গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৭
চন্দ্রা কফি হাউসেবসে বসে তার দিদির ব্যাপারটা ভাবছিল। খেয়াল করেনি যে আতিফ তার সামনে দাঁড়িয়ে।
আতিফ চন্দ্রাকে আগেই দেখেছিল ফটোতে আগে। তাকে সিয়াই দেখিয়েছিল চন্দ্রা আর সিয়ামের একসাথে ফোটো বিধায় তার চিনতে অসুবিধা হয়নি। আতিফ এবার কিছুটা গলা ঝারার ভান করলো। সেই আওয়াজ শুনে চন্দ্রা ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সিয়া যেমন আতিফের বর্ণনা দিয়েছিল তেমনি ঠিক। চন্দ্রা উঠে দাঁড়িয়ে বললো ” আতিফ..? ” আতিফ বললো “হ্যাঁ আমিই আতিফ” চন্দ্রা চেয়ার দেখিয়ে বললো “প্লিজ সিট”
আতিফ চেয়ার টেনে বসল চন্দ্রার মুখোমুখি।
চন্দ্রা এবার প্রশ্ন করলো “তা আতিফ তোমায় এখানে কেন ডেকেছি তা নিশ্চই বুঝতে পারছো..?”
আতিফ হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়িয়ে বললো “হ্যাঁ সেই একই বিষয় নিয়ে আমরও কিছু বলার আছে।”
চন্দ্রা দুটো কফি অর্ডার দিয়ে বললো “আমিই তাহলে বলি আগে..?” আতিফ সম্মতি দিল। চন্দ্রা বলতে শুরু করলো “তা আতিফ আমি যা সিয়ার কাছ থেকে শুনলাম তোমাদের রিলেশন অনেককটা বছরের। তা হটাৎ এমন কি হলো যে তুমি সিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছো..?”
আতিফ এবার মাথা হালকা নীচু করে বললো “কারণটা হচ্ছে আমার মা তিনি মেনে নিতে পারছেন না সিয়াকে। তিনি আগে থেকেই আমার জন্যে মেয়ে দেখে রেখেছিলেন কিন্তু আমায় জানাননি। এখন জোর করছেন আমায় তাকেই বিয়ে করতে হবে।”
চন্দ্রা পুরো কথাটা শুনে বললো “তা এই মায়ের ব্যাপারটা তোমার এতদিন রিলেশন চালিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়েনি..?” আতিফ বললো “না মা সিয়াকে আমার বান্ধবী হিসেবে বেশ পছন্দ করেন তবে বউ হিসেবে তিনি মানতে পারবেন না জানিয়েছেন।”
চন্দ্রা এবার মুখটা খানিকটা শক্ত করে বললো ” তা তুমি কেনো ভালো করে বোঝাচ্ছেনা মাকে..?তুমি যদি বলো তাহলে আমরা কথা বলতে পারি তোমার মায়ের সাথে।”
আতিফ আঁতকে উঠে বললো “না না আমি মাকে বুঝিয়েছি কিন্তু মায়ের উপর কথা বলার সাহস আমার নেই। আমি মাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি আর ভালবাসি তার কথার খেলাপ আমি করতে পারবো না।”
চন্দ্রা এবার খানিকটা রেগে বললো “আর সিয়ার এতবছরের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে..? মেয়েটা এতবছর ধরে নিঃস্বার্থ ভাবে যে তোমার প্রতি ভালোবাসো উজাড় করে দিল..? তার কি..?”
আতিফ উত্তর দিলো না। বলা যায় ভাষা খুঁজে পেলো না। কিছুক্ষন পর সে বললো “আমি এসব কথা শুনতে চাইনা ভাবী। আমি সম্পর্ক তাকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবনা এই শেষ কথা। মায়ের বিরুদ্ধে যাওযার ক্ষমতা আমার নেই।” এই বলে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে চন্দ্রার হাতে দিয়ে বলল “আগামী মাসের পঁচিশ তারিখ আমার বিয়ে আপনারা আসবেন না জানি তাও আমন্ত্রণ রইলো।”
চন্দ্রা কার্ডটা নিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। সে এবার বুঝলো যে মানুষ নিজে থেকে বলদাতে চায় তাকে শত চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না। চন্দ্রা আর কথা না বাড়িয়ে শুধু বললো “আর কিছু বলার নেই আমার। শুধু এইটুকুই বলার যা তুমি করবে তাই তুমি ফিরে পাবে অন্যরূপে অন্যভাবে প্রস্তুত থেকো।” এই বলে কার্ডটা চন্দ্রা ব্যাগে রেখে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে পড়লো।
____________________________________
চন্দ্রা বাড়ি ফিরে এসে সিয়ার রুমে গেলো। সিয়া তখনও একই ভাবে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল। চন্দ্রা গিয়ে আস্তে করে সিয়াকে ডাক দিতেই সিয়া একপ্রকার দৌড়েই এলো চন্দ্রার সামনে। চন্দ্রাকে কিছু বলতে না দিয়ে সিয়া বললো “কি হলো ভাবী..? আতিফ কি বললো..?তুমি মানতে পেরেছ তাকে..?বলো না ভাবী বলো না চুপ করে আছো কেনো..?” চন্দ্রা কি বলে সান্তনা দেবে বুঝতে পারছিলো না। সে ভেবেছিল বাড়ি এসে কিছু করে বুঝিয়ে দেবে সিয়াকে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ভুল ছিল। সে এখন এই পাগল মেয়েটাকে বোঝাবে হয়ে সে এতদিন অপাত্রে ভালোবাসা ঢেলেছিল। চন্দ্রা সিয়াকে বাচ্চাদের মত করে বুঝিয়ে শান্ত করলো। আতিফের সব কথাই খুলে বললো। শুধু বিয়ের ব্যাপারটা চেপে গেলো, এখন বিয়ের ব্যাপারটা তুললে সিয়া না জানি কি করে ফেলবে।
দিভায়ের চিন্তা সিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে চন্দ্রা ভীষণ ঘেঁটে ঘেঁটে ছিলো। তারপর সিয়ামের হাতে নিজের পার্সোনাল ডায়েরি হাতে দেখে চন্দ্রা হঠাৎই মেজাজ বিগড়ে যায়।
এক দৌড়ে গিয়ে সিয়ামের হাত থেকে নিজের ডায়েরি টা একপ্রকার ছিনিয়েই নিলো চন্দ্রা। সিয়াম চন্দ্রাকে দেখে হালকা হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু চন্দ্রা সেসব না শুনেই মেজাজ দেখিয়ে বললো ” আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে আমার পার্সোনাল ডায়েরি ধরার..?ভুলে যাবেন না আপনাকে আমি স্বামীর অধিকার এখনও দিইনি যে সেই অধিকারে আপনি আমার পার্সোনাল জিনিস হাত দেবেন।”
এই বলে চন্দ্রা ডায়েরিটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এইদিকে যে তার কথায় একজনের হৃদয়ের শত ভাগ হলো সেই দিকে তার নজর গেলো না।
রুম থেকে বেরোনোর কিছুক্ষন পর চন্দ্রা বুঝতে পারলো সে বোধহয় মাথা গরমে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। সে পুনরায় সিয়ামের রুমে সিয়ামকে খুঁজতে গিয়ে দেখে সিয়াম নেই। সারা বাড়ি খোঁজ করলে দারোয়ান চাচা জানায় সিয়াম কিছুক্ষন আগেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে। চন্দ্রার এবার ভীষন অপরাধ বোধ হলো নিজের উপর। কি দরকার ছিল মানুষতাকে ওভাবে বলার।
এসব ভাবতে ভাবতেই চন্দ্রার ফোন বেজে উঠলো। চন্দ্রা তাকিয়ে দেখলো ইন্দ্রা ফোন করেছে। চন্দ্রা ফোন তুলতেই ইন্দ্রা বললো ” হ্যালো চন্দ্রা। বলছি একটু তাড়াতাড়ি আয়না এই বাড়ি বাবার শরীরটা খারাপ করেছে। আমি একা পারছি না।” চন্দ্রা এবার বিচলিত হয়ে বললো “কি বলিস দিভাই আবার কি হলো..? দাঁড়া আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়েই বেরোচ্ছি।” এই বলে চন্দ্রা ফোন রেখে রেডি হতে চলে গেলো।
রেডি হয়ে এসে এক সার্ভেন্টকে সব বুঝিয়ে দিলো যে সিয়ামের অফিস থেকে আসার পর কি কি লাগে। আর তার কাছেকাছে থাকতে যাতে তার অসুবিধা না হয়।
এই সব বুঝিয়ে চন্দ্রা বেরিয়ে গেলো ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে।
.
.
.
সিয়াম বাড়ি এলো সন্ধ্যার দিকে এসেই চন্দ্রাকে না দেখতে পেয়ে চন্দ্রার নাম ধরে ডাকল দুই একবার। তখনই সার্ভেন্ট এসে বললো “স্যার বৌমনি তো বাড়িতে নেই বাপের বাড়ি গেছে কি দরকারে আপনার ফোন বন্ধ তাই বললো আপনাকে যেনো জানিয়ে দিই।” সিয়াম এবার ফোন হতে নিয়ে দেখলো সেটা সুইচ অফ হয়ে পড়ে আছে।
সিয়ামের এবার ফোন টাকে তুলে আছার মারতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু অদতেই দোষ তার ভেবে নিজেকে শান্ত করলো। সকালে জরুরী ডাক পড়ায় তাকে একটু তাড়াতাড়িই অফিস যেতে হয়েছিল। চন্দ্রাকে বলারও সময় পায়নি। সিয়ামের এবার মনে হলো চন্দ্রা তার উপর হয়তো রেগে আছে। চন্দ্রার ফোন ফোন লাগিয়ে দেখলো সে কল রিসিভ করছে না। সিয়াম তা দেখে চিন্তায় ইন্দ্রাকে ফোন করলো।
ইন্দ্রা জানালো চিন্তার কিছু নেই। তার বাবা এখন ঠিক আছেন চন্দ্রা একটু ফাঁকা হলেই তাকে ফোন করে নেবে।
সিয়াম শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে সেটা শুনে।
_____________________________
চন্দ্রা রাত ৯ টার পর একটু ফ্রি হয়ে বসলো নিজের রুমে। আজ সারাদিন তার অক্লান্ত পরিশ্রম গেছে। ফোন দেখারও সুযোগ পায়নি সে। সিয়ামের কথা মাথায় আসতেই দেখলো সিয়ামের 15+ মিসড কল হয়ে রয়েছে। চন্দ্রা কল ব্যাক করলো কিন্তু ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো না। চন্দ্রার এবার ভীষণ খারাপ লাগা শুরু হলো।
কিছুক্ষন পর দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে চন্দ্রা নীচে গিয়ে দেখলো তার নামে একটা পার্সেল এসেছে। চন্দ্রা সেটা নিয়ে দেখলো সিয়ামই পাঠিয়েছে তাকে।
চন্দ্রার এবার মুখে হালকা হাসি ফুটলো। নিজের রুমে এসে পার্সেলটা খুলতেই প্রথমে তার চোখে পড়লো একটা চিরকুট। তাতে লেখা….
প্রিয় চন্দ্রাবতী❤️
আমার বলে সম্মোধন করলাম না কারণ সেই অধিকার আমি পাইনি। নিজের দিক দিয়ে যতটা হয় আমি আমাদের সম্পর্কটায় দেওয়ার চেষ্টা করেছি জানিনা কতটুকু কি পেরেছি। কাল আমাদের বিয়ের ছয় মাস পূর্ণ হবে তাই তোমার জন্য স্পেশাল কিছু অরেঞ্জ করেছি। এই পার্সেলে কিছু উপহার রইলো তোমার জন্য। পছন্দ হলে কাল একবার তোমায় আমার দেওয়া এই উপহার গুলোতে সজ্জিত দেখতে চাই। ইচ্ছে হলে পরো আমি জোর করবো না। তবে কাল অবশ্যই এই ঠিকানায় পৌঁছে জেও বিকেল ৬ টায়। অনেক বড়ো সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
ইতি
সিয়াম
চন্দ্রা চিরকুটটা নিয়ে একটা বড়ো হাসি দিল। কালকের কথাটা তার মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। সে নিজেও তো কত কিছু প্ল্যান করে রেখেছিল এই দিনটার জন্য। তার এতদিনের একটু একটু করে সঞ্চয় করা অনুভুতি সিয়ামকে ব্যাক্ত করবে বলে এই দিনটাই বেছে রেখেছিল চন্দ্রা।
চন্দ্রা ঠিক করলো কালই সে তার সব অনুভুতি মনের এতো ব্যাকুলতা সব প্রকাশ করবে। সে ভালোই বুঝেছে এই মানুষ টাকে ছাড়া তার কখনই ভালো থাকা হবে না। জীবনে প্রাণ খুলে বাঁচতে গেলে তার এই মানুষটাকেই চাই।
তাই আর ফোন না করে পার্সেল টা পাশে রেখে চিরকুটটা বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো চন্দ্রা।
#চলবে..?
গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৮
আজ শুক্রবার। পরিষ্কার আকাশ রোদ ঝলমল করছে চারিদিকে, চন্দ্রার খুশিতে যেনো রোদও সামিল হয়ে নিজের কিরণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সকাল থেকেই চন্দ্রা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। কখনো গুনগুন করছে তো কখনো বাড়ির এদিক সেদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে মাঝে গিয়েই সিয়ামের দেওয়া শাড়ীটা নিজের গায়ে ফেলে আয়নায় দেখছে।
ইন্দ্রা বেশ অনেক্ষণ ধরেই চন্দ্রার কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিলো। শেষে আর নিজেকে ধরে না রাখতে পেরে চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো..
–এই চন্দ্রা কি হয়েছে বলতো আজ তোর..? এতো খুশি কিসের..?আজ কিছু আছে..?সকাল থেকে দেখছি কেমন খরগোশের মতো এদিক সেদিক লাফিয়ে বেরাচ্ছিস। কি এমন হলো আমায়ও একটু বল..?
ইন্দ্রার শেষের কথাটায় ছিলো দুষ্টুমির আভাস। চন্দ্রা তা ভালই ধরতে পারলো। এবার তার নিজের মনের মধ্যেই প্রশ্ন জাগলো আসলেই কি সে একটু বেশি লাফাচ্ছে খুশির ঠেলায়..? তারপর নিজেকে সামলে বললো ” ক-ক-ক-ই, আমাকে আবার কই লাফাতে ঝাপাতে দেখলি..? হ্যাঁ মেজাজটা হালকা ফুরফুরে ব্যাস এই টুকুই। তোর এই আমার ওপর নজরদারি করাটা আর গেলো না।”
ইন্দ্রা এবার মুখটা বেজার করে বললো “যা বাব্বা নরজদারি কই করলাম..?উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছেস তাই জিজ্ঞেস করলাম কারণটা কি..?”
চন্দ্রা এবার তাড়া লাগিয়ে বললো “এই যা তো তুই তোর কাজে যা আমার পিছনে লাগা ছেড়ে।”
ইন্দ্রা চন্দ্রার দিকে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। চন্দ্রা আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়লো নিজের শাড়ি গয়নাগাটি নিয়ে।
___________________________________
বিকেল পাঁচটা।
চন্দ্রার এবার হার্টবিট ফাস্ট হতে শুরু করেছে। এতো ভেবে ভেবেও এখনও সে রেডি হয়ে উঠতেই পারেনি। সে ভেবেছিল দিভাই কে সব কথা এসে বলবে। কিন্তু এখন তো দেখছে তাকে দিভাইয়ের হেল্প নিতেই হবে। অগত্যা চন্দ্রা শাড়ি রেখে ইন্দ্রাকে টেনে টেনে নিয়ে এলো নিজের রুমে।ইন্দ্রা এবার নিজের হাতটা চন্দ্রার হাত থেকে ছাড়িয়ে বললো “কি হয়েছে কি বল তো..? এতো তাড়া কিসের তোর..? আর এই শাড়ি গয়না..এই তুই সত্যি করে বল তো কই যাবি তুই..?”
চন্দ্রা এবার আমতা আমতা করে সিয়ামের কাছে যাওয়ার কথাটা বললো।
ইন্দ্রার মুখে এবার দুষ্টুমির হাসি দেখা দিলো। ইন্দ্রার এই হাসি দেখে চন্দ্রা চোখ বড়ো বড়ো করে বললো “এই জন্যে ঠিক এই জন্যেই আমি তোকে আগে জানতে চাইনি। জানতাম আমি তুই আবার পিছনে লাগবি।”
ইন্দ্রা শাড়িটা হাতে নিতে নিতে বলল “কই আর পিছনে লাগতে দিস বল তুই..?আমি কি একবারও জিজ্ঞেস করেছি বল যে তুই আজ রাত বাড়ি ফিরবি কিনা..?”
চন্দ্রা বোধহয় বুঝলো কথার ইঙ্গিতটা। চমকে উঠে বললো ” দিভাই তুই আবার শুরু করেছিস..?যা তো তুই আমি একাই তৈরি হয়ে নেবো।”
ইন্দ্রা শব্দ করে হেসে বললো “আমি তো, আজ ওই বাড়ি যাবি কিনা সেটার কথা বলছিলাম।”
চন্দ্রা লাজুক মুখটা লুকোবার জন্য বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো “থাক তোকে আর এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে না।”
ইন্দ্রা হেসে চন্দ্রাকে তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পাক্কা দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে চন্দ্রাকে রেডি করে আয়নার সামনে দাঁড় করালো।
চন্দ্রা নিজেকে দেখে যেনো নিজেই চিনতে পড়লো না। পড়নে সাদা ডিজাইন করা শাড়ি, হাতে চুড়ি, কানে ঝুমকো, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক আর হালকা মেকাপ। চন্দ্রা নিজেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিল আয়নায়।
ইন্দ্রা তা দেখে হালকা গলা ঝেড়ে বললো “বলছি কি অ্যাম্বুলেন্স কি এখন থেকে ফোন করে রাখবো..?”
চন্দ্রা ভ্রূ কুচকে বললো “মানে..? অ্যাম্বুলেন্স কেনো..?”
ইন্দ্রা এবার চন্দ্রার দুই কাঁধে হাত দিয়ে পিছন থেকে বললো “না মানে যদি তোর বর আজ তোকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়..? আচ্ছা ধর বাইচান্স চিন্তেই পারলো না তুই ওর বউ তাহলে..?”
চন্দ্রা এবার ইন্দ্রাকে হালকা মেরে লাজুক হেসে বললো “যা তো তুই এবার।” ইন্দ্রা হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
__________________________
চন্দ্রা ঠিকানা হাতে নিয়ে একটা ফার্মহাউসের সামনে দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালা তো এই বাড়িটাই বলে নামিয়ে দিল তাকে। বাড়িটি বেশ সুন্দর দেখতে। সামনে সিয়ামদের বাড়ির সামনের মতো বড়ো গার্ডেন ফুল দিয়ে সাজানো।
চন্দ্রা ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো বাড়িটির ভিতর। সামনেই সর্ভেন্ট দাঁড়িয়ে ছিল। তারা চন্দ্রাকে দেখেই সামনে এগিয়ে এসে বললো..
–ম্যাম আসুন। আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি স্যারের কাছে।
চন্দ্রা এবার যেনো একটু মনে সাহস পেলো। সার্ভেন্টটা চন্দ্রাকে একটা রুমের সামনে নিয়ে গিয়ে বললো…
–আপনি ভিতরে যান ম্যাম স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। এই বলে সে চলে গেলো।
চন্দ্রা আসতে আসতে ভিতরে ঢুকলো রুমের বেশ অন্ধকার দেখে ভয়ে যেই দরজা দিয়ে পুনরায় বেরোতে যাবে ওমনি আলো জ্বলে উঠলো রুমের। সাথে কিছু গোলাপ ফুলের পাপড়ি এসে চন্দ্রার মাথায় পড়লো। চন্দ্রা চমকে পিছনে তাকাতেই দেখলো সিয়াম হাসি মুখে হুইচেয়ারে বসে আছে।
সিয়ামকে আজ পুরো অন্যরকম লাগছে। তার সাদা শাড়ির সাথে মিলিয়ে সেও আজ সাদা শার্ট পড়েছে। চন্দ্রা কি আরেকবার ক্রাশ খেলো..?
ওপর দিকের মানুষটার যে তার থেকে খারাপ অবস্থা চন্দ্রা বুঝতেই পারলো না।
সিয়ামের হার্টবিট ভীষণ ফাস্ট চলছে। না চন্দ্রাকে তো সে এইভাবে সেজেগুজে প্রথম বার দেখছে না, তাহলে কেনো প্রত্যেকবার তার একই অনুভুতি কাজ করে চন্দ্রাকে দেখলে.? কেনো প্রত্যেকবার সে মুগ্ধ হয় এই রমণীর প্রতি..?বারবার তোলপাড় করে তার সমস্ত অনুভূতি।
চন্দ্রার সমস্ত রূপই সিয়ামের খুব পছন্দের। এই যো এখন সে অবাক দৃষ্টিতে চোখ গোল গোল করে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে এই রূপও সিয়ামকে ভিতর থেকে ভীষণ আকর্ষন করছে।
সিয়াম এবার নিজেকে সামলে চন্দ্রার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো “ওয়েলকাম ওয়াইফি। চারিপাশটা কেমন লাগছে বললে না তো..?” চন্দ্রা এবার হুঁশে ফিরে চারিপাশ টা দেখলো। বেশ সুন্দর ফুল বলুন দিয়ে ডেকোরেশন করা চারিদিক। চন্দ্রার মুখে এবার আপনাআপনিই হাসি ফুটে উঠলো। সিয়াম এবার চন্দ্রাকে নিয়ে গিয়ে একটা টেবিলের সামনে বসলো। টেবিল টাও বেশ সুন্দর করে ডেকোরেট করা। চন্দ্রার মনটা আরো খুশি হয়ে গেলো।
কিছু সময় পেরোনোর পরও চন্দ্রা দেখলো সিয়াম একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে তার দিকে। চন্দ্রা এবার লজ্জা পেয়ে ইতস্তত করে সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো “কি দেখছেন ওমন করে..?”
সিয়াম হালকা হেসে উত্তর দিলো “দেখছি না ভাবছি, ভাবছি তোমার নামটা এক্কেবারে মিলে গেছে তোমার সাথে। আজ সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে চাঁদ নিজে হেঁটে আমার ঘরে এসেছে।”
চন্দ্রা এবার ভীষণ লজ্জা পেলো। নিজের এতো প্রশংসা শুনতে সে অভ্যস্ত নয়। সিয়াম এবার হেসে বললো “চন্দ্র তুমি কি জানো লজ্জা পেলে তোমায় লাল টমেটোর মত লাগে। দেখো গাল গুলো কেমন লাল লাল হয়ে গেছে বলেই পাশ থেকে একটা ছোট্ট আয়না ধরলো চন্দ্রার মুখের সামনে। চন্দ্রা আয়নায় নিজেকে দেখে ফিক করে হেসে ফেললো।
সিয়াম সেই হাসি দেখে শুকনো চোখে তাকিয়ে বললো “এভাবেই হাসতে থেকো চন্দ্র। হাসলে তোমায় ভীষণ মিষ্টি লাগে। কক্ষনও যেনো তোমার চোখে জল না আসে এমনকি আমি না থাকার পরও।”
চন্দ্রা এবার বিস্মিত হলো মনের আকুলতা না চাপতে পেরে জিজ্ঞেস করলো “এমন করে কেনো বলছেন..? কোথায় যাবেন আপনি..?আপনাকে না বারণ করেছি এইসব কথা বলতে। আর কি সারপ্রাইজ এর কথা বলেছিলেন আপনি কই সেই সারপ্রাইজ..?”
সিয়াম এবার আলতো হেসে বললো ” বলা যায় না চন্দ্র কার জীবনে কি মোড় আসে সময়ের স্রোতে কে কোথায় ভেসে যায়।”
চন্দ্রার এবার ভালো লাগছে না মানুষটা এসব কি কথা বলছে আজকের দিনটাতে। চন্দ্রা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সিয়াম একটা খাম বাড়িয়ে চন্দ্রার টেবিলের কাছে রাখলো। চন্দ্রা তাতে হাত না দিয়ে বললো “কি আছে এতে..?”
সিয়াম সোজাসাপ্টা জবাব দিল “ডিভোর্স পেপার”
চন্দ্রার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে ভাবেইনি এরকম কিছু হতে পারে। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা হাতে নিল কিন্তু খুললো না।
কিছুক্ষন পিনপিনে নীরবতা কাজ করলো দুজনের মাঝেই।
তারপর সিয়ামই আগে মুখ খুললো। হালকা গলা ঝেড়ে বললো ” চন্দ্র ”
চন্দ্রা এবার চেঁচিয়ে উঠলো “একদম ডাকবেন না আমায় এই নামে। আপনি এই সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমায় এখানে ডেকেছেন..? আগে একটুও টের পেলে আমি মোটেই আসতাম না এখানে। ” বলে মাথা নীচু করে ফেললো টপ টপ করে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।
সিয়াম এবার চন্দ্রাকে কাঁদতে দেখে চন্দ্রার দিকে এগিয়ে এসে বসলো। চন্দ্রার মুখের কাছ থেকে চুল সরিয়ে কিছু বলতে যেতেই চন্দ্রা সিয়ামের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললো “স্পর্শ করবেন না আমায় একদম। খারাপ লোক একটা। এতদিন যে নিজের মায়ায় আটকালেন তার প্রতিদিন কে দেবে..?নিজেকে আমার অভ্যাসে পরিণত করলেন তার দায় ভার কে নেবে..? বলুন.?” বলে আবার চন্দ্রা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সিয়াম স্বাভাবিক ভাবে বললো “মায়া একসময় কেটে যাবে চন্দ্র । অভ্যাসও বদলে যাবে। সময় সব বদলে দেয় চন্দ্র, দেখই না কয়েক মাস আগেও তুমি আমার থেকে ডিভোর্স চাইতে মুক্তি চাইতে আমার কাছ থেকে। আর আজ..?আমি কারোর জীবনের বোঝা হতে চাই না চন্দ্র। আমি চাই তুমি পাখির মত আকাশে উড়ে বেড়াও নিজের স্বপ্ন পূরণ করো। আমার থেকে অনেক ভালো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে ডিজার্ভ করো তুমি চন্দ্র। তাই তো দেখো না আজ পর্যন্ত স্বামীর অধিকার টুকুও দিতে পারেনি আমায়। বন্ধুত্ত্ব আলাদা জিনিস চন্দ্র আর ভালোবাসা আলাদা। আমরা সারাজীবন বন্ধু হয়ে থাকতেই পারি কিন্তু তাতে কি সংসার হবে..? উল্টে তোমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে অকালে। তাই যা ডিসিশন নেবে মাথা ঠাণ্ডা করে।”
চন্দ্রা এবার কাঁদতে কাঁদতে হাপাতে শুরু করেছে। সিয়াম তা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো “শান্ত হও চন্দ্রা। কষ্ট হচ্ছে তো”
আদতেই কষ্টটা এই সময় চন্দ্রার চোখের জল দেখে কার বেশি হচ্ছে সেটা ঠিক ধরতে পারলো না সিয়াম।
চন্দ্রা কান্না থামালো না। ওইভাবেই বললো “কে বলেছে আমি আপনাকে শুধু বন্ধু ভাবি..? কে বলেছে আপনি আমার উপর বোঝা..?কে বলছে আমি আপনার সাথে সংসার করতে পারবোনা..? বলুন কে বলেছে..?
আপনাকে ছাড়া আমার চারপাশ অন্ধকার সিয়াম। আপনি কেনো বোঝেন না..?”
“আপনি না আমার চোখ পড়তে পারেন তাহলে এইটুকু কেনো বুঝলেন না যে এই পাগল, উড়নচণ্ডী, বেখেয়ালি মেয়েটা আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে বলুন কেনো বুঝলেন না..?” বলে চন্দ্রা সিয়ামের জামার কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সিয়ামের বুকে মাথা রাখলো। আজ আর সিয়াম চন্দ্রাকে আগলে নিলো না। চন্দ্রার এবার আরো বেশি করে অনুভব হলো সে সিয়ামকে ছাড়া সে কতোটা একা।
চন্দ্রা সিয়ামের বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে কাঁদতে বললো সিয়ামকে বললো “আপনিই আমার স্বাধীনতা, আপনিই আমার শান্তির যায়গা। আপনি বোঝা নন আমার আপনি শক্তি আমার। এইজীবনে আপনাকে ছাড়া আমি দ্বিতীয় কাউকে চাই না বিশ্বাস করুন। আমি বুঝেছি আপনাকে ছাড়া আমার কোনোদিনই ভালো থাকা হবে না। আপনি আমার এতো কাছে এসে সারাজীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে কিছুতেই সেগুলো কেড়ে নিতে পারেন না সিয়াম কিছুতেই না।” চন্দ্রার কান্নার বেগ বাড়লো সাথে হাপনিও।
সিয়াম এবার চন্দ্রাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। চন্দ্রা যেনো তবুও শান্ত হচ্ছে না নিজের মনে সিয়ামকে বলেই যাচ্ছে তার মনের কথা।
সিয়াম আর উপায় না পেয়ে চন্দ্রার মুখ দুই হাত দিয়ে উঁচু করে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো চন্দ্রার ঠোঁটে।
কয়েক সেকেন্ড পর চন্দ্রা শান্ত হলো। বর্তমান অনুভুতিটা তার মাথায় আসতে সময় লাগলো। চন্দ্রার মাথায় কথাটা পৌঁছাতেই চন্দ্রাও তাল মেলালো সিয়ামের সাথে। সিয়ামও চন্দ্রার সম্মতি পেয়ে চন্দ্রাকে আরেকটু নিজের কাছে টেনে নিল। শান্ত হলো দুটি মন, শান্ত হলো চারপাশে পরিবেশ।
#চলবে..?