গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৯
সিয়া ঘড়ি দেখছে আর রাস্তা দেখছে। আতিফ তাকে বলেছিলো দুপুর ১২ টায় কফি হাউসের সামনে দেখা করতে,কিন্তু এখন বাজে ১২:৩৫ । সিয়ার মধ্যে তাও সেইরকম কোনো বিরক্তি দেখা যাচ্ছে না, বরং তার চেয়ে চিন্তায় বেশি ঘামছে সে। সে জানে আতিফ একটা চাকরির জন্য সারাদিন কতো ঘোরে এদিক ওদিক। সিয়া এবার ফোনটা তুলে অতিফের নম্বর ডায়াল করতেই দেখলো সামনে থেকে আতিফ ছুটে ছুটে আসছে। আতিফ এসে সিয়ার সামনে দাড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বলল ” সরি সরি তুই তো জানিস আমি একটু লেট লতিফ। রাগ করিস না প্লিজ। তোর জন্য অনেক গুলো চকলেট….” শেষ করতে দিল না সিয়া একটু রাগী স্বরেই বলল ” রোজ রোজ এক ডায়লগ শুনতে ভালো লাগে না আতিফ ” কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে বলতো আমি..? আতিফ একটু হকচকিয়ে গেল সিয়ার কথা শুনে সিয়াকে খুব কমই রাগতে দেখে সে। সিয়া ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ কিন্তু রেগে গেলে সেই রাগ আতিফও ঠান্ডা করতে পারে না সহজে। এর মধ্যেই সিয়া আবার বলে উঠলো ” অন্তত একবার ফোনটা করে বলে দিলে পারতি যে কাজে আটকে আছি তাই আসতে দেরি হবে কিছুক্ষণ। তুই জানিস না আমার চিন্তা হয় দেখ চিন্তায় কেমন ঘেমে স্নান হয়ে গেছি।” বলে নিজের ডান বাম হাতটা দেখলো আতিফকে। আতিফ এবার আফসোসের সুরে বলে উঠলো ” হয়েছে তো! আর কি করবো বল..?এই মাঝ রাস্তায় কান ধরে ওঠবস করবো..? বল করবো তাই করছি দ্বারা।”
এই বলে সিয়াকে কিছু বলতে না দিয়েই রাস্তায় কান ধরে একবার ওঠবস করতেই সিয়া আসেপাশে তাকালো অনেক মানুষই আগ্রহের সাথে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়া এবার আতিফের হাত ধরে কফি হাউসের ভিতরে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর সব ঠিকঠাক হতেই সিয়া প্রশ্ন করলো আতিফকে ” সবই তো বুঝলাম কিন্তু ছিলি কই তুই এতক্ষণ..? ”
আতিফ কফির কাপে চুমুক দিতেই যাচ্ছিলো সিয়ার কথা শুনে সেটা মুখের কাছ থেকে নামিয়ে আমতা আমতা করে নীচের দিকে তাকিয়ে বলল “ওই একটা বন্ধুর শরীর খারাপ তাই তাকে নিয়ে একটু হসপিটাল গিয়েছিলাম।”
সিয়া এবার চোখ সরু করে তাকিয়ে বললো ” তা এমনি মাথা নীচু করে মিনমিন করে বলার কি আছে..?আমি কি তোকে খেয়ে ফেলতাম নাকি এটা শুনলে..?” আতিফ কিছু না বলে শুকনো হাসলো শুধু কিন্তু কিছু বললো না।
____________________________
চন্দ্রা স্নান সেরে বাগানে এসে পায়চারি করছিলো আর নানা রকমের ফুলগুলিকে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। এই কাজ ভারী পছন্দের চন্দ্রার, হুটহাট পছন্দ হলেই সেই ফুলটি তুলে নেওয়া একদম পছন্দনা তার। চন্দ্রার নিজের বাড়িতেও এতো না হলেও বেশ অনেকগুলো ফুলের গাছ ছিল। আসে পাশের বাচ্চারা চন্দ্রার ভয়ে সেগুলিতে হাত দিতে পারতো না। চন্দ্রা যখন বাড়িতে থাকতো না তারা চুপিচুপি এসে একটা দুটো করে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যেত। যদিও চন্দ্রা প্রত্যেকবারই ধরে ফেলত তারপর তাদের বকুনিও দিতো তবু তারা এই কাজ করতো। চন্দ্রা এইসব মনে করতে করতে আনমনে হেসে ফেললো। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো কিছুটা দূরে সিয়াম তার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে তে।
