#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
আস্তে আস্তে আমাদের বাড়ি আবারও মানুষে মানুষে ভরে উঠলো। কিন্তু এইবার আগেরবারের মতো নয়। এইবার সবাই নতুন বউ দেখতে এসেছে। সবাই বললো, উনি না-কি আমার দ্বিতীয় মা!
আমি দূরেই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। কেন জানি উনার সামনে যেতে ভয় লাগছিল। আড়াল থেকেই চেয়ে রইলাম। সবাই উনার সাথে হাসাহাসি করছে, আড্ডা দিচ্ছে। কিছুসময় পর বাবার চোখ আমার উপর পড়তেই আমাই এসে নতুন মায়ের কাছে আমাকে নিয়ে গেল। বাবা এই প্রথম বাইরে থেকে এসে আগে আমাকে ডাকেনি। অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পর আমার কাছে এসেছে। অভিমানে চোখ ভরে উঠছিলো কিন্তু বাবার সেইদিকে খেয়াল নেই। নতুন মা ওই ছেলেটাকে পাশেই বসিয়ে রেখেছে। বাবা বড়ো আপাকেও ডাক দিল কিন্তু বড়ো আপা ছিল না।
বাবা আমাকে নতুন মায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে বলে উঠল,
‘রহিমা, এটা আমার ছোট মেয়ে। আজ থেকে তোমারও মেয়ে। এখন থেকে তোমার দুইটা মেয়ে একটা ছেলে। আমার মেয়েগুলোকে কোনোদিন অবহেলার চোখে দেখবে না। মায়ের মতোই ভালোবাসবে।’
আমি উনার দিকে তাকালাম। বাবা আমাকে ইশারা দিয়ে উনার পাশে যেতে বললো। উনি আমাকে প্রথমে কাছে টেনে নিল না, পরে বাবার আমার প্রতি করা ইশারা দেখে মুখে হাসির রেখা টেনে আমাকে কাছে টেনে নিল। উনার এমনভাবে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরা দেখে পাড়ার চাচি-দাদীরাও খুশি হলো কিন্তু আমি উনার ছোঁয়াতে মায়ের মতো অনুভূতিটা পেলাম না।
বাবা আমাকে ইশারা করে বলল,’আজ থেকে এটা তোমাদের মা। মাকে কোনোদিন কষ্ট দিবা না।’
আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম। বাবা আমাকে নতুন মায়ের আরেকপাশে বসিয়ে দিল আর আমার হাত উনার মুঠোতে দিল। আমিও চুপচাপ উনার পাশে বসে রইলাম। পাড়ার চাচি-দাদীরা গল্পঃ করতে করতে হেসে উঠছে কিন্তু আমার মনে হাসি নেই কেন জানি। মনে হচ্ছে আমার বাবার ভাগ নিয়ে নিবে কেউ।
উনি সবকিছুর মাঝে ওই পাশে ওই ছেলেটার হাত ছাড়েনি কিন্তু কিছুসময় পর ঠিকই আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে।
আমার সবকিছু ভালো লাগলেও কেন জানি ওই ছেলেটাকে দেখে ভালো লাগলো না। মনে মনে ধারণা জন্মে যাচ্ছিলো ছেলেটা যদি আমার আদরের ভাগ্ নিয়ে নেয়।
বড়ো আপা নতুন মাকে দেখে সেই সন্ধ্যা থেকে রুমের দরজা আটকে দিয়েছিলো এরপর আর বের হয়নি। পাড়ার কয়েকজন চাচি দরজা ধাক্কা দিয়ে আপাকে ডেকেছিল কিন্তু আপা দরজা খুলেনি।
আমার ছোট্ট মনে আপার জন্য ভীষণ হাহাকার করে উঠল। আপা বাবার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিল। বারেবারে শুধু আপার বলা বিকালের কথাগুলো মনে পড়ছে। আমার আপা কতই না কষ্ট পাচ্ছে!
এরইমধ্যে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। বড়ো আপা এখনো স্বাভাবিক হয়নি দ্বিতীয় মায়ের সাথে। আপা ‘মা’ ডাকে না। আপা দ্বিতীয় মায়ের সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। আপা নিজের মতো করে থাকে। সবসময় উনাকে এড়িয়ে চলে। আগে বাবা খেতে বসলে আমাদের দুইবোনকে দুইপাশে বসিয়ে খেতে বসতো কিন্তু এখন বাবা আরেকপাশে বসে ওই ছেলেটাকে নিয়ে।
আগে বাবা বড়ো মাছ আনলে উঠোনে আসতেই আমার আর আপার নাম ধরে ডাক দিয়ে উঠতো কারণ আমরা দুইবোন মাছের মাথা পছন্দ করতাম। আর বাবাও খেতে বসলে সবার আগে মাছের মাথাটা দুই ভাগ্ করে আমাদের দুইবোনের প্লেটে তুলে দিতো কিন্তু এইবার আর এমন করেনি। এইবার ওই ছেলেটারই প্লেটে মাছের মাথা তুলে দিয়েছে। বাবা যখন আমাদের দুইবোনকে মাথাটা ভাগ করে দিচ্ছিলো তখন নতুন মা বলে উঠল,
‘বলছি কী,,, সাকিবও মাছের মাথা খায়।’
বাবা এটা শুনে আমার প্লেট থেকে মাথাটা নিয়ে ওই ছেলেটার প্লেটে দিয়ে দিল। বাবা চাইলে তিনভাগ করে দিতে পারতো কিন্তু বাবা তা করেনি।
