#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে [৩১]
প্রভা আফরিন
জামশেদ পুনরায় এসেছেন পিয়াসার ফ্ল্যাটে। বন্ধ ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই একটা গুমোট গন্ধ নাকে লাগল। আলো জ্বালাতেই দপ করে রঙিন হয়ে উঠল চারপাশ। অনেকদিন ধরে বন্ধ পড়ে আছে বলেই বোধহয় আশপাশ কেমন ধুলোমলিন। বিলাসদ্রব্যের গায়ে ময়লা জমেছে। জামশেদ ঘরের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে চারপাশ অবলোকন করেন। এখনো একই রকম অগোছালো রয়ে গেছে সবকিছু। এলোমেলো আসবাবপত্র। কিছু যে খোঁজা হয়েছে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রথমদিন দেখে অবশ্য সন্দেহ করেছিলেন চুরি-ডাকাতি কেইস। কিন্তু সেই সন্দেহ টেকেনি, কারণ লকারে সমস্ত গহনা, অর্থ অক্ষত ছিল। জামশেদ এলোমেলো জিনিসগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন। সাগর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সন্ধান করেছে। প্রত্যেকটা ডিভাইস নষ্ট করেছে। তাহলে ডকুমেন্টস থাকার নিশ্চয়তা কতটুকু? সেগুলো কোনো ডিভাইসে ছিল নাকি কাগজে বা পেনড্রাইভে তাও অজানা। তবে কিছু যে আছে এ নিয়ে জামশেদের এখন আর বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। নতুবা এস এন শিকদারের কাছের মানুষের ক্ষতি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে হুমকি কেউ দেবে না। সামান্য এক খু’নের মামলার ভয়ে কেউ এতটা মড়িয়া হবে না। হয়তো তারাও ভয় পেয়ে গেছে অন্য কোনো সত্যি সামনে চলে আসার। ঠিক এই বিশ্বাসেই জামশেদ ছুটে এসেছে। কিন্তু এত বড়ো ফ্ল্যাটে প্রতিটা জিনিস ধরে ধরে খোঁজা তো সম্ভব নয়। তারজন্য একটু স্মার্টলি চিন্তা করতে হবে।
পিয়াসা তো জানতই ডকুমেন্টস উদ্ধারের জন্য ওর পেছনে হাত ধুয়ে পড়বে রাশেদ। তারই কিনে দেওয়া ফ্ল্যাট এটা। সুতরাং তার অবাধ বিচরণ এখানে বহাল ছিল। পিয়াসা নিশ্চয়ই ঝুঁকি নিয়ে এই ফ্ল্যাটে সেটা রাখবে না। তাহলে রাখবে টা কোথায়? জামশেদের মাথায় শুরুতেই এলো পিয়াসার বাপের বাড়ির কথা। কিন্তু এই কথা তো সাগরদের মাথাতেও এসেছে। পিয়াসার মৃ’ত্যুর আগেই নাকি একবার চোর ঢুকেছিল ওদের বাড়িতে। কিন্তু চুরি করতে পারেনি। আগেই নাকি পালিয়ে গেছিল। নিশ্চয়ই সন্ধানে ব্যর্থ হয়েছিল। জামশেদ তবুও পিয়াসার বাবার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলো। যেহেতু সাগরের বিষয়টা এখনো গোপনে আছে তাই পিয়াসার মা মিসেস লিপি এখনো মেয়ের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে অবগত নন। তিনি পুলিশ দেখেই প্রথমে মেয়ের কেইসের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। জামশেদ সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বললেন,
“আমার একটা ছোটো ইনকুয়েরি করার ছিল। উইথ ইয়োর পারমিশন।”
“শিওর অফিসার। আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট। কিন্তু কোন বিষয়ে?”
“মৃ’ত্যুর আগে পিয়াসা শেষবার যখন এ বাড়িতে আসে, কিছু রেখে গেছিল? গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফাইলস বা কিছু যা খুবই দরকারি?”
মিসেস লিপি চিন্তিত হলেন। সময় নিয়ে খানিক ভেবে বললেন,
“তেমন কোনো বিষয় তো ছিল না। আলমারি ঘেটে পুরোনো ফোনটা নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছিল।”
“আমি একবার আলমারিটা চেক করতে চাই।”
মিসেস লিপির সঙ্গেই পিয়াসার ঘরে ঢুকলেন জামশেদ। আলমারি ঘেটে কিছুই উদ্ধার করতে পারলেন না। পুনরায় বললেন,
“আপনি একটু ভেবেচিন্তে বলুন। পিয়াসা এমন কিছু রেখে গেছে বা আপনাকে ফোনে জানিয়েছে যা ওর জন্য খুবই দরকারি ছিল। কিংবা এমন কোনো স্থান যেখানে ওর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র থাকে।”
মিসেস লিপি বললেন,
“তেমন কিছু তো খেয়াল হচ্ছে না। শেষবার যখন এলো খুবই তাড়াহুড়ায় ছিল। আলমারি থেকে ফোনটা বের করে, সেটাকে চালু করে। এরপর প্রসাধনীগুলো কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেখে চলে যায়। আমাকে বলে যায় এগুলো যেন এক্সপায়ার করে গেলেও ফেলে না দেই। যেভাবে আছে সেভাবেই যেন থাকে।”
“প্রসাধনী!” জামশেদ ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগোলেন। মিররের ফ্রন্টে সাজানো প্রত্যেকটা প্রোডাক্টের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। লিপস্টিক থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা প্রসাধনীর কৌটো খুলে খুলে দেখলেন। শেষে সেরাভে ব্র্যাণ্ডের ময়েশ্চরাইজারের ঢাউস কৌটোটা খুলে হতাশ হয়ে যেই না রাখতে গেলেন হঠাৎই একটা বিষয় ভেবে মস্তিষ্ক চঞ্চল হয়ে উঠল। ময়েশ্চারাইজারের কৌটোটা একদম ভরা। অথচ সে তুলনায় ওজন হালকা। কেন? তিনি আবার খুললেন কৌটোটা। সরাসরি আঙুল ডুবিয়ে দিলেন ক্রিমের ভেতর। সজাগ মস্তিষ্কের লক্ষ্য অব্যর্থ। কৌটোর ভেতর হতে আরেকটা হালকা ওজনের কৌটো উদ্ধার হলো। যার ওপরেই ময়েশ্চারাইজারের মিথ্যা আরোপন ছিল। সেই ছোটো কৌটোর ভেতর পাওয়া গেল পেনড্রাইভ। জামশেদের বুক উত্তেজনায় থরথরিয়ে কাঁপছে। এই প্রথম পিয়াসা মেয়েটার চতুরতার ওপর ভীষণ খুশি হলেন তিনি। মিসেস লিপিকে অতি শীঘ্রই কেইসের সব খোলাসা হবে আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। গাড়িতে বসে অফিস যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না। ল্যাপটপটা নিয়ে পেনড্রাইভ ইনসার্ট করলেন চলন্ত পথেই। সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি কালবিলম্ব না করে এস এন শিকদারের নম্বরটা ডায়ালে উঠালেন।
_______________
বাংলাদেশের স্মাগলিং গ্যাংয়ের এক পরিচিত নাম তানভীর খন্দকার। বছর চল্লিশের এই ব্যক্তি দেখতে যতটাই ভদ্রলোক গোছের, কর্মকাণ্ড ততটাই দুর্ধর্ষ। বন্দর দিয়ে দেশে চোরাচালান অনুপ্রেবেশে সে সিদ্ধহস্ত। জাহাজে আমদানিকৃত পন্যের মধ্যে ভরে ই’য়া’বা, স্কো’পা’লামিন, এল’এস’ডি সাপ্লাই দেয়। তার আওতায় দেশে মোট ১৬টি গ্যাং সক্রিয় আছে। এসব গ্যাং শুধু মা’দকের প্রসারই নয়, বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত। যার মধ্যে অন্যতম হলো বড়োলোকের বিলাসী ছেলে-মেয়েদের মাঝে ড্রা’গের প্রসার ঘটানো। আর সবচেয়ে বড়ো চক্র হলো স্কো’পা’লামিন ড্রা’গের সাহায্যে মানুষকে বশ করে তাকে সর্বহারা করা, অথবা কোনো টার্গেট করা নারীকে এর মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে কালো দুনিয়ায় টেনে আনা। ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল থেকে শুরু করে ব্লু-ফিল্ম সবেই তাদের রমরমা ব্যবসা। এসব মানতে না পেরে কোনো কোনো দুর্বল চিত্তের মেয়ে আ’ত্মহ’ত্যার পথও বেছে নেয়। কেউ বা থানায় যোগাযোগ করে। দোষী ধরা পড়ে না। তানভীরের আওতায় ঢাকা ডিভিশনের গ্যাং লিডার রাশেদ। তাবড়-তাবড় ব্যক্তিদের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ বলেই তাদের সহজে আইনের আওতায় ফাঁসানো যায় না।
তানভীরের নারী প্রীতি সীমাহীন। নারীই ওদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। রাশেদ সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত সুবিধা আদায়ে পিয়াসাকে ঠেলে দিয়েছিল বসের দিকে। অ্যালেনের বেলাতেও তাই। পিয়াসা তার রূপ ও আকর্ষণীয় ব্যবহারে সহজেই তাদের সান্নিধ্যপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেটাই কাল হলো ওদের জন্য৷ পিয়াসা উচ্চাকাঙ্খী। এই দুনিয়ার সঙ্গে সে যত বেশি মিশছিল তার লোভ, লালসা ক্রমেই বেড়েই চলছিল। কিন্তু এটা বেইমানের দুনিয়া। রাশেদ যে পিয়াসাকে শুধুই ব্যবহার করছে এবং সুযোগ পেলে ছুঁড়ে ফেলতে দু-বার ভাববে না সে সম্পর্কে ধারণা ছিল বলেই পিয়াসা গোপনে ওদের বিরুদ্ধে তুখোড় কিছু প্রমাণ সরিয়ে রেখেছিল। যা অনায়াসেই ওদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর মোক্ষম অ’স্ত্র। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক ছিল তাদের পেছনে লাগা একজন সাংবাদিক ও একজন ব্যারিস্টারকে খু’ন করার প্রমাণ। যে খু’নের কোনো সুরাহা আজও হয়নি। পিয়াসা সেই বিপদজনক প্রমাণ নিজের হস্তগত রেখে নিজেকে নিরাপদ ভেবেছিল। তা ওর কাল তো হলোই সঙ্গে বিপদ ডেকে আনল পুরো একটি চক্রের।
তানভীরকে অবশ্য প্রকাশ্যে ভীষণ কম দেখা যায়। কাজের বাইরে বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরেই থাকে। এবার পিয়াসার ব্যাপারটা মাথায় চিন্তা ধরিয়ে দিয়েছিল। ঝামেলা দূর করার দায়িত্ব ছিল রাশেদের ওপর। রাশেদ নিজে সেইফ থাকতে সেই দায়িত্ব দিয়েছিল সাগরের ওপর। ভেবেছিল সেইফলি সব হয়ে যাবে। হতোও। কিন্তু ভাগ্য! ওদের ধরিয়ে দেওয়ার সূত্রটা যে আরো বছর দুই আগেই শুভ্রা মৃ’ত্যু রহস্যে ফেলে এসেছিল। মৃ’ত্যুর আগে পিয়াসার ফোনটা যদি তুষারের কাছে না আসত তাহলে হয়তো অনেক কিছুই আড়ালে রয়ে যেত। পিয়াসা ও রাশেদ লোভ-লালসার যে খেলার সূচনা করেছিল, পিয়াসার মৃ’ত্যু সেই খেলায় ক্লাইমেক্স হিসেবে এসে সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিল। একেই বলে নিয়তি!
তানভীর ও তার দল সতর্ক হওয়ার আগেই শ্রাবণের কাছে পরাস্ত হয়েছে। এই সাফল্যের আরো বড়ো একটা কারণ গোপনে অপারেশন চালানো। যদি প্রকাশ্যে তৎপরতা দেখাতো নির্ঘাত কানে কানে ছড়িয়ে জায়গামতো সংবাদ পৌঁছে যেত। শ্রাবণ এটুকু জানে সর্ষেতেই ওরা ভূত নিয়ে ঘোরে।
মূলহোতাকে আটক করে জাহাজের ভেজাল সহকর্মীর হাতে সোপর্দ করে শ্রাবণ ক্ষীপ্র গতিতে ছুটল বিল্ডিংয়ের দিকে। ইতিমধ্যেই বিল্ডিংয়ের কুখ্যাত বাসিন্দারা বিপদ বুঝে সতর্ক হয়ে গেছে। বের হওয়ার পথ না পেয়ে ভেতর থেকে গু’লি ছুঁড়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তাদের কাছে বি’স্ফো’রক আছে বলে সতর্কও করে দিয়েছে। যদি বেচাল করে তবে বিল্ডিংসহ উড়িয়ে দেবে। এতে অপরাধীর সঙ্গে কিছু নিরীহ কর্মচারী ম’রবে। সবচেয়ে বড়ো কথা ভেতরে অনন্যা রয়েছে। তাকে উদ্ধারেই তো এত ঘটা করে আয়োজন। ওর প্রাণের ক্ষতি শ্রাবণ কেমন করে হতে দিতে পারে!
পরিস্থিতি আবারো নাগালের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে। বিপদজনক বিল্ডিংয়ের আশেপাশের সমস্ত দোকানপাট, আশেপাশের বিল্ডিংয়ের মানুষজন সবাইকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে পুলিশের আরো দুটো ইউনিট যোগদান করেছে ওদের সঙ্গে। সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গার তীর এখন একখণ্ড যু’দ্ধক্ষেত্র। বাতাসে চাপা উত্তেজনা। সময়ের কাটা যত এগোচ্ছে উৎকণ্ঠা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে ক্রমাগত হুমকি দেওয়া হচ্ছে তাদের যেতে না দিলে বি’স্ফো’রণ ঘটাবে। এতে আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনারও ক্ষতি হবে।ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে। পুলিশ মোটেও সেটা হতে দিতে চায় না। পুলিশ নিচে থেকে মাইকে করে বিল্ডিংয়ের লোকেদের আত্মসমর্পণের আহ্বান করে যাচ্ছে ক্রমাগত। মনোযোগ যখন এদিকে সরে গেছে তখন শ্রাবণ দুজন সিনিয়র এএপিকে সঙ্গে নিয়ে স্পট থেকে সরে নিকটবর্তী বিল্ডিংয়ে ঢুকে গেছে। বাইরে থেকে বাড়িতে ঢোকার একমাত্র রাস্তা এখন ছাদ। বিপদজনক হলেও ভিন্ন কোনো পন্থা নেই। পুরোনো বাড়ির চওড়া ছাদ। দুটো বিল্ডিং কাছাকাছি হওয়ায় অনায়াসে চলে গেল। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের নল তাক করে ছাদে পাহারারত একজনকে নিঃশব্দে ঘায়েল করা গেল। তবে মেঝেতে পড়ার আগে ধরেও ফেলল। শব্দ পেলে বাকিরা সতর্ক হয়ে যাবে। আর শ্রাবণরা জানেও না ভেতরে ঠিক কতজন রয়েছে। নিঃশব্দে সিড়ি ধরে নামতেই দুজনের চোখে পড়ে গেল ওরা। একজন দৌড়ে নিচে নেমে যেতে পারল আরেজনকে গু’লি করে দিল এএসপি হাসনাত আলম। নিচে যে নেমে গেছিল সে খবর ছড়িয়ে দিয়েছে। মুহূর্তেই চারিদিকে গো’লা’গুলি শুরু হলো।
শ্রাবণ তখন শুধু রুমের পর রুম একজনকেই খুঁজছিল। ওকে প্রটেকশন দিচ্ছিল বাকি দুজন। যতগুলো বন্ধ দরজা ছিল সবগুলো ভেঙে ভেতরটা চেক করল। অতঃপর কাঙ্ক্ষিত সেই দরজা। যার ওপারে অনন্যার দেখা তো মিললই সঙ্গে তাকে জিম্মি করে কোলের ওপর বসিয়ে রাখা রাশেদকেও। ব’ন্দুকের মুখে অনন্যা যতটা না ভীত, রাশেদের কোলের ওপর বেকায়দায় পড়ে সে ততটাই ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে আছে। শ্রাবণের দেখা পেয়ে ও যেন জানে পানি পেল। চাপা কণ্ঠে ডাকল,
“শ্রাবণ!”
ডাটিয়াল অফিসার আঙুলের ডগায় পি’স্তল ঘুরিয়ে, জ্বলন্ত দৃষ্টিটা রাশেদের দিকে রেখে আদুরে স্বরে বলল,
“মাই ব্রেভ গার্ল, তোমার অগ্নিঝরা মনে বৃষ্টি নামাতে শ্রাবণ চলে এসেছে।”
অনন্যা হতভম্ব হয়ে গেল। এমন শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে প্রেম ছড়াতে ইচ্ছে করছে লোকটার! রাশেদ অনন্যাকে শক্ত করে চেপে ধরে হুমকি ছুঁড়ল,
“পি’স্তল নামাও রোমিও। নয়তো আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রাণভোমরাও খতম।”
শ্রাবণ বিনাবাক্যে পি’স্তল নামিয়ে দিল। তবে ওর জবান থামল না। ভারী কণ্ঠস্বর গমগম করে বলে উঠল,
“তোমার কোনো ক্ষতি করেনি তো?”
কথাটা যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেই রমনী খাঁচায় বন্দি পাখি হলেও বিরক্তি প্রকাশে ছাড়ল না,
“না, তুমি আসলে করবে বলে রেখে দিয়েছে।”
“উফ বাঁচালে! দমটাই আটকে ছিল আমার।”
অনন্যা অবাক না হয়ে পারে না। নিরস্ত্র হয়ে কিনা তিনি বলছেন, বাঁচালে! রসিকতা করার জায়গার অভাব পড়েছিল! ও বলল,
“আর আমার দম যে আটকে আসছে।”
“তুমি তো কোলে বসে আছো। এদিকে আমি একটা কোলের অভাবে ঘুমাতে পারছি না।”
শ্রাবণের কণ্ঠ দুঃখী শোনায়। অনন্যা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
“অসভ্য পুলিশ। আমি অন্যের কোলে বসে আছি দেখো না? পারলে নিজের কোলে নিয়ে যাও। এরপর যত পারো ঘুমিয়ো।”
শ্রাবণ দুষ্টু হেসে বলল,
“প্রমিস তো? তবে একটা বিষম ফ্লাইং কিস দাও। এমনি এমনি না, হাত উঁচিয়ে, কনুই ফ্লিপ করে দাও। দেখবে কোল বদলে গেছে।”
বাইরে তুমুল গো’লাগু’লির শব্দ। পুলিশ নিচতলার দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছে। এমন ভয়ংকর মুহূর্তে দোতলার এক কক্ষে দুই নর-নারী এক অপরাধীর হাতে জিম্মি অবস্থায় রসিকতায় মত্ত। স্বয়ং রাশেদও এদের সিরিয়াসনেসের মাত্রা দেখে ভেবাচেকা খেয়ে গেছে। উদ্দেশ্য সফল, রাশেদ বিভ্রান্ত। অনন্যা শ্রাবণের কথার ইঙ্গিত মতো রাশেদের কোলে অধিষ্ঠিত অবস্থাতেই ব’ন্দুক ধরা হাতটাকে সজোরে কায়দা করে মাথার কাছ থেকে সরাতে সক্ষম হতেই সেকেন্ডের মাঝে শ্রাবণ ঝাঁপিয়ে পড়ল রাশেদের ওপর। ততক্ষণে রাশেদের পি’স্তল হতে গু’লি বেরিয়ে শ্রাবণের কানের পাশ দিয়ে চলে গেছে। আক্রমণে অনন্যা মেঝেতে ছিটকে পড়েছে। দুই বলিষ্ঠ পুরুষের ধ’স্তাধ’স্তি ও খালি হাতের মা’রা’মারিতে দিশেহারা অনন্যা। দুজনের পি’স্তলই দূরে ছিটকে পড়েছে। দেহের শক্তিকে পুঁজি করে লড়ছে। কিন্তু শ্রাবণের স্পেশালিটি হতো হাতের সঙ্গে ওর মুখও চলে। অনন্যা তখন বুদ্ধিমতির পরিচয়টা দিল। শ্রাবণের পি’স্তলটা লুফে নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে দিল। শ্রাবণ ক্যাচ ধরে রাশেদের মাথায় ধরতেই আবারো স্থির হয়ে গেল চারপাশ।
রাশেদের চোখে ভয় নেই। এত বড়ো গ্যাং লিডার কখনো পি’স্তলের মুখে থরথরিয়ে কাঁপে না। ও বলল,
“কেন সময় নষ্ট করছো অফিসার? থানায় নিয়ে চলো।”
তখন পিছন থেকে অনন্যা বলে উঠল,
“না শ্রাবণ। এর জেল আমি চাই না। দীর্ঘদিন আদালতে কেইস ঘুরবে, শুনানি পিছাবে একসময় প্রভাবশালীদের ছায়ায় বের হয়ে আসবে।”
“তুমি কী চাও, অনু?” শ্রাবণের প্রশ্ন।
অনন্যা উত্তেজিত ক্ষোভ, উদ্বেলিত বেদনায় জর্জরিত হয়ে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলল,
“ওকে এতটা নির্মমভাবে মা’রো যেন প্রতি ক্ষণে আমার আপার দুঃসহ যন্ত্রণা, মৃ’ত্যুর আগের অপমান মনে করে কাঁদে। তুষার ভাইয়ার পিতৃত্বের হাহাকার টের পেয়ে চিৎকার করে। আমার বাবার মৃ’ত্যু, মায়ের মানসিক অস্থিরতার দুর্বিষহ দিনগুলোর একাংশের যন্ত্রণার ভার যেন সে সহ্য করে মা’রা যায়। ওর লা’শ দেখে যেন আত্মা কেঁপে ওঠে। ঘৃণা জাগে।”
“তথাস্তু।”
চলবে…