চন্দ্রা এবার সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল ” কি দেখছেন ওমন করে..? ”
সিয়াম একই ভাবে তাকিয়ে উত্তর দিলো ” আমার ফুলকে ” সিয়া স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল ” কিন্তু আমি তো দেখলাম আপনি তো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ”
সিয়াম হালকা হেসে উত্তর দেয় ” আমি আমার ফুলকেই দেখছিলাম চন্দ্র মনের চোখ দিয়ে দেখলে আপনিও আমার মত দেখতে পেতেন। ”
চন্দ্রা সিয়ামের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না একটা ফুলের সামনে গিয়ে বলল ” এই ফুলটা দেখুন এটি বোধহয় এই বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুল ”
সিয়াম আনমনে বলে উঠলো ” নাহ্ আমার চোখে আমার ফুলটিই সবচেয়ে সুন্দর শুধু পুরো বাগানে না, পুরো পৃথিবীর মধ্যেই তার মতো নিষ্পাপ পবিত্র ফুল আমি কোথাও দেখিনি।”
চন্দ্রা সিয়ামের পুরো কথা না শুনলেও কিছু কথা তার কানে এলো। এবার সে ব্যাকুল হলো সেই ফুলটিকে দেখার জন্য সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল ” আমিও দেখতে চাই আপনার সেই ফুলকে। দেখান না কোথায় আছে ” বলে এইপাশ ওইপাশ দেখতে লাগলো।
সিয়াম এবার পড়লো মহা মুশকিলে এই জন্য সে জোরে কথাটা বলতে চায়নি। তাও চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য বলল ” চন্দ্র সেই ফুলের মালিক আমি ঠিকই…কিন্তু সেই ফুলের উপর এখনও কোনো অধিকার নেই আমার । যেদিন সেই ফুলের উপর সমস্ত অধিকার আমার থাকবে সেই দিন নিশ্চই দেখবো আপনাকে।” এখন চলুন দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। চন্দ্রা এবার কিছু না বলে খানিকটা মুখ ফুলিয়েই সিয়ামের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। সিয়াম বুঝতে পারলো চন্দ্রার অভিমান হয়েছে। সিয়াম কিছু একটা ভেবে চলে গেলো লাঞ্চ সারতে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই চন্দ্রা ঘরে এসে দেখলো সিয়াম ফোন নিয়ে কিছু করছে। তাই সেও ব্যাস্ততা দেখানোর জন্য আলমারিতে জামাকাপড় গুলো ঠিকঠাক করতে লাগলো।
চন্দ্রার অভিমান হয়েছে ঠিকই। তাকে না বন্ধু বলেছে সিয়াম অথচ একটা ফুল গাছ তাকে দেখাতে পারছে না। এ কেমন বন্ধুত্ব তার..?তারমানে নিশ্চই সে চন্দ্রাকে বন্ধু ভাবতে পারেনি এখনো। এই অভিমান না চন্দ্রা দেখাতে চাইছে আর না নিজে সইতে পারছে। তাই ঠিক করেছে সে বেশি কথা বলবেনা সিয়ামের সাথে সে যতক্ষণ না নিজে থেকে সিয়াম বোঝে যদিও বুঝবে এই আশাও নেই তার। তার মন যে কি চায় মুহুর্তে তা সে নিজেও বুঝতে অক্ষম।
সিয়াম চন্দ্রার গাল ফোলানো মুখ দেখে ফোনটা পাশে রেখে আলতো স্বরে ডাকল ” চন্দ্র ” চন্দ্রার কোনো হেলদোল দেখা গেলো না সে আগের মতই কাজ করে যাচ্ছে । সিয়াম আর এক-দুইবার ডাকল চন্দ্রার নাম ধরে তখনও যখন চন্দ্রা সারা দিলো না।
