। উরবি নিরুর উদ্দেশ্যে হেঁকে দরজার দিক হতে মুখ ফেরাতেই পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় হল। বেফাঁস, উড়ো লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল উরবি। ঠিক এই সময়ে দু’জনে দুই ভাবনায় মগ্ন। একদিকে উরবির বিভ্রম হচ্ছে লোকটা আজ এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? কেনই বা সে তাঁর মাথাটা আজ উঁচু করে দু’চার কথা শুনানোর সামর্থ্য হারাচ্ছে! আর অন্যদিকে উপহত আবিদ গুপ্ত রোষের মধ্যেও ভাবুক হয়ে উঠছে, শক্ত,উড়নচণ্ডী, রগচটা মেয়েটা আজ তার ওপর এতো সদয় হল কী করে? চক্ষুলজ্জাই বা তার কোথায় গিয়ে লুকাল! অবশ্য তা কোনোকালেই বোধহয় ছিল না উরবির! আর এই অস্বাভাবিক চরিত্রের মেয়ের হাতে খাবার খেতে তো সে বসে নেই! সে চামচ দিয়েই খাবে। প্রয়োজনে বাঁ হাতে খাবে!
চলবে…
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share