গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #৬
এভাবেই কেটে গেছে মাঝে দুটো দিন। চন্দ্রা পুরো বাড়িটা ভালো ভাবে দেখে বুঝে নিয়েছে। পুরো বাড়িটা জুড়ে উপর নীচ করে আছে মোট নয় টা মতো রুম এর মধ্যে একটাতে থাকে সিয়াম আর চন্দ্রা, একটাতে সিয়া একটাতে সিরাজ আরেকটাতে থাকেন সুইটি বেগম। বাকি পাঁচটি রুমের মধ্যে সিয়ামের উপরের একটা রুম যা ফাঁকা থাকে, আরেকটি সিয়ামের বাবা মায়ের রুম যা বন্ধ থাকে, আর বাকি রুম গুলির মধ্যে একটি গেস্ট রুম ও একটি স্টোর রুম। বাকি দুটো রুম নাকি বন্ধই থাকে সবসময় তার চাবি আছে না হারিয়ে গেছে তাও কেউ খোঁজ রাখে না নাকি। এই বাড়িটা সিয়ামের বাবা মায়ে ভীষণ পছন্দ করে কিনেছিলেন তারপর নিজেদের ইচ্ছমতো সাজিয়েছিলেন।সিয়ামের বাবা মা দুজনেই ছিলেন ভীষণ শৌখিন যা চন্দ্রা সিয়ামের দুটো রুম দেখেই বুঝেছে যে তেনাদের ছেলেও সেই গুন পেয়েছে। এইসব খবর চন্দ্রা পেয়েছে বাড়ির এক অতি পুরোনো মালীর থেকে।তিনি নাকি সিয়ামের বাবা মা থাকাকালীনই এখানে কাজে লেগেছিলেন।
কিন্তু চন্দ্রার একটা জায়গায় খটকা লেগেছে যে তিনি এই পুরো বিষয়টিই কেমন ভয়ে ভয়ে বলেছেন। চন্দ্রা সিয়ামের বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি শুধু অ্যাক্সিডেন্ট বলে এড়িয়ে গেছেন।
সিয়াম আপাতত বাড়িতে নেই।সে গেছে তার অফিসে খুব জরুরী কাজ না থাকলে সে অফিস যায় না।তবে এই কদিন নাকি তাকে রোজই অফিস যেতে হবে। অফিসে কি নিয়ে নাকি ভীষন ঝামেলা হয়েছে এই টুকুই বুঝেছে চন্দ্রা সিয়ামের গতরাতে কারোর সাথে কল কনভারসেশনে। এই দু-দিনে সিয়ামের সাথে চন্দ্রার কথা হয়েছে বলতে স্বাভাবিক টুকটাক ধরনের যেমন খেয়েছেন, ঘুমাবেন কখন এইসব নিয়ে। চন্দ্রা সারাদিনের বেশিরভাগটাই থেকেছে নয়তো ছাদে নয়তো বাগানে। সে সিয়ামের টুকটাক হেল্প করে দিলেও মনের মধ্যে ভীষন রকম জড়তা রয়েছে তার।
এইসব ভাবতে ভাবতে চন্দ্রা এগোচ্ছিল সিয়ামের উপরের ঘরের দিকে সিয়ামের ঘরের পাশের ঘরটা সিয়ার আর তার পাশের টা সিরাজের।চন্দ্রা সিরাজকে দেখে তাড়াতাড়ি করে সিয়ামের ঘরে প্রবেশ করতে গেলো, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।সিরাজ দৌড়ে এসে চন্দ্রার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো।দুইদিন নেশায় বুদ থাকায় চন্দ্রার কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল তার।আজ চন্দ্রকে সামনে দেখে আগেরদিনের চড়ের কথাটা সর্বপ্রথম মাথায় এলো সিরাজের।তার রাগ টা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
চন্দ্রা ছটপট করতে লাগলো সিরাজ টা দেখে বাঁকা হাসি হেসে মুখটা চন্দ্রার মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল “খুব রস হয়েছে না।আগে তো খুব আমার পিছনে ঘুরতি হাতটা ধরার জন্যে বায়না করতি এখন কি নতুন নাগর পেয়ে আমায় ভুলে গেলি..?আরে তুই যা চাস ভাই দিতে পারবে না কিন্তু আমি পারবো তুমি বোঝো না কেনো বলোতো পাখি।”
চন্দ্রার এবার শরীর শক্ত হয়ে এলো রাগে সিরাজের পায়ে পাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারলো গালে। তারপর সিরাজের কলার ধরে বলল “জানি না কোন জন্মের পাপের কারণে তোকে আমি এই জন্মে নিজের জীবনে অভিশাপ হিসেবে পেয়েছি। নিশ্চই কোনো বড়োসড়ো ধরনেরই পাপ করেছিলাম নয়তো তোর মতো জানোয়ারের ঘরের বৌমা হয়ে আসি..?আর শোন আমার সাথে লাগতে আসবি না ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট পাওয়া মেয়ে আমি নাহলে পরের বার নিজের হাড়ের টুকরো গুনে শেষ করতে পারবি না।” বলে সিরাজের কলার ছেড়ে দিল সিরাজ কিছু করার উদ্দেশ্যে একপা বাড়াতেই পিছন থেকে সিয়া এসে বলল “কি করছিস তোরা এখানে..?”
সিরাজ নিজেকে সংযত করে হাত নামিয়ে “কিছু না” বলে সিয়ার পাশ কাটিয়ে নীচে নেমে বাড়ি দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
সিয়া চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বলল “নীচে চলো মা ডাকছে গ্রাম থেকে কিছু মেহমান এসেছে তারা তোমাকে আর ভাইয়াকে দেখতে চাইছেন। আমি ভাইয়াকে ফোন দিয়েছিলাম কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইয়াও চলে আসবে।” এই বলে সিয়া নীচে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালেই চন্দ্রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে “মনি এই দুদিন কোথায় ছিলেন..?”
সিয়া পিছন ফিরে বলল “ঘরের বউ হয়ে এইটুকু খোঁজ রাখো না..?” চন্দ্রা আমতা আমতা করলো সে কাকেই বা জিজ্ঞেস করতো সিয়ামের সাথে তো ভালোভাবে কথাই বলে ন সে তার উপর এই বাড়ির সার্ভেন্ট গুলো কেমন করে তাকায় যেনো।তাই সে কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
চন্দ্রকে এভাবে দেখে সিয়া নিজেই বলল “মায়ের এক বন্ধু ভীষণ অসুস্থ তাই মা তাকে দেখতে গিয়েছিল। কিছু কারণবশত আসতে পারেননি আজ সকালেই বাড়ি এসেছে।”
চন্দ্রা মাথা হালকা নাড়িয়ে সিয়ার পিছু পিছু নীচে গেলো। চন্দ্রাকে দেখতে পেয়ে সুইটি বেগাম সবার সামনে নিয়ে গেলেন। মেহমানরা চন্দ্রা দেখে বললেন…
– বাহ্ ভাবী সিয়ামের বউকে তোহ খুব মিষ্টি দেখতে
– হ্যাঁ তাইতো এতো সুন্দর পুতুলের মতো বউ কই পেলেন ভাবী…?
– এই মেয়ে তোমার কি শুধু এই রূপই আছে নাকি গুনও আছে..? এক কাপ চা করে আনোতো সবার জন্য আর আমার চায়ে চিনি কম দেবে।
চন্দ্রা এবার পড়লো মহা মুশকিলে সে রান্নার র পারে না। সুইটি বেগমও কথায় ব্যাস্ত সবার সাথে তাকে ডেকে বলারও উপায় নেই। অগত্যা চন্দ্রা মুখ বেজার করে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলো। তখনই সিয়ামকে বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখল।কয়েক সেকন্ডের জন্য চোখাচোখি হলো দুজনের।চন্দ্রা চোখ সরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সিয়ামও সবার সাথে কথা কথা বলল ভালোমন্দ জিজ্ঞেসা করল সবাই খুব প্রশংসা করলো চন্দ্রার। সেই দেখে সিয়াম মুচকি হেসে মনে মনে বলল “পছন্দটা কার দেখতে হবে না।”
প্রায় মিনিট পনেরো হয়ে গেলো চন্দ্রাকে যে সেই রান্নাঘরে যেতে দেখলো আর তোহ দেখাই নেই। সিয়াম এবার আসতে আসতে রান্নাঘরে গেলো। গিয়ে যা দেখলো তাতে সিয়ামের হুশ উড়ে গেলো।
চন্দ্রা এক কড়াই জলে অর্ধেকের বেশি চা পাতা দিয়েছে তার উপরে ভেসে আছে তেজ পাতা, লবঙ্গ, আর বেশ কিছুটা না ছোলা আদা।
সিয়ামের এবার পেট ফেটে হাসি এলো। কোনমতে মুখচেপে হেসে মুখ স্বাভাবিক করে ডাক দিল “চন্দ্র” চন্দ্রা চমকে পিছনে তাকালো।
সিয়াম তা দেখে বলল “আসতে আসতে আমি ভয় পাবেন না”। চন্দ্রা স্বস্থির নিশ্বাস ছেড়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো।
সিয়াম একটু খোঁচানোর জন্য বলল “তা কি বানাচ্ছেন..? চা পাতার স্যুপ..? আচ্ছা এটা খেয়ে শরীরের কোন কোন উপকার হবে..?না মানে এতো স্বাস্থ্যকর স্যুপ তো আগে কোনদিন দেখিনি তাই আর কি।”শেষের কথাটা একটু হাসি চেপেই বলল সিয়াম।
চন্দ্রা এবার বিরস মুখে তাকিয়ে সিয়ামকে বলল”আপনিও মজা নিচ্ছেন..?
সিয়ামের এবার একটু খারাপ লাগলো চন্দ্রাকে বলল “আমি যেমন যেমন বলছি সেইভাবে করুন ঐ কড়াটা ঐ পাশে রাখুন আমি সার্ভেন্টকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দেবো”।
চন্দ্রা ধীরে ধীরে সিয়ামের কথা মতো কাজ করলো। সবশেষে চন্দ্রা অপরিপক্ব হাতে কাপে চা ঢালতে গিয়ে অল্প চা সিয়ামের পায়ের আঙুলের কাছে পড়লো।চন্দ্রা “সরি সরি” বলে পায়ের দিকে তাকালো পায়ের বুড়ো আঙুলটা যেনো একটু নড়লো। সিয়াম সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল “ইটস ওকে..! প্রথম প্রথম ওরাম একটু হয়। নিন নিন আপনি তাড়াতাড়ি করুন ওখানে এবার সবাই খুঁজতে শুরু করলো বলে। চন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে সব কাপ-প্লেট সাজিয়ে ট্রেতে নিয়ে সিয়ামের সাথে ডাইনিং রুমে গেলো। কিন্তু কোথাও একটা তার খটকা থেকেই গেলো যা শুনেছে সে সিয়ামের দুইপা-ই অবশ তাহলে হালকা চা পড়াতে পায়ের আঙুলটা নড়ে উঠলো কিকোরে..?সে হালকাই হোক না কেনো। চন্দ্রা হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে বলল “না না কি দেখতে কি দেখেছি কে জানে সব আমার মনের ভুল ওনার পা নড়বে কীকরে তুইও না চন্দ্রা।”
#চলবে…?