#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৪
‘তুই বড়ো হয়ে গেছিস ফুল।’
‘কেন বলছো আপা?’
‘আজকে আর মাছের মাথার জন্য কান্না করলি না যে! মা থাকাকালীন আমার ভাগটা একটু বড়ো হলেই তুই যে কান্না করতি! আর আজ…!’
‘বাদ দেও আপা। ওও তো আমাদের ছোট ভাই। চলো খাবে।’
‘ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছিলি। এতো তাড়াতাড়ি বুঝদার হয়ে গেল আমার বোনটি?’বলতে বলতে আপা এগিয়ে আসলো।
আমি চুপ হয়ে রইলাম। আপা হেসে আমার গালে হাত রেখে বলে উঠল,
‘যা, দুইজন একসাথে খাবো। আর আলাদা করে তোর প্লেটে দুই পিস মাছ নিস্।’
‘আপা, আমি মাছ খাই না যে তুমি জানো না?’
‘জানি, মা বেছে দিলে ঠিকই খেতি। যা নিয়ে আয়, আমি বেছে দিবো নে।’
আমি আমাদের প্লেটগুলো আনতে হাসি হাসি মুখে দৌড়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম কিন্তু গিয়ে দেখি আমাদের প্লেট নাই । বাবারা খেয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। সম্পূর্ণ রান্নাঘর খুঁজেও কোনো ভাত পেলাম না। আর আমার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা সেই প্লেট দুইটাও পেলাম না।
মনে মনে ভাবলাম,হয়ত মা কোথাও তুলে রেখেছে। ঘরে যেকোনো সময় বিড়াল ঢুকে পরে সেজন্য হয়ত মা কোথাও রেখেছে।
আমি মা-বাবার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।
রুমে দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখি মা টিভি দেখছে আর বাবা খাটে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
এই টিভিটা আগে আমার মা থাকাকালীন সামনের রুমে ছিল যাতে সবাই একসাথে দেখতে পারি কিন্তু এই মা আসার পর বাবাকে বলিয়ে টিভিটা নিজের রুমে এনে ফেলেছে। যার ফলে টিভি দেখার ইচ্ছে থাকলেও দেখতে পারি না। বাবা অবশ্য আপত্তি জানিয়েছিল যে টিভি রুমে এনে ফেললে বাচ্চারা কী দেখবে! মা উত্তরে বলেছিল,’ওরা তো সবসময় বাইরে বাইরে থাকে, আমিই তো বাড়িতে থাকি। ওদের টিভির প্রয়োজন পড়বে না। টিভি চোখের সামনে থাকলে ওদের পড়া হবে না।’
জবাবে বাবা কিছু বলেনি, বাবা ভেবেছিল মা হয়ত আমাদের কথা চিন্তা করে কিন্তু আসলেই কী তা…! টিভির দিকে তাকিয়ে একটা মলিন শ্বাস বেরিয়ে এলো।
আমি ভীতু চেহারায় এগিয়ে গেলাম মায়ের সামনে। মা সিরিয়াল দেখছে। বুঝাই যাচ্ছে, সব মনোযোগ টিভির মধ্যেই। অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও মা যখন কিছু জিজ্ঞেস করলো না তখন আমি নিজেই ডাক দিলাম।
মা বোধহয় আমার ডাকে বিরক্ত হলো। তিনি ঘাড় ফিরে কপাল কুঁচকে বলে উঠল,’কিছু বলবে?’
‘মা, আমাদের ভাতের প্লেটগুলো কই?’
‘কই আবার! তোমরা না খেয়ে চলে গিয়েছিলে আমি ভেবেছিলাম আর খাবে না তাই বাড়ির পেছনে ক্ষুদার্ত বিড়াল-কু’কু’র ছিল ওদের খাইয়ে ফেলেছি। ভেবেছি, ফেলে দেওয়ার চেয়ে ওরা খাওয়া ভালো।’
আমি ছোট করে ‘ওহ’ বলে চলে আসতে নিলে মা আবারও বলে উঠল,
‘রান্নাঘরে আর ভাত আছে কিনা দেখো! মনে হয় কিছু অবশিষ্ট আছে। সেগুলো খেয়ে পাতিলটা ধুয়ে রেখো।’
আমি ভেবেছিলাম ভাত হয়ত আছে তাই খুশি মনে রান্নাঘরে আসলাম কিন্তু কোনো পাতিলে ভাত পেলাম না। ভাতের পাতিলে কিছু পোড়া ভাত অবশিষ্ট আছে কিন্তু সেগুলোতে পানি দেওয়া। বুঝতে বাকি রইল না যে মা হয়ত ইচ্ছে করেই এমন করেছে।
আমি আমাদের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম, আপা এসব জানলে আরও বড়ো সরো কান্ড ঘটে যাবে তখন হয়ত বাবা আপাকে আরও কষ্ট দিবে। তাই হাসিমুখে আপার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘আপা, চলো। আজ আমরা ভাত খাবো না। আমরা ঝালমুড়ি বানিয়ে খাবো।’
আপা ফোনে কারো সাথে বোধহয় কথা বলছিলো। আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। আপার দিকে তাকালে আপা কিছু একটা হয়েছে সেটা বুঝে ফেলবে। আমি চাই না, বাড়িতে আর কোনো কিছু হোক।
আপা কিছু না বলে ফোনটা কান থেকে খাটে রেখে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি খাটে তাকাতেই দেখলাম কেউ একজন লাইনে আছে, আপা বোধহয় রাগের মাথায় কল কাটতে ভুলে গিয়েছে। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে কাটতে নিতেই ওইপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠল,’ফুল,আমি রাসেল। ফোন কেটো না। তোমার হাতে রাখো।’ কণ্ঠস্বর আর নাম দেখে বুঝে নিয়েছি এটা ওই এলাকার রাসেল ভাই। এলাকায় উনার বেশ নাম-ডাক আছে কিন্তু ভাইয়ের সাথে আপার কীসের কথা…! ভাবতে গিয়েও ভাবলাম না কারণ এখন এসব ভাবলে চলবে না। ভাইয়ের কথা অনুযায়ী ফোন হাতে রেখেই আপাকে ডাকতে ডাকতে পেছন পেছন দৌড়ে গেলাম।
রান্নাঘরে যেতেই দেখি আপা পানি দেওয়া সেই পাতিলটা নিয়ে রক্তচক্ষু করে দাঁড়িয়ে আছে। আপা পাতিল হাতে নিয়ে হনহন পায়ে সোজা মা-বাবার রুমে চলে গেল।
মায়ের কাছে গিয়েই কড়া গলায় চিৎকার করে বলে উঠল,’এই বাড়িতে আমরা এতো বোঝা হয়ে গিয়েছি সেটা আপনি আগে বলে দিলেই হতো। আমরা আলাদা হয়ে যেতাম।’
আপার চড়াগলা শুনে বাবা চোখ খুলে উঠে বসে বিরক্তিসহিত কণ্ঠে বলে উঠল,’কী হয়েছে! এতো চেঁচামেচি কীসের!’
‘সেটা আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীকেই জিজ্ঞেস করুন।’ বলতে না বলতেই আপার গালে সপাটে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল বাবা।
এতে নতুন মা এগিয়ে এসে আপাকে আগলে ধরার ভাণ করতে নিলে আপা হাত দিয়ে রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে ওখানেই থামিয়ে দিল নতুন মাকে।
বাবা আবারো নতুন মায়ের কাছ থেকে সব জিজ্ঞেস করলে নতুন মা কিছু কথা রসিয়ে রসিয়ে বাড়িয়ে বলতেই বাবা বলে উঠল,
‘ক্ষুদার্ত কু’কু’রকে ভাত দিয়েছে সে, এতে দোষের তো কিছু করেনি। তোরা ভাত রান্না করে খেতে জানিস না! সামান্য একটা জিনিস নিয়ে এতো চেঁচামেচি ক্যান করছিস?’
আপা রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে পাতিলটা দরজার বাইরে ছুঁড়ে মারতেই বাবা আবারও আপাকে তৃতীয়বারের মতো থাপ্পড় মেরে দিল।
আপা দুই গালে হাত রেখে কিছুক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ওর গাল বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। আপার কান্না দেখে আমারও চোখ বেয়ে কান্না এসে গেল।
‘তুমি বদলে গেছো বাবা।’ আপা ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেই আমার হাত ধরে রুমের বাইরে নিয়ে আসলো।
রুমে এসেই আপা খাটে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। আমি পাশে গিয়ে আপার ঘাড়ে হাত রাখতেই আপা হুড়মুড়িয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আপার এমনভাবে কান্না দেখে মায়ের কথা মনে পরে গেল। মা থাকাকালীন আমাদের দুইবোনের কোনোদিন চোখের পানি পড়েনি। মা আমাদের দুইজনকে অনেক যত্ন করে আগলে রাখতো আর সেই মা যাওয়ার আজ দুইসপ্তাহও না পেরোতেই সামান্য খাবার নিয়েও আমাদের কত বেগ পোহাতে হচ্ছে!
আচ্ছা, বাবা তো আগে এমন ছিল না! মাত্র কয়েকদিনের ব্যাবধানে মনে হচ্ছে ইনি আমার বাবা নই, ইনি ভিন্ন একটা মানুষ। অথচ মা থাকাকালীনও কত্ত ভালোবাসা ছিল আমাদের। হুট্ করে সব যেন বিলীন হয়ে গেল। ভেবেছিলাম, মা নাই তো কী হয়েছে! আমাদের প্রানপ্রিয় বাবা আছে। তিনি ঠিকই আমাদের আগলে রাখবেন কিন্তু আসলেই কী তা!কেন এমন হয়ে গেল! হুট্ করে সেদিন রাতের মায়ের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মা মারা যাওয়ার রাতে বাবার কথা বলতে গিয়ে মা একটা কথা বলেছিল যে পরেরদিন বাবাকে ফিরতেই হবে। তার মানে মা কী সেদিনই পরিকল্পনা করে রেখেছিল যে তিনি এই দুনিয়ায় আর থাকবেন না! কেন এমন করলো আমার মা! মা মারা যাওয়ার রাতে টেবিল ল্যাম্পের আবছা আলোতে মায়ের সিক্ত চেহারাটা দেখেছিলাম আমি, যেই চেহারাতে অনেক দুঃখ লুকিয়ে ছিল। মায়ের অশ্রুমাখা চোখ। বারেবারে মায়ের সেই অশ্রুমাখা চেহারাটা ভেসে উঠছে। এসব ভাবতেই দপ করে মাথায় আসলো, মায়ের সেদিনের লেখা ডায়রিটা। মা কী এমন লিখেছিল কান্নামাখা চোখে, কেনই বা মা আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছিল! এর আগে বাবাই বা পাঁচদিন নিখোঁজ ছিল কেন! অথচ পাড়া প্রতিবেশিদের মা বলেছিল বাবা কাজে বাইরে গিয়েছে অথচ যেখানে মা নিজেই বাবার খবর জানতো না!
সবকিছু বের করতে হবে আমার।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(