সিয়াম এবার গলার স্বর নীচে নামিয়ে একটু ঘোর মিশিয়ে ডাকলো ” চন্দ্রাবতী “।
চন্দ্রার হাতটা থেমে গেলো কাপড়ের ভাঁজেই। যতবার সে এই ডাকটা শোনে ততবারই একই অনুভূতি হয়। শরীরের শিরায় শিরায় কাঁপন ধরে, কেনো তার এইরকম অনুভূতি হয় সে নিজেও জানে না। এই ডাক জানো কাউকে মনে করিয়ে দেয়।
চন্দ্রা এবার সিয়ামের দিকে ফিরে বললো ” বারণ করেছিলাম না এই নামে ডাকবেন না আমায়। ”
সিয়াম এবার গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বলল ” আমি কি করতাম আপনাকে তো নাম ধরেই ডাকছিলাম আপনি তো সাড়া দেননি। তাই দায়ে পরে এই পথ টাই বাছতে হলো আমায়, আর আপনিও দেখুন কি সুন্দর সাড়া দিলেন।”
চন্দ্রা একটু রাগী চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললো ” তা এতবার করে ডাকার কি হয়েছে শুনি একটু ”
সিয়াম হাফ ছেড়ে বললো ” বলছি আগে আপনি সোফায় এসে বসুন তো লক্ষী মেয়ের মতো” চন্দ্রা কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না বরং তার অভিমানী মন করতে দিলো না তাই সে চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসল।
সিয়াম এবার আলমারি থেকে একটা ব্যাগ এনে চন্দ্রার হাতে দিলো। চন্দ্রা অবাক হয়ে সিয়ামকে জিজ্ঞেস করলো ” কি আছে এতে..? আর আমাকে কোনো দিচ্ছেন..? ”
সিয়াম বলল ” আপনার জন্যই ওইটা তাই খুলে দেখুন কি আছে।” চন্দ্রা এবার ব্যাগ থেকে জিনিসটি বের করতেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। ব্যাগে ছিলো হুমায়ূন আহমেদের কিছু গল্প সমগ্র।
চন্দ্রার খুশি তার মুখ চোখে দেখা যাচ্ছে।
সিয়ামের ও যেনো ভীষণ ভালো লাগছে চন্দ্রার এই হাসি মুখ দেখে।সে ঠিক করলো মাঝে মাঝেই চন্দ্রাকে একটু রাগিয়ে দেবে তারপর সে এইরকম উপহার নিয়ে এসে রাগ ভাঙাবে শুধু চন্দ্রার এই নিষ্পাপ হাসি মুখটা দেখার জন্য।
চন্দ্রা উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলো “আপনি কি করে জানলেন আমি গল্প পড়তে ভালোবাসি…?”
সিয়াম হেসে বললো ” আপনার দিনে বেশির ভাগ সময়ই গল্পের বই নিয়ে বসে থাকা দেখে।”
চন্দ্রা এবার সব রাগ ভুলে বললো ” অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি বলে বোঝাতে পারবো না আমি কতটা পরিমাণ খুশি হয়েছি। ”
সিয়াম বলল ” ধন্যবাদ দিতে হবে না, এর বদলে একটা জিনিস চাইবো দেবেন..?”
চন্দ্রা এবার ভাবুক ভাবে বললো ” আমার কাছে তো দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তাও বলুন আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে নিশ্চই দেবো।”
সিয়াম হেসেই বললো ” হ্যাঁ ম্যাডাম আপনার সাধ্যের মধ্যেই চাইছি। আচ্ছা আমরা তো একে অপরকে বন্ধু বলি তাইতো…?” চন্দ্রা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল।
সিয়াম এবার বললো ” বন্ধুরা কি কেউ আপনি আপনি করে কথা বলে একে ওপরকে তাই আমি চাই আমরা এবার দুজন দুজনকে তুমি করেই সম্বোধন করব। ব্যাস এইটুকুই চাই দিতে পারবেন..?”
