গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৭
চন্দ্রা হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে বলল “না না কি দেখতে কি দেখেছি কে জানে সব আমার মনের ভুল ওনার পা নড়বে কীকরে তুইও না চন্দ্রা।”
মেহমানরা ভীষণ প্রশংসা করলো চায়ের। চন্দ্রা হেসে মনে মনে সিয়ামকে অনেক ধন্যবাদ দিলো। সিয়ামকে দেখেও মনে হলো সে চন্দ্রার থেকেও বেশী খুশি হয়েছে চন্দ্রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখে।
__________________________
দুপুর ২ টা
মেহমানরা সবাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে রওনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরী হলো। সুইটি বেগমও গেলেন তাদের সাথে তাদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে।
ইতিমধ্যে সিয়াম সিয়া দুজনের খাওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। মেহমানরা জোর করে তাদের দুজনকে তাদের সাথেই বসিয়েছেন। সিয়াম বসতে চাইছিল না সুইটি বেগম জোর করে বসিয়েছেন। সুইটি বেগমও একসাথেই খেয়ে নিয়েছেন মেহমানদের ছাড়তে যাবেন বলে। এখন বাকি শুধু চন্দ্রা সবাই চন্দ্রকেও বলেছিল বসার জন্যে কিন্তু চন্দ্রা না করে দিয়েছে সবাই বসে পড়লে পরিবেশনের দিকে দেখবে কে..? তার উপর সে আবার নতুন বউ এখন মেহমানরা হাসি মুখে কথা বললেও পিছনে ঠিকই তার এই আগে বসে খেয়ে নেওয়া নিয়ে কথা শোনাবেন।
সবশেষে চন্দ্রা রান্নাঘরটা গোছগাছ করে যেই খাবারের টেবিলের সামনে এসে কোমড় থেকে আঁচলটা খুলে যেই বসতে যাবে সামনে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো “ওভাবেই বেশি ভালো লাগছে জান। দিন দিন হট হয়ে যাচ্ছ বুঝলে তা রহস্য কি..? ভাই কি একটু বেশি আদর দিয়ে ফেলছে..?” শেষ কথাটা বেশ কিছুটা সুর টেনেই বলল সিরাজ।
চন্দ্রার রাগে গা জ্বলে উঠলো রক্তচক্ষু নিয়ে বলল “জানোয়ার জানোয়ারই থেকে গেলি, মেয়েদের কোনোদিন সম্মান না আগে জানতিস না এখন জানিস”
সিরাজ বাঁকা হেসে কিছু বলতে নিলেই সেখানে সিয়া উপস্থিত হয়। সিরাজ তাকে দেখে কথার টোন পাল্টে বলে “আরে ভাবী খেতে দেন। আর কতক্ষন ওয়েট করা লাগবে..?আমার কি ক্ষুদা পায়না নাকি..?”
চন্দ্রার হালকা খটকা লাগে সে পিছন ঘুরে দেখেতেই দেখে সিয়া দাড়িয়ে।চন্দ্রা এবার বুঝতে পারে সিরাজের পাল্টি খাওয়ার কারণ।
চন্দ্রা সিয়াকে জিজ্ঞাসা করে “আপু কিছু লাগবে আপনার..?”