আমি কাটার ভয়ে একা মাছ খেতে পারি না, এজন্য সবসময় মাছ আনলে মাথার উপরের অংশটা মা দিতো, আমি সেটার ম’গ’জ খেতাম। বাকি ভাতটুকু খাওয়ার সময় মা নিজেই পাশে বসে মাছের কাঁটা বেছে বেছে দিতো । এইবার আর মাছ নিলাম না, মা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম বাবা মাছ এনেছে। প্রথমবারই মাকে মনে পরে গেল।
আমি ছেলেটার প্লেটের দিকে আরেকবার তাকালাম। মাছের মাথা আমার ভীষণ পছন্দের তাই খারাপ লাগছে। ছেলেটার খাওয়া দেখে বুঝেছি ছেলেটা মাছের মাথা খেতে পারে না কিন্তু নতুন মা ইচ্ছে করে হয়ত বলেছে। ছেলেটা প্লেটে এমনি নড়াচড়া করে মাথাটা নস্ট করে ফেলেছিলো। বাবা বোধহয় আমার বারবার তাকানো আর আমার মনমরা ভাবটা খেয়াল করেছে। সেজন্য ছেলেটাকে বলে উঠল,
‘তোমার ফুল আপাকে একটু দেও।’
ছেলেটা বাবার কথা শুনে ‘না’-বোধক মাথা নেড়ে প্লেট নিয়ে দূরে সরে গেল। সেটা দেখে নতুন মা বলে উঠল,
‘খাক না, ছোট মানুষ নস্ট হয়ত একটু করছে।’ সেটা বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ফুল, তুমি মাছের পিস নিয়ে খাও। সাকিব মাথা পছন্দ করে তো।’ বলেই জোর করে হাসলো।
বাবা আর জবাবে কিছু না বলে খাওয়াতে মনোযোগ দিল। বাবা জানতো যে আমি মাছের কাটার ভয়ে মাছ খাই না তবুও বাবা কিছু বললো না। খাওয়ার আগে এসব দেখে আমারও ভীষণ কান্না পেল, আমার বাবা আমাকেও এখন আর ভাত খাইয়ে দেয় না।
আপা বোধহয় খেয়াল করেছে যে আমি শুধু ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছি। তাই আপা এগিয়ে গিয়ে মাছ নিতে গেলেই বাবা বলে উঠল,
‘তুই না-কি রহিমাকে মা ডাকিস না!’
বিনিময়ে আপা বলে উঠল,’আমার সময় দরকার।’
বাবা হুট্ করে রেগে গিয়ে বলে উঠল,’এতোদিনেও তোর সময় হয়নি?’
‘আমার মায়ের জায়গা আমি অন্য কাউকে হুট্ করে দিয়ে দিবো না।’ আপার বলতে দেরি কিন্তু বাবার তাড়িয়ে এসে মারতে দেরি হলো না।
আপা গালে হাত দিয়ে বাবার দিকে এক নজর তাকিয়ে উঠে চলে গেল। আপার আর মাছও নেওয়া হলো না, খাওয়াও হলো না।
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বাবা আপাকে মেরেছে। আমার বাবা কোনোদিন আমাদের দুইবোনের গায়ে হাত তুলেনি, উল্টো মা যদি বকা দিতো তবে বাবা আমাদের আগলে নিতো কিন্তু সেই বাবা আজ আমার আপাকে মেরেছে। তাও বা এত্তো ছোট কারণে! আমার বাবার প্রতি ভালোবাসা থেকে একটু একটু করে উঠে যাচ্ছে। আপা এতো বিশ্বাস করতো বাবাকে সেই বাবা আপার সব বিশ্বাস ভেঙে ফেলতে লাগল। শুধু তাই নয় আপা না খেয়ে যখন রুমে চলে যাচ্ছিলো তখন বাবা একবারও আপাকে আটকালো না। বাবা তার ছেলেকে খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। এমনিও বাবা আগের মতো আর আমাদের ওভাবে কাছে টেনে নেয় না।
আমারও আর খেতে ইচ্ছে করলো না। তাই আপার প্লেট আর আমার প্লেট দুইটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে আপার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে গেলে বাবা শুধু বললো,
‘তুই কই যাচ্ছিস।’
আমি ‘আপার কাছে’ উত্তর দিতেই বাবা আর কিছু বললো না। বাবার সেই বলার মধ্যে আমি আগের মতো কোনো ভালোবাসা পায়নি।
আমি আপার কাছে যেতেই আপা চোখ মুছে ফেলল।
‘আপা খাবে চলো।’
আপা আমার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘তুই খেয়ে নেয়। আমার না ভালো লাগছে না।’
‘আপা, খাবারের সাথে রাগ করে না এতে আল্লাহ অখুশি হয়। এটা মা বলতো।’
আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে বলে উঠল,
‘ফুল, আমার বাবা তো এমন ছিল না! আমাকে আমাকে আজ মেরেছে বাবা।’ বলতে বলতে আপার হিচকি উঠে গেল। আপা কান্না দেখায় না, বেশি কষ্ট পেলে সহ্য করতে না পেরে আমার সামনে কাঁদে। আপার কান্না দেখে আমারও কান্না এসে গেল।
এরমধ্যে বাবা একটিবারও আমাদের খেতে ডাকলো না। আমার বাবার প্রতি এতটুকু বিশ্বাস ছিল যে বাবা হয়ত রাগের মাথায় মেরেছে, পরে রাগ কমলে আমাদের দুইবোনকে একসাথে খাইয়ে দিবে কিন্তু না। বাবা একটিবারও আমাদের ডাকলো না। এতে ভেতরে ভেতরে আরও বেশি কষ্ট পেলাম। কান্না গুলো যেন দলা ফাঁকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।)