#বোরখাওয়ালী
পর্বঃ ৪
লেখাঃ Mst Liza
.
লঞ্চ-ঘাট পার হয়ে আমরা গিয়ে বাসে উঠলাম।এর মাধ্যে আমাদের মাঝে আর তেমন কোনও কথা হয় নি।বাস চলতে শুরু করেছে…আর আমরা দুজনেই পাশাপাশি নীরবে বসে আছি।এমন সময় জানালার দমকা বাতাস এসে আমার চুলগুলো হালকা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে।খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এক প্রশান্তির আভাস ফিরে পেয়েছি।চোখদুটো বন্ধ করে ডুব দিলাম সেই অতীতের ১৫ বছর আগে..
তখন আমি ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়ি।বাবা প্রবাসী ছিল তাই আমি আর মা তখন মামার বাড়িতেই থাকতাম।বড়দের খুব সম্মাণ করতাম।আমি যখন যা আবদার করতাম মামা সব আবদার পূরণ করে দিত।মামার একটি পুচকি মেয়ে ছিল নাম আরি।সবার খুব আদরের।শুধু আদরের বললেই ভুল হবে যা পটু না!!একবার কথা বলা শুরু করলে আর থামার নাম নেই।ওইটুকু ছোট্ট একটি মেয়ে তার কথা শুনলে যে কোনও বড়, বুড়ো মানুষও টাসকি খেয়ে যাবে।সে একবার ঈদের সময়কার কথা খুব রমরমাট আয়োজন চলছিলো চারিদিকে।সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠেই আমাকে ডাকা শুরু করে দিয়েছে।বলছে এই আবির ওঠো! ওঠো না! তুমি না বলেছিলে আজ আমায় মেলায় নিয়ে যাবে?
আমি ওকে বুঝালাম দেখো আরি এতো সকালে মেলার কোনও দোকানপাট খুলে নি।সবাই আগে ঈদের নামাজ পরবে, সেমাই খাবে, সেলামি দেবে। তাই দোকান খুলবে। তুমি আমাকে এখন ঘুমাতে দাও।
-নাহ না তুমি আমাকে ঢপ দিচ্ছ।এক্ষুণি আমাকে নিয়ে যাবে তোমার স্কুল মাঠটিতে।আমি এখনই যাব, গিয়ে দেখবো, তাই তোমার কথা বিশ্বাস করবো মেলা হচ্ছে কিনা!! কাল সারারাত ঘুমিইনি আমি মেলায় গিয়ে নাগরদোলা চরবো বলে।আর তুমি বলছ এখন যাবে না তাই না?
-আহহ আমি যাব না কখন বললাম আমি তো বলেছি পরে যাব।আর মেলাতে নাগরদোলা আসবে তোমায় কে বলেছে?
-আমি যানি মেলায় নাগরদোলা থাকে।আগে একবার নাগরদোলা এসেছিল তো। তখন তো আমি ছোট ছিলাম।তাই বাবাই উঠতে দেই নি।বলেছিল পরে যাবো এখন পরে যাব না তুমি আছো তো।তোমার সাথে উঠে চুপচাপ তোমার হাতটি ধরে বসে থাকব।একবার আকাশে উড়বো আবার আকাশ থেকে ঘুরে এসে মাটিতে নামবো কি মজাটাই না হবে বল? চল চল!! আমি তো ওর কথা শুনে হাত, পা ছুটিয়ে হাসা শুরু করেছি।আর ঘুমিয়ে কি হবে।এই পুচকি আমায় ঘুমাতে দিল তো।তার থেকে বরং গিয়ে দেখিয়ে আনি।
গিয়ে দেখি মাঠ খালি।সবে কয়েকটি দোকান বসেছে কসমেটিকস্ এর সেইগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা আছে।আসে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।-দেখেছো সব দোকান বন্ধ।এখন বাড়ি চল।তখন মুখ কালো করে বাড়ি চলে আসলো।আমার খুব খারাপ লাগছিল ওর অমন চেহারাটা দেখে।
জানুয়ারি তে আরি কে স্কুলে ভর্তি করা হলো।রোজ একসাথে স্কুলে যেতাম।একদিন স্কুলের সামনে একটি লোক ভ্যানে করে আঁখ নিয়ে বসেছিল।ওর যখন ছুটি হয় তখন আমার টিফিন।সেদিন ক্লাসে কারও পড়া হয় নি।আমাদের সবাইকে স্যার কান ধরে বেঞ্চের উপর দাড়ঁ করিয়ে রেখেছে।টিফিনের ঘন্টা বেজে উঠার পরও স্যার ক্লাস থেকে যায় নি।হঠাৎ ক্লাস রুমের দরজার সামনে এসে
-এই আবির তোমরা সবাই ওই রকম কান ধরে দারিয়ে আছো কেন? এটা আবার কেমন পিটি করছো তোমরা সবাই?
-একি আরি দেখছো না স্যার ক্লাসে আছে।এখন এখান থেকে যাও।
-যাব তার আগে আমাকে ৫টা টাকা ধার দাও তো।আমি আঁখ খাবো। বাড়িতে গিয়ে বাবাই কে বলে তোমার টাকাটা আমি দিয়ে দেব।
সবাই হাসছে ওর কথা শুনে।স্যারও কিছু বলে নি পুচকি মেয়ে বলে কথা।আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে স্যার ওকে দিয়ে দিলে ও দৌড়ে চলে গেল।এরকম আরও অনেক স্মৃতি আছে যেগুলো মন থেকে মুছে যাবার নয়।জীবনে যেমন আনন্দের সময় আসে তেমন কস্টের সময়ও আসে।হঠাৎ একদিন মামার ট্রাক এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়।তার কিছুদিন পর আমার বাবা দেশে ফিরে আসে।আমাকে আর মাকে নিয়ে খুলনায় এসে বিজনেস শুরু করে।আমরা পরে ওদের খোঁজ নিয়েছিলাম কিন্তু পাই নি।আরি আর মামি তখন মামার বাড়িতে ছিল না।শুনেছিলাম মামা সব সম্পত্তি মামির নামে অনেক আগেই লিখে দিয়েছিল।আর মামি সম্পত্তি বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে কোথায় গিয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না।মামা আর মামির বিয়েটা পালিয়ে হয়েছিল।মামির বাবার বাড়ির কোনও ঠিকানা না পাওয়ায় আমাদের আর তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা হয় নি।তবে আমরা অনেক খুঁজেছি।যারা মামির কাছ থেকে সম্পত্তি কিনেছিল তাদেরকে অনেক অনুরোধ করে আমাদের খুলনার বাড়ির ঠিকানাটা বাবা-মা দিয়ে এসেছিল।বলেছিল যদি কখনও ওরা খোঁজ করে তাহলে যেন আমাদের ঠিকানা টা দিয়ে দেই।
কিন্তু এতো বছর পর আরি এইভাবে আমার সামনে এসে দাড়াবে তা আমি ভাবতে পারি নি।সত্যি বলতে সেই ছোটবেলা থেকেই আমার মন শুধু ওকেই ভালোবেসেছে।অনেক অপেক্ষা করেছি ওর জন্য।কিন্তু এখন ও কাছে থাকতেও আমি কিছু বলতে পারছি না।এ যেন সম্পূর্ণ আলাদা একটি মেয়ে।কেউ এতোটা বদলে যাই কিভাবে? আচ্ছা ওকি আমাকে চিনবে? সেই আগের মতোন নাম ধরে ডেকে দুষ্টু-মিস্টি কথাগুলো বলবে? না ওতো এখন বোরখাওয়ালী।বদলে গেছেও।এখন এই বোরখাওয়ালীর মাথায় ভালোবাসার মানে ঢুকবে না।
বর্তমান,,,,,,
-এই যে শুনুন
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমাকে বোরখাওয়ালী ডাকছে।
-আমরা কি চলে এসেছি?
তাকিয়ে দেখি বাসের সব যাত্রী নেমে যাচ্ছে।বাসের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি বাস নতুন রাস্তায় এসে দাড়িঁয়েছে।এখান থেকে বাস আর যাবে না।
-হ্যাঁ, আমরা এসে গেছি নামুন।
-আপনি সরলে তো নামবো
-ওহহ হ্যাঁ, সরি!
আমি সিট থেকে উঠে উপর থেকে ব্যাগগুলো নামালাম।
তারপর বাস থেকে নেমে একটি রিক্সা ডাকলাম।
যদিও রিক্সাতে বোরখাওয়ালী উঠতে চাই নি।বলেছিল ইজি বাইকে যাবে।কিন্তু আমি বোঝালাম এতোগুলো ব্যাগ নিয়ে ইজি বাইকে গেলে মেইন রোডে গিয়ে নামিয়ে দেবে তারথেকে বরং রিক্সাতে করে যাই বাড়ির সামনে নামালে ব্যাগগুলো বইয়ে নেওয়ার ধকল থাকবে না।
-পুরুষ মানুষের এত্তগুলো ব্যাগ লাগে?
-আরে এতে কি শুধু আমার কাপড় নাকি? বাড়ির সকলের জন্য ঈদের কাপড়ও আছে।
দুজনে একটা দোতলা বিল্ডিং এর সামনে এসে রিক্সা থেকে নামলাম।
-নিন এসে গেছি আপনার ফুপ্পির বাড়িতে!
-আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব? যানি না আর কোনও দিন দেখা হবে কিনা!! তবে আল্লাহর যেন আপনার ভালো করে। ভালো থাকবেন। আসি।আল্লাহ হাফেজ।
পেঁছনের দিকে আর ঘুরে তাকালো না।সোজা হেটে গেটের কাছে গিয়ে কলিংবেল বাজাল।
চলবে…. ইনশাআল্লাহ..