সিয়া বলে “নাহ্ তেমন কিছুনা তুমি একা একা খাবে তাই সিয়াম ভাইয়া বলল তোমার কাছে গিয়ে যেনো বসি। ভাইয়া ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছে নইলে সেই আসতো।” বলে সিয়া চন্দ্রার পাশের চেয়ারে বসে ফোন টিপতে লাগলো।
চন্দ্রা মনে মনে উপরওয়ালা কে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে চন্দ্রা ঘরে এসে দেখে সিয়াম কাজ নিয়ে ব্যাস্ত।তাই সিয়ামকে আর না ডিস্টার্ব করে চন্দ্রা চলে যায় তার মন ভালো করার জায়গায়।
বাগানে এসে চন্দ্রা বেঞ্চে বসে ভাবতে থাকে তার আর সিরাজের প্রথম আলাপের দিন গুলো…
_____________________________
চন্দ্রা তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সবসময় হাসি আড্ডা ঘুরতে যাওয়া এই সব নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো সে। কিন্তু ঘটনার সূত্রপাত হয় নবীন বরণের দিন সে দিন চন্দ্রা নীল রঙের শাড়ি পরে গিয়েছিলো কলেজে। কলেজ গেটে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এক নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা ছেলের সাথে ধাক্কা লেগেছিল তার। আর সেই মানুষটিই ছিলো সিরাজ। ধাক্কা লাগার পরও কয়েক সেকেন্ড দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সিরাজ মাথা চুলকে মুচকি হাসি হেসে ” সরি ” বলে চলে গিয়েছিল।
সিরাজ ছিলো চন্দ্রার দুই ক্লাস সিনিয়র। দেখতে শুনতে কোনদিক থেকেই খারাপ ছিল না সে। চন্দ্রার সব বন্ধু-বান্ধবীদের প্রেম করা দেখে তারও কিশোরী মনে সখ জেগেছিল প্রেম করার। চন্দ্রার বন্ধুরা সেই শুনে সর্বপ্রথম সিরাজের নামই নিয়েছিল।তারা বুঝতে পেরেছিল কোথাও না কোথাও সিয়ার বেশ লাগে সিরাজকে। চন্দ্রার হয়ে তার বান্ধবীরাই সিরাজের কাছে প্রস্তাব রেখেছিল চন্দ্রার জন্য।
সিরাজ হেসে বলে বলেছিল ” যার জন্যে বলতে এসেছো তোমরা…কই তাকে তো কোথাও দেখছি না..?সে নিজে যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তবেই এই প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করবো আমি”
এই কথা শুনে চন্দ্রার বান্ধবীরা চন্দ্রাকে আড়াল থেকে টেনে বের করে এনে সিরাজের সামনে দাড় করিয়েছিলো। সিরাজ এই অবস্থা দেখে হেসে চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করেছিল “ওরা যা বলছে তা কি সত্যি..?পছন্দ করো আমায়..?”
চন্দ্রা লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। চন্দ্রাকে কিছু বলতে না দেখে সিরাজ নিজেই বলল ” চুপ থাকা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ”। চন্দ্রা লাজুক হেসে মুখটা আকাশের দিকে করে নিয়েছিল। সেই দেখে সিরাজও মুখটা আকাশের দিকে করে রেলিং ধরে বলেছিলো “আমারও তোমায় ভীষণ ভালো লাগে জানো চন্দ্রা, সেই প্রথম দিন থেকে। আজ তুমি না বললেও কোন না কোনোদিন আমি নিজেই তোমায় আমার মনের কথা বলতাম।”
এভাবেই চলতে থাকলো সময় দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল তাদের প্রেমের। চন্দ্রা যখন সিরাজের বন্ধুমহলের সাথে পরিচিত হলো তখন সিরাজের ব্যাপারে বিভিন্ন কথাই তার কানে আসতো যেমন সিরাজের চরিত্রে সমস্যা আছে। সে অনেকের সাথে রাত কাটিয়েছে। এরাম অনেক কিছু তবে চন্দ্রা এসব এড়িয়ে চলত কারণ সিরাজের হাবভাবে সেইরকম কখনোই কিছু প্রকাশ পায়নি। তিন মাসের রিলেশনশিপে সিরাজ চন্দ্রার হাত টাও ধরেনি এমনকি চন্দ্রা বায়না করলেও না। তাই চন্দ্রা চেয়েও মানুষটিকে সন্দেহ করতে পারতো না।
