ভবঘুরে পর্বঃ০৬

0
641

ভবঘুরে পর্বঃ০৬
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

ভূতে ধরা উরবির চতুর্দিক ঘিরে বসে আছে সবাই। একটু পরপর এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে চলেছে উদগ্রীব হয়ে । কিন্তু উরবি কোনোপ্রকার বাঙ্-নিষ্পত্তি করছে না। মস্তিষ্কের ভেতর কেবল সকালের ঘটনাই ঘুরছে ভ্রমরের মতোন ভোঁ ভোঁ করে। মাথা দুভাগ করে ভ্রমরটাকে শূন্যে উড়িয়ে নিষ্কৃতি দিলেই যেন বাঁচে!। লোকটা তাকে এতদূর নামিয়ে এনে শেষবেলায় এসে আঘাত করে কীসের প্রতিশোধ নিল? বিগত দিনের ঘটনার জন্য যদি প্রতিশোধ নিয়ে থাকে তবে উরবি তাকে ছাড়বে না! জংলিটার রক্ষা নেই! নিস্পন্দের ন্যায় সে ভোঁতা মুখে বসে রইল অনেক্ষণ যাবৎ। একসময় যখন সবকিছু অসহ্য বাড়াবাড়ি এবং নেহাৎ একটা ঘটনাকে তিলকে তাল করা বলে মনে হলো তখন সে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে থামালো সবাইকে। শুধু থামিয়েই ক্ষান্ত হল না,বরং সবাইকে একপ্রকার জোরপূর্বক নিজের ঘর থেকে বাইরে বের করল কয়েক মিনিটের মাথায়। রয়ে গেল শুধু নিরু। ঘটনার আদ্যোপান্ত সে কিছুই জানে না। এতক্ষণ পর্যন্ত সে বোকার মতো বসে বসে ইশতিয়াক সাহেব এবং ছোটমামির প্রশ্ন ছোড়াছুড়ি দেখছিল আর আসল ঘটনা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আগাগোড়া কিছুই তার মাথায় টানল না। উরবি যখন বাবা এবং ছোটমামিকে উপেক্ষা করে বাগান থেকে হনহন করে হেঁটে আসছিল ক্রোধভরে ঠিক তখনই নিরু প্রবেশ করছিল মূল ফটক দিয়ে। বাকিদের সঙ্গে সেও উরবির পিছুপিছু তার ঘরে গেল। তারপরের ঘটনা পাঠকের অনবগত নয়।
উরবি সবাইকে বের করে দিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল দরজার৷ কি যেন বিশেষ কাজ শেষ করার ঢঙে বার-দুই হাত ঝেড়ে নিরুর দিকে তাকিয়ে স্বভাবিক কণ্ঠে বলল,
– নে কী পড়া আছে বের কর এবার। আপদ গেছে।
নিরু সেদিকে কানই দিল না। কালক্ষেপণ না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
-‘ কাহিনিটা কী রে? কীসব ভূত-টূতের ব্যাপার?
উরবি ভেতরের চেপে রাখা নিশ্বাসটা ফোঁস করে ছেড়ে দিয়ে মুখ ফেরাল বিষণ্ণ হয়ে। বলল,
– শুনবি?
নিরু ব্যগ্রতা লুকিয়ে নিরুদ্বেগে বলল,
– হুম,শুনতেই তো চাই!