চন্দ্রা এবার খানিকটা ভেবে উত্তর দিল ” আচ্ছা, কিন্তু এটা তো আর এক দিনে সম্ভব নয়, তাও আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করবো।”
সিয়াম বললো “চেষ্টা করলেই হবে।আমি জানি অভ্যাস বদলাতে একটু সময় লাগে।”
চন্দ্রা হেসে বই গুলো নিয়ে সোফা থেকে উঠতে যেতেই সিয়াম বলে উঠলো “আরেকটা জিনিস চন্দ্র।” বলে আলমারি থেকে গিয়ে একটি বক্স বের করে চন্দ্রার সামনে আনলো। চন্দ্রা বক্সটা দেখে সিয়ামকে জিজ্ঞেস করলো ” এটায় কি আছে..?” সিয়াম বক্সটা খুলে দুই জোড়া বলা বের করে বলল “এটা আমার মায়ের বালা। এই বালা দুটো আমার ভীষণ পছন্দের ছিলো ছোটো থেকেই , তাই মা বলত যখন আমার বউ আসবে তখন জানো আমি এই বালা জোড়া তাকে দিই।” চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “কিন্তু আমাকে..?” সিয়াম হেসে বালা দুটো নিয়ে চন্দ্রার হাতে দিয়ে বলল “ডিভোর্স না হওয়া অবধি তো আপনিই আমার বউ। তাই আপনাকেই দিলাম, ডিভোর্স হলে নাহয় আমায় আবার ফিরত দিয়ে যাবেন। কিন্তু এ বাড়িতে যতদিন আমার কাছে আছেন ততোদিন এই বালাটা সাবধানে হতে রাখবেন।” চন্দ্রা শুধু মাথা নাড়িয়ে বালা জোড়া নিলো পড়ার জন্য। সিয়ামের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে একটু খারাপ লেগেছে তার।কেনো লেগেছে সে নিজেও জানে না। এসব ভাবতে ভাবতে বালা জোড়া পড়তে গিয়ে চন্দ্রা দেখলো বালাটা তার হাতে ঢুকছে না। সে সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল ” বালা জোড়া মনে হয় আমার হাতের মাপের চেয়ে ছোটো বুঝলেন, তাই হচ্ছে না।”
সিয়াম হাত বাড়িয়ে বলল ” কই দেখি আমাকে দিন আমি পরিয়ে দিচ্ছি।” চন্দ্রা বললো ” হুম চেষ্টা করে দেখুন হবে বলে মনে হয় না। ”
সিয়াম বালা জোড়া হাতে নিয়ে চন্দ্রার ডান হাতটা নিজের হাতে নিল। চন্দ্রা সিয়ামের হাতের স্পর্শে কেমন কেঁপে উঠল। এই প্রথম কোনো পুরুষ তাকে স্পর্শ করলো। আচ্ছা প্রথম বলা যায় কি সেই পাহাড়ি অঞ্চলে…” ভাবতে ভাবতেই আলতো চাপ পড়লো চন্দ্রার হাতে, চন্দ্রা তাকিয়ে দেখলো বালা জোড়া সুন্দর ভাবে ঢুকে গেছে তার দুই হাতে ।তেমন কোনো ব্যাথাও লাগেনি।” চন্দ্রা এবার লাজুক ভঙ্গিতে বালা জোড়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। যদিও সেসব কিছুই নয় একটা মেয়ে হয়ে সে বালা পড়তে পারলো না এটা তার কাছে ভীষণ লজ্জার ঠেকছে তাই মুখ লুকোতে এসব।
সিয়াম এবার চন্দ্রকে প্রশ্ন করলো ” আপনি চুড়ি একদম পড়েন না তাই না..? ” চন্দ্রা এবার খানিকটা মুখ তুলেই বলল ” নাহ্ আমার খুব একটা পছন্দের নয় চুড়ি। আমি জানি আপনি হয়তো ভাববেন মেয়ে হয়ে চুড়ি পছন্দ নয় এ আবার কেমন কথা। তাও আমার ঠিক পছন্দের নয় কারণ আমি হাতে বেশিক্ষণ রাখতে পারি না হাত উসখুশ করে। তবে আপনি যেহেতু এটা খুলতে বারণ করেছেন আমি খুলবো না।”
সিয়াম চন্দ্রার কথা শুনে বেশ খুশি হলো। সেও নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সম্পর্কটার উপর এবার যা হবে সব উপরওয়ালার হাতে।
#চলবে..?