সত্য টা চন্দ্রার সামনে তখন এলো যখন তারই এক কাছের বান্ধবী কাঁদতে কাঁদতে রাত ৮ টায় তার বাড়ি এলো। তার অবস্থা ছিল জীর্ণশীর্ণ, কাপড়ের অবস্থা খুবই খারাপ। চন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে শান্ত করিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলো তার এরকম দশার কারণ কি..? তখনই সে বললো তাদের ক্লোজ একজনের পার্টিতে গিয়েছিলো সে। সেখানে সিরাজ ও তার বন্ধুরাও উপস্থিত ছিল। সিরাজ অতিরিক্ত ড্রিংক করায় নিজের হুশ হাড়িয়ে ফেলেছিল আর সামনে তাকে পাওয়ায় তারই হাত ধরে টেনে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে অসভ্যতামী করার চেষ্টা করেছিল। জোরে গান বাজার দরুন কেউই কোনো টের পায়নি। সিরাজ নেশায় থাকায় তাকে জোরে ধাক্কা দিতেই সে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়েছিল। আর সেই সুযোগে সে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে এসেছে। চন্দ্রার বাড়িটা বেশি দূর নয় সেখান থেকে তাই দৌড়ে সে এই অবস্থায় চন্দ্রার বাড়িতেই এসেছে।
চন্দ্রা প্রথম বিশ্বাস না করতে চাইলেও মেয়েটির কিছু তাদের সাথে গ্রুপ পিক আর ভিডিওর সাউন্ড শুনে বুঝে গিয়েছিল সেটা সিরাজ। যদিও ভিডিওতে কিছু দেখা যায়নি তেমন শুধু খাপছাড়া খাপছাড়া ভয়েস ছাড়া। গানের জন্য সেটিও পরিষ্কার নয়। কিন্তু যতটুকু ছিলো চন্দ্রার বিশ্বাস ভাঙার জন্য যথেষ্ট ছিল।
সেইরাতে চন্দ্রা সারারাত জেগে ছিল। সারারাত শাওয়ার নিয়ে ভিজে জামায় বসেছিল নিজের ঘরে। সকালে চন্দ্রার বাবা চন্দ্রকে ডাকতে গিয়ে তাকে জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন মেঝেতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডক্টরকে ফোন করে আসতে বলেন। টানা একসপ্তাহ ভুগেছিলেন চন্দ্রা সেই ভয়ংকর জ্বরে। চন্দ্রা প্রথম তার বাবাকে তার জন্য কাঁদতে দেখেছিল তার অসুস্থতায়। চন্দ্রার নিজেরই মনের অবস্থা ভালো না থাকায় বাবার সাথে তেমন খুলে কথাও বলতে পারেনি।
সিরাজ অনেকবার ফোন দিয়েছিল এর মধ্যে কিন্তু চন্দ্রা ধরেনি। টানা এক সপ্তাহের পর কলেজে গিয়ে সিরাজকে সব প্রমাণ সহ দেখিয়ে তার সাথে ব্রেকআপ করেছিল। এতে সিরাজ ভীষণ পরিমাণে রেগে গিয়েছিলো তার দাবী সে যার সাথে যা খুশি করুক চন্দ্রার সাথে তো করেনি। তার তো হাত পর্যন্ত ধরেনি তাহলে ব্রেকআপের মানে কি..?সে বোধহয় ভুলে গিয়েছিল “এক মাঘে শীত যায় না “। চন্দ্রা আর কথা বাড়ায়নি সিরাজকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে, সেই মেয়েটিকে থানায় কেশ করতে বলে সেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল।তারপর চার বছর তার আর সিরাজের দেখা হয়নি। মাঝে শুনেছিল সে থানায়ও গেছে কিন্তু পয়সার জোরে বেচেঁ গেছে। চন্দ্রা এই সিরাজ নামক অভিশাপ টাকে জীবন থেকে ভুলতে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন খন্ডায় কে..? যার মুখ সে জীবনে দর্শন করতে চায়নি এখন দায়ে পরে তাকেই দিন রাত চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে।
সিয়ামের আওয়াজ কানে আসতেই পুরোনো দিনের কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলো চন্দ্রা। তাড়াহুড়ো করে উঠে গেলো সিয়ামের রুমে। গিয়ে দেখলো সিয়াম হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে।
চন্দ্রা যেতেই সিয়াম বলল “ফোন টা কাছে রাখবেন না চন্দ্র..? দেখুন তো আপনার মামা কতবার কল দিয়েছে। আমি ধরতে গিয়েই কেটে গেলো।এখন একবার করবো কলব্যাক..?”
চন্দ্রা পড়িমড়ি করে সিয়ামের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল “না না আমি করে নেবো পরে”
সিয়ামের কেমন খটকা লাগলো চন্দ্রার ব্যাবহারে টাও কিছু বললো না সে।
_______________________________
সিয়া বসে আছে কফিহাউসে আর বার বার ঘড়ি দেখছে। এবার তার ভীষণ বিরক্তি লাগছে।সে চলে যাওয়ার জন্য উঠতে গেলেই। সামনের চেয়ারে একটা ছেলে ধপ করে এসে বসে বলতে লাগলো “সরি সরি সরি…! তুইতো জানিস বল আমি একটু লেট লতিফ।এখন রাগ করিস না প্লিজ..আমি তোকে অনেকগুলো চকলেট আইসক্রিম কিনে দেবো তারপর মাথায় কাঁচা ফুল লাগিয়ে রিকশায় করে সারা ঢাকা ঘুরাবো প্রমিস। সিয়া এই কথা প্রায় একশবার শুনে ফেলেছে টাও যতবারই শোনে ততবারই রাগ ভুলে হেসে দেয়। সিয়া ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বের করে সামনে রেখে বললো “ওইসব কিছু লাগবে না আপাতত তুই চাকরিটা জোগাড় কর আতিফ।মা ঘর থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।আর তুইতো জানিস ঘরে আমার অবস্থা। মা বেশিদিন রাখতে চায়না আমায়। শুধু সিয়াম ভাইয়া আছে বলে রক্ষে নয়তো কবেই কার সাথে….”
আতিফ সিয়ার কথা মাঝে কেটে বললো “আহঃ সিয়া থাক নাহ এখন এসব কতদিন বাদ তোকে দেখলাম বলতো এখন এসব না বললেই নয় আর আমি তো চেষ্টা করছি বল একটা চাকরির..?”
সিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো আতিফ আর সে বেস্টফ্রেন্ড ছিলো দশ বছরের তার মধ্যে তারা রিলেশনে আছে পাঁচ বছর হলো।এখন শুধু আতিফের একটা চাকরির অপেক্ষা তাহলেই সে ঘরে তাদের বেপারে জানতে পারবে। সিয়া নিজেও একটা প্রাইভেট ফর্মে চাকরি করে।সেখান থেকে যা পায় তার অর্ধেক ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখে আর বাকি দিয়ে আতিফের জন্য তার প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন জামা-কাপড়, টুকটাক হাত খরচা ইত্যাদিতে দেয়।
বলতে গেলে আতিফ এখন পুরোটাই সিয়ার উপর নির্ভশীল বলতে গেলে যদিও সিয়া তাকে এগুলো জোর করেই দেয়। এমনকি মেস ভাড়াও দিতে চায় কিন্তু আতিফ নেয় না সেইটুকু খরচ সে টিউশনি করে তুলে নেয়। খাওয়ার খরচও সেখান থেকে কিছুটা বাঁচে। কিন্তু সিয়া শুনলে তো রোজ সে দুপুরে আতিফের জন্য খাবার নিয়ে আসে নিজে লুকিয়ে বানিয়ে। আর সে রোজ আসতে না পারলে এক চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলের হাতে পয়সা দিয়ে রোজ খাবার পাঠিয়ে দেয়।
আতিফ মাঝে মাঝে গালে হাত দিয়ে সিয়াকে দেখে আর ভাবে তার এই খারাপ ভাগ্যে করে পেল সে এই রাজকন্যাটাকে..?।
সিয়া ডাকতে আতিফের ধ্যান ভাঙলো সিয়া বলল “এবার উঠি রে এখন থেকে একটু মলে যেতে হবে। বাড়িতে মা আছে আর মা থাকলে তো জানিস রাত আটটার আগে আমায় বাড়ি ঢুকতে হয়।”
আতিফ একটু মন খারাপ করে বলল “এই তো এলি এক্ষুনি চলে যাবি..? যাহ তাহলে তোকে এখন আটকে রাখার ক্ষমতা নেই আমার। কদিন যেতে দে সারাজীবনের মত আটকে রাখবো আমার কাছে।”
সিয়া লাজুক হেসে আটিফের চুল এলোমেলো করে বলল “দেখবো”
বলে দুজনেই বেরিয়ে পড়ল নিজেদের নিজেদের গন্তব্যে।
#চলবে…?