– আর কী শুনবি। কি একটা ঘটনা ঘটে গেল আজকে। সকালে উঠে খিদে লেগেছিল খুব। তখনো কেউ উঠেনাই। কিছু রান্না করেও খেতে ইচ্ছে হল না। আমবাগানে গেলাম আম কুড়াইতে। রাতে যা আম পড়ছিল সব কুড়িয়ে একজায়গায় রাখলাম। ওগুলা স্পর্শ করতে ইচ্ছে হল না। তুই তো জানিস,আমার খুব শখ যে গাছের ডালে বসে গাছ থেকে ছিঁড়ে আম খাই। তো, প্রতিদিনকার মতো আজকেও গাছে উঠলাম। গাছের ডালে বসে সুন্দর করে পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আম খাইলাম কয়েকটা। তারপর আরেকটা চিকনা ডাল থেকে একটা আম ছিঁড়তে গিয়ে হাত ফসকে নিচে পড়তে যাচ্ছিলাম। কোন্ কপালের ভাগ্য যে ডাল ধরতে পারছি নাহয় আজকে মরতাম। তারপর কি হলো শুন…
এভাবে উরবি একে একে সবিস্তারে সমস্ত খুলে বলল সখীকে৷ শেষের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা কথা বলতে গিয়ে মুখখানা চাপা রাগে,স্পষ্টতর দুঃখে,শোকাবহ অপমানে বিমর্ষ করে ফেলল সে। সবটুকু শুনে নিরু খলখলিয়ে হেসে ওঠল। প্রায় মিনিট তিন সেই হাসি দীর্ঘায়ু হল। উরবির রাগান্বিত সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টির সমুখে হাসির ছটা কমে এলো ধীরে ধীরে। তবু সে কণ্ঠস্বরে হাসি হাসি ভাবটা ব্যাপৃত রেখে বলল,
– শুরু থেকেই সবটুকু দারুণ রোমান্টিক ছিল। কিন্তু শেষে এসে তরী ডুবিয়ে দিল।
কথা শেষ হতে না হতেই আবারো খিলখিল করে হেসে উঠল নিরু। উরবি আগের দৃষ্টি বজায় রেখে ঝংকার দিয়ে উঠল,
– মজা লস? আমি আছি যন্ত্রণায় আর তুই হাসতেছস।
– ‘হাসুম না তো কী করুম?’ নিরুর হাসি প্রকোপ থামে না এবার।
কেন জানি এই প্রসঙ্গটা তাকে বিঁধছিল একটু একটু করে। কারণেই, সুযোগ সদ্ব্যবহার করে উরবি দূরদর্শিতার সঙ্গে প্রসঙ্গটা পাল্টে নিল।বলল,
– সুর পাল্টাইছস কেন আবার? তোদের গ্রামের ভাষাটা বাজে। সবকিছু জগাখিচুড়ি। ভাল্লাগেনা।
– আমিতো এই গ্রামেরই মেয়ে। তোর সঙ্গে এসে এসব বলতে হয়। আর তুইও তো এই গ্রামে জন্ম। বড় নাহয় ঢাকাতেই হলি? তাতে কী?
– যাইহোক বাদ দে। আমার অভ্যাস নেই তাই হয়তো ভাল্লাগে না।
নিরু মুখ গম্ভীর করে বইখাতা খুলে বসল। উরবির কথার প্রত্যুত্তরে কিচ্ছুটি বলল না। অবুঝকে বুঝিয়ে নিজের বুলি খরচা করার কোনো মানে হয় না। গ্রামের মেয়ে হয়ে গ্রামের প্রতিকূলে কথা বলাটা মোটেও সাজে না।. উরবির বিরুদ্ধে একটা অদৃশ্য অভিমান অকস্মাৎ অতিথি পাখির মতোন চেপে বসল নিরুর মানসতটে। বয়সে বড় না হলে এক্ষুনি একটা কড়া ধমক লাগিয়ে দিত সে। অথচ বয়সের ভেদাভেদের কারণে তা করা তো দূর ভাবতেই গেল না নিরুর শুভ্র মন। বাকিটা সময় ধরে সে বুকভর্তি অনুরাগে সিক্ত হতে লাগল শুধু।

