গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৮
শরৎকালের সকাল। আকাশ যেনো পেঁজা তুলার মতো মেঘে ছেয়ে আছে। চন্দ্রা সিয়ামের উপরের রুমের বড়ো ব্যালকনির দোলনটাতে বসে নিজের ফোনে পুরনো সব ছবি দেখছে। কতো স্বপ্ন কতো আশা অথচ সময়ের পরিবর্তনে আজ সবই স্মৃতি। চন্দ্রার বাড়ির পাশেই তার একটা ছোটো ক্যারাটে স্কুল ছিল। সেখানে চন্দ্রা ও তার চেনা পরিচিত এক ভাইয়া ক্যারাটে শেখাতো ছোট ছোট বাচ্চাদের। সেই স্কুলটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল চন্দ্রার। এখন কি অবস্থা সেদিকের সেটা ভেবেই দীর্ঘনিশ্বাস বেড়িয়ে এলো চন্দ্রার। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল শুধু।
ফোনের ভাইব্রেশনে ফোনের দিকে দেখতেই একটা নাম জ্বলজ্বল করে ওঠে স্ক্রিনে ” পাপা “।
চন্দ্রার অভিমানটা আরো গাঢ় হয়ে আসে। ফোন টা কেটে দেবে দেবে করেও ধরল সে কিন্তু কোনপ্রকার কথাই বললো না।ওপাশ থেকে চন্দ্রার বাবা বলে উঠেন ” এখনো রেগে আছিস মা..?”
চন্দ্রার এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে সে চেঁচিয়ে বলে ওঠে “তো খুব আনন্দ হওয়ার কথা আমার..? এমন কি শত্রুতা ছিলো পাপা আমার সাথে তোমার এভাবে সত্যটা লুকিয়ে কেনো বিয়েটা দিলে..? একবারও জানতে পারলে না আমায়..?তুমি একবার আবদার করলেই আমি নিজেই হাসতে হাসতে বিয়ে করে নিতাম ওনাকে। কিন্তু এভাবে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে..” পুরো কথা শেষ করতে পারলো না চন্দ্রা তার আগেই কান্নায় ভেংগে পড়লো।”
চন্দ্রার বাবা নরম সুরে বললেন ” আমার কথাটা একবার শোন মা। আমি সত্যি জানতাম না রে এই বিষয়ে তুই জানিস না। তুইতো জানিস বিয়ের আগের দিন অবধি আমি বাইরে ছিলাম দেশের। সব দায়িত্ত্ব ছিলো তোর মামা – মামীর ঘাড়ে। তারা আমায় বলেছিলো তোর নাকি বিয়েতে সম্পূর্ণ মত আছে, তবেই না আমি হ্যাঁ করেছিলাম এই বিয়েতে। আর তোকে যখন জিজ্ঞেস করলাম তুইও তো নিশ্চুপ ছিলি তাই আমিও ভেবে নিয়েছিলাম তুই রাজি এই বিয়েতে।”
চন্দ্রা কান্নারত অবস্থায় বলল ” হ্যাঁ আমি রাজি ছিলাম কিন্তু সেটা শুধুই তার ছবি দেখে এবং তিনি একজন বিজনেসম্যান এইটুকু জেনে। এর বাইরে তো আমাকে আর কোন ইনফরমেশনই দেয়া হয়নি। আর তুমিই বা এই বিয়েতে সম্মতি দিলে কীকরে বাবা..?”
চন্দ্রার বাবা চয়ন সাহেব এবার খানিকটা চুপ করে রইলেন তারপর বললেন ” কেমন আছিস তুই..?ওখানে অসুবিধা হচ্ছেনা তো..? হলে আমায় জানাবি। আর জামাইকে নিয়ে আয় আমাদের বাড়ি একদিন। ”
চন্দ্রার মনে হলো তার পাপা তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। সেসব ছেড়ে চন্দ্রা বলল ” ভালো আছি পাপা। তুমি কেমন আছো..? আর আমি দেখছি তোমার জামাইকে বলে কবে তিনি ফাঁকা থাকেন তোমায় জানিয়ে দেবো কোনো।”
চয়ন সাহেব ওপাশ থেকে বললেন ” আমিও ভালো রে মা। আর একটা কথা বলি শোন। বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তুই একটু মানিয়ে নিয়ে চলিস কেমন। সিয়াম ছেলেটা খুব ভালো রে।”
চন্দ্রা কিছু বলতে পারলো না ” হুম ” ছাড়া। তার মনের অবস্থা সে একাই জানে। সিয়ামকে সে মেনে নিত যদি তাকে বিয়ের আগেই এইগুলো জানানো হত। কিন্তু এখন ভীষণ জড়তা কাজ করে হয়তো প্রথম রাতের এতবড়ো শক আর তার খারাপ ব্যাবহারের জন্যই এইটা।
আরও টুকটাক কথা বলে রেখে দিল চন্দ্রা ফোন।
এই দ্বিতীয় বার চন্দ্রা তার বাবাকে এতো সুন্দর করে কথা বলতে দেখলো তার সাথে। চন্দ্রার মায়ের মৃত্যু হয় চন্দ্রার জন্মের সময়। তখন থেকেই তার দুই মেয়ে চন্দ্রা আর ইন্দ্রাকে নিজের হাতে বড়ো করেছেন চয়ন সাহেব। তিনি মেয়েদের সব ইচ্ছে পূরণ করলেও তিনি ছিলেন ভীষণ কঠিন।দুই মেয়েই তাকে বেশ ভয় পেত। ইন্দ্রা ছিলো চন্দ্রার চার বছরের বড়ো। মা মারা যাওয়ার পর সেই জানো চন্দ্রার মা হয়ে উঠেছিল। চন্দ্রার শুধু আফশোস হয় এক জায়গায় তার ওতো সুন্দর গুণসম্পন্ন দিদিটা পড়লো এক খারাপ লম্পট ছেলের প্রেমে। যার বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই করতে হারালো নিজের বাবাকেই। বাবা ত্যাজ্য কন্যা করলো তাকে। কিন্তু চন্দ্রা তার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে এখনো কথা বলে সে জানে বাবা কথা না বললেও ভীষণ কষ্ট হয় তারও।
তার মনের মধ্যে এখন এটাই চলছে আজ তার যদি মা বেচেঁ থাকতো তাহলে হয়তো এগুলো হতে দিত না।
তার বিয়েটাও কেমন অদ্ভুত রকম ভাবে হয়েছিল।বিয়ের সময় বরকে দেখতে দেওয়া হয়নি এমনকি বিয়ের সময় মোটা পর্দা লাগানো হয়েছিল সামনে। জিজ্ঞেস করায় সুইটি বেগম বলেছিলেন এটা তাদের বংশগত নিয়ম। চন্দ্রা আর কথা বাড়ায়নি। এমনকি গাড়িতে ওঠার সময়ও সিয়াম আগেই বসে ছিল গাড়িতে নামার সময় সুইটি বেগম তাড়াতাড়ি করে সিয়ামের আগেই গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে বাসর ঘরের জন্যে। চন্দ্রা কেনো জানি কিছু মেলাতে পারছে না সব ঘটনা গুলো কেমন জানি অদ্ভুত।
________________________________
সন্ধ্যে ৬ টা
সিয়াম বাসায় ফিরে দেখলো চন্দ্রা বই বুকের উপর রেখে তার নিচের রুমের বেডের পাশে সোফায় ঘুমিয়ে আছে। সিয়ামের প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল মুখে। এতো প্রশান্তি এই তিন বছরে বোধহয় কোনো কাজেই পায়নি। যা সে এখন ক্লান্ত হয়ে ফেরার পর চন্দ্রার এই ঘুমন্ত মুখ দেখে পাচ্ছে।
সিয়াম চন্দ্রাকে কিছুক্ষণ দেখে ফ্রেশ হয়ে কিচেন থেকে নিজেই এক কাপ কফি আনলো।
সিয়ামের বাকি কোম্পানির কাজ গুলো সারার জন্য ল্যাপটপটা খুঁজতেই দেখলো ল্যাপটপের ব্যাগটা সোফায় চন্দ্রার মাথার কোন পড়ে। সিয়াম চন্দ্রার কাছাকাছি গিয়ে আসতে আসতে ব্যাগ টা নেওয়ার চেষ্টা করছিল আর মনে মনে দোয়া করছিলো যাতে চন্দ্রার ঘুম না ভেঙ্গে যায়। সিয়াম যেই ব্যাগটা নিতে হালকা জোরে টান দিল। ওমনি চন্দ্রা সিয়ামের সব দোয়ায় জল ঢেলে চোখ খুললো।
সিয়াম তখন ঝুঁকেই ছিলো কিছুটা চন্দ্রার দিকে ফলে চোখ খুলেই সিয়ামকে একদম কাছে পেলো তার। কয়েক মিনিটের জন্য থমকে গেলো দুজনেই। সিয়াম এতো সামনে থাকায় তার শরীর থেকে এক তীব্র এক পুরুষালী গন্ধ এসে চন্দ্রার নাকে ঠেকছে তাতে ঘোর লেগে যাচ্ছে তারও। সিয়াম এবার নিজেকে সামলিয়ে কিছুটা সরে এসে গলাটা হালকা ঝরলো।
চন্দ্রা নিজেও বেশ লজ্জা পেয়ে উঠে বসে কানের পিঠে চুল গুজলো।
সিয়ামই এবার অস্বস্তি ভাবটা কাটাতে বলল ” সরি চন্দ্র আমার জন্য আপনার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।”
চন্দ্রা এবার ইতস্তত করে বলল ” আরে না না ইটস ওকে, আপনি এসেগেছেন আমি একটুও টের পাইনি। আপনি ডাকলেন না কেনো..? আর আপনি কফি খাবেন..?”
সিয়াম হেসে বলল ” আপনি এতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন তাই আর ভাঙ্গতে চাইনি আর আমি নিজেই নিজেই কফি নিয়ে খেয়ে নিয়েছি , আসলে কিছু কাজ বাকি আছে ল্যাপটপে। আপনি যান ফ্রেশ হয়ে আপনার কফিটা নিয়ে আসুন আমি ততক্ষণে কাজ শেষ করে নি। তারপর একসাথে বসে আরেককাপ কফি খাবো নয় আপনার সাথে। ”
চন্দ্রা হালকা হেসে বলল ” আচ্ছা “। সে যতটা সম্ভব জড়তা কাটানোর চেষ্টা করছে সিয়ামের সাথে একজন সাধারণ বন্ধুর মতো মেশার চেষ্টা করছে।
চন্দ্রা কিচেনে কফি নিতে গিয়ে হঠাৎই খেয়াল এলো সিয়াম যখন তার ওতো কাছে ছিলো তখন চন্দ্রার কেনো যেনো মনে হচ্ছিল এই মুখ চোখ সে আগেও দেখেছে কোথাও।চন্দ্রা মাথায় জোর দিয়েও মনে করতে পারলনা কিছু নাহ এটাও মনেরই ভুল নাহলে সে তো আগেও সিয়ামকে দেখেছে এইরকম তো কিছু মনে হয়নি তার।
#চলবে..?