বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-২১+২২

0
810

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২১]
প্রভা আফরিন

অনন্যা পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ফোন আসায় কথার মাঝে বিঘ্ন ঘটলেও শ্রাবণ অত্যন্ত শান্ত হয়ে ফোন কানে ধরে রেখেছে। স্পিকারে ভেসে আসা সংবাদে মস্তিষ্ক যতটা চঞ্চল হয়েছে, দৃষ্টি ততটাই নমনীয়, শান্ত। অনন্যা ঘাড়ে ফেলে রাখা চুলে খোপা প্যাঁচাতে শুরু করেছে এই সুযোগে। শ্রাবণ ওর খোপা করা দেখতে দেখতেই জামশেদের কথা শুনছে। জামশেদ বললেন,
“স্যার আরেকটা আপডেট আছে।”
“বলুন।”

“ভিক্টিমের বাড়ির দারোয়ান ও পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী ছবি দেখে নিশ্চিত করেছে সাগরকে ওই বিল্ডিংয়ে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখেছে। আমরা ধোঁয়াশার মাঝেও সঠিক পথেই এগিয়েছি, স্যার। শুধু ব্যস্ততা ও প্রেশারে কয়েকটা জিনিস মাথা থেকে বের হয়ে গেছিল। গতকাল পিয়াসার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এসেই সাগরের ছবি কালেক্ট করি। আজ সেখানে গিয়ে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হলাম। ফেরার পথে জানতে পারলাম ভাগাড়ে বেওয়ারিশ লা’শ পাওয়া গেছে।”

“আর সেই লা’শটা ভিক্টিমের বাড়ির কাজের লোকের।”

“ইয়েস স্যার, মধ্যবয়সী মহিলাটাকে খুবই নির্মমভাবে মা’রা হয়েছে।”

“আচ্ছা, আপনি লা’শের সুরতহালের ব্যবস্থা করুন। আমি আজ আসব একবার। বাকি কথা সামনাসামনি হবে।”

শ্রাবণ রেখে দিল। এদিকে লা’শের কথা শুনে অনন্যার হাত থমকে গেছে। বলল,
“লা’শ! কার লা’শ?”

ফোন পকেটে রেখে শ্রাবণ অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলে,
“পিয়াসার বাড়ির কাজের লোকটা খু’ন হয়েছে।”

অনন্যার আধখোপা করা চুলগুলো আবারো কাঁধ বেয়ে নেমে পিঠে ছড়িয়ে গেছে। উত্তেজিত স্বরে বলল,
“কাজের লোক!”

শ্রাবণ এদিক-ওদিক চেয়ে বলল,
“খোলা রাস্তায় এসব আলোচনা সমীচীন নয়। তুমি চাইলে গাড়িতে উঠতে পারো। অফিস যাবে তো! ঠিকানা বললে ড্রপ করে দেই চলো।”

অনন্যা হাতের পিঠে নজর ফেলে ঘড়ি দেখল। সময় হয়ে আসছে। ও সম্মতি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। শ্রাবণ চোখে কালো চশমা পরে, লোমশ হাতে স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে। গাড়ি ছোটে ধানমণ্ডি রোডে। অনন্যা জানতে চায়,
“ভাবির কেইসটার সঙ্গে আপার যোগসূত্র আছে নিশ্চয়ই!”

“অবশ্যই। দুইখানেই মেইন সাসপেক্ট সাগর। ভিক্টিমদের সঙ্গে তার সখ্যতা পরিষ্কার।”

“সাগর!” অনন্যা দাঁতে দাঁত চিপে। ঘৃণায়, ক্রোধে চোখটা যেন জ্বলে ওঠে। বলে,
“ওকে ধরতে পারোনি?”