গত দিনের মতো কেতাদুরস্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল আবিদ। তবে আজ একটু সকাল সকালই বেরোল। উদ্দেশ্য সেই টং দোকানের লোকটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। এসব দোকানে সকাল সকাল একটু ভিড় থাকে লোকজনের; এরপর প্রায় শান্ত হয়। বেলা এগারোটার পর পর থেকে আবারো জমজমাট হতে শুরু করে। এখন বেরোলে একটু শান্ত পরিবেশে দু’চারটা আলাপ করা যাবে। ভেবে দ্রুতলয়ে বাড়ি ছাড়ল সে। কিন্তু মূল গেট পার হয়ে কয়েক কদম এগুতেই পথিমধ্যে বাঁধ সাধলো দশ কি এগারো বছরের এক বালক। জানালো, বাজারের টং দোকানদার মজিদের ছেলে সে। মজিদ তাকে পাঠিয়েছে আবিদকে দুপুরে খাবারের দাওয়াত করার জন্য এবং বলে দিয়েছে যে এখন যাতে দোকানে না যায়। এতটুকু জানিয়ে সে চঞ্চল চড়ুইয়ের মতো ফুড়ুৎ করে মুহূর্তেই নাই হয়ে গেল। নিরাশ হয়ে পূর্ববৎ ফেরার পথ ধরল আবিদ। মজিদ তবে ঠিকি জানতো আবিদ গতদিনের মতোন এই সময়ে আবার আসবে তার সঙ্গে দেখা করতে। উৎপ্রেক্ষা নিপাট মন্দ নয় তার। সে দোকানের দিকেই তো যাচ্ছিল। নাহ্! লোকটাকে যতটা সহজসরল আর হাবাগোবা ভেবেছে আদতে তা নয়। একটু ধূর্তও আছে বটে! নজরটা আরেকটু তীক্ষ্ণ করা আবশ্যক এবার। তবে, দোকানে যেতে না করার কী কারণ থাকতে পারে? যদিও এতো লোকের সুমুখে গুহ্য বাক্যবিনিময় স্বচ্ছন্দে চালানো দুরূহ ব্যাপার। এজন্যই হয়তো সে দাওয়াত দিয়ে নিভৃতে ডেকে নিয়ে সমস্ত খুলে বলতে চায়। যাইহোক, বাকীটা সেখানে গিয়েই দেখা যাবে।

সোজা বাড়িতে ফিরে গেল না আবিদ৷ ছায়া নিবিড় আম্রকানন পেরিয়ে পেছনের গেট হয়ে ঘাটলার দিকে এগোল সে। জন্মলগ্ন থেকে সে যথেষ্ট ঘরকুনো স্বভাবের হলেও জীবনের অমসৃণ গতিপথের অজস্র ফাটলের মাঝে সহসা বিশাল কোনো এক খানাখন্দে পড়ে সে বাহিরমুখী হতে বাধ্য হয়েছে। জীবন তাকে বাধ্য করেছে ভবঘুরে হতে। বিশ্বনিখিলে কেউ নিজের পোক্ত আসন ছাড়তে চায় না, অদৃষ্ট আর জীবনের তাড়নায় ছাড়তে বাধ্য হয় মানুষ। যেভাবে দ্রুতলয়ে সে বেরিয়েছিল ঠিক তার বিপরীত পৃষ্টে ধীরলয়ে ঘাটলা পাড়ে এসে বসল সে। চারিদিকে তখন নিস্তব্ধতা জিইয়ে রয়েছে ভীষণভাবে। তেজোময় সূর্য তখন পুবাকাশ থেকে সরে এসে আধো মাথার ওপর বিরাজমান। বেলা এগারোটা হবে হয়তো! পুরো তল্লাট তখন পিঙ্গলবর্ণের সূর্যালোকে উদ্ভাসিত। পাকা ঘাটলার দুই পাড় ঘেঁষে ঈষৎ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি মধ্যমাকৃতির গাবগাছ। সেই গাছের ছায়াতলে নিষ্কর্মে দুইহাত বুকে গুঁজে বসে আছে আবিদ। গাবগাছের সরু একটি ডালে মনোহারী বাঁশমতি পাখি মৃদুস্বরে কাকে যেন অভ্যর্থনা করতে করতে এডাল-ওডাল করছে একাকিনী। পুষ্করিণীর ঘোলাটে জলে জোড়া মৃগেল মাছ পিঠ উল্টে গভীরে গেল বুদবুদ তৈরি করে। দূর হতে ভেসে আসছে খুঁটি পোঁতার হরদম টকটকটক শব্দ। গ্রীষ্মের গুমোট তাপদাহে সহসা একটা হিম-চ্যুত নরম বাতাসে নড়ছে গাছের পাতাগুলো। পাতা-পাতায় মিলনে ক্ষীণ শব্দ হয়। তাও অনায়াসে শোনা যায় এমন মুমূর্ষ নিস্তব্ধতা! হঠাৎ নিস্পন্দতা কাটিয়ে দু’জন মেয়েমানুষের মৃদু গুঞ্জন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে আবিদের। পরমুহূর্তে দৃশ্যমান হয় দু’টি মূর্তি। উরবি আর নিরু। উরবির কাঁধে ভাঁজ করা হাতজাল আর নিরুর হাতে মাছে নেওয়ার বেতের ঝুড়ি।

দুজনকে দেখে আবিদ বেজায় বিরক্ত হল। তার স্বাভাবিক নিরাসক্ত মুখমণ্ডলে বিরক্তির একটা ছাপ বিদ্যুতের মতো খেলে গেল মুহূর্তেই। কপালে জেঁকে রইল অপ্রসন্ন সুক্ষ্ম ভাঁজ,আর ঠোঁটের কোণে ঝুলে রইল বিরক্তি। যেখানেই যায় সেখানেই কেন এই মেয়ের উপস্থিত হতে হবে? কোন্ দৈব কপাল নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিল সে! মাত্র কয়েকদিনে যা ঘটেছে বিগত ভবঘুরে জীবনেও এতোকিছু ঘটেছে বলে মনে পড়ে না তার। আর, কুঁজড়ামি মেয়েটাকে দেখলেই কেন তার সুপ্ত বিরক্তিটা অঙ্কুরিত হয়! তার স্বভাবটাই বা এমন ব্যাটা ব্যাটা কেন? অথচ তার পাশের মেয়েটা কত ভদ্র আর সাধারণ। সে কি তা দেখে না? অনুধাবন করে না? অবলোকন করে না? অসাধারণ কেন তাকে হতে হবে? অসাধারণ? আসলেই কি অসাধারণ?
ওরা দুজন গুনগুন কথা বলতে বলতে ঘাটলা পাড়ে চলে এল। এসেই যেন আলপটকা আবিদকে দেখে ভূতগ্রস্তের মতো চমকে উঠল দু’জনে। কিন্তু উরবি প্রাণপণে লুকাল নিজের উৎকণ্ঠা। কোনোপ্রকার মিঠাকড়া কথা না বলে সে নিরুদ্যমে বিপরীতমুখী ঘাটে বসে পড়ল৷ কাঁধ থেকে হাতজাল নামিয়ে রাখল পাশে। শুরতে নিরু কথা বলল,
– আপনি না বাইরে গেছিলেন, দেখলাম জানালা দিয়ে! এখানে কেমনে?
আবিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ হেসে কৌতুকের স্বরে বলল,
-‘এই আমি সেই আমি নই। কিন্তু সেই আমি এই আমি নই।’
নিরু গুরুতর ঢংয়ে বলল,
– বুঝিনি!
আবিদ হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল,
– জাস্ট কিডিং৷ আপনারা কি পুকুরে জাল ফেলবেন নাকি? প্রশ্নটা ছোঁড়া হল আনমনা উরবির দিকে তাকিয়ে।
উরবি অগ্রাহ্যভরে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তপ্ত পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে বলল,
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

– বাবা বলেছে আপনাকে জাল ফেলতে। দুপুরে রান্না হবে।
কথাটা শেষ হতে না হতেই নিরু অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে তাকাল উরবির দিকে। উরবি অজ্ঞাতসারে কুট করে একটা চিমটি কেটে বসল নিরুকে। চিমটির অর্থ, আমি যা বলছি তাতেই সন্তুষ্ট থাক। নিরু সম্মতিসূচক ফিক করে হেসে দিল। কিন্তু আবিদ শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হেলান দিল কংক্রিটের তৈরি ঘাটলায়। ভারী স্বরে বলল,
-‘ তোমরা দু’জনে মিথ্যা বলছ। কারণ আংকেলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ঘর থেকে বেরোনোর সময়। তিনি আবার আমাকে জাল ফেলতে বলবে কোন্ দুঃখে? তিনি তো জানেন আমি ঘরে নেই।
নিরু নিরুত্তর। উরবি ভারহীন বসে রইল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীর বিপদে পড়ে গেল সে। এখন কী উত্তর দিবে? অনেক ভেবে সে দর্পভরে উত্তর দিল,
– ঐ যে ছাদ থেকে আপনাকে দেখেছেন, তাই। এতো প্রশ্ন করছেন কেন? মন চাইলে ফেলবেন নাহলে নাই।
উরবির মুখনিঃসৃত কথায় অভূতপূর্ব ঝাঁজ টের পেল আবিদ। এই ঝাঁজের সঙ্গে সকালের ঘটনার সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে তা স্পষ্টতর বোধগম্য হয়। ঔষধ তাহলে কাজে দিয়েছে! এবার যদি অন্তত তার পিছন ছাড়ে! সে আরো উদাসভাবে বলল,
– বেশ তো! আমারো ইচ্ছে নেই এই মুহূর্তে জাল ফেলার। পারলে আপনি ফেলুন।
উরবি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। জাল হাতে উঠে দাঁড়াল। নিরুর দিকে তাকিয়ে আবিদের চেয়ে দ্বিগুণ উদাসভরে বলল,
– আয় তো নিরু। বাবা আসতে আসতে আমরা কিছুক্ষণ মাছ ধরি। কোনো পুরুষমানুষ লাগবে না আমাদের। শেষের কথাটা আবিদের দিকে কটাক্ষপাত করে বলল উরবি। জবাবে আবিদ কেবল গা জ্বালা ধরানো বাঁকা হাসল।
নিরু উঠে দাঁড়াল মাছ নেওয়ার ঝুড়ি হাতে। ঝুড়িটা একপাশে রেখে দুই শখী মিলে বহুকষ্টে জালের কোপ বানাল মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে। জাল কিন্তু উরবির হাতেই। বানানো হয়ে গেলে উরবি ঘাটের একটা সিঁড়ি ভেঙে পায়ের পাতা পরিমাণ পানিতে নেমে নিজের সর্বোচ্চশক্তিতে জাল ছুঁড়ল পানিতে। গোলাকার হয়ে জালের ভারী গুলতি স্পর্শ করল স্থবির জল। ছপ করে শব্দ হলো। পরক্ষণেই টাল সামলাতে না পেরে সেও ঝপাং করে পানিতে পতিত হল। চকিতে একবার ডুবে গিয়ে পুনরায় সোঁ করে ভেসে উঠল সে। হাত পা নেড়ে হাপুস- হুপুস সাঁতরে পায়ের তলায় ঘাটের সিঁড়ি খুঁজে, মুখভর্তি পানি নিঃসারিত করে জাল টানতে শুরু করল সে। এ যেন পাক্কা জেলে! শুধুমাত্র গায়ের জোরের অভাব! ওটুকু থাকলেই সে মহিলা জেলেদের দলে নাম লেখাতে পারতো নিঃসন্দেহে। পুরোটা বিষয় আবিদ বিহ্বলের ন্যায় হাঁ করে দেখে গেল শুধু। সে নিজেও ভালো মতোন হাতজাল চালাতে পারে না। অথচ এই মেয়ে পুরোদস্তুরে পোড় খাওয়া জেলের মতোন জাল ছুঁড়ল এই মাত্র! কোন্দলিয়া মেয়েটা এই কৌশল রপ্ত করল কখন কে জানে!
জাল টানা শেষে ক্লেদমিশ্রিত জালটা নিয়ে ঘাটলার ওপর চাতালে উঠে এলো উরবি। পাকা চাতালের ওপর শব্দ করে রাখা হল জাল। নিঃশব্দে পিছুপিছু গেল নিরুও। মেরুদণ্ড বাঁকা করে নিচের দিকে ঝুঁকে ব্যাটা ছেলের মতো জাল পরিষ্কার করতে লাগল সে। ঝুড়িতে উঠে আসতে লাগল একে একে বিবিধ প্রকৃতির মাছ। মলা-ঢেলা পুঁটি, এবং গুটিকয়েক শিং মাছ। মাছগুলো আমগন্ধী কাদা থেকে তুলে ঝুড়িতে পুরে নিচ্ছে নিরু। উরবির পরনের ঢিলেঢালা গোলাপি রঙা টিশার্ট এবং প্লাজু ভিজে জুবুথুবু হয়ে গায়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে। সপসপে কাপড়ে নারীদেহের দুরালভ সুক্ষ্ম ভাঁজগুলো ফুটে উঠেছে তার অলক্ষ্যে। আবিদ চশমখোরের মতোন চেয়ে থাকতে পারল না বেশিক্ষণ। ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে এড়ানো গলায় বলল,
– ঠিক আছে, আপনারা মাছ মারুন। আমি যাই৷ আমার আর থেকে কাজ কী?
নিরু বলে উঠল,
– সে কি কোথায় যাচ্ছেন? আপনিও থাকুন আমাদের সাথে… পরমুহূর্তেই তার ঘটিরাম সুহৃদ এর জল জবজবে শরীরের কথা মাথায় ধরলে সে জল-নিমজ্জিত মুড়ির মতো চুপসে গেল পলকে। বোকার মতোন কপট হেসে মিনমিন করে বলল,
– ঠিক আছে যান তাহলে।
বলে সেও সলজ্জে চোখদুটো ভূপতিত করে অধর চেপে ধরল দাঁতে।
আবিদ ঠোঁটের কোণে একটুকরো চৌকস হাসি টাঙিয়ে পা বাড়াল। উরবি পেছন থেকে চড়া গলায় বলল,
– আর শুনেন, বাবাকে আসতে নিষেধ করবেন। বলবেন,আজকে ওরাই মাছ মারবে। আর যদি বেশি জোর করে তাহলে বলবেন, এখানে আসলে তার জন্য চুবানি অপেক্ষা করছে।
আবিদের গতি একটু শ্লথ হল বটে কিন্তু সে পেছনে না তাকিয়ে সম্মতিসূচক হাত নাড়ল। আবিদ ছোট করে আওড়াল, ‘মেয়েটা বাবাকে ছাড় দেয় না দেখছি’

আবিদ চলে যাওয়ার পর নিরু আগের চিমটিটা উরবিকে ফেরত দিয়ে বলল,
– কী দরকার ছিল, আঁতেলগিরি করে নিজে পানিতে ভিজার?
উরবি চিমটি খেয়ে অস্ফুট আর্তনাদে ঈষৎ লাফিয়ে উঠল। বলল,
– আরে প্রেস্টিজ আছে না? ঐ ব্যাটা দেখিস না কেমন পার্ট নিচ্ছিল? তাই আমি নামছি।
নিরু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
– বিরাট কাজ করে ফেলছ। অচেনা একটা লোকের সামনে কেও এভাবে ভিজে? সেন্স নাই তোর?
– ভিজছি তো কী? ন্যাংটো তো নাই নাই?
– উরবি,তুই দিনদিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিস। নিজের শরীরের দিকে একবার দ্যাখ তুই। ওয়েট ওয়েট ওয়েট, তুই আংকেলকে আসতে না করেছিস তুই ভেজা বলে?
– হ্যাঁ।
উরবি রহস্যময় হেসে ভ্রু নাঁচাল,
– তাহলে লোকটার সামনে ভিজলি কেন? কাহিনি কী?
উরবি ভারি চিন্তায় পড়ে গেল। তার মস্তিষ্ক-চরে নানান প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে উদ্ভ্রান্ত মৎস্যের মতো। নাহ্ ভাসত দেওয়া যাবে না। নিমেষে সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে নিয়ে সে চাতাল থেকে জাল তুলে সিঁড়ি ভেঙে নামল হাঁটু পানিতে। কর্দমাক্ত জালটা পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করতে করতে নিরুর প্রশ্নের দুরুত্তর করল সে,
– তুই কি কানা? নিজেই তো দেখেছিস আমি জংলিটার গা ছাড়া ভাব দেখে রাগ করে পানিতে নামছি। কোথাকার জল কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস বলতো? কী কাহিনি হবে আবার?
– কিজানিরে বাবা তোরাই জানিস। দুই কাঁধ উঁচিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল নিরু। উরবি আরেকটা জালের কোপ বানাতে বানাতে খোঁটা দেওয়া গলায় বলল,
– কেন? আপনি যে প্রথম দেখায় ক্রাশ খাইছিলেন সেটা কী ছিল?
– হ্যাঁ ক্রাশ একটু খেয়েছিলাম বটে। কিন্তু তোর মতো এভাবে আধ ন্যাংটো হই নাই।
– কুত্তি, আমি মোটেও আধ ন্যাংটো না। বেশি কথা বললে তোকেই ন্যাংটো করে দিব ফাজিল মেয়ে।
বলতে বলতে আরেকটু দূরে গিয়ে স্তব্ধ পানিতে হাতজাল ছুঁড়ল উরবি। কয়েকটা মলা মাছ দ্রুত সাঁতরে অন্যত্র পালাল। শূন্যে লাফিয়ে আবারো পানিতে ডুবল কিছুসংখ্যক মাছ। এভাবে দুই সখীর মাছ ধরা অব্যাহত রইল দুপুর পর্যন্ত।
……………………………………………

ব্যাগ কাঁধে আবিদ যখন মজিদের দোকানের সামনে উপস্থিত হলো তখন সময় দুপুরে সাড়ে বারোটা। মাথার ওপর দীপ্ত সূর্যটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশ গুমোট। দোকানে লোকসমাগম খুব একটা নেই বললেই চলে। মজিদ আমন্ত্রিত অতিথিকে দেখামাত্র তেলতেলে হাসি দিয়ে দোকান থেকে বেরোল। দুঃখিত গলায় বলল,
-‘ দোকানে আইতে না করছি বইলা কষ্ট পাইয়েন না ভাইজান। আপনারে সব খুইলা কমু। আহেন এহন। গরীবের ঘরে চারডা ডালভাত খায়া যান।
আবিদ অনুচ্চ হাসল। মজা করে বলল,
– দেখিয়েন, শুধু ডালভাত হলেই খাব। অন্যকিছু হলে প্রোগ্রাম ক্যানসেল।
মজিদ মুখের ভেতর কী বলল ঠিক বোঝা গেল না। এরপর চাঁদিফাটা রোদে কুঞ্চিত কপালে দোকানের ভেতর দৃকপাত করে কর্মরত ছেলেকে বলল,
– এই, আমি গ্যালাম। খাইয়া আসি। খবরদার কাউরে বাকী দিবি না।
ছেলেটা মাথা নাড়ল। মজিদ সামনে দুইপা এগিয়ে রসপূর্ণ মুখে বলল,
– আহো ভাইজান।
আবিদ হাসিমুখে ডানহাত বাড়িয়ে সামনে আগানোর ইঙ্গিত দিল। মজিদের পথ মাড়াতে মাড়াতে তার মনটা ভাবুক হয়ে ওঠল। বাস্তবিক ডালভাত খাওয়াতে পারে এমন লোকজন বাদে বৈভবশালী কোনো ব্যক্তির নিমন্ত্রণ সে চোখবুঁজে না করে দিতো। অতিরঞ্জন তার পছন্দ নয় কোনোকালেই। সমাজের সহজসরল মানুষগুলোই তার ভালোবাসার মূলকেন্দ্র। কিছু নিম্নবিত্তরা পেটের দায়ে খারাপ কাজে লিপ্ত হয় তা ঠিক। কিন্তু যারা সৎপথে চলে তারা কখনো হিংসুটে হয় না, অন্যের সম্পদে লোলুপ দৃষ্টি রাখে না, তারা বুকভরা ভালোবাসা দিতে জানে। জগন্মণ্ডলের প্রত্যেকটি প্রাণী-পক্ষী ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসা কে না পেতে চায়? ভালোবাসা কখনো চিৎকার করে বলে না যে আমায় তোমরা নাও,ভালোবাসা কুড়িয়ে সম্ভোগ করার মতো বস্তু৷ জৈষ্ঠ্যমাসের আমপাকা ভোরে যেভাবে আম্রকাননতলে পাকা আম বিছিয়ে থাকে তেমনি ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকে সর্বত্র। কুড়িয়ে নেওয়ার কষ্টটা করতে হয় শুধু।
প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর ওরা এসে থামল মজিদের বাড়ির উঠোনে। মজিদ অলক্ষ্যে হাঁকল,
– কৈ রে জব্বারের মা। মেহমান তো লইয়া আইছি। তাড়াতাড়ি আয়। পিঁড়ি দে। শরবত দে।
হেঁশেলঘর থেকে একজন অবগুণ্ঠিত মহিলা এসে সালাম দিল আবিদকে৷ আবিদ লজ্জায় কোণঠাসা হয়ে পড়ল।

চলবে…
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share