বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-২৯+৩০

0
810

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২৯]
প্রভা আফরিন

একটি নিস্তব্ধ কক্ষ। তীব্র মাথা যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করতে করতে বিছানায় শায়িত রমনী চৈতন্য লাভ করে। চোখ মেলতে সীমাহীন কষ্ট অনুভব হয়। শরীর দুর্বল লাগছে। মাথায় যেন পাথর বেঁধে রাখা। উঠতে চেষ্টা করেও পারল না। তীব্র তেষ্টায় কণ্ঠনালীতে শুষ্কতা বিরাজ করছে। বারকয়েক ঢোক গিলে ভাবল পানি খেয়ে নেয়। চোখের পল্পব পিটপিট করে দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই সেই ইচ্ছে উবে গেল। একটা অপরিচিত, পুরোনো সিলিং দেখতে পেল চোখের সামনে। অনন্যা উঠে বসে হতভম্ব হয়ে গেল। এ কোথায় সে! অনেকটা সময় লাগল অতীতের সবকিছু স্মরণ করতে। কলিজাটা যেন লাফিয়ে উঠল। ঠিক কী হয়েছে ওর সাথে অনন্যা বুঝল না। কীভাবে, কে এখানে এনেছে তাও বুঝতে পারছে না। কিন্তু এটুকু বুঝতে বাকি নেই ও বিপদে পড়েছে। প্রথমেই হাবীবের নামটা স্মরণে আসে। জেল থেকে জামিন নিয়ে বের হয়েছে হাবীব। কোথাও অব্যক্ত ক্ষো’ভে তাকে অপহ’রণ করল নাতো! বুকের ভেতর এক ধোঁয়াশাময় ভয় ক্রমেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে।

নোংরা, তেলচিটে ও ছারপোকা ঠাসা বিছানা ছেড়ে অনন্যা উঠে দাঁড়ায়। নিজেই নিজেকে বোঝায় বিপদে দিশেহারা হলে চলবে না। শক্ত থাকতে হবে। এর শেষ দেখা পর্যন্ত লড়াই করতে হবে। হাল ছেড়ে শত্রুর কাছে আকুতি সে করবে না। অনন্যা প্রথমে নিজের আশপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে। ক্ষীণ আলো ঘরজুড়ে, দেয়াল রঙচটা। বদ্ধ ঘরে গুমোট গন্ধ। দরজার কোণে সিগারেটের ফিল্টার দেখেই ও নিশ্চিত হয়ে গেল এটা একটা পুরুষের ঘর। সেটাই হওয়ার কথা। এখন দিন কী রাত কিছুই ঠাহর করতে পারল না অনন্যা। কতক্ষণ এখানে আছে তাও জানে না। উদ্বিগ্ন মস্তিষ্কে, দুর্বল পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। হাতলে টান দিতেই বুঝল দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সেটাই স্বাভাবিক। অনন্যা ফিরে তাকায়। জানালাটা খোলার চেষ্টা করে। বোধহয় বহুদিন বন্ধ পড়ে আছে। খুলতে চাইল না। টানাটানি করতে গিয়ে আওয়াজ হয়। অনন্যা ভয় পেয়ে যায়। যদি বাইরে থেকে কেউ শুনে ফেলে! তখনই খেয়াল হলো দরজার নিচটায় কিঞ্চিৎ ফাঁক আছে। ছুটে গিয়ে মেঝেতে শুয়ে দেখার চেষ্টায় মত্ত হয়। ক্ষীণ আলোক রশ্মি দেখা যাচ্ছে। হয়তো সন্ধ্যা অথবা ভোর এখন। অথবা আলোক স্বলতায় এমন দেখাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ দেখার চেষ্টায় লিপ্ত থেকে অবশেষে দুজোড়া পা এদিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। অনন্যা লাফিয়ে উঠল। এতক্ষণে এটুকু বুঝেছে জ্ঞানহীন অবস্থায় ওর সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেনি। জ্ঞান ফিরেছে দেখে যদি কিছু ঘটে! অনন্যা বিভিন্ন একশন মুভিতে যেরকম সিন দেখে অভ্যস্ত তাই মাথায় এলো। অর্থাৎ জ্ঞানহীন হওয়ার ভান ধরে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

ক্যাচক্যাচ শব্দ করে দরজা খুলে গেল। দুটি কর্কশ পুরুষ কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই তারা বিছানায় শায়িত মেয়েটিকে দেখে নেয়। একজন ভ্রুকুটি করে বলল,
“এই বা* আর কতক্ষণ পইড়া থাকব? রাইত থাইকা সকাল হইলো নড়নচড়ন নাই।”
অপরজন জবাব দিল,
“থাকুক পইড়া। কষ্ট কম হইলো। উপরের আদেশ এরে কিছু করন যাইব না। যা করার বস আইয়া করব।”
“বসের আবার ধইরা আনার বাতিক কবে থাইকা হইলো? ওইটা তো আমাগো কাম। বসের গলায় তো এমনেই নায়িকা নায়িকা সব মাইয়ারা ঝুলে। আঙুলের ইশারায় কাপড় খুইল্যা দেয়।”
“হা হা! হেগো গায়ে কাপড় থাকেনি! এই টুকু টুকু জামা পিন্দে। তয় এই মাইয়াডারে ভদ্র ঘরের মনে হইতাছে।”
“এরে নিয়া টেনশন আছে। বসেরে অস্থির লাগতাছিল। পেরেশানিতে আছে মনে হয়। বিদেশ থাইকা নাকি ঘন ঘন ফোন আয়ে ইদানীং।”
“বসেরও বস থাকে। সেই মনে হয় টাইট দিতাছে। আমগো তা ভাইবা কাম নাই। আজ জাহাজে কইরা চালান ঢুকব ঘাটে। হুনলাম বড়ো বসেও আইবো। সারাদিন মেলা কাম। চল আগেভাগে নাশতা সাইরা লই। বস আইব আবার। এ ততক্ষণ বন্ধ ঘরেই পইড়া থাকুক।”