শ্রাবণ বেশ স্বতঃস্ফূর্ত স্বরেই বলল,
“বর্তমানে পলাতক।”

অনন্যা অনেকক্ষণ চুপ রইল। কী ভেবে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“কিন্তু ভাবি তো জানতো সাগর আপার সঙ্গে কী করেছে। এরপরও সখ্যতা রাখল কীভাবে? আমার মাথায় তো কিচ্ছু ঢুকছে না।”

শ্রাবণ চমৎকৃত হয়ে বলল, “গুড পয়েন্ট অনু। তবে তুমি এ নিয়ে টেনশন নিয়ো না। আমার ওপর ছেড়ে দাও বিষয়টা। খড়ের গাদায় সুঁচ আছে এটা যেহেতু নিশ্চিত। সুতরাং খড় জ্বালিয়ে দিয়ে হলেও সূচের রহস্য ভেদ করতে হবে।”

ভরসা পেল অনন্যা। তবুও পিয়াসার ব্যাপারটা কেমন খোঁচাতে থাকে অন্তরে। গন্তব্যে পৌঁছে ও নেমে গেল গাড়ি থেকে। শ্রাবণ ডেকে উঠল,
“শোনো, তোমার বন্ধুকে থ্যাংকস দিয়ো আর পক্ষ থেকে।”
“কেন?” অনন্যা ভ্রুকুটি করে।
“কেউ কমপ্লিমেন্ট দিলে থ্যাংকস দিতে হয়। তাকে বোলো সেও বিউটিফুল। এবং তার বন্ধুটিও।”

অনন্যা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল। শ্রাবণ শুনে নিয়েছে ইতু কথা! চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়িটা। দৃষ্টিসীমায় যতক্ষণ ছিল, রিয়ারভিউ ভেদ করে একজোড়া চোখ ওকে দেখছিল। শফিক পাশে এসে দাঁড়িয়ে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কে পৌঁছে দিয়ে গেল তোমায়?”

অনন্যা চমকে পাশ ফিরল। স্মিত হেসে ছোটো করে উত্তর দিল,
“প্রতিবেশী।”
“আগে তো দেখিনি।”
“আগে প্রয়োজন পড়েনি।”
“তুমি কী প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গেই মেশো না?”
অনন্যা উদাস হলো। বলল,
“একসময় আমি যেখানেই যেতাম পরিবেশ মাতিয়ে রাখতাম। এখন সেই প্রফুল্ল মনটা হারিয়ে গেছে।”
“খুঁজে বের করছো না কেন? এই বয়সে এতটা নিস্পৃহতা কেন আঁকড়ে আছো?”
অনন্যা স্তিমিত স্বরে বলল,
“জানি না।”
_______________

শ্রাবণের সামনে এখন জামশেদ উপস্থিত। দুজনের আলোচনার বিষয় নতুন পাওয়া বস্তাবন্দি লা’শ। সংবাদ মাধ্যমে ইতিমধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে কেইসটাকে নিয়ে। ছড়াচ্ছে হাজারো জল্পনাকল্পনা। ভিক্টিম দুজনই নারী হওয়ায় কেউ কেউ বলছে কুখ্যাত রে’পি’স্ট সিরিয়াল কি’লারের আবির্ভাব হয়েছে। যদিও দ্বিতীয় ভিক্টিমের ধ’র্ষ’ণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে এলে বাকিটা জানা যাবে। কিন্তু সেসব নিয়ে পুলিশের মাথা ব্যথা নেই। তারা মোক্ষম একটা সূত্র পেয়েছে। যে সূত্রের নাম সাগর। সাগরের বিষয়টা পুলিশ প্রকাশ করেনি মিডিয়ার কাছে। সেদিন রাশেদের কাছে সাগরকে সন্দেহ করার বিষয়টা প্রকাশ করেও যে বোকামি হয়ে গেছে এখন বুঝতে পারছে ওরা। রাশেদের বা সাগরের পরিবারের সঙ্গে সাগরের যোগাযোগ থাকলে সতর্ক হয়ে গেছে আরো। শ্রাবণ বলল,
“আমাদের দৃষ্টি ঘুরেফিরে সাগর ও রাশেদ এই দুটো মানুষের ওপর নিবদ্ধ। এ জন্য নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এই দিকটা আগে সরাতে হবে। ব্রডলি চিন্তা করতে হবে।”

“কিন্তু স্যার, ঘাপলা তো এই দুজনেরই সবচেয়ে বেশি।”

“সে জন্যই তো দৃষ্টিটা প্রসারিত করতে হবে। ওরাও জানে আমাদের দৃষ্টি ওদের দিকেই। এও জানে প্রুভ ছাড়া পুলিশ অন্ধ। তাই প্রতিটা পা ওরা সতর্কতার সঙ্গেই ফেলবে। আমাদের চোখ ওদের পা থেকে সরিয়ে পথের দিকে দিতে হবে। সেই পথই গন্তব্য দেখাবে।”

জামশেদ মাথা নেড়ে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,
“সাগরের রেকর্ড একদম ফার্স্টক্লাস। মানুষের যেমন তিনবেলা ভাত খাওয়া আর রাতে ঘুমাতে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়, সাগরের কাছে মেয়েও তেমনই নিত্য অভ্যাসের বিষয়। একদম ডিগ্রিধারী উইমেনাইজার।”

শ্রাবণ জিভের আগা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ উৎপন্ন করে, যেন মজার কিছু শুনেছে। বলে,
“ওহ আচ্ছা! তার বরশির একটা মাছ তবে পিয়াসাও ছিল হয়তো!”

“পিয়াসার গায়েবি সূত্রে পাওয়া বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এই বান্দাকে বেশ কয়েকবার দেখা গেছে। তাকে কেন্দ্র করে প্রাথমিকভাবে বিষয়টাকে দাঁড় করালে অপরাধটা এমনও হতে পারে, সাগর একজন রে’পি’স্ট, যে প্রথমে ভিক্টিমের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে, এরপর ড্রা’গ দিয়ে শিকারকে আয়ত্ত্বে এনে কার্য সম্পাদন করে। হয়তোবা ছবি বা ভিডিও-ও ধারণ করে। যেমনটা শুভ্রা মেয়েটার সঙ্গে করেছিল। পিয়াসার বেলায় হয়তো বিষয়টা জটিল ছিল কিংবা অন্য কোনো স্বার্থ, তাই মে’রে পালিয়ে গেছে।”

শ্রাবণ বিরস বদনে বলল,
“আপনার কল্পনাশক্তি দারুণ। এখন এই কল্পনার ভিত্তিটাও খুঁড়ে বের করুন। তবে কাজের লোকটাকে মা’রার স্ট্রং কারণ পাচ্ছি না।”

“হয়তো এই কেইসের ব্যাপারে এমন কিছু জানত যা বিপদজনক। তাই মহিলাকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে।”

শ্রাবণ মাথা নেড়ে বলল,
“আরেকটা ইনফরমেশন নোট করে রাখুন। পিয়াসা জানত শুভ্রার সঙ্গে সাগরের অ্যাফেয়ার ছিল বা সাগর শুভ্রাকে ফাঁসিয়েছে। দুটোর একটা নিশ্চিত৷ সব জেনেও পিয়াসা এর সঙ্গেই যোগাযোগ রেখেছে। স্ট্রেঞ্জ না?”

“পিয়াসা কিন্তু উগ্র ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল, স্যার। ফ্ল্যাটটা কীভাবে কিনল জানা যায়নি। যাদের থেকে কিনেছে তারা বর্তমানে আমেরিকায়। রিচ করতে চেষ্টা করেও পাচ্ছি না।” জামশেদ সঙ্গে যোগ করে দিল।
শ্রাবণের তবুও খটকা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে শুভ্রার সময়টা হতেই কোনো গণ্ডগোল ছিল। সব জানতে সাগরকে চাই। শ্রাবণের অভিব্যক্তি আচমকা চঞ্চল হয়। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“উইমেনাইজারদের প্রবৃত্তি কী?”

“নারীসঙ্গ!” সরল গলায় জবাব দিয়ে জামশেদ ভ্রুকুটি করে ফেলল। শ্রাবণ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে।
_________________

বিনিদ্র রজনীতে জাঁকিয়ে বসেছে স্তব্ধতা। ধূসর আকাশতটে আজ অমাবস্যা। একাকী ফ্ল্যাটে নিরবতা নিয়ে অপেক্ষারত এক জননী। একমাত্র পুত্রের পথ চেয়ে খাবার আগলে বসে থাকা ফাহমিদার এখন নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘড়ির কাটা দশটার ঘর পেরোলে ডোরবেল বাজল। অপেক্ষার অবসান! ক্লান্ত, অবসন্ন মুখে রাজপুত্র শাহনেওয়াজ তার ব্যক্তিগত রাজ্যে পদার্পণ করল। দেখল রাজমাতার মুখে ঘন অমাবস্যা। জুতো খুলে, ভেতরে আসতে আসতে বলল,
“এত দামী লাইট জ্বালিয়ে কী লাভ যদি কারো মুখের অন্ধকার দূর না করতে পারে!”

ফাহমিদা ঝাঁঝের সঙ্গে প্রত্যুত্তর করলেন,
“এত বড়ো বাসা নিয়ে কী লাভ যদি মানুষই না থাকে!”

“আম্মু…” শ্রাবণ মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরতে এসেছিল। ফাহমিদা শাসিয়ে বললেন,
“ময়লা গায়ে ধরবি না আমায়। গোসল করে আয়।”

হতাশ হয়ে শ্রাবণ চলে গেল। ফিরে এসে খেতে বসতেই দেখল দুটো প্লেটে খাবার বাড়া হয়েছে। শ্রাবণ কপট রাগ নিয়ে বলল,
“আবার না খেয়ে বসে ছিলে?”

“তাতে তোর কী?”

শ্রাবণ নতি স্বীকার করে বলল,
“জানোই তো আমার ডিউটি এটা। মাঝে মাঝে ফিরতে দেরি হবেই। তাই বলে না খেয়ে এতরাত অবধি বসে থাকবে? তোমার অসুখ হলে আমায় কে দেখবে?”

একদম শিশুর মতো শোনায় ছেলের কণ্ঠ। ফাহমিদা মনে মনে গলে গেলেন একদম। বাইরে মিথ্যা কঠোরতা দেখিয়ে বললেন,
“বারন করেছিলাম পুলিশ প্রশাসনে না জড়াতে। কোনোকালে আমার কথা শুনিস না। বিপদের কোনো ঠিক আছে? আমি একা মানুষ। অসুখ হলে আর কিই বা হবে? একা বাড়িতে পড়ে থাকলে কেউ দেখার থাকবে না।”

“টুসি কই? ও থাকে না তোমার সঙ্গে?”

ফাহমিদা রেগে চামচ বারি দিয়ে বললেন,
“কাজের লোক সঙ্গে থাকলেই নিঃসঙ্গতা কাটে?”

“তাহলে মামাবাড়ি ঘুরে আসো।” শ্রাবণ নিবিষ্টমনে ভাত মাখাচ্ছে।

ফাহমিদা হতাশ গলায় বললেন,
“তবুও বিয়ের কথা বলবি না!”

শ্রাবণ ক্ষীণ হাসি চেপে বলল,
“ওহহ! এর জন্য এত রাগ! করে নেব বিয়ে। বলো কেমন মেয়ে চাও?”

ফাহমিদা ছেলের কথায় অদ্ভুত চোখে চাইলেন। বললেন,
“কেমন মেয়ে চাই মানে? সংসার আমি করব নাকি তুই? এই প্রশ্ন তো আমার তোকে করার কথা।”

“আমি তো সারাক্ষণ ডিউটি নিয়েই ব্যস্ত থাকব। সংসারে তোমরাই থাকবে সারাদিন।”

“দিনশেষে তোমাকেও সংসারেই ফিরতে হবে। দরজা খুলে যখন অপছন্দের বউকে দেখবে তখন আর সংসারে শান্তি হবে না। ঢং ছেড়ে বল, পছন্দ আছে কোনো? না থাকলে দুই মা-ছেলে মিলে পছন্দ করে নেব।”

শ্রাবণ খাওয়া থামায়। চোখের পাতায় ভর করে এক বিষাদঘন কেশরাশিযুক্ত মায়াবী মুখ। বিড়বিড় করে বলে,
“সে আছে এক অভিশপ্ত নগরীর রাজকন্যা। তার রাজ্যের সমস্ত অভিশাপ দূর করে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে আসব।”

চলবে…

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২২]
প্রভা আফরিন

সকাল সকাল ভাত ও পটল ভাজি রেঁধে খেয়ে নিল অনন্যা। টিউশনিটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে একটু আরাম মিলেছে। হুড়োহুড়ি করে কাজ করতে হয় না এখন। রান্নার ফাঁকে বইতেও একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু দেহে আরাম মিললেও পকেটের দফারফা। আগে মায়ের হাতে সোনামুখ করে কিছু টাকা গুজে দিতো মাস শেষে। মায়ের অভাব না থাকলেও এতে ওর নিজের ভালো লাগত। এখন আর সেটা সম্ভব নয়। উল্টে নিজেরও চলার কষ্ট হয়ে যাবে। অনন্যা খরচ কমিয়ে প্রতি মাসে কিছু টাকা জমাচ্ছিল জার্নালিজমের ওপর কোর্স করার জন্য৷ ইচ্ছে আছে প্রিন্ট মিডিয়া অথবা টিভি চ্যানেলের হয়ে কাজ করার। আপার মৃ’ত্যুর আগে অবশ্য এটাই ছিল অনন্যার ফিউচার প্ল্যান। কিন্তু আপার চলে যাওয়ার পর নিজের এই স্বপ্নটার কথা ও প্রায় ভুলেই গেছিল। শেষমেষ করতে পারবে কিনা কে জানে! তার তো আবার আনপ্রেডিক্টেবল লাইফ। আজ যা ভাবে পরদিন সকালেই তা উলটে যায়। খেয়েদেয়ে ভার্সিটির জন্য তৈরি হয়ে নিল ও। শিউলির বোঁটার মতো কুয়াশাচ্ছন্ন কমলাটে কামিজের সঙ্গে জলপাই রঙা প্রিন্টেড প্যান্ট। চুলে ফ্রেঞ্চ বেণি করে সামনে রাখল। অল্পকিছু চুল কপাল ও কানের পাশ থেকে বের করে গালের ওপর ফেলে একটা মেসি লুক ক্রিয়েট করল। কব্জিতে সাদা বেল্টের ঘড়ি। ত্বকের ওপর প্রসাধনী খুব একটা ব্যবহার না করলেও অনন্যা সর্বদা পরিপাট্যতা বজায় রাখে। রুচিশীলতা ও মার্জিত লাইফস্টাইল ওর ব্যক্তিত্বের প্রথম পরিচয়। মুখে মুখে তর্ক জিনিসটা ওর অভ্যাসে নেই।

পাশের বেডের তমা আপু ওর স্নিগ্ধতা দেখে মুগ্ধ হয়ে বলল, “কী ব্যাপার অনন্যা? বেশ গ্লো করছো যে!”

অনন্যা বই-খাতা গুছিয়ে কাঁধে ব্যাগ তুলে ঠোঁট উলটে জবাব দিল, “কী জানি! দৌড়ঝাঁপ একটু কমে গেছে, তাই হয়তো।”

“স্ট্রেস কম নিলেই পারো। তোমার এই গুমোট ভাবটাই মুখটাকে ম্লান করে দেয়। একটু দাঁত বের করে হাসো। এমনিতেই মুখের গ্লো বেড়ে যাবে।”

অনন্যা স্মিত হেসে বেরিয়ে গেল ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। আজিমপুর সরকারি কলোনিতে নিজ হোস্টেল থেকে বের হতেই ওর ঠোঁটের স্মিত হাসিটা মুছে গেল। জেঁকে বসল অস্বস্তি। কেন জানি মনে হয় কেউ সিসিটিভির মতো ওর গতিবিধি নজরে রাখছে। এই ভাবনাটা ওকে শান্তি দিচ্ছে না। মস্তিষ্কে ভাবনা আসে ও কি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে নাকি!

ক্লাস শেষে নীলক্ষেত বইয়ের দোকানে ফাইনালের শিট কালেক্ট করতে এসেছে ইতু ও অনন্যা। অনন্যা যেন একটু সংকুচিত। বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। উশখুশ করছে। ইতু ওর হাত ধরে চিপাগলিতে ঢুকে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আস্তে করে বলল,
“এভাবে চোরের মতো হাঁটিস কেন? কাউকে খুঁজছিস নাকি?”

অনন্যা সত্যি কথাটাই বলল, “ইতু, আমার না মনে হয় কেউ আমাকে ফলো করে।”

“মানে? কে ফলো করে? কোনো বখাটে? নাকি কোনো আশিক?”

ইতুর দুষ্টুমি গায়ে না মেখে অনন্যা আবার বলল,
“উহু, মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ লুকিয়ে ফলো করে। আমার খুব ভয় করছে। এটা কি সত্যি নাকি আমি মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছি?”

“কার এত্ত বড়ো কলিজা! পুলিশের ক্রাশকে ফলো করে? তুই ওই হ্যান্ডসাম পুলিশকে এক্ষুনি ফোন কর। করে জানা ইউ আর ইন ডে’ঞ্জা’র। সে যেন এ্যাকশন হিরোদের মতো এসে তোকে সেইভ করে বুকে আগলে নেয়।”

অনন্যা হাতের শিটগুলো দিয়ে ইতুর বাহুতে বারি মা’রে। বিব্রত মুখে, দাঁতে দাঁত চিপে বলে,
“তোর মুখ খুব বেশি চলে। সেদিনও উল্টোপাল্টা বলে আমাকে লজ্জায় ফেলেছিস।”

“লজ্জা পাওয়া ভালো। ছেলেরা লাজুক মেয়ে পছন্দ করে। আর লজ্জায় ফেলেছি বলেই না বুঝেছি অপর পক্ষের আশকারাও নেহাৎ কম না। নাহলে কী আমার প্রশংসার সুযোগে তোরও প্রশংসা করে দেয়! এটাই আশকারা। আদনান চলে যাওয়ার পর তোর মনে ঝং ধরে গেছে। তাই বুঝিস না।”

কথাটা বলেই ইতু জিভ কাটল। চোরা চোখে চেয়ে দেখল অনন্যা নির্বিকার। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ও। কেননা আগে যতবার মুখ ফসকে নামটা উচ্চারণ করেছে ততবারই অনন্যার মুখ করুণ হয়েছে। বিরহের ভারী নিশ্বাসে ছেয়ে গেছে চারপাশ। এখন আর তেমনটা হয় না। অনন্যা আবেগে লাগাম টানতে শিখে গেছে যে। পরিমিতবোধ ওর প্রতিটি চলনে প্রস্ফুটিত। সেই বোধই এখন ইতুর এই মজাগুলোকে প্রশ্রয় দিতে পারছে না।

ইতু ওর কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত স্বরে বলল,
“শুভ্রা আপার ওপর দেওয়া মিথ্যা অপবাদ তোর সম্পর্ক ভেঙেছিল। শুভ্রা আপার ক’ল’ঙ্কমুক্তি তোকে নতুন সম্পর্ক গড়ে দেবে দেখিস।”

অনন্যা জবাব দিল না। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে যেমন ডরায়, অনন্যাও সেভাবে নতুন কোনো স্বপ্ন বুনতে ভয় পায়। দুটি বছর! মাত্র দুটি বছর ওকে ভেঙে-গড়ে যেন একযুগসম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছে। ইতু মজা করে বলল,
“পুলিশরা একটু রাফ এন্ড টাফ হয়। চো’র-গু’ন্ডা পি’টিয়ে অভ্যাস কিনা! তবে প্রেমের বেলাতে নিশ্চয়ই কোমল, তুলতুলে হবে। দেখে নিস শুভ্রা আপার কেইসের অগ্রগতি নিয়ে কথা বলতে তিনি নিজেই বাহানা করে তোর কাছে আসবে। তোকে কষ্ট করে যেতে হবে না। এমা… তুই ব্লাশ করছিস!”

অনন্যা নিজের আরক্ততা সামলে কপট রাগে লাল হওয়ার ভাব করে ইতুকে তাড়া করল।
_______________

জামশেদ আছেন দৌড়ের ওপর। একেই তিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আগের ওসি বদলি হওয়ার পর নতুন ওসির যোগদান নিয়ে গড়িমসি চলছে। অবশ্য এখানে কিছু পলিটিক্স চলছে। আগের ওসি সৎ হতে গিয়ে কিছু হোমরাচোমরার লেজে পা দিয়ে ফেলেছিল। তাই বদলি করে দিয়েছে উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। বেশিরভাগ দায়িত্ব এখন জামশেদের ঘাড়েই চেপে আছে। প্রতিদিন নিত্য নতুন কেইস, মামলা, তদন্ত, চার্জশীট নিয়ে জান কয়লা হয়ে গেছে। তারওপর তদন্ত অফিসার হিসেবে বাদী পক্ষের পরিবারের কাছে জবাবদিহি, আদালতের গণ্ডিতে ছোটাছুটি তো আছেই। পিয়াসা মা’র্ডার কেইসে মিডিয়া কভারেজ বেশি হওয়ায় চাপ হলেও স্বস্তি হলো শাহনেওয়াজের নজর আছে এখানে। কেইস আদালতে উঠতে চলেছে। সাক্ষ্য, প্রমাণ দর্শাতে হবে। যার জন্য সাসপেক্ট সাগরকে ধরতে হাত ধুয়ে লেগেছে ওরা। ইনফর্মারেরাও ফিল্ডে কাজ করে চলেছে। তবে শাহনেওয়াজের নির্দেশে জামশেদ আপাতত এক অতিশয় রূপবতীকে নজরে রাখছেন। সম্পর্কে সে সাগরের রিসেন্ট গার্লফ্রেন্ড। লাস্যময়ী এই তরুণীর নাম সাদিয়া। ছোটো পোশাকের আবেদনময়ী এক একটা পিকচার চোখে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো। মেয়েটির ইন্সটা একাউন্ট স্ক্রল করেই জামশেদের কপালে ঘাম ছুটে গেছিল। এরপর থেকে প্রতিবার এই মেয়ের আপডেট নেওয়ার আগে মনের শয়তান তাড়ানোর জন্য “আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম” পড়ে নিচ্ছেন।

মধ্যবয়সী কাজের মহিলার লা’শের ডিটেইলস হাতে পেয়েছে ইতিমধ্যে। মহিলার নাম লতিফা। কমলাপুর বস্তিতে থাকত। পিয়াসার বাড়িতে এই মহিলা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে কাজ করত। অর্থাৎ বেঁচে থাকলে অনেক কিছুই জানার সম্ভাবনা ছিল। খু’নির ফেঁসে যাওয়ার সুযোগ আছে বলেই হয়তো সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। একটা নিরীহ প্রাণ ঝরে গেল হায়নার থাবায়। জামশেদ আফসোস করে উঠলেন।

জামশেদ যখন এদিকটায় মগ্ন তখন শাহনেওয়াজের হাতে একটি অপ্রত্যাশিত ভিডিও ক্লিপ এসে পড়ে। হোটেল রেডিসন ব্লুতে আয়োজিত একটা জমকালো পার্টির ভিডিও। তাতে দেখা যাচ্ছে রঙিন, ধোঁয়াটে আলোর নিচে অ’স্ত্র ব্যবসায়ী অ্যালেন হাতে লাল পানি নিয়ে বেশ আমোদে মজে আছে। তবে শাহনেওয়াজের মনোযোগ অ্যালেনের চেয়ে তার পাশে থাকা রমনীর দিকে থমকে গেল। পিয়াসা! পরনে হট রেড কালