বেড়াজাল পর্ব-৩৩

0
511

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৩৩

সিনথিয়া বার বার বাথরুম টু রুম আর রুম টু বাথরুম করছে। চন্দ্রা দুবার ওয়ারেস জল দিয়েছে তাও তেমন কাজ হচ্ছে না। চন্দ্রা জানে লিমিটেশন তাই অল্পই দিয়েছে একদম।

চন্দ্রা এদিক ওদিক তাকালো। সিসিটিভি লাগানো আছে রুমের ভিতর না হলেও ডাইনিং বড়োগেট সবজায়গায়। চন্দ্রা ওতো ভাবলোনা ধরা সে এমনিই পড়বে পরে, কিছু না কিছু ভাবে। সিসিটিভি ফুটেজ বন্ধ সে এখন কোনোভাবেই করতে পারবে না। কিন্তু সিয়াম বার বার ঘরের ভিতরের সিসিটিভি থেকে সাবধানে থাকতে বলেছে তাকে।

চন্দ্রা সিনথিয়াকে বললো “আমি দেখছি যদি রুমে কোনো ওষুধ থাকে।” যদিও কথাটা ভিত্তিহীন সে মোটেই এই একদিনে এসে কারোর রুম থেকে ওষুধ খুঁজে পাবে না।
সিনথিয়া কিছু বললো না। কারন সে বলার অবস্থায় নেই পেত চেপে পা মুড়ে সোফায় বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না আজ সকাল অবধিই তো সে ঠিক ছিলো, হটাৎ কি এমন খেলো সে যাতে তার পেট এতো মুচড়াচ্ছে। আজ সব খাবার বাইরে থেকে অর্ডার দেওয়া হবে তাই সে সব সার্ভেন্ট দের ছুটি দিয়েছে। তার সাথে থাকা আয়াকেও আজ বেরেপাকামি করে সে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সিনথিয়া এসব ভাবতে ভাবতেই মাথা সোফার পিছনের দিকে হেলিয়ে দিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ রইলো না সে স্বস্তি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার তাকে বাথরুমের শরণাপন্ন হতে হলো।

সিয়া আগেই জেনে নিয়েছিল সুইটি বেগমের রুম। তাই একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আলমারি খোঁজা শুরু করলো। কোথাও না পেয়ে লকার খোলার কথা ভাবলো। সিয়াম ওকে চাবি ছাড়া লকার খোলার জন্য আরও একটা উপায় বলেছে। চন্দ্রা ব্যাগ থেকে একটা নেইল কাটার বের করলো সেখান থেকে নেইল ফাইলটা খুলে লকার খোলার চেষ্টা করলো। সময় লাগলো তবে খুলে গেলো। চন্দ্রা একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিল। কিন্তু সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না ফাইল তো সে পেলো, কিন্তু সেখানে মোট পাঁচটা মোটা মোটা ফাইল রাখা। চন্দ্রা বুঝবে কীকরে এবার..? পড়ে দেখার মতো তার হাতে সময় নেই।
চন্দ্রা ভেবে না পেয়ে সিয়ামকে কল করলো। দুই বার কল হয়ে কেটে গেল। চন্দ্রা এবার উপায় না পেয়ে চিন্তিত হয়ে ফাইল গুলো দেখতে লাগলো। না প্রচুর পেপার্স, চন্দ্রা এটাই বুঝতে পারছে না এতো দরকারি কাগজ কিসের..?
বাইরে থেকে কারোর আসার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি করে আলমারি টে আবার ফাইল গুলো রেখে দরজা বন্ধ করে দিলো চন্দ্রা।
সেইসময় সিনথিয়া ঘরে ঢুকলো। মেয়েটা একেবারে নেতিয়ে গেছে কিছুক্ষনেই। হাঁটতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে। চন্দ্রা সিনথিয়াকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ধরলো। নিজের হয়ে সাফাই দিতে গিয়ে নিজের কথাতেই কথা জড়িয়ে ফেললো ” আমম সিনথিয়া আমি আসলে এখানে ওষুধ মানে ওই আলমারির কাছে ওই দিকে ভাবলাম আমি।” চন্দ্রা কি বলছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সিনথিয়া কি তাকে দেখেছে..?

সিনথিয়া চন্দ্রার হাতের উপর হাত রেখে বললো “রিলাক্স আপু, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখন এই ঘর থেকে চলো মম পছন্দ করেননা ঠিক তার ঘরে কেউ ঢুকুক।”

চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে সিনথিয়া নিয়ে বেরিয়ে ওর রুমে গেলো। সিনথিয়া কে বললো ” ওহহ, দেখেছো আমি আমার ব্যাগ টা আনিনি। দাড়াও ওইটা নিয়ে আসি আর তোমার জন্য এক গ্লাস ওয়ারেসের জলও আনি।”
সিনথিয়া মাথা নাড়ালো। চন্দ্রা রুমের বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখে আবার সুইটি বেগমের রুমে ঢুকলো। তাড়াতাড়ি করে আবার আলমারি খুলে ফাইল দেখতে লাগলো। শেষে একটা নীল রঙের ফাইল পেলো সেটা খুলতেই আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চন্দ্রার সামনে পড়তেই চন্দ্রার চোখ চিকচিক করে উঠলো।

চন্দ্রা তাড়াতাড়ি করে ফাইল থেকে কাগজ গুলো বের করে নিল। কি মনে করে অন্য ফাইল থেকেও কটা কাগজ নিলো যদি কোনো কাজে লেগে থাকে ভবিষ্যতে। ফাইল নইলে সমস্যা হবে এই ভেবে শাড়ির ভাঁজে আসতে করে নিয়ে আঁচল দিয়ে নিজেকে পুরো ঢেকে নিলো। তারপর আসতে আসতে নীচে গিয়ে কাগজ গুলো ব্যাগে ঢোকাবে এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলো, থামাথামির নাম নেই বাজছে তো বাজছেই। চন্দ্রা তাড়াহুড়োতে ব্যাগে না রেখে সোফার সিটের নীচে রেখে দরজা খুলতে গেলো।
.
.
” পিয়াস এই পিয়াস..!” বিরক্তি নিয়ে ডাকতে ডাকতে নিজের অফিসের রেস্ট ঢুকে টাইয়ের নট ঢিলে করে গা এলিয়ে দিল নিজের চেয়ারে। একমাত্র তার এই রুমেই সিসিটিভি নেই। চন্দ্রার জন্য চিন্তা হচ্ছে তার। সকাল থেকে কল দিতে পারেনি মেয়েটাকে, কতদূর কি এগোলো কি হলো সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বিরোধি পক্ষ আগের দিন সকাল থেকেই ঝামেলা শুরু করেছে , কাল পরিবেশ শান্ত থাকলেও আজ সকাল থেকেই চারিদিকে হাজার রকম নিউজ বেরোচ্ছে। প্রেস কনফারেন্স এই সব দিক দেখতে গিয়ে ফোন পর্যন্ত ধরতে পারেনি সে। চন্দ্রা নিজেও সকালে উঠে খবরের কাগজে এইসব নিউজ পড়ে গেছে। সিয়াম তাকে চিন্তা করতে বারণ করেছে আশ্বাস দিয়েছে সে এইদিকটা সে সামলাবে।
.
.
.
পিয়াস হন্তদন্ত হয়ে সিয়ামের রেস্ট রুমে ঢুকেই চিন্তিত মুখ নিয়ে বলে উঠলো ” সর্বনাশ হয়ে গেছে রে সিয়াম..! রাসেল ব্লস্টার্ড টা পিঠে ছুঁড়ি মেরেছে। সুইটি বেগমকে আটকানোর জায়গায় সব বলে দিয়েছে।” বলে চোখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে পিয়াস আবার চোখ তুলে তাকালো সিয়ামের দিকে। সিয়ামকে চোখ বুঝে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে পিয়াস কি প্রতিক্রিয়া করবে বুঝতে পারলো না। নিভে যাওয়া গলায় বললো “। শুনলি সিয়াম..? কিছু তো বল..? রাসেল কি করে এমন করতে পড়লো..? সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছিলাম আমরা ওকে।”

সিয়াম এবার হালকা চোখ খুলে বললো ” উম হুম ! কি জানিস তো পিয়াস আমরা যাকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভাবি দিন শেষে তারাই পিঠে ছুঁড়ি মারে। ওর যে আমার উপর রাগ ছিলো আমি বুঝেছিলাম তবে এতটা করবে বুঝিনি। যাক ছাড় ওসব ও নিজের শাস্তি নিজে পাবে যখন এই কোম্পানি থেকে বেরিয়ে অন্য কোম্পানিতে অ্যাপ্লাই করবে। মিলিয়ে নিস তুই ঠিক এক মাস পরই ও এখানে আমার সামনে থাকবে। আর সত্যি তো একদিন জানারই ছিলো আজ না হোক কাল। কিন্তু এখন আমার চন্দ্রার জন্য বেশি চিন্তা হচ্ছে। এসব ছাড় এখান থেকে বেরোতে হবে এখন চন্দ্রার কাছে যাওয়া বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। গার্ড দের ইনফর্ম কর। ”

পিয়াস মাথা নাড়িয়ে বেরোতে গেলেই সেই রুমে আওয়াজ হলো দরজায়। সিয়াম ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার এই রুমে পিয়াস ব্যতীত অতি দরকার ছাড়া কেউ আসে না। তাহলে..?”

পিয়াস সিয়ামকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বাইরে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার সে রুমে ঢুকলো এবার তাকে আগের থেকে বেশি চিন্তিত লাগছে। সিয়াম হাঁপ ছাড়ল। আজ সকালটা বোধহয় না হলেই ভালো হতো।
পিয়াস এবার এসে বললো ” বেরোনো যাবে না সিয়াম এখন বাইরে প্রচুর ভির প্রেস মিডিয়া সমান তালে ভিড় বেড়েই চলেছে। সবার তোকে চাই নইলে ঝামেলা করবে।”

সিয়াম এবার সত্যিই চিন্তায় পড়লো ভীষন। এইদিক সে সামলে নেবে কিন্তু ওই দিক চন্দ্রা একা কীভাবে সামলাবে..? সে চেয়েও এখন এখন থেকে বেরোতে পারবে না।

শেষমেশ পিয়াসকে কিছু বলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

____________________________________

অপূর্ব সিয়ার জন্য দুই ব্যাগ চকলেট নিয়ে এসেছে। আর সেই সব পেয়ে সিয়া খাবার দাবার ছেড়ে সেইগুলো নিয়ে বসেছে।
সায়মা বেগম সেই নিয়ে ছেলেকে বকেই যাচ্ছে তখন থেকে। কেনো সে এই খাবার সময় এতগুলো চকলেট এনেছে।
অপূর্ব কপাল চাপরালো। তার তো এখন নিজেকে এই বাড়িতে থাকা ভারাটে লাগছে। যাই হোক আসেপাশে সব দোষ তার হয়ে যাচ্ছে।
এই তো আগের দিন রাতেই পকোড়া গুলোয় একটু নুন হয়ে গিয়েছিল। সিয়া সেই শুনে মুখ ফুলিয়ে সায়মা বেগমের কাছে নালিশ ঠুকেছে, আর সেই নিয়েই কি ঝামেলা, সায়মা বেগম, অলীক সাহেব সবাই বেশ ভালো করেই বকেছে তাকে। লজিক দিয়ে বুঝিয়েছে মাঝে মাঝে তরকারিতে নুন বেশি খেতে হয়। এইসব লজিক শুনে অপূর্বের অর্ধেক রাত অবধি ঘুম আসেনি।

সব মেনে নিলেও সিয়ার ওই মুখ ফোলানো তার সহ্য হয়নি। তাই ডিউটি থেকে আর্জেন্ট ছুটি করিয়ে গোলাপ আর চকলেট নিয়ে হাজির হয়েছে। গোলাপ গুলো সিয়াকে যদিও দেওয়া হয়নি এখনও।
.
.
সিয়া দুই হাতে দুটো চকলেট খেতে খেতে রুমে ঢুকলো। অপূর্ব তাকে কিছুক্ষন দেখে হেসে এগিয়ে গিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ নাক গাল মুছিয়ে দিল। সিয়া স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ” বুকটা তার ধক ধক করছে হটাৎ।”
অপূর্ব সেইরকম হাসি মুখ করেই বলল “বাচ্চাদের মতো নিজেও খেয়েছো নাক গালকেও খাইয়েছ দেখছি।”

সিয়া মুখ ফুলিয়ে বিছনায় পা তুলে বসলো। চকলেট এনে দিয়েছে বলে আর ঝগড়া করলো না। হটাৎই তার মনে পড়লো কতদিন সে চকলেট খায় না। একসময় ভীষণ পছন্দের ছিলো তার চকলেট। টাকা থাকলেই সিয়া এদিক ওদিক থেকে চকলেট কিনে খেতো। কিন্তু আতিফের পড়াশোনা শেষে চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করার সময় থেকেই সে এসব ছোটো ছোটো জিনিসে পয়সা খরচ করা ছেড়ে দিয়েছিল। খালি মনে হতো ওই টাকা বাঁচিয়ে আতিফকে কিছু একটা কিনে দেবে। সিয়ার আর গলা দিয়ে নামলনা চকলেট মনটা বিষয়ে গেছে তার।

অপূর্বের শান্ত ধীর গলায় তার নাম শুনে তার দিকে ফিরলো সে।
অপূর্ব কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বললো ” আজ আতিফকে দেখলাম হসপিটালে। বউয়ের সাথে এসেছিল। আমায় না চিনলেও আমি ঠিকই চিনেছি। কিন্তু তার মুখ দেখে আমার কেমন যেনো লাগলো ঠিক ভালো না। একবার মনে হয়েছিল গিয়ে কথা বলি মেরে ওখানেই মুখটা ভেঙে দি। কিন্তু করিনি তোমার অপমান আমার সহ্য হতো না আর ওখানেই খুন করে দিতাম আমি রাস্কেল টাকে।”

সিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো “ভালোই আছে। ভালো থাকার জন্যই তো ছেড়ে গেছে। আর প্লিজ অপূর্ব ওর কথা আর তুলবে না কখনো।” বলে আবার চকলেটে কামড় বসালো।
অপূর্ব সিয়ার দিকে তাকালো। কষ্ট দিয়ে ফেললো কি মেয়েটাকে..? কবে সে মানসিক শারীরিক দিক থেকে নিজের করে পাবে মেয়েটাকে..? কবে তার হয়ে যাবে পুরোপুরি..? আদেও হবে তো.?

অপূর্ব আনা গোলাপ ফুল গুলো বিছানায় একপাশে রেখেই চলে গেলো রুমের বাইরে। সিয়া কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলো ফুলগুলোকে। সেগুলো হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো রুমের দরজায় দিকে তাকিয়ে।

______________________________

সিরাজের জোড়াজুড়িতে ফোনটা অন করতেই হয়েছে ইন্দ্রাকে। নয়তো সে হুমকি ধমকি দিয়ে গেছে পরে এমন ফোনে না পেলে বাড়ি থেকে এসে তুলে নিয়ে যাবে। ইন্দ্রা বেশ ভয় পায় এই বেখেয়ালি ছেলেটাকে কখন যে করে বসে। তাই ইন্দ্রা আর রিস্ক না নিয়ে সিরাজের কথা মত ফোন খুলে রেখেছে। কিন্তু তার এখন মনে হচ্ছে কেনো খুললো সে ফোন টা..?

সিরাজ অলরেডি চার ঘণ্টায় দশবার ফোন করে ফেলেছে।
প্রত্যেক বারই ইন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেছে সে চেক করছে ইন্দ্রা ফোন আবার বন্ধ করলো কিনা।

লাস্ট ফোন আসার কয়েক মিনিট পর আবার ফোন আসতেই ইন্দ্রা এবার ফোন তুলে রেগে বললো “কি হয়েছে টা কি বলবেন..? এতবার ফোন করার কোনো মানে হয়..? আমি একটা কাজ করতে পারছি না ঠিক ভাবে।”

সিরাজ ওপাশ থেকে বললো “আমার সন্দেহ হচ্ছে তোমার উপর যদি আবার ফোন বন্ধ করে দাও। তুমি এই কলে থেকেই বাকি কাজ করো।”

ইন্দ্রা হাঁপ ছাড়ল। হ্যাঁ তার কাছে আপাতত এটাই বেটার বার বার ফোন ধরার চেয়ে।

ফোনের ওপাসে সিরাজ মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে সারাক্ষণ জ্বালাতে তার মাঝে যে খুশি হয় সে সেই খুশি আর কিছুতে পায় না।

# চলবে..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে