গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১২
ভোর ৪ টে। সিরাজের রুমের ভিতর যেনো ঝড় বয়ে গেছে। চারিদিক ভাঙা জিনিসে ছড়াছড়ি। সিরাজ মাথার চুল টেনে মাথা নীচু করে বসে ব্যালকনির ধার ঘেঁষে। এবার যেনো সব তার সহ্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। চন্দ্রা আর সিয়ামকে সে যতবার একসাথে দেখে ততবার তার বুকে রক্তক্ষরণ হয়। সেই কারণে সে বেশির ভাগই বাড়িতে থাকতো না কিন্তু দিনশেষে তো তাকে বাড়িতেই ফিরতে হয়।তার মনে যে চন্দ্রার জন্য সফট কর্নার ছিলো সেটা সে অস্বীকার করতে পারবে না সেই সফট কর্নারটা যে ভালোলাগা না ভালোবাসা সেটা সে নিজেও জানে না। এটা তো মানতেই হবে চন্দ্রাকে সে বাকি মেয়েদের থেকে আলাদা চোখে দেখতো। চন্দ্রার পবিত্রতায় হাত দেওয়ার কথা সে কখনো মাথাতেও আনেনি। হ্যাঁ এটা ঠিক অনেক মেয়েকেই সে নিজের শয্যাসঙ্গী করেছে তবে কাউকে জোর করে নয় সবাই তার পয়সার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতো। চন্দ্রা তার জীবনে আসার পর সে এইসব থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়েছিল নিজেকে নেশাভানও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল বলতে গেলে। কিন্তু ওই “এক মাঘে কি আর শীত যায়..?” তেমনটাই ঘটলো তার সাথেও।সেইদিন পার্টিতে বন্ধুরা জোর করে তাকে ড্রিংকস করিয়েছিলো। তাই সে হুশ-জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলেছিল সেইরাতে। সে ঠিক কি করেছে তার মনেও নেই ঠিকভাবে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আঘাত সিরাজের তখন লেগেছিল যখন চন্দ্রা তার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।তারপর ওই থানায় কেস। এতদিনে নিজেকে সারাক্ষণ নেশায় ডুবিয়ে সেইসব কথা ভুলে থাকতে চাইলেও বিয়ের দিন চন্দ্রাকে নিজের বড়ো ভাইয়ের বউ হিসেবে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিলো তার। তার দরুণ সময় পেলেই চন্দ্রাকে সে কটু বাক্য শোনাত। সিরাজ হাতের দিকে তাকালো বেশ খানিকটা কেটে গেছে আরও কয়েক জায়গায় ভালোই চোট লেগেছে। যদিও এর চেয়ে অনেক বেশি লেগেছে তার হৃদয়ে। সে ঠিক করেছে চন্দ্রা যখন তার ভাইয়ার সাথে ভালো আছে তখন সে আর তাদের সম্পর্কে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। সে স্বীকার করে ভুল একসময় তারই ছিলো কোনো মেয়েরই এইসব শুনে মেনে নেওয়ার কথা না চন্দ্রা তার জায়গায় ঠিকই ছিলো।
সিরাজ উঠে দাড়ালো। শাওয়ার নিয়ে এসে নিজেই এক এক করে সব গোছাতে লাগলো ঘরের। ভাঙ্গা জিনিস গুলো সার্ভেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করলো।
_______________________________
সকাল ১০ টা
সিয়া আজও দাড়িয়ে আছে আতিফের জন্য। গতকালে ইন্দ্রার অতীত শুনে সিয়ার মনে ভীষণ ভয় হচ্ছে মনটা কেমন উসখুশ করছে। সিয়া জানে এই অস্বস্তির অবসান ঘটবে একমাত্র আতিফের সান্নিধ্য পেলে।
আতিফকে আসতে দেখেই সিয়া এক মুহূর্ত দেরি না করে আতিফকে গিয়ে জাপটে ধরল শক্ত করে।
আতিফ একটু হকচকিয়ে গেল। সিয়া সাধারণত এমনটা করে না। আতিফ কিছু জিজ্ঞেস না করেই সিয়ার পিঠে হাত রাখলো। সিয়া নিজেই কয়েক মিনিট বাদ আতিফকে ছেড়ে দাড়ালো। তারপর দুজনে বসল একসাথে কিছুক্ষন। সিয়া গতকালের সব ঘটনা খুলে বললো আতিফকে। কিন্তু আতিফ তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।স্বাভাবিক ভাবেই নিলো ব্যাপারটা যেটা সিয়ার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগলো।
________________________________
সিয়া বাড়ি ফিরে ঠিক করলো সে চন্দ্রার বাড়ি যাবে। কিন্তু বাড়ির ড্রাইভার আজ ছুটি নিয়েছে আর সিয়াও ড্রাইভিং পারে না ঠিকঠাক। উপায় না পেয়ে সিরাজকে জোরাজুরি করলো তাকে ড্রাইভিং করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সিরাজের যাওয়ার এক ফোঁটা ইচ্ছে না থাকলেও বোনের জেদের কাছে হার মেনে তাকে যেতেই হলো সিয়কে নিয়ে।
সিয়াম সকাল থেকে চন্দ্রার দেখা পায়নি। সেই যে একবার এসে তাকে ফ্রেশ হতে হেল্প করলো তারপর তাকে চা টুকুও ইন্দ্রা দিয়ে গেছে। সিয়াম ডাকবে না ডাকবে না করেও থাকতে না পেরে চন্দ্রার নাম ধরে ডেকেই ফেলল।
চন্দ্রা তখন রান্নাঘরে ইন্দ্রার সাথে গল্প করছিল। সিয়ামের আওয়াজ পেয়ে ইন্দ্রা দুষ্টুমি করে বললো “কি যাদু করলি বলতো এতো দেখি বউকে কিছুক্ষন না দেখতে পেয়েই চোখে হারাচ্ছে।” চন্দ্রা ইন্দ্রাকে হালকা ঠেলা মেরে বললো “খালি উল্টোপাল্টা কথা, কিছু হয়তো দরকার পড়েছে তাই ডাকছে।” ইন্দ্রা আবার দুষ্টু হাসি হেসে বললো “হ্যাঁ নতুন বউদের ওমনি একটু আধটু দরকার পড়ে বরের কাছে বুঝলি।” চন্দ্রা এবার খানিকটা লজ্জা পেলো। ইন্দ্রা বললো “থাক আর লজ্জায় লাল নীল না হয়ে যা বরের কাছে।নইলে দেখবো রান্নাঘর থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।” বলে ইন্দ্রা হেসে দিল। চন্দ্রা” ধ্যাত দিভাই তুইও না” বলে দৌড়ে চলে গেলো সিয়ামের রুমে। ইন্দ্রার হাসি মুখটা মিলন হলো যতই যে হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করুক বাইরে ভিতরে সে গুমড়ে গুমড়ে মরছে। কিন্তু তা দেখাতে চায় না কাউকে সে জানে তাকে কিছু মানুষ ভীষণ ভালোবাসে তার কষ্ট দেখে তারাও দ্বিগুণ কষ্ট পাবে।
চন্দ্রা নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো সিয়াম একমনে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়া এসেছে টের পেয়ে সিয়াম ঘুরে বললো “সকাল থেকে কোথায় ছিলে..?”
চন্দ্রা এবার বললো “আমি তো দিভাইয়ের কাছে কিচেনে ছিলাম। কিন্তু আপনি ডাকছিলেন কেনো..? আর এভাবে কেউ ডাকে..?দিভাই কিভাবে পিছনে লাগছিল বলুনতো..?”
সিয়াম ফট করে জিজ্ঞেস করলো “কিভাবে শুনি..?” চন্দ্রা কোনোকিছুই না ভেবে বলে উঠলো “বললো যে আপনি আমায় চোখে হারান। আমি বললাম দরকারে ডাকছেন হয়তো। সে বলে হ্যাঁ নতুন বউদের ওমন একটু দরকার পরে…” পুরো কথাটা শেষ করার আগেই চন্দ্রার খেয়াল এলো কি বলছে সে। সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দেখলো সিয়াম ঠোঁটের কিছুটা উপর দুই আঙ্গুল চেপে মুচকি মুচকি হাসছে। চন্দ্রা লজ্জায় জিভ কাটলো সবজায়গায় দরকারের চেয়ে বেশি বলার অভ্যাসটা তার এখনো গেলো না।
সিয়াম এবার চন্দ্রাকে বললো “হ্যাঁ তোমার দিভাই তো ঠিকই বলেছে দরকার তো আছে।”
চন্দ্রা হালকা লজ্জা পেয়ে বলল “কি দরকার বলুন..?”
সিয়াম এবার চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বললো “চন্দ্র আমি চাইছি আজ আমরা একটু বাইরে যাই, ঘুরিফিরি তাতে
ইন্দ্রার মনও ভালো হবে সাথে তোমারও।”
চন্দ্রা শুনে বললো “হ্যাঁ ভালো আইডিয়া। তাহলে সিয়া আপুকেও ডেকে নিন।”
সিয়াম হেসে বললো “হ্যাঁ অবশ্যই। মহারানীর কথার খেলাপ করার সাধ্য কি আমার আছে..?” চন্দ্রা লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়েই হোচট খেলো কর্পেটে।
পরে যেতে নিলেই সিয়াম ধরে ফেললো চন্দ্রার হাত। চন্দ্রা টাল সামলাতে না পেরে সিয়ামের শার্টের কলার ধরে সিয়ামেই কোলেই পড়ে গেলো।
চন্দ্রা ভয়ে আসতে আসতে চোখ খুলে বুঝতে পারলো তার অবস্থান ঠিক কোথায় কিন্তু সেখান থেকে নড়ার ক্ষমতা সে পেলো না। চন্দ্রা তখন কলার ধরে টান দেওয়ায় সিয়ামের থেকে তার মুখের দূরত্ব প্রায় কয়েক ইঞ্চি সমান।
সিয়ামের চোখে চোখ পড়তেই চন্দ্রার বুক ধুকপুক করতে শুরু করলো। সে যেনো বাইরে থেকে আওয়াজ পাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির। অন্যদিকে সিয়ামেরও অবস্থাও নাজেহাল এই প্রথম সে চন্দ্রার এতো কাছে। কিছু নিষিদ্ধ ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তার। চন্দ্রা শাড়ী পরে থাকায় তার অনুভূতি হলো সিয়ামের হাত তার কোমরের কিছু অংশ স্পর্শ করে আছে। এইকথাটা মাথায় পৌঁছাতেই চন্দ্রার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার তাড়াতাড়ি করতে উঠতে গিয়ে আবার পিছল খেলো সে। সিয়াম এবার চন্দ্রার কোমরটা একটু শক্ত করেই ধরে বললো “এতো তাড়াহুড়ো কিসের তোমার..?একটু সাবধানে কাজকর্ম করতে পারো না..?” এই প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেলো সে এতো কাছ থেকে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না চন্দ্রার, সে চুপটি করে সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। ওই চোখে যেনো রাজ্যের সব মায়া জড়িয়ে চন্দ্রা চেয়েও যেনো চোখ ফেরাতে পারলো না।
তখনই আওয়াজ এলো ডোর বেলের। চন্দ্রার এবার হুশ ফিরল। সেই আওয়াজ শুনে চন্দ্রা সিয়ামকে ছেড়ে একটু দূরে চলে গেলো লজ্জায়। চন্দ্রা আর দাড়িয়ে না থাকতে পেরে দৌড়ে চলে গেলো বাইরে।
ডোর বেলের শব্দ শুনে ইন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দিতেই, সিয়া “আপুইইইই” বলে চেঁচিয়ে ইন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো।
ইন্দ্রাও হেসে জড়িয়ে ধরলো সিয়াকে। সিয়া এবার ইন্দ্রাকে ছেড়ে বলল “দাড়াও আপু আমি ভাইয়া-ভাবীর সাথে দেখা করে আসি। এই বলে সে চন্দ্রার রুমে চলে গেলো।
ইন্দ্রা সিরাজকে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালো। তারপর কিচেন থেকে গিয়ে চা নাস্তা এনে টেবিলে রাখলো। চা তুলে সিরাজকে দিতে গিয়েই অসাবধান বশত চায়ের খানিকটা গিয়ে পড়লো সিরাজের হাতে। সিরাজ তাড়াতাড়ি হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইন্দ্রা এবার ঘাবড়ে গেলো সামনে কিছু না পেয়ে তার ওড়না দিয়েই সিরাজের হাতটা মুছে দিতে দিতে বলল “সরি সরি ক্ষমা করবেন আমি এইরকমটা করতে চাইনি, আসলে আসলে”
সিরাজ বুঝতে পারলো ইন্দ্রা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে তাই সে ওড়নাটা হালকা করে সরিয়ে বললো “আচ্ছা আচ্ছা আপনি আগে শান্ত হোন আমার তেমন কিছুই হয়নি। চা খুব একটা বেশি গরম ছিলো না আর আমি বুঝতে পেরেছি অসাবধানতা বশত হয়েছে এটা আমি এতো উত্তেজিত হবেন না।” ইন্দ্রা তাও শুনলো না দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বাটি করে বরফ এনে সিরাজকে দিলো হাতে লাগানোর জন্য। সিরাজও বেচারা উপায় না পেয়ে বসে বসে হাতে বরফ ঘোষতে লাগলো।
#চলবে..?
গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৩
সম্পত্তি, এই সম্পত্তি লোভ এমনই এক জিনিস যার জন্য মানুষ নিজের মানুষগুলোকেও খুন করতেও দুইবার ভাবে না। তেমনই এক মানুষ হচ্ছেন এই সুইটি বেগম। সুইটি বেগম ছিলেন দুই বোন দুই ভাই। তিনি ছিলেন বড়ো আর সুহানা মানে সিয়ামের মা ছিলেন তার দুই বছরের ছোটো তাদের ছোটো ছিলো তার দুই ভাই। সুইটি বেগম বড়ো মেয়ে হওয়ায় একটু বড়ো হতেই তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক দায়িত্ব। সেই চাপে তিনি পড়াশোনাও মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়ো দেশ – বিদেশ ভ্রমন করার, বড়ো কোনো বাড়িতে বিয়ে করার। সুহানা তার দুই বছরের ছোট হলেও সে ছিলো সুইটি বেগমের থেকে বেশ সুন্দরী ও শিক্ষিতা। তাকে কোনো সময় কেউ কাজের জন্য জোর করতো না আর না করা হত তাদের দুই ভাইকে তাদের পড়াশোনার উপর বেশি জোর দেওয়া হতো। পড়াশোনার খরচের অর্ধেক দিতো সুইটি বেগম সেলাইয়ের হাতের বিভিন্ন কাজ করে। সুইটি বেগম মুখে কিছু না বললেও বেশ কষ্ট পেতো সে এই সব দেখে। তার বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় তিনি জানান তার পছন্দ একজনকে আর তিনিই হলেন সিয়ামের বাবা আয়ান সাহেব। সবাই তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তারা ভাবেন সেই প্রস্তাব সুহানার জন্য আর তারা রাজি হয়ে যান। বিয়ের আগে তাদের দেখা করার তেমন একটা চল ছিলোনা তাদের গ্রামে। সরাসরি বিয়ের সময় সুহানার যায়গায় সুইটিকে দেখে ছেলেপক্ষ ভীষণ অবাক হন। আয়ান সাহেব জানান তিনি সুহানাকে চাড়া কাউকে বিয়ে করবেন না। সবাই পরিস্থিতির শিকার হয়ে সুয়াহার সাথেই আয়ান সাহেবের বিয়ে দেন। কিন্তু কেউ একটিবারের জন্যও সুইটি বেগমের কথা ভাবেন না। তিনি মানুষিক ভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েন, কয়েকবার সুইসাইড করারও চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হননা। তারপর তিনি ঠিক করেন তিনি যতদিন বেচেঁ আছেন তিনি সুহানাকেও ভালো ভাবে সংসার করতে দেবেন না। আর আয়ান সাহেবের সম্পত্তি তিনি নিয়েই ছাড়বেন যেকোনো হালে যেকোনো মূল্যে। কিছুদিন বাদ সুইটি বেগমকেও বিয়ে দেওয়া হয় শিহাব সাহেবের সাথে। তিনি ছিলেন এক প্রাইভেট ফর্মে কর্মরত। সুইটি বেগমকে তিনি মাথায় তুলে রাখলেও সুইটি বেগম তাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না আর না তার অর্থে সন্তুষ্ট হতে পারতেন। এর কিছু বছরের মধ্যেই সিয়া ও সিরাজ জন্ম নেয়। সুইটি বেগমের সম্পত্তির লোভ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, মনে পরে প্রতিশোধের কথা। শিহাব সাহেবকে তালাক দেন তিনি, যদিও এটা খুব একটা সহজ ছিলো না কারণ সুইটি বেগম শিহাব সাহেবকে সহ্য না করতে পারলেও শিহাব সাহেব ভীষণ ভালোবাসতেন তাকে। তারপর তিনি সব দোষ শিহাব সাহেবের উপর চাপিয়ে গিয়ে ওঠেন সুহানা বেগমের বাড়ী। আয়ান সাহেব সুইটি বেগমের বানানো সব কথা বিশ্বাস করে থাকতে দেন নিজের বাড়ি। কিন্তু সেই বিশ্বাস চুরমার করে তিনি সুহানা ও আয়ানের সংসারে আগুন লাগাতে থাকেন নিত্য দিনের ঝামেলা লাগাতে থাকেন তাদের সম্পর্কে। যদিও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আয়ান সাহেব কিন্তু সুহানা বেগম টা মানতে মোটেই রাজি ছিলেন না।অবশেষে একদিন সব প্ল্যান করে দুজনের অ্যাক্সিডেন্ট করান। সুহানা বেগম ও আয়ান সাহেবের মৃত্যুর পর তিনি সিয়ামকে নিজের ছেলের মত যত্ন-আত্তি করতেন কারণ একটাই তার সম্পত্তি। আয়ান সাহেব সব সম্পত্তির তার ছেলে ও বউয়ের নামে করে ভাগ করে দিয়েছিলেন। সিয়ামের যেদিন সঠিক বয়স হয় তিনি সিয়ামকে দিয়ে সিয়ামের সম্পত্তির ভাগটা লিখিয়ে নেন। কিন্তু তার দ্বিতীয় দলিলের শর্ত ছিল সিয়ামের মায়ের পরবর্তীকালে যদি কিছু হয় সিয়াম তার মায়ের সম্পত্তির ভাগ নিজের নামে করতে পারবে একটি বয়সের পর।কিন্তু তাকে কিছু নিয়কানুন মানতে হবে। যেমন তাকে পুরো সুস্থ-সবল হয়ে সেই দলিলে স্বাক্ষর করতে হবে। কোনরকম শারীরিক অসুস্থ্তা বা মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সে সাক্ষর করলে সেই সম্পত্তির পুরো ভাগটাই চলে যাবে অনাথআশ্রম বা বৃদধাশ্রমে। সুইটি বেগম ভালোই বুঝেছিলেন দ্বিতীয় উইলটা অনেক ভেবে চিন্তেই বানিয়েছেন আয়ান সাহেব। যাতে পরবর্তীকালে তাদের কিছু হলেও সিয়ামের কোনো ক্ষতি না হয়। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো সেই দলিল সুইটি বেগমের কাছে নেই আছে সিয়ামের কাছে। সিয়ামকে সুইটি বেগম যতবার এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে সিয়াম এড়িয়ে গেছে।
একদিন সুইটি বেগম সিরাজকে সম্পত্তির ব্যাপারটা খুলে বলতে সিয়াম কিছুটা শুনতে পায়। সেই রাতে প্রচুর ড্রিংক করে সে বাড়িও ফেরে না রাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
দুইদিন পর সুইটি বেগমের কাছে হসপিটাল থেকে কল আসে সিয়ামের অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার। সবাই দেখতে গেলে ডাক্তার জানান তার পা দুটি ড্যামেজ হয়ে গেছে।সে আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে কি না ঠিক নেই। সেই কথা শুনে সুইটি বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে এতো দিন সিয়ামকে বাঁচিয়ে রাখার কারণ তার এইভাবে বৃথা যাবে সে ভাবেনি। তাও সিয়ামকে দেশের বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখান সুইটি বেগম যাতে সিয়াম চলতে পারে। কোনো কোনো ডক্টর সিয়ামের ঠিক হওয়ার আশ্বাস দেন তো কোনো কোনো ডাক্তার সারাজীবন না হাঁটতে পারার আশ্বাস দেন। কথায় আছে না “আশাতে বাঁচে চাষা” সুইটি বেগমেরও ঠিক এই অবস্থা এখন।
কিন্তু তার চিন্তা অন্য জায়গায় এতদিন সে সিরাজকে নিজের দলে রেখে অনেক কাজই করিয়ে নিত। কিন্তু সিরাজের হটাৎ কেমন পরিবর্তন সুইটি বেগমের চোখে লাগছে। না এভাবে চলতে দিলে তো চলবে না এইযে এতো সম্পত্তি সবই তার ছেলের জন্য মেয়েকে নিয়ে তার কোনোকালে তেমন মাথাব্যাথা ছিলও না, আজও নেই সম্পত্তির ভাগ চাইলে তাকেও নয় কিছুটা দেওয়া যাবে সম্পত্তি কি আর কম নাকি তার কাছে এখন..? কিন্তু তার আর বাকিটাও চাই। তিনি ঠিক করলেন সিরাজকে ডেকে এবার তার সাথে কথা বলতে হবে। এখনও সেই দলিলের পেপার্স হাতে পাওয়া বাকি তার। এতে তাকে একমাত্র সাহায্য করতে পারে সিরাজ।
___________________________________
বিকেল ৪ টে
চন্দ্রা সবাইকে নিয়ে বেরোলো কিছু কেনাকাটির উদ্দেশ্যে। যদিও সিরাজকে নিয়ে যাওয়ার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। আর তার যা দেখে মনে হলো সিরাজেরও তেমন ইচ্ছে ছিলো না যাওয়ার। কিন্তু সিয়ামের আর সিয়ার জোড়াজুড়িতে তাকেও যেতেই হলো। কিন্তু তারা ঠিক করলো বেশি দুর যাবে না সামনেই কোথাও কেনাকাটা করবে ও ঘুরবে। যদিও সেটা শুধু সিয়ামের জন্যই, তার এই অবস্থায় সব জায়গায় যেতে প্রবলেম হবে তাই চন্দ্রার এইরকম সিদ্ধান্ত। চন্দ্রা ভেবেছে তার এই সিদ্ধান্ত যে শুধু সিয়ামের জন্য তা কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু সবাই ঠিকই বুঝতে পেরেছে। সিয়াম মনে মনে বেশ খুশি হলেও ইন্দ্রা সিয়া ইতিমধ্যে মুচকি মুচকি হাসা শুরু করে দিয়েছে।
মোটামুটি রকম সব কেনাকাটি শেষ করে মেয়েরা ঠিক করলো তারা পাশের পার্কে যাবে। সিরাজ শুধু পর্যবেক্ষন করছিলো চারিদিক এখানে আসা অবধি সে একটা কথাও বলেনি, সিয়ামকে সাহায্য করতেই জানো এসেছে সে শুধু।
পাশের পার্কে যেতেই সিয়া ইন্দ্রা ও সিরাজকে টেনে নিয়ে গেল অন্য দিকে কিছু কথা আছে বলে। যদিও সবই বাহানা চন্দ্রা আর সিয়ামকে কিছুটা সময় একসাথে কাটাতে দেওয়ার এই বুঝে সিরাজ ও ইন্দ্রাও মানা করলো না সিয়াকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায় যখন সিয়ার ফোনে আতিফের কল আসলো আর সে কিছুটা দুর চলে গেলো কথা বলতে।
ইন্দ্রা ভীষণ উসখুশ করছে। সিরাজ কিছুটা হলেও বুঝলো ব্যাপারটা তার নিজেরও কেমন একটা লাগছে। তাও সে নিজেকে সামলে ইন্দ্রাকে বললো “চলুন আমরা গিয়ে ওদিকটায় বেঞ্চে বসি। এখন চন্দ্রা ও সিয়াম এর কাছে ফিরে গেলে খারাপ দেখাবে।” ইন্দ্রা সম্মতি জানালো সিরাজের কোথায় তারপর দুজনে গিয়ে বসলো সামনের দিকের বেঞ্চে।
___________________________
এইদিকে চন্দ্রা সিয়াম ভালোই বুঝেছে তাদের স্পেস দিতেই সবাই প্ল্যান করে অন্য জায়গায় গেছে। তাও দুজনেই চুপ জানো দুজনেরই কেউ কিছুই বোঝেনি। সিয়াম এবার চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চন্দ্রাকে বলল “চন্দ্র হাওয়াই মিঠাই খাবে..?” চন্দ্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল “কেনো আমি কি বাচ্চা নাকি..?” সিয়াম হেসে বললো “কেনো হাওয়াই মিঠাই খেতে গেলে কি বাচ্চা হতে হয়..?” চন্দ্রা মুখ বেঁকিয়ে বলল “না তা নয় তবে আমি কোনো দিন হাওয়াই মিঠাই খাইনি, সবসময় বাচ্চাদেরই দেখেছি খায়।” সিয়াম এবার আকাশ থেকে পড়লো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “সিরিয়াসলি চন্দ্র তুমি ছোটোবেলাতেও কোনোদিন খাওনি..?” চন্দ্রা উত্তর দিলো “না বাবা দিতেন না যদি আমার আর দিভাই এর শরীর খারাপ করে এইসব ভয়ে। কিন্তু দিভাই ঠিকই বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে এটা ওটা খেতো। তবে আমার সে সুযোগ হয়নি তেমন।” সিয়াম আফসোস করে বলল “ইসস চন্দ্র শৈশবকালের দারুন একটা আনন্দ মিস করে গেলে তুমি। তুমি জানো এটাকে ছোটো বেলায় আমরা বুড়ির চুল বলতাম আর স্কুলের সামনে ভ্যানে করে এলেই বড়ো একটা হাওয়াই মিঠাই তৈরি করিয়ে সব বন্ধুরা মিলে ভাগ করে খেতাম।” চন্দ্রার শুনে বেশ মজা লাগলো তারও এবার একবার ট্রাই করার ইচ্ছে হয়েছে খুব মিষ্টি হয় শুনে সে কোনোদিন ট্রাই করার কথাও ভাবেনি। সিয়াম হেসে গিয়ে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দিল। চন্দ্রা সিয়ামকে জিজ্ঞেস করলো “আপনি খাবেন না..?” সিয়াম বললো “নাহ তুমিও খেয়ে দেখ আজ কেমন লাগে” চন্দ্রা তাও শুনলো না তার থেকে কিছুটা নিয়ে সিয়ামের মুখের সামনে ধরলো। এবার কার সাধ্য সিয়ামকে হাওয়াই মিঠাই খাওয়া থেকে আটকায়..?এখন তো তার ডায়াবেটিস থাকলেও সে পুরোটা খেয়ে নেবে। সিয়াম হেসে মুখে নিলো কিছুটা। চন্দ্রা একটু খেয়ে বললো “এ তো খেতে ভীষণ মজা। বলে বাকিটা সে নিজেই খেয়ে নিল।” সিয়াম চন্দ্রার এইরকম বাচ্ছামি দেখে হেসে আরও কতগুলো হাওয়াই মিঠাই কিনে দিল। চন্দ্রার খুশি আর দেখে কে।
#চলবে..?