ভবঘুরে পর্বঃ০৭
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
আবিদ লজ্জায় কোণঠাসা হয়ে পড়ল। অপ্রস্তুত গলায় কোনরকমে মহিলার সালামের উত্তর দিলেন,
– ‘ওয়ালাইকুমুস্সালাম।’
মহিলা ছোটছোট অথচ দ্রুত পদে চলে গেল অন্দরে; একটু পরই ফিরে এলো দরিমা হাতে। আবিদ ততক্ষণে কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছে মজিদের দিকে। মজিদ অনেকটা লজ্জায় এবং সংকোচের সাথে সৌজন্যতার হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বলেছিল,” এইসবের কী দরকার আছিল ভাইজান! ” জবাবে আবিদ কিচ্ছুটি না বলে হাসিটা ফিরিয়ে দিয়েছিল শুধু।
অবগুণ্ঠিত মহিলাটা মাটির বারান্দায় দরিমা বিছিয়ে দিতেই আবিদ আর মজিদ সেখানে বসে একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে পথ হাঁটার ক্লান্তি দূর করল। আবিদ খাড়া রোদ্দুরে কপাল কুঁচকে চারিপাশে চোখ ঘুরাল একবার। ঘন খড়ের চালওয়ালা মাটির ঘর মজিদের। আয়তনে মোটামুটি বড়োই বলা চলে। বড় ঘরটার ঠিক বিপরীতে একটা ছোট দোচালা কুঁড়েঘর। কুঁড়েঘর থেকে একহাত দূরে লম্বাকৃতির নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। অধিকন্তু আশপাশটাও ছোট-বড় কিছু গাছের ছায়াতলে আবৃত। ভিটার সীমানার চতুর্দিকে মোটা বাঁশ প্রোথিত করা বাঁশের বেড়া দ্বারা বেষ্টিত। প্রবেশপথে একটা টালমাটাল রূপালি টিনের দরজা। প্রবেশপথের খানিক ডান পাশেই নাঙ্গা গোসলখানার নলকূপ চেপে গোসল করছে একজন আট কি দশ বছরের উলঙ্গ বালক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ উৎফুল্ল আজ। আবিদ বুঝতে পারল, মেহমান আসার সুযোগে মায়ের চোখ এড়িয়ে সে ইচ্ছেমতো গোসল করে নিচ্ছে। ঐ নিরবচ্ছিন্ন নলকূপের ক্যাঁচকোঁচ শব্দ বাদে পুরো বাড়িটায় নিস্তব্ধতার মোটা চাদর বেছানো। বাড়িতে লোকজন বড় কেউ নেই নাকি মেহমান আসার দরুন সবাই চুপ মেরে গেছে কে বলতে পারে!………………
– ‘তা ভাইজান, বুঝতে পারছি, আফনে এলাকায় একডা ভালা উদ্দেশ্য লইয়া আইছেন। কিন্তু, আফনের পরিচিয় কিন্তু এহনো জানলাম না।’
মজিদের কথায় ঘোরের জাল ছেঁদ হয় আবিদের। সে উদাম গোসলখানা থেকে চোখজোড়া ফিরিয়ে মজিদের ওপর রাখল। প্রথমে যেন সে মজিদের কথা শুনতে পেল না,
– ‘হু?… ওহহ। আসলে আমার আলাদা কোনো পরিচয় নেই। আমি সরাসরি কোথাও যুক্তও নেই। তবে, যেখানেই অসংগতি দেখি, সময়-সুযোগে সেখানেই ছুটে আসি। সরাসরি যুক্ত নেই ঠিক,কিন্তু পেছনে পেছনে একটু আছি বটে।’
মজিদ অধর প্রসারিত করে বড়ো বুঝবানের মতো মাথা নাড়ল সামনে পিছনে। সে বুঝতে পারল আবিদ তাকে স্পষ্টভাবে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করতে চাইছে না। তাই জোরজবরদস্তির করে তার বৃত্তান্ত জানতে চাওয়াতে ফল বিশেষ হবে না।
– ‘আইচ্ছা,তা কী সমস্যা পাইলেন আমাগো এলাকায়?’
আবিদ একটু সময় নিয়ে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল,
– ‘আপনাদের তো সীমান্তবর্তী এলাকা। দক্ষিণেই ভারতের সীমান্ত। খবর আছে, একটা নির্দিষ্ট সময়ে মানবপাচার হয়। তারচেয়ে বেশি যা হয় তা হল বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আনা-নেওয়া। আমার জানা দরকার এর পেছনে মূল হোতা কারা?’
মজিদ ভারি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সামনে বসা মানুষটাকে যদি সে এসব টুকিটাকি খবর দেয় তাহলে তার ওপর যে ঝটিকা বয়ে যাবে এতে সন্দেহ নেই। এলাকার রাঘববোয়ালেরা এমনিতেই তার ওপর অপ্রসন্ন ভিন্ন দল সমর্থন করায়। মজিদ বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থেকে একসময় চোখ খুলল। ক্ষীণ গলায় বলল,
– ‘আফনারে এসব কইলে তো আমার জান নিয়ে টানাটানি হইবো! যদিও আমি তেমুন কিছুই জানি না।’
আবিদ অভয় দেওয়া গলায় বলল,
– ‘আপনার কিছুই হবে না আশা করি। আচ্ছা, আমি যে আপনার এখানে এসেছি সেটা কেউ জানে? বা ক্ষতি হতে পারে এমন কেউ দেখেছে?’
মজিদ সেই দোকান থেকে এই পর্যন্ত সমস্ত পথ অতিক্রমের ঘটনা মস্তিষ্কে একবার খেলিয়ে দেখে বেশ বিশ্বাসের সঙ্গে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
– ‘নাহ্, তেমন কেউ দেহেনাই।’
আবিদ উত্তর জানার জন্য সুমুখে ঈষৎ ঝুঁকে উন্মুখ হয়ে ছিল। উত্তর পেয়ে সে প্রফুল্লচিত্তে টানটান হয়ে বসে বলল,
– ‘সুতরাং… কোনো সমস্যা নেই। আপনি যা যা জানেন। সব বলুন নির্ভয়ে।’
মজিদ আনমনে ঠোঁট চেপে চোখের তারাদ্বয় ঘুরাল। বোধহয় তার জ্ঞাত সমস্তকিছুর বিবরণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। খানিকপর সে গম্ভীরগলায় বলা শুরু করল,
– ‘কী আর বলমু ভাইজান, আমাদের এলাকাডা হচ্ছে মদতির(মাতাল) আঁতুড়ঘর। রাইতের বেলায় বের অইলে দ্যাখবেন। খোলা মাডের মইধ্যি বইয়া জুয়া খেলে,মদ গিলে। যাগো হাতে মদ পৌঁছায় নাই তারা গাঞ্জা টানে। বেশিরভাগই বেকার পোলাপান।’
– ‘এসব মাদকদ্রব্য কি ঐ সীমান্ত দিয়ে আসে?’ কথার মাঝখানেই প্রশ্ন করে বসে আবিদ।
মজিদ সজোরে মাথা চালিয়ে বলল,
– ‘হুয়।’
– ‘পুলিশ অভিযান চালাতে আসে না?’
– ‘আহে। কিন্তু তাগোরে ধরে না। ধমক-টমক দিয়া চইলা যায়।’
– ‘আপনি এতোকিছু জানেন কীভাবে?’ ডান পাশের ভুরু উঁচিয়ে বঙ্কিম চোখে কৌতুহল উদ্দীপ্ত হয়ে জানতে চায় আবিদ। সে জানে, রীতিমতো জেরা করে বসেছে সে। কিন্তু
জানা তো তার চাই-ই। আবিদের কথায় মজিদ যেন একটু কাঁচুমাচু হয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই সে সকল ভয়,ভীতি, সংকোচ, জড়তা বিসর্জন দিয়ে নড়েচড়ে স্বাভাবিক হয়ে বসল।বলল,
– ‘কইতে লজ্জা নাই বোজলেন,একসময় আমিও ওগো দলে আছিলাম। তয় সে বহুত পুরানা কতা। এরফর অবশ্য আমাগো দলডা ভাইঙ্গা গেছিল। থানায় নতুন এক পুলিশ আইসা আমাগোরে ধইরা লই গেছিল। কিন্তু এরা নতুন পোলাপান জুটে এসব করতাছে। আরো কত খারাফ কাম করে কে যানে৷’
সব শুনে আবিদ চিন্তিত মুখে গালের ঘনকালো দাড়ি মন্থরগতিতে টানতে টানতে বলল,
– ‘বুঝলাম, কিন্তু কারা করছে এসব। তাদের পরিচয় কি বলা যায়?’
– ‘ঠিক কে কে আছে কইতে পারমু না। তয় মেম্বারের ছেলেরে ঐদিকে একটু বেশি আসা-যাওয়া কইরতে দেহি। এরতে বেশিকিছু জানি নাহ্!’
– ‘ঠিক আছে, এতেই চলবে আমার।’
এরপর আর সেই বিষয়ে বিশেষ কোনো কথা হল না দু’জনের মধ্যে। আবিদ ঠিকি চর্মচোখে লক্ষ্য করছিল মজিদ এই বিষয়ে কথা বলতে তুষ্ট নয়। দেখতে নিরীহ টাইপের হলেও মজিদ ভেতরে অগাধ জলের মাছ। তাতে কী? আবিদের যা জানার ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। এই অল্প সংবাদেই রাঘববোয়ালদের মাথা কাটতে এগোতে পারবে সে। এবার সুস্থ মাথায় পরিকল্পনামতো কাজে নামার অপেক্ষামাত্র।
একজন বারো-তেরো বছরের শ্যাম-বালিকা দরিমার ওপর রঙিন দস্তরখান বিছিয়ে লম্ফ- ঝম্ফ করতে করতে চলে গেল। আবিদ এবার বুঝে নিল,বাড়িতে আরো সদস্য রয়েছে। খানিক আগে দুজনের কথোপকথনে মাঝে একবার অনবগুণ্ঠিতা মহিলা এসে শরবত-বিস্কিট পরিবেশন করে গিয়েছিল নিভৃতে। তারা আলাপচারিতায় এতোই নিমগ্ন ছিল যে সেগুলোতে হাত দেয়ার অবকাশ পায়নি কেউই। এখন আর সেসব গিলে দুপুরের খিদেটা নষ্ট করার মানে হয় না। কাজেই মজিদের ইশারায় বালিকাটি চঞ্চল পায়ে ট্রে নিয়ে প্রস্থান করল৷ ক্রমে ভেতর ঘর থেকে মৃদুমন্দ হাঁড়িপাতিল নাড়ানোর খুচখুচ শব্দ ভেসে আসছে মধ্যাহ্নের ভ্যাপসা স্তব্ধ বাতাস ঠেলে। নারিকেল গাছ থেকে কাঠবিড়ালে-খাওয়া একটা ঝুনো নারকোল ধপাস করে পতিত হলো তপ্ত মাটিতে। মজিদ বিড়বিড় করে জনান্তিক করল, “নারিকেল সব খাইয়া ফেলল রে”
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দস্তরখান পাঁচ-সাত পদের স্বতন্ত্র তরকারিতে পরিপূর্ণ করে দিয়ে গেল বালিকাটি। সবই অনাঘ্রাত,টাটকা মাছ-মাংস আর শাক-সবজি।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
মজিদকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে বেশ। আগন্তুক এক মুসাফির লোককে সেবা দিতে পেরে খুশির জোয়ার তার চোখমুখে ছলকে পড়ছে যেন। সচরাচর গ্রামের মানুষের মন দরিয়ার ন্যায় প্রসস্থ হয়। অতিথিকে খাওয়ানোর বেলায় সিকিপরিমাণ কার্পন্য করে না তারা। স্ব স্ব সাধ্যমতো আপ্যায়নে কোনো খুঁত রাখতে চায় না গ্রাম্য উদারমনা মানুষগুলো। মজিদও তার ব্যতিক্রম নয়। হাসি হাসি মুখে আবিদকে যথাসাধ্য উদরস্থ করালো সে এবং বিদায়বেলায় আবার আসার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করিয়ে বিদায় দেওয়া হল। আবিদও মনে মনে মজিদের ব্যবহারে পরিতুষ্ট হয়ে ফেরার পথ ধরল।
…………………………………………..
দিনকয়েক পরের কথা। গ্রীষ্মের আলসে দুপুর। খাবারদাবার খেয়ে সবার চোখে ঘুমঘুম ভাব থাকে এই সময়ে। বাইরে অবিশ্রান্ত রোদ্দুরে মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাসও কারখানার যন্ত্র-নির্গত বাতাসে মতোন উষ্ণ। সমস্ত প্রাণীকূল এই উত্তাপ থেকে আত্মরক্ষা করতে জায়গায় জায়গায় তরুতলে আশ্রয় নেয়। উরবি গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তার ছোটমামির পাশে। আজ কী মনে করে এই ঘরে এসে শুয়েছে সে। তার ধারণা, ছোটমামির ঘরটা অন্যান্য ঘরের তুলনায় শীতল থাকে গরমকালে। কারণেই, একটু আগেই খেয়ে এসে কোনো কথাবার্তা ছাড়া শুয়ে পড়েছে সে। যদিও দুপুরে ঘুমানোটা তার ধাতে নেই। ডানপিটে স্বভাবের মেয়ে সে। ঘুমানোর সময়টা যতোই সংকীর্ণ আর সংকুচিত করা যায় ততই তার জন্য মঙ্গল। কিন্তু তার শরীরটা আজ অকারণেই ম্যাজম্যাজ করছে বলে অগত্যা বিছানার আশ্রয় নিতে হল। কিন্তু প্রকৃতি যে তার অনুকূলে রবে না সে কি তা জানতো? যখন তার চোখের দোরগোড়ায় রাজ্যের সুশ্রী ঘুম-পাখীরা উড়ে বসল তখন জানালার বাইরে একটা কুশ্রী পাখির কিচকিচ ঝগড়ার শব্দে রাজ্যের ঘুম-পাখিরা শশব্যস্ত হয়ে পালাল,অর্থাৎ ঘুম ছুটে গেল। তার ঠোঁট গলে দিয়ে বেরিয়ে এলো অস্ফুট বিরক্তির শব্দ। পাশ ফিরে শুতেই তার চোখজোড়া আটকালো ছোটামামির জল ছলছল মুখের ‘পরে। তাঁর রমণীয় মুখমণ্ডলের দুই ধারে দু’টো কান্নার রেখা সুস্পষ্ট। উরবির বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে অনভিজ্ঞ অনুভূতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। ঘুম যেটুকু বাকী ছিল তাও আর অবশিষ্ট রইল না চোখে। সে ডান কনুইয়ে ভর করে বাম হাতে ছোটমামির মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে আকুল গলায় বলল,
– ‘কাঁদতেছ কেন মামণি? কী হইছে?’
বলা বাহুল্য, উরবি তার ছোটমামিকে ‘মামণি’ বলেই ডাকে৷ এ সালমারই(উরবির ছোটমামি) শিখিয়ে দেওয়া সম্মোধন। প্রথমটা মামি কিছু না বলে জইফের মতোন তাকিয়ে রইল উরবির ব্যাকুল চোখের দিকে। এরপর ধীরে-ধীরে নিজের মুখের ওপর হতে উরবির হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কপট-হাস্যে মৃদু মাথা নেড়ে বলল,
– ‘কিছু না উরবি। তুমি ঘুমাও।’
উরবি গোঁ ধরে বলল,
– ‘বলো বলছি মামণি। আমি তো তোমার ছোটবোনের মতো। তুমি চাইলেই শেয়ার করতে পার।’
মামি অগ্রাহ্যভরে পাশ ফিরে বলল,
– ‘বলার মতো তো কিছু নাই উরবি। এ আর নতুন কী? ‘
– ‘কী সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি। মামার সঙ্গে কথা হয় না?’ উরবি যেন আজ মামির নিঃশব্দ অশ্রুবিসর্জনের কারণ জেনেই তবে ছাড়বে।
– ‘সে তো প্রতিদিনই হয়।’
– ‘তাহলে?’ ব্যাকুলতা কণ্ঠে ফুটে ওঠে উরবির।
মামি পুনরায় উরবির দিকে পাশ ফিরল। চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় থেমে থেমে বলল,
– ‘উরবি,…একজন বন্ধ্যার কষ্ট সে ভুক্তভোগী ছাড়া কে বুঝবে বল! আমার না ঢাকায় চলে যেতে মন ইচ্ছে করতেছে। মা’র কাছে। ‘
– ‘মামি,এসব আল্লাহর খুশি। তাঁর যখন ইচ্ছে হবে তিনি তোমার কোলে সন্তান দিবে। কেন মন খারাপ করো বলো? বন্ধ্যা তো তুমি না। একটু না-হয় দেরি হচ্ছে। অনেকেরই তো হয়।’
– ‘আট বছর হয়ে গেল…’ একটু থামে মামি। আবার বলে, ‘কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাচ্চা দেখলে তোমার মামা খুশি হয়ে যখন তাদের আদর করে,কোলে নেয় তখন না আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যায়। আমি আর পারি না উরবি…’ বলতে বলতে আবারো মামির কণ্ঠ জামানো অশ্রুভারে রুদ্ধ হয়ে আসে। পুন বাষ্পাকুল হয় চোখের পর্দা। পরক্ষণেই নামে মৃতপ্রায় ফোয়ারা। প্রত্যুৎপন্নমতি উরবি কী বলে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না। ইতস্তত করে অমোঘ বাণী খুঁজতে থাকে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে সে মামির দিকে ফিরল। মামি তখন আবারো পাশ ফিরে শুয়েছে৷ বলল,
– ‘মামি, তুমি বোধহয় জান না। আমার বড় মামা জন্ম নিছিল নানীর বিয়ের দশ বছর পর।’
একটুখানি আশার আনকো আলোয় সালমার ভগ্ন গলায় স্বর ফুটল,
“আসলেই?”
উরবি গভীর প্রত্যয়ে ভুরু উল্টে বলল,
– ‘তা নয়তো কী? মামার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। আচ্ছা মামা কবে আসছে?’
– ‘এইতো দু তিনমাস পর আসতে পারে। ব্যাপারটা কী?’ কোণা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মামি।
উরবি দু-হাত মেলে চোখ আয়ত করে বলল,
-‘ কী?’
সালমার ভেতরের চেপে থাকা ক্লেশ যাতনাটা এবার উবে গেল। তবু মুখে তার বিষণ্ণতার ছাপ রয়েই গেল। বলল,
– ‘হঠাৎ তোমার মতির পরিবর্তন? আজ এতো ভালো হলে কেমনে?’
উরবি অভিমানী গলায় বলল,
– ‘আমি মনে হয় খারাপ?’
মামি ভুল শুধরে বলল,
– ‘আহা,তা কখন বললাম, বুঝাতে চাইলাম, প্রতিদিন কেমন চিল্লাফাল্লা করো সারাদিন। আজকে এমন চুপচাপ?’
উরবি এবার ক্লান্তবৎ বালিশের ওপর লেপ্টে শুয়ে পড়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
– ‘শরীর ভাল না মামণি। মাথাটা টিপে দাও একটু।’
“সুযোগ পেলেই কাজে লাগানোর ধান্দা।” অদুরে স্বরে কথাটা বলেই ঢিমেতালে উরবির মাথা টিপতে লাগল মামি। উরবি শুধাল,
– ‘আচ্ছা মামণি, ঐ লম্বা লোকটা আর কয়দিন থাকবে এখানে?’
– ‘তা তো জানি না, কেন?’
– ‘ধ্যুর, লোকটাকে বিরক্ত লাগে আমার।’
– ‘বিরক্ত লাগার কারণ? কিছু বলছে তোমাকে?’
-‘নাহ, কোনো কারণ নেই।’
– ‘ভারী মুশকিল তো! কারণ ছাড়াই একটা লোককে বিরক্ত লাগবে কেন?’
উরবি জবাব দিল না মামির কথার। এই মুহূর্তে তার ঐ লোকটাকে যে কোনো উপায়ে হেনস্তা করার উদ্ভট ইচ্ছে জেগেছে। ইচ্ছেটা মনের ঘরে বেঁধে রেখে অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ঘুম ভাঙল শেষ বিকেলে আসি আসি সন্ধ্যায়। দিনশেষে সূর্য তখন বিলুপ্ত হয়েছে দিকচক্রবালে। কেবল তার শেষ নিভু নিভু ঝাপসা আলোটা বিদ্যমান পৃথিবীজুড়ে। উরবি চটপট করে উঠে দাঁড়াল। ওয়াসরুমে ঢুকে চোখমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুমঘুম ভাবটা দূর করল। এরপর দুতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নামল নিচে নিজের ঘরে। ওয়ারড্রবের ড্রয়ার থেকে দু-তিনটে পাকা টসটসে আম হাতে নিয়ে বেরোল ঘর থেকে। এরপর আপনমনে চিকন দাঁতে কুটকুট করে আমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে গুটিগুটি পায়ে এগোল বাগানের দিকে৷ অামবাগানের প্রতিটি গাছের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন মৃদুমন্দ আলো বেঁচে রয়েছে। খানিকপর সন্ধ্যার শেষ আহ্বানে তাও তিরোহিত হবে। পশ্চিমাকাশটা গোধূলির শেষ সূর্যের স্মৃতি বহন করে স্বর্নাভ আবির মেখে বসে আছে। দুপুরের গুমোট আবহাওয়ার কাটিয়ে বাগানের গাছগুলোর ফাঁকফোকর গলে দক্ষিণা বাতাস হুমড়ে পড়ছে সর্বাঙ্গে। গাছেগাছে পাখিরা নিজেদের ভাগের আম খেয়েদেয়ে ঘুমানোর আয়োজন করছে এবার। উরবির বেশ ভালো লাগল পরিবেশটা। সে গুনগুন করে গান গেয়ে সুমিষ্ট আমের নির্যাস আস্বাদন করে যাচ্ছে। হঠাৎ বাগানের শেষ প্রান্তে চোখ গেল তার। বন্ধ হয়ে গেল গুনগুন গান, বন্ধ হল আম চাবানো। চমকাতে গিয়েও থমকে গেল সে। বিশালদেহী কেউ একজন গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উরবি বরাবরই ডাকাবুকো স্বভাবের। ভয় জিনিসটা তাকে কাবু করতে পারেনি কোনোকালে। সে পুনরায় আম খেতে খেতে এগিয়ে গেল বস্তুটিকে লক্ষ্য করে। দূরত্ব কমার সাথে সাথে সে বুঝতে পারল সেই খাম্বার মতোন লোকটাই বাগানের গহীনে দাঁড়িয়ে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেঁটে কাছে গেল উরবি। অন্য লোকের জন্য নিজের পছন্দ জায়গা এড়িয়ে চলার মতোন বোকা সে নয়। প্রয়োজনে সে যেতে বাধ্য হবে। লোকটা আনমনে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে পশ্চিমের আবির রাঙা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। উরবির পায়ের তলায় শুকনো পাতার আর্তনাদও কানে গেল না তার। জড়বস্তুর মতো সটান দাঁড়িয়ে রইল অন্যমনষ্ক হয়ে কি এমন ভাবছে দৈত্যটা? মাথা টাথা ঠিক আছে তো? ভাবতে ভাবতে আবিদের পিঠে তর্জনী দিয়ে খোঁচা দিল উরবি। আম ঠাসা মুখে অপরিস্ফুট গলায় বলল,
– ‘এই যে দৈত্য। আপনি আমার বাগানে এসে আমাকে ভয় দেখাইতেছেন কেন?’
লোকটা ফিরেও তাকাল না। অস্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বলল,
– ‘কিছু বলবেন? বলার থাকতে বলে চলে যান।’
– ‘ওরে বাবা, সাহস তো কম না! আমার বাড়িতে এসে আমাকে বলতেছেন চলে যান।’
– ‘আচ্ছা স্যরি,আমিই চলে যাচ্ছি।’ বলেই লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হল। কেন জানি উরবি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুইহাতে পথ আঁটকে দাঁড়াল। পথরোধ পেয়ে লোকটা থমকাল। ওহোঃ চলে গেলে হবে কী করে? লোকটাকে তো তার উত্যক্ত করার কথা ছিল। উরবির মাত্র মনে পড়ল দুপুরের ঘুম চোখে চাড়া দিয়ে ওঠা অভিলাষটা। আবিদ মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যত্র। উরবি গভীর চোখে অবলোকন করল লোকটার চোখদুটো টকটকে লাল৷ একদম আজকের আকাশের মতোন ছোপ ছোপ রক্তিম! যৎসামান্য ভয়ে তটস্থ হল সে। তবুও নিজেকে নির্ভীক প্রমাণ করতে ছপছপ করে আম গিলে চলেছে সে। লোকটা ড্যাবড্যাব করে লালবর্ণের চোখদুটো মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই বুঝি উরবিকে গিলে খাবে। হঠাৎ উরবি ওয়াক করে মুখভর্তি চিবানো আম আবিদের বুকের ওপর শার্টে ফেলল। এরপর মুখের ভিতর থেকে বিশাল জিহ্বাটা বের করে কাঁদো কাঁদো হয়ে জিহ্বা হাতের আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল আর বলতে লাগল,
– ‘আপনার জন্য আমি পোকা খাওয়া আম গিলে ফেলেছি ওয়াক্। থুঃ। মরে যান আপনি। অভিশাপ দিলাম।’
আবিদ আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। নিজের শরীরে উরবির দাঁতের নিচে পিষ্ট আমের দিকে তাকিয়ে এবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হল সে। ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই তার মাথায় খেলল না। বুঝতে পারল না তার দোষটা আসলে কোথায়? আবিদ প্রাণপণে ক্রোধ সংবরণ করে কাটাকাটা গলায় নাক সিঁটকে বলল,
– ‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। আপনি আমার গায়ে এসব ফিকে মারলেন কেন? পাগল নাকি?’
– ‘আমি যদি শকুন হই আপনি তাহলে গরু? ঠিক আছে তাহলে। আমি শকুন সেটা মেনে নিলাম। তাহলে আপনিও গরু। মানুষ না।’ এতটুকু বলে থামল সে। একটু জিরিয়ে নিয়ে বারকয়েক থুথু ফেলে আবার বলল,
-‘বজ্জাত লোক৷ এভাবে তাকিয়ে থাকছেন তাই তো ভয় পেয়ে পোকা খাওয়া আম গিলছি। ও আল্লাহ, আমার পেটে যদি পোকার ডিম চলে যায়! আমি পোকার মা হব।’
এবার রীতিমতো কেঁদে ফেলল উরবি।
চলবে…
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share