সশব্দে দরজা লাগানোর সেকেন্ড কয়েক পর অনন্যা আটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিল। চোখ মেলল ভয়ে ভয়ে। তার মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে গেল লোকদুটোর কথা। কীসের চালান আসবে, কে বস কিছুই তো নাম উল্লেখ করে বলল না। অন্ধগলিতে স্তব্ধ হয়ে বসে না থেকে অনন্যা ছুটল জানালাটা খোলার জন্য। অন্তত জনবহুল এলাকা হলে আশেপাশের বিল্ডিংয়ের মানুষদের নজর কাঁড়তে পারবে। জানালার ভারী পাল্লার সঙ্গে কসরত করে ঘাম ঝরিয়ে দিল অনন্যা। পর্যায়ে খুলতে সক্ষম হলো। একটু ফাঁক হতেই হুড়মুড় করে সকালের ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে ছুঁয়ে দিল সর্বাঙ্গ। ইঞ্চি পাঁচেক খুলতেই অনন্যার চোখের সামনে ধরা দিল বিস্তৃত নদী। এই স্থান
অনন্যার চেনা। বুড়িগঙ্গার তীর!

ঠিক তখনই সশব্দে দরজা খুলে গেল। অনন্যা চমকে পিছু ফিরতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। উত্তেজিত, আহ’ত, আতঙ্কিত স্বরের মিশ্রণে বলে ওঠে,
“আপনি?”
বিপরীতের পুরুষটি মুচকি হেসে মাথা দোলায়,
“আমিই।”
________________

একটি নির্ঘুম, ক্লান্তিকর রাতের অবসানে শ্রাবণ একদম দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঘুমে চোখদুটো টেনে আসছে। হাতের ব্যথাটাও বেড়েছে। এরই মাঝে মাথায় দপদপ করে শতশত চিন্তা। সব মিলিয়ে ওর অবস্থা একদম নাজুক। সাগর বর্তমানে জ্ঞানহীন। হাতে, পায়ে পরপর দুটো গুলি খেয়ে সবটা স্বীকার করে নিয়েছে সে। একে একে যেসব সত্যি শুনল তার অর্ধেকটাই ওর আন্দাজ করা হয়ে গেছিল। বাকিটা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারল না। জবানবন্দি রেকর্ড করে গোপনীয়তার সঙ্গে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এখন। এদিকটা জামশেদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে শ্রাবণ বেরিয়ে গেল। আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। এরপর সরাসরি অপারেশন অনন্যা উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যদিও এখনো অবধি কোনো ট্রেস পাওয়া যায়নি। ওর টিমও বসে নেই। বিষয়টা এখন গোপন মিশনে রূপান্তর হয়েছে। একটা চক্রকে ধরতে তৎপর সকলে। কিন্তু বাকিদের কাছে এটা নেহাৎই পেশাদারিত্বের হুকুম পালন মাত্র। শ্রাবণের কাছে তার প্রিয়তমাকে ফিরে পাওয়ার লড়াই।
শ্রাবণ গাড়িতে বসেই সিটে গা এলিয়ে দিল। জামশেদের ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়েছে। নির্দেশ করল,
“পথটুকু ঘুমিয়ে যাব। বাড়ি পৌঁছে আমায় ডেকে দেবেন।”
“জি স্যার।”

শ্রাবণ এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে বাড়ি পৌঁছালো। মাথা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। মায়ের শরীরের হালচাল জেনে ওষুধ খায়িয়ে দিল। ভাগ্য ভালো মামী এসে থাকছে মায়ের কাছে। পুলিশ প্রটেকশন দিয়েছে বাড়িকে ঘিরে। এদিকে তার নিজেরও চেকাপ প্রয়োজন। হাতের ব্যথা বেড়েছে। কোনোমতে দুটো শুকনো পাউরুটি চিবিয়ে পেইনকিলার নিল ও। ফাহমিদা ছেলের ব্যস্ততা ও বিপর্যস্ত মুখ দেখে বললেন,
“কী শুরু করেছিস তুই? কোথায় থাকিস, কী করিস কিচ্ছু জানি না। এখন আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে ছোটাছুটি করছিস? রাতে তো একটুও ঘুমাসনি বুঝতে পারছি। কেন এত প্রেশার নিচ্ছিস, শ্রাবণ?”

“শান্তির জন্যই তো ছুটছি আম্মু। মিলে গেলেই লম্বা বিশ্রাম।”
“বিশ্রাম নয়, বিবাহ। বউ এনে দেব। একমাস আর কাজমুখো হবি না।”
শ্রাবণ মুচকি হাসল জবাব না দিয়ে। ফাহমিদা পুনরায় বললেন,
“শুনলাম ইসহাক চাচার নাতনিকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে আবারো শোকের মাতম লেগেছে। এই পরিবারের বিপদ-আপদ শেষই হয় না। অথচ এলাকার সবচেয়ে সম্রান্ত, ভদ্র পরিবার ওরা। কী জানি হলো মেয়েটার সাথে। ভাবতেই ভয় করছে।”

শ্রাবণের ফোনে তখনই কল এলো। জানাল ই-পার্সেল কোম্পানির লোক সেজে অনন্যাকে তুলে নিয়ে যাওয়া লোকটাকে আইডেন্টিফাই করা গেছে। নাম জিসান, বছর খানেক আগেও সে ছিনতাই কেইসে ফেঁসেছিল। ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। শ্রাবণ ওর বর্তমান বর্তমান অবস্থান খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়ে নিজ পোশাক পরিবর্তন করে নিল। ফাহমিদা চিন্তিত হয়ে বললেন,
“দুটো ঘণ্টা ঘুমিয়ে যা অন্তত। শরীরটাকে কী শেষ না করে খান্ত হবি না?”
“প্রাণটাকে রক্ষা করি আগে।” বলতে গিয়েও বলল না শ্রাবণ। বের হতে হতে জানাল,
“অনন্যার বাড়িতে খবর পাঠাও, আম্মু। তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে আনার যু’দ্ধে যাচ্ছি।”
“তারমানে?” ফাহমিদা বিস্ময়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে গেল,
“আমার শান্তি উদ্ধারে যাচ্ছি, আম্মু। একটু দোয়া করো। যেন তোমার দোয়ায় হলেও তাকে পেয়ে যাই।”

জিসানের বাড়ি ডেমরা। সেখান থেকেই ওকে পাকড়াও করেছে শ্রাবণ। সেই সঙ্গে আটক করেছে ওর পরিবারের সদস্যদের। জিসান পুলিশকে সহায়তা না করলে তার পরিবারকে ছাড়া হবে না এমনই হুমকি দেওয়া হলো। ভয় দেখানোর নমুনাস্বরূপ দুটো রাবার বুলেট ছুঁড়ল জিসানের বাহুতে। পরের বুলেটটা হবে প্রাণঘাতী, যা বুকের দুই ইঞ্চি নিচে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেবে। শ্রাবণকে এতটা ক্ষীপ্ত হতে তার ইউনিটের কেউ কখনো দেখেনি। সরাসরি কোনো অপারেশনেও সচরাচর সে থাকে না। কিন্তু এবার শ্রাবণ নিজেই সম্পূর্ণ ইউনিটকে পরিচালনার পাশাপাশি এই কেইসটা আলাদা করে দেখছে। সব ঠিকঠাক এগোলে একজন মাস্টারমাইন্ড ধরা পড়বে আজ। তাই প্রস্তুতিও জোরেসোরেই নেওয়া হলো।
______________

অনন্যা কাঁদছে। চোখে-মুখে ঘৃণার গাঢ় ছায়া। অতীত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনাকে ভাই বলে ডাকতাম। অথচ আপনিই…”

“আমিও তোমাকে বোন বলে মেনেছিলাম বলেই এখনো অক্ষত আছো, অনু। কী জানো তো, শুভ্রার সব কিছুতে আমার গাঢ় দুর্বলতা। তোমার মাঝে শুভ্রার ছায়া আছে বলেই তুমি এত যত্নে আছো। নয়তো এতক্ষণে আমার পোষা একদল হায়না তোমায় নিয়ে উৎসব করত।”

রাশেদের মুখে আপার নাম শুনে অনন্যা জ্বলে উঠল,
“বেই’মান, প্রতা’রক! লজ্জা করে না ওই পাপী মুখে আমার নিষ্পাপ বোনের নাম নিতে?”

রাশেদ অভিভূত হয়ে গেল, “সী, তুমি সত্যিই শুভ্রার ছায়া। ও তোমারই তো প্রতিবাদী ছিল। বেই’মান, প্রতা’রক বলে আমায় গা’লাগা’লি করত। তাতে কিন্তু আমি রাগ করিনি। বড্ড ভালোবাসতাম যে।”

“ভালোবাসতেন? ভালোবাসলে ভাবির সঙ্গে পরকীয়া করলেন কীভাবে? কী করে পারলেন ড্রা’গ দিয়ে সাগরের দ্বারা লাঞ্ছিত করতে?”

রাশেদ আরেকদফা অভিভূত। হাত তালি দিয়ে বলল,
“এটাও জেনেছো? আর কী কী জানো?”

“আমার পরিবারকে ধ্বংস করার ইতিহাস জানি। বলুন এসব মিথ্যা?”

“একদমই না। সবই ঠিক ছিল। শুধু শুভ্রার অতিরিক্ত সাহস এমন একটা পরিণতি এনে দিল। আমি আজও মানতে পারি না ওর ছেড়ে চলে যাওয়া। যার কারণে দেখো, আমি এখনো বিয়ে করিনি। স্ত্রীর আসনটা কাউকে দিতে পারিনি।”

অনন্যার ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একটা মানুষ কতটা নিচু পর্যায়ে চলে গেলে এমন হেসে হেসে নিজের অপরাধের কথা বলে! অনন্যা এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেয়েও রাশেদের থেকে জবাব চায়। জানতে চায় তার আপা কোন সাহসের মূল্য দিতে প্রাণ হারাল।

***
শুভ্রা…
মিডিয়ায় পা রাখা উঠতি উপস্থাপিকা। যার রূপের সঙ্গে সঙ্গে গুণের কদর চারিদিকে। কর্মক্ষেত্রেই তার পরিচয় ঘটে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রাশেদের সঙ্গে। বলাইবাহুল্য রাশেদ শুভ্রার প্রেমে পড়ে প্রথম দর্শনেই। প্রস্তাব রাখে প্রেমের। শুভ্রার জন্য এ ধরনের বিষয় নতুন নয়। কাজের সুবাদে হরহামেশাই এসবের সম্মুখীন হতে হয়। তবে সে বাস্তববাদী। মোহে আটকে কোনো ভুলে জড়াবে না। নির্ভীক, স্পষ্টভাষী ও কোমলতার সংমিশ্রণের এই ব্যক্তিত্বই যেন রাশেদকে আরো বেশি বেপরোয়া করে দিল তাকে পাওয়ার জন্য। সরাসরি প্রস্তাব রাখল বিয়ের। অথচ অর্থনৈতিক স্তরায়নে রাশেদরা উচ্চবিত্ত এবং শুভ্রার পরিবার মধ্যবিত্ত। দুই পরিবারেই দ্বিমত দেখা দিল। তবুও সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে রাশেদ শুভ্রাকে বিয়ে করে। বিয়ের প্রথম এগারোটা মাস শুভ্রার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। রাশেদের মুকুটের সবচেয়ে দামী হিরক হয়ে ও শোভা পেয়েছিল ও। কিন্তু দাম্পত্যের শেষ একটা মাস ছিল ওর জীবনের চরমতম বিভৎস সময়। যার প্রথমেই সে আবিষ্কার করতে পেরেছিল স্বামীর সঙ্গে নিজেরই ভাবির অনৈতিক সম্পর্ক। এর মদদদাতা অবশ্য পিয়াসাই ছিল। ননদের স্বামীর বিশাল সম্পদ, প্রতিপত্তি, জৌলুশ পিয়াসার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। পরিবারের নানান আড্ডার ছলে, নানান ইইঙ্গিতপূর্ণ রসিকতার দ্বারা আশকারা দিয়েছে রাশেদকে। রাশেদ এসবের পুরোনো খেলোয়াড়। অনায়াসেই ধরে ফেলেছিল ভাবিরূপি নারীর গোপন বাসনা। এরপর একান্তে দেখা করা, হোটেলের রূমে দরজা বন্ধ করে কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে দুইহাত ভরে দামী দামী জিনিস শপিং করে ফেরা সবই লোকচক্ষুর আড়ালে চলছিল। শুভ্রা বুদ্ধিমতি। তার প্রতি ভাবির বিদ্বেষ ভালোই ধরতে পেরেছিল। সন্দেহ হলেও রাশেদ শুভ্রাকে এত বেশি আগলে রাখত যে সহসাই বুঝে উঠতে পারছিল না আসল রূপটা। প্রকৃত অর্থেই রাশেদ ওকে রাণী করে রেখেছিল। কিন্তু রাজার একজন রাণী থাকলে গণিকাও যে শ-খানিক হয়। রাশেদ সেই প্রাচীন চিরায়ত রাজাদের প্রথার অমর্যাদা করেনি। রাণীকে তার ভালো জগতের প্রাপ্য সব দিলেও বাইরে তার আলাদা এক কালো জগত ছিল। শুভ্রা স্বামী ভালোবাসায় ডুবলেও ভেসে যায়নি। বরং সতর্ক হয়ে খেয়াল করতে লাগল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসগুলো। এরপর পরকীয়া আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হলো স্বামীর অচেনা রূপ। ব্যবসার আড়ালে মিলল গোপন কর্মকাণ্ডের হদিস।

সর্বদা ন্যায়ের পথ চলেছে শুভ্রা। সেখানে স্বামীর অপকর্ম ওকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। কত তর্ক-বিবাদ হয়েছে এরপরের দিনগুলোতে। পায়ে পড়ে বলেছিল কালো জগৎ পরিহার করতে। যখন বুঝল স্বামীকে ফেরানো সম্ভব নয় তখন সরাসরি তালাকও চেয়েছিল রাশেদের কাছে। কিন্তু রাশেদের শুভ্রার প্রতি প্রকৃত অর্থেই নেশা ছিল। স্ত্রী হিসেবে শুভ্রাকেই সে ধরে রাখতে চেয়েছিল, বাধ্য করে হলেও।

