#বেলা শেষে আলো
০৪
#ইসরাত_জাহান_এশা
—- মা,,, তোমার মুখে কি কোনো কথা বাঁধে না?
—কথা বাঁধবে কেনো? দোষের কি বলছি? অভাবের সংসার। নিজেরাই খেতে হিমশিম খাই আবার একটা পেট কিভাবে চালাবো? তার চেয়ে বরং তুই তোর বাচ্চা নষ্ট করে ফেল তারপর ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে আয়।
তনিমা আর কোনো উত্তর দেয় না।চোখের পানি মুছতে মুছতে রুমে গিয়ে শুয়ে কাঁদতে থাকে। তনিমার আসার কথা শুনে তনিমার ছোট বোন তিশা বিকালে আসে তনিমাকে দেখতে৷
তিশা— কিরে আপা কেমন আছিস?
— এইতো আছি। তোর কি খবর?
— আমি আছি ভালোই। কিন্তু শুনলাম তোর কপাল নাকি আবার পুড়ছে? তোর নাকি ঘরে সতীন আছে?
— তুই কি আমাকে দেখতে এসেছিস নাকি আমাকে কাটা গায়ে নুনেরছিটে দিতে?
— নুনের ছিটে কোথায়? জানার জন্য বললাম আর কি। তা তোর সতীনের সাথে তোর মিলে? ঝগড়া করে না? কিভাবে খাবি একসাথে থাকা তো সম্ভব না৷ শোন বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার আগে তুই ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে আয়।
— তিশা একটু থামবি? কোথায় একটু শান্তনা দিবি তা না করে তুই আমাকে নিয়ে মজা নেস। বারবার ছেড়ে দেওয়া কথা বলো তুই আর মা তোরা কেমন আমি বুঝি না৷ আমি গর্ভবতী তোরা কেউ কি নিবি আমার আর বাচ্চার দায়িত্ব?
— কি বলিস তুই এসব? তুই মা হবি এমন বেকুবের মতো কাজ করছ কেনো।
—আমি কি করছি তোরা এতদিনে কেউ একটা বার খোঁজ নিছো? তুই ফোন দিয়ে একবার জিজ্ঞেস করছ কেমন আছি? কিভাবে আছি তোরা তো চেয়েছিলি ঘার থেকে বোঝা নামাতে তাই বাড়িঘর না দেখে বিয়ে দিছে। আজ সবার মন্দ কথা নিন্দা সব আমি ভোগ করি।
— আসলে আমি আমার সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত।জানিস,,,,
— থাক! তুই তোর শশুর বাড়ির এখন গুনগান আর সুখের কথা বলে আমাকে আর যন্ত্রণা দিস না। মা ষড়যন্ত্র করে আমার সংসার টা নষ্ট করে ফেলেছে। সবুজের তো ভালো একটা চাকরি হয়েছে বিয়ে করেছে আবার। আর এদিকে আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো।হেরে গেলাম আমি জীবনের কাছে। টাকার কাছে মা আমাকে বিক্রি করে দিলো। আর কয়টা দিন অপেক্ষা করলে কি হতো।
— আপা তুই সবুজের ব্যাপারে এতো খবর কই পাইছো।
— সোহানি ফোন দিয়েছিলো ও সব বলেছে আমাকে। তুই নিজের বোন হয়ে তো একদিন খোঁজ নিতে পারেসনি। কিন্তু সোহানি বান্ধবী হয়েও প্রায় প্রায় খোঁজ নিতো।
— ওহহ। তুই এখন কি করবি?
— জানিনা কি করব। তবে এইটুকু জানি বাচ্চা নষ্ট করব না। তারপর আস্তে আস্তে চেষ্টা করব কিছু একটা করার আর এখানেই কিছুদিন থাকব।
রাতে তিশার স্বামী আসে বেড়াতে। তিশা অস্থির হয়ে যায় স্বামীকে কি খাওয়াবে কিভাবে যত্ন আত্মী করবে।তনিমাকে দেখানোর জন্য এমন ভাব শুরু করছে তিশা মনে হয় যেনো তিশার স্বামী মিলন নতুন আসছে নতুন জামাই ভুল ত্রুটি হলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে৷
তনিমা এসব দেখে যেনো বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট অনুভব হয়। ইচ্ছে করছে মন খুলে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে। কিন্তু কোনো উপায় নেই সবটা মুখ বুঁজে সহ্য করে নিতে হবে।
তনিমার কাঁদতে না চাইলেও চোখ যেনে না কেঁদে শান্ত হয়না।
—আপা দেখ মিলন কতো কিছু নিয়ে আসছে। আজকে সবাই ভালো মন্দ খেতে পারবি।
— এসব কি বলছিস তিশা? আমরা কি খারাপ খাই আর তুই মিলন কে নিয়ে এমন ভাব শুরু করছিস মনে হচ্ছে মিলন এ বাড়িতে নতুন আসছে।
— কেনো আপা তোর হিংসা লাগছে?
— বাজে কথা বলিস কেনো আমার হিংসা লাগবে কেনো।
— না লাগতেও তো পারে তোর জামাই তো আসলই না। আবার তোর আগের বর তা তো বলার বাইরে আনবে কি? আরো আমাদের অন্য ধংস করেছে।
— দয়া করে থাম তিশা। আর বলিস না বার বার কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিস না।ছোট বোন কোথায় বড় বোনকে সাহায্য করবি তা না করে বার বার খোঁচা দিতে আসিস। তুই যদি এমন করে বলিস তাহলে বাইরের লোকেরা কি করবে।
তিশা কোনো উত্তর না করেই ভেংচি কেটে চলে গেলো। তনিমা মনে মনে ভাবে নিজের মায়ের পেটের বোন এমনও হয়? মা যেখানে এমন বোন তো তা তো আরো দূর। বাঁচতে হলে নিজেকেই সব সামলাতে হবে।
★
অনেক দিন হয়ে গেলো তনিমা বাড়িতে নেই। রিমা এই কয়দিন খুব শান্ত শিষ্ট ছিলো কোনো ঝামেলা ছিলো না ঘরে। আজকে রাতুলের ফুরফুরা মেজাজ দেখে রিমা সাহস নিয়ে কাছে গিয়ে বলল,,,
— একটা কথা বলার ছিলো।
— হুমম বলো শুনতে পারছি।
— বলছি তুমি আমাকে কেনো পছন্দ করো না? কেনো তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে গেলে?বিয়েটা করাটা কি বেশি প্রয়োজন ছিলো?আমি না হয় খারাপ কিন্তু মেয়েটা কি করেছে? মেয়েটার কথা ভেবেও তো___
— এসব প্রশ্ন করে মুড নষ্ট করতে আসছো এখন আমার?
— না তবে আমি জানতে চাই আমার অন্যায় কি? কেনো তুমি আমাকে পছন্দ করো না?
— দেখ বার বার এক কথা বলে মাথা নষ্ট করিস না।
— ভালোই ভালোই বল্লে তোমার কানে কথা যায় না? কেনো বিয়ে করেছো আবার কি দরকার ছিলো তোমার কিসে অভাব দিয়েছি আমি?
রাতুল রিমার উচ্চ গলায় কথা শুনে মেজাজ আর ঠিক রাখতে পারেনি। বসা থেকে উঠে রিমার চুলের মুঠি ধরে বলে তোকে বিয়ে করেছি এটা তোর কপাল নাহলে তোর মতো কালীকে কে বিয়ে করত? না আছে চেহারা না আছে চেহারার গঠন তারপর সারাদিন মানসিক ভাবে যন্ত্রণা দিতি। শোন আমাকে আর কখনো এই সব প্রশ্ন করবি না। তাহলে তোর খবর আছে। বলেই রাতুল রিমাকে নিচে ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে তখন রিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল____
— আমিও দেখবো এই সংসার কতদিনের হয় কতদিন তোমার এই সুন্দরী বউকে নিজের কাছে রাখতে পারো আমিও দেখব। শেষ পর্যন্ত যদি কেউ তোমার পাশে থাকে তাহলে এই রিমাই থাকবে।
— তোমার কি ঘরে শান্তি ভালো লাগে না বড় বউ? কি দরকার এসব প্রশ্ন করার ছেলে মানুষ রাগ বেশি বোঝোই তো। তোমাকে তো কোনো দিক দিয়ে কম দিচ্ছে না তাহলে এতো জিদ কেনো তোমার? পারনি তো নিজের স্বামী কে আঁচলে বেঁধে রাখতে এখন আসছ বড় বড় কথা বলতে।
— মা থামুন তো! আজ আপনার জন্যই এমন হয়েছে আপনি আপনার ছেলেকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছেন। আমার নামে সব সময় আপনার ছেলের কাছে খারাপ খারাপ কথা বলতেন। আপনার ছেলের মাথাটা আপনি চিবিয়ে খেয়েছেন আপনি তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে সাহায্য করেছেন। নাহলে কখনোই আপনি ঐ মেয়েকে ঘরে তুলতেন না। আদরের একটা ছেলে লাই দিয়ে বাদরের মতো ছেরে দিছেন।
— ছেলে এখন বড় হয়েছে ছেলের সাথে কি পারা যায়৷ তুমি এখন আমার সাথে ঝগড়া না করে ভাবো কিভাবে পথের কাটা সরানো যায়। নিজের সংসার আর স্বামী আঁচলে বাঁধতে শিখো৷
— হুমম সেটাই করব। তার জন্য যতদূর আমার যেতে হয় আমি যাবো৷
★
অনেক দিন হলো তনিমা বাড়িতে নেই রাতুল তনিমা কে ফোন দেয় যেনো রাসেল কে নিয়ে তনিমা চলে আসে।
— না আমি যাবো না।
— যাবো না মানে কি?
— যাবো না মানে যাবো না।
— মানে আরো কয়দিন থাকতে চাও?
— যদি বলি সারাজীবন।
— মাথা গরম করবে না তনিমা কালকের দিন থেকে পরশু দিনই চলে আসবে আর নাহলে___
— নাহলে কি করবেন?
— আমি নিজ গিয়ে টেনে হ্যাচরে নিয়ে আসব আর শোন তোর পেটে আমার সন্তান সুতরাং পাগলামী করিস না তোর বাবা-মা তোকে কখনোই দেখবে না। আমার মেজাজ গরম করিস না তাহলে তুইও আমার খারাপ রূপটা দেখবি।কথাটা মনে থাকে যে রাখছি।
রাতুলে ফোন কেটে দিলে তনিমার মা তনিমা কে জিজ্ঞেস করে।
— কে ফোন দিছে?
— রাতুল।
— কি বলছে কবে নিয়ে যাবে?
—পরশু যেতে বলছে আমিই না করে দিয়েছি। বলেছি যাবো না।
— বললেই হলো যাবি না? বিয়ে হয়েছে তার মানে রাতুল তোর স্বামী। তোর পেটে আবার ওর বাচ্চা তুই এখন এসব পাগলামি রাখ। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে যদি বাচ্চা নষ্ট করো তাহলে আমরা রাখবো না হলে বিদায়।
আর যদি চাও বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখুক তাহলে নিজের সংসার নিজে বুঝে নিতে শেখ। শক্ত করে সংসার আর স্বামীকে ধরে রাখ।
— নিজের সূখের জন্য অন্যের সংসার ভাংব?
— তো কি করবি শুনি?
তনিমা কোনো জাবাব না দিয়ে চুপচাপ রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে। তনিমার বাবা কাজের কারনে ঢাকায় চলে যান। বাড়িতে যে একটু ভালো করে খোঁজ খবর রাখবেন সেই উপায়ও নেই। খুবই সরল আর নরম মনের মানুষ এতো পেচ তার ভিতরে ঢুকে না। আর তনিমার মাও ওর বাবার কথার তেমন গুরুত্ব দেয় না এর জন্য তিনি এইসবের মধ্যে আসেন না।
রাতুলের কথা মতো তনিমা না গেলে রাতুল রাসেলকে ফোন দেয়।
— রাসেল তোমার বোনকে আমি আরো ২দিন আগে আসার কথা বলেছি তুমি এখনো ওকে নিয়ে আসছ না কেনো? এখন আমাকে যেতে বাধ্য করো না।
— তনিমা তো যেতে চাইছে না। আর কিছু দিন__
— আর একদিনও না আজই তুমি ওকে নিয়ে আসবে না হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
রাসেল বাসায় গিয়ে তনিমাকে বলে রেডি হয়ে নে আজই তোকে দিয়ে আসব।
— কোথায়?
— কোথায় আবার? তোর শশুড় বাড়িতে।
— আমি যাবো না। আমি গেলেই বাড়িতে অশান্তি হবে।
— তুই এখানে থাকলে আমাদের অশান্তি হবে। তাই দয়া করে তুই তোর জায়গায় যা।
তনিমা রাসেলের কথা শুনে কান্নায় ভেংগে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত রেডি হয়ে নেয়। রাস্তায় যেতে যেতে তনিমা রাসেল কে জিজ্ঞেস করে__
— ভাই আমি এতোই পর হয়ে গেছি? তোরা জেনেশুনে আমাকে বাঘের গুহায় ছেড়ে আসছিস?
রাসেল কোনো উত্তর দেয় না শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছে। তনিমা রাসেলের থেকে কোনো প্রতি উত্তর না পেয়ে নিজেই চুপ হয়ে যায়।
রাসেল তনিমাকে রেখে আসার সময় বলে।
— ভালো থাকিস বোন।
এবার তনিমা উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলে আর মনে মনে বলছে।
আযাবের মধ্যে রেখে বলে যাচ্ছো শান্তিতে থাকিস।
— কিরে কিছু বলবি না?
— আসতে পারো।
চলবে,,,,,