অন্যদিকে পিয়াসা তখন রাশেদের বউ হবার বাসনায় বিভোর। রাশেদকে তার চাই যেকোনো মূল্যে। এতসবের মাঝেও দুজনের মেলামেশা কোনো অংশে ফিকে হয়নি। শুভ্রার কাছেও ততক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার। দিনে দিনে সেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। প্রমাণ খুঁজছিল স্বামীর বিরুদ্ধে। রাশেদ সব বুঝেই তখন শুভ্রাকে থামাতে ও নিজের কাছে বন্দি রাখতে ভিন্ন পন্থার সাহায্য নেয়। পহেলা বৈশাখের দিন সাগর শুভ্রাকে জানায় রাশেদের বিরুদ্ধে কিছু জোড়ালো প্রমাণ জোগাড় করেছে। যা শুভ্রাকে দিতে চায়। সেই আশ্বাসে শুভ্রা তার কাছে দেখা করতে গেলে ড্রা’গের সাহায্যে অচেতন করে কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি তোলা হয়। উহু, সাগর শুভ্রার সঙ্গে খারাপ কিছু করতে পারেনি। রাশেদের বউয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু করার কল্পনা কেউ করলেও তার পরিণাম নির্মম। সাগরের সাথে কয়েকটা ফটো রেখে ওকে চলে যেতে বলে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল রাশেদ নিজেই। শুভ্রার ইগো, নিজের ব্যক্তিত্বের প্রতি সীমাহীন দম্ভ ধূলিসাৎ করতে এবং শুভ্রার ওপর মিথ্যা দোষারোপ এনে ওকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতেই এই পরিকল্পনা ছিল। ড্রা’গে বুদ শুভ্রা চেতনা লাভ করে প্রতিবাদ করতে, নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণ করতে যথার্থ প্রমাণ খুঁজে পাবে না। রাশেদের সামনে হীনমন্যতায় মুখ বুজে থাকবে এমনই ভেবেছিল সে। তবে সেটা একান্তেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে থাকত। ঘূনাক্ষরেও বাইরে প্রকাশ পেতো না। সাগরও মুখ খুলত না। ভুলটা হলো সেদিনই সন্ধ্যায়। শুভ্রা চেতনা লাভ করার পর টের পেয়েছিল কিছু একটা হয়তো ঘটেছে। তার অবস্থাটা তেমনই ছিল। বাড়ি ফিরতেই শুভ্রার শ্বশুরবাড়ির মানুষের সঙ্গে একটু মন কষাকষি হয়। উৎসবের দিন কিনা বাড়ির বউ নিখোঁজ! এরই জেরে রাশেদও শুভ্রার সঙ্গে তর্কাতর্কি করে। শুভ্রা তখনই বাপের বাড়ি চলে যায়। এদিকে পিয়াসার আহ্বানে রাশেদকে ছুটতে হয় তার কাছে। ভাবে আগামীকালই নাহয় শুভ্রার ব্যাপারটা সামলাবে। গাঢ়তম সান্নিধ্যের পর মদিরায় বুদ রাশেদ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই তার ফোনে ঢু মেরে পিয়াসা তার স্বার্থসিদ্ধির মোক্ষম চাবিকাঠি পেয়ে যায়। এবং সে-ই শুভ্রার ছবিগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।

এরপরের ঘটনাগুলো পিয়াসা ব্যতীত সকলের কাছেই ছিল চরম বিস্ময়কর। শুভ্রা জানত তার সঙ্গে গতকাল কিছু ঘটেছে। সাগরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি দেখে ভেবেই নেয় সাগর ওকে রে’ইপ করেছে। কিন্তু বিষয়টা উপস্থাপিত হয়েছে পরকীয়া হিসেবে। যেটা শুভ্রা ও তার সম্রান্ত পরিবারের জন্য সহ্য করার মতো ছিল না। ফলাফল শুভ্রার মতো স্বচ্ছ চরিত্রের মানুষ এমন অপবাদ, লাঞ্ছনা সইতে পারেনি। তাকে কেউ বিশ্বাসও করেনি। অন্ধভাবে ভালোবাসা স্বামীর কালো মুখোশ, চরিত্রে কালি লাগা, পরিবারের অসম্মান, বাবা-মায়ের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, সব মিলিয়ে একইসময় প্রবল মানসিক প্রেশার, অস্থিরতা ওকে ঘিরে ধরে। যা থেকে মুক্তি না পেলে যেন পাগল হয়ে যাবে। বিচক্ষণ মানুষেরও সমীকরণে গরমিল হয়ে যায়। শুভ্রার মৃ’ত্যু সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। স্বয়ং রাশেদও মানতে পারেনি স্ত্রীর অকাল মৃ’ত্যু। পিয়াসার ওপর খু’ন চেপেছিল ওর। কিন্তু ধুরন্ধর পিয়াসা এমন সংবাদ দিল যে তাকে ধৈর্য ধরতে হলো। কেননা পিয়াসার গর্ভে রাশেদের অস্তিত্ব বেড়ে উঠছিল। শুভ্রার বাবার মৃ’ত্যুটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। এরপর পিয়াসার বাড়ি ছাড়া ছিল পরিকল্পনার অংশ। ডিভোর্স দিতে গিয়ে গর্ভবতী জানাজানি হলে সকলের চোখে তা তুষারের সন্তান বলেই গন্য হলো। সুতরাং ডিভোর্স আটকে গেল। বোকা তুষার কিনা ভেবেছিল সংসার বাঁচানোর সুযোগ পেয়েছে!

রাশেদ হাসতে হাসতে বলল,
“ইশ! যে বাচ্চার জন্য তুষারের এত কষ্ট, এত আক্ষেপ, জানলই না সেই বাচ্চার বাপ আসলে ও ছিলই না।”

ঘৃণায় অনন্যার বমি পেয়ে গেল। মনে হলো সম্মুখের ব্যক্তিটির মুখে থুতু ছুঁড়ে দেয়। দুজন মানুষের লোভ, লালসা কতগুলো নিরীহ জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছিল তা যদি অনুধাবন করার ক্ষমতা এদের থাকত!

চলবে….

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [৩০]
প্রভা আফরিন

“কোন কালো জগতের পাপী মানুষ আপনি? যার জন্য আমার আপা এত কষ্ট পেল।”

অনন্যার কণ্ঠের ক্ষোভ টের পায় রাশেদ। সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে সে। কিন্তু সবের মাঝে একবারও নিয়ন্ত্রণহারা হয়নি। চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করে হাঙ্গামা বাঁধায়নি বা ছেড়ে দেওয়ার আকুতিও করেনি। বরং তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন অসঙ্গতি উদ্ধারে। সবটা শুনেই যেন সে শান্ত হবে। রাশেদেরও যেন আর কোনো রাখঢাক নেই। লজ্জা বস্ত্র একবার খসে গেলে আড়ালটাও সরে যায়। তবে জবাব সে দিল না। সিগারেট পোড়া, মোটা ঠোঁটে হাসি খেলিয়ে বলল,
“তুমি এখানে কীভাবে এলে বলো দেখি?”
“আপনারা তুলে এনেছেন।”
“কিন্তু সিসিটিভিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তুমি হেঁটে হেঁটে এসেছো। কেউ তোমাকে জোর করেনি।”
অনন্যা বিস্মিত। ব্যাপারটা ধরতে মস্তিষ্কে কিছুটা চাপ পড়ল। চেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে,
“ডেভিলস ব্রেথ! ওই ড্রা’গ যেটা আমার আপাকে দিয়েছিলেন!”
রাশেদ হাসল। অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “আপনি ড্রা’গস ওয়ার্ল্ডের সাথে সংযুক্ত?”

ঘরে একজন লোকের আগমন ঘটল। কৃষ্ণ বর্ণ দেহ, চোখদুটো জ্বলজ্বলে। হাতে খাবার ও কোকের বোতল। রাশেদের ইশারায় অনন্যার সামনে খাবারগুলো নামিয়ে দিয়ে চলে গেল লোকটা। রাশেদ কোকের বোতলের ছিপ খুলতে খুলতে বলল,
“পুলিশের সঙ্গে থেকে ভালোই চালাক-চতুর হয়েছো। জিজ্ঞাসাবাদ করে ক্লান্ত হয়ে গেলে বোধহয়। খেয়ে নাও। এখনো কতকিছু জানবে, দেখবে।”
“আমার কথার জবাব দিন।”
“তোমার মুখে ভাইয়া ডাকটা মিস করছি।”
“সম্বোধনের যোগ্য আপনি নন।”
রাশেদ যেন খুব কষ্টে উথলে ওঠা রাগটা সামলাল। আফসোস করে বলল,
“তুমি জানো, শুভ্রাকে আমি কখনো হিট করিনি। আমাকে গা’লাগা’ল দিলেও না। তোমার বেলাতেও পারছি না। তোমার এই সুন্দর মুখটায় তাকালেই ওর চেহারাটা খুঁজে পাই।”

অনন্যা বুঝল লোকটা কথা ঘোরাচ্ছে। রাশেদ কোকের বোতল ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও। এতে কিছু মেশানো নেই।”

অনন্যার পেটে খিদে। কিন্তু খাওয়ার রুচি নেই। নাড়িভুড়ি উলটে আসতে চাইছে যেন। চুপ থেকে কালক্ষেপণ না করে ও আবার প্রশ্ন করল,
“সব তো ঠিকই ছিল। আপা নেই, পিয়াসা ও আপনার মধুময় জীবন। তবে হঠাৎ তাকে মা’রলেন কেন?”

রাশেদ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “তোমাকে কে বলেছে আমি মে’রেছি?”

অনন্যা ঠোঁটের কোণা টেনে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গি প্রকাশ করে জবাব দেয়, “সাগর তো আপনারই সাগরেদ। তার করা মানেই আপনার করা। যেমন আমার আপাকে ব্যবহার করেছিলেন। মানুষটা আপনার চরিত্রের নির্মমতার বলি হলো।”

রাশেদ ক্ষেপে গেল, “আমার নয়, অনু। আমার কোনো দোষ নেই ওর মৃ’ত্যুর পেছনে। আমি শুভ্রাকে সর্বোচ্চ সুখ দিয়েছি, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছি। সমস্ত ঐশ্বর্য ওর পায়ের কাছে এনে দিয়েছি। নিজের কাছে যত্নে সারাজীবন রেখেও দিতাম। আমার ভবিষ্যত সন্তান ওর পবিত্র কোল থেকেই জন্মাতো। কিন্তু ওই বি* পিয়াসার লোভের জন্যই আমার সব ভেস্তে গেল।”

অনন্যা অবাক হয় রাশেদের ভাবনার ওপর। এতকিছুর পরেও সে ভাবে শুভ্রার মৃ’ত্যুর পেছনে তার কোনো হাত নেই? ঐশ্বর্য, আরাম দিয়েই নারীকে কাবু করা যায় তার ভাবনা? অথচ বিবাহিতা নারীর প্রকৃত সুখ-সাচ্ছন্দ্য স্বামীর পবিত্র ভালোবাসায়। এর মর্ম যদি বুঝত। এ নিয়ে তর্ক করার অদম্য ইচ্ছেটা অনন্যা গিলে নিল। রাগিয়ে দেবে না ও, সব শুনতে হবে।
“আপনার ক্ষণজন্মা বাচ্চার মা সে। আপনার উথলে পরা অবৈধ প্রেম। এতসবের পরেও বিয়ে কেন করলেন না তাকে?”

“আমরা কিন্তু বাইরে চলাচলের জুতো পরে বেডরুমের মধ্যে হাঁটি না। সে যতই দামী বা ব্র‍্যাণ্ডেড প্রোডাক্ট হোক। এটাই নিয়ম।”

বক্তব্যের অর্থ বুঝল অনন্যা। সে মৌন রইল আরো কিছু শোনার আশায়। রাশেদ কিন্তু নিরাশ করল না,
“তবে ঝড়ো বাতাসে বাইরের ময়লা ঘরে ঠাঁই পাবার পায়তারা করলে শান্ত থাকতে হয়। কেন না বাতাস যতক্ষণ আছে ধুলো উড়বেই। ঝড় থেমে গেলে সেই ধুলোকে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হয়। পিয়াসার বেলাতেও তাই। কিন্তু মানতেই হবে মেয়েটার মাঝে দম ছিল। মানুষকে আকৃষ্ট করার দারুণ এক ক্ষমতা ছিল বলেই দীর্ঘদিন আমার সঙ্গ পেয়েছিল। আরো পেতো। কিন্তু মেয়েটা বড্ডো অধৈর্য। সে এতটাই উড়তে শুরু করেছিল যে আমাকেই ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে!”
______________

সাগর তার অপরাধ স্বীকার করেছে। জবানবন্দিতে জানিয়েছে পিয়াসার খু’ন হওয়ার দিনে ফ্ল্যাটে ঠিক কী ঘটেছিল। খু’নের পেছনে মূল কারণ হিসেবে একটি গোপন ডকুমেন্ট এর নাম এসেছে। যাতে কিছু অপকর্মের প্রমাণ সরিয়েছিল পিয়াসা। নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তা। কারণ ও বুঝে গেছিল রাশেদ ওকে শুধু ব্যবহার করছে। অ্যালেন থেকে শুরু করে বড়ো বড়ো রাঘব বোয়ালদের কাছে বিনোদন হিসেবে প্রদর্শিত হতো পিয়াসা। ছিল স্বার্থ আদায়ের শর্টকাট টেকনিক। কিন্তু ক্রমেই পিয়াসা অস্থির হচ্ছিল। কদর্য মনের মানুষ বলেই সে জানত এরা কতটা বেইমান হতে পারে। রাশেদ যে বেইমানি করবে না তার কী নিশ্চয়তা। তার জন্যই কিছু ডকুমেন্ট সংগ্রহে রেখেছিল ও। পিয়াসা টের পাচ্ছিল একটু একটু করে ও কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। রাশেদ ওকে জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা হ্রাস করছে। মড়িয়া পিয়াসা তখন শেষ অ’স্ত্র হিসেবে ডকুমেন্ট এর হুমকি দিল। ব্ল্যাকমেইল করতে চাইল রাশেদকে। কিন্তু বোকা নারী, রাশেদের সঙ্গে বুদ্ধির দৌড়ে টিকতে পারেনি। কোনোরূপ ঝুঁকি এড়াতে এই বিষাক্ত প্রাণীকে সাফ করা একান্তই প্রয়োজন ছিল৷ তাও কোনো প্রমাণ না রেখে। রাশেদ একমাস আগেই দেশ ছাড়ে। এরপর পিয়াসার কাছে ডকুমেন্টস খোঁজ চালানো হয়। না পেয়ে একে একে সমস্ত ডিভাইস নষ্ট করা হয়৷ কাজের মহিলা জানত পিয়াসার ফ্ল্যাটে রাশেদের নিত্য আনাগোনা। এই তথ্যটাও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। খু’নের দিন সাগর গিয়েছিল শেষবারের মতো ডকুমেন্ট এর খোঁজ চালাতে। কিন্তু ঝামেলাটা মূলত সেই বাঁধিয়ে ফেলেছিল।

পিয়াসার ওপর সাগরের একটা লোভ ছিল। এর জন্য অবশ্য পিয়াসাই দায়ী। সে আশেপাশের পুরুষদের আকৃষ্ট করতে পছন্দ করত। নজরের মধ্যমণি হয়ে থাকতে ভালোবাসত। পিয়াসার প্রতি রাশেদের অনাগ্রহ টের পেয়ে তাই নিজের ইচ্ছেটা সংবরণ করতে পারেনি সাগর। ড্রা’গে বুদ করে ওকে ধ’র্ষ’ণ করে। পিয়াসার যখন হুশ ফেরে ততক্ষণে তার ঘর উলোটপালোট করে খোঁজাখুঁজি সম্পন্ন করেছে সাগর। নিজের বিপদ টের পেয়ে গেছিল পিয়াসা। শেষ মুহূর্তে গিয়ে তার পুরোনো ফোনের কন্টাক্টের শুরুতে সেইভ করা নম্বরটাতেই কল করে। যার প্রতি একসময় এতটাই আসক্ত ছিল যে স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তুষারকে ও বলতে চেয়েছিল কিছু৷ সুযোগটা দেয়নি সাগর। বসার ঘরের শোভা হিসেবে ঠাঁই পাওয়া কাচের ভারী বস্তুটা দিয়ে সরাসরি মাথায় আঘা’ত করে। পিয়াসা ভূলুণ্ঠিত হয় বিনাশ্রমেই। প্ল্যানিংয়ের বাইরে আকস্মিক কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেলে সাগর ভড়কে গিয়ে পালিয়ে যায়।

জবানবন্দিটা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে জামশেদের মাথায় হুট করেই ডকুমেন্টস বিষয়টা খেলে যায়। এমন কিছু তো তারা সন্ধান করে পায়নি। সাগরও পায়নি। অর্থাৎ সেটা এখনো আছে। অথবা কিছুই নেই। পিয়াসা অহেতুক ভয় দেখাতে চেয়েছে। তবুও কেন জানি জামশেদ স্থির হতে পারলেন না। মনকে বোঝাতে হলেও আরেকবার সবটাতে চোখ বুলাতে হচ্ছে। এই মন জিনিসটা বড়োই ভয়াবহ। কিছু চাইলে না পেয়ে শান্তি পায় না। যেমন শাহনেওয়াজ স্যার। মনের মানুষের জন্য জীবনের ঝুঁকি, প্রফেশনের ঝুঁকি নিতেও দুইবার ভাবলেন না। নাহ, এতসব চিন্তা নিয়ে বাঁচা যায় না। এককাপ কড়া করে চা পান করা দরকার।
_____________

জিসানের কাছে ইতিমধ্যেই একবার কল এসেছে। ওদের দলের আরেকজনকে ঘাটে পাঠাতে হবে। চালান আসবে। সকলে কাজে তৎপর হবে। তাই আজ লোক বেশি দরকার। জিসানের কণ্ঠ থেকে মিনমিনে জবাব বেরিয়েছে। কারণ সে এখন পুলিশের কাছে জিম্মি। এই খবর বিপরীতের মানুষেরা জানে না। অনন্যাকে নির্বিঘ্নে তুলে আনার দায়িত্বটা জিসানের ঘাড়েই ছিল। নির্দেশ ছিল মেয়েটাকে তুলে এনেই গা ঢাকা দিতে হবে। কিন্তু বাড়িতে বৃদ্ধ বাপের শ্বাসটান উঠে এখন-তখন অবস্থা। হাসপাতালে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েই পালাবে ভেবেছিল। কিন্তু মেয়েটাকে ফোনে কথা বলা অবস্থাতে আসক্ত করলেও ব্লান্ডার যেটা হয়েছে তা হলো ফোনের ওপাশে তখন তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের মানবটা ছিল। যে অনায়াসেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে সতর্ক হওয়ার আগেই ওকে ধরে ফেলেছে। এমনকি জিসানের ফোনে আসা কল থেকে লোকেশন ট্রেস করে ফেলেছে অনায়াসে। এরপর গাড়িতে যেতে যেতেই একটা গ্রুপ প্ল্যানিং করে ফেলেছে ওরা।
শ্রাবণরা আছে সাদা পোশাকে। শত্রুর শিবিরে আজ ওদের ইউনিফর্মে ঢোকা যাবে না। পুলিশের উপস্থিতি জানলে যে কেউ খবর পৌঁছে দেবে। ব্যস্ত বুড়িগঙ্গার তীরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেই কার্যোদ্ধার করবে।

নদীর পাশ ঘেঁষা বাড়িটা দোতলা, সরু ও পুরোনো ধাঁচে গড়া। নিচতলায় গোডাউন। একটি পন্য বোঝাই জাহাজ থেকে বিদেশ হতে আমদানিকৃত তেল, চিনি, মশলা এসে আশ্রয় নিচ্ছে সেই গোডাউনে। হাসনাত আলম নামের এক ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে সেই পন্য খালাস দেখতে দেখতে হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে এক ষণ্ডা কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করল,
“এবার আমদানির অবস্থা কেমন, ভাইজান?”

লোকটা তাকাল। অনাহুত ব্যক্তিকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা গেল না। উপেক্ষা করে সামনে পা বাড়াতে নিলে হাসনাত আলগোছে পি’স্তলটা তার তলপেটে ঠেকিয়ে হুমকি দিল,
“নড়লে জায়গাতেই গেড়ে ফেলব।”

শ্রাবণ লাফিয়ে উঠে গেছে মালবাহী জাহাজের ভেতর। পর পর দুজনকে গু’লিতে ঘায়েল করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলিশান কেবিনের দরজায় হানা দিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“দ্য গ্রেইট স্মাগলার তানভীর খন্দকার। আপনি আমায় স্মরণ করলেন। আর আমি এসে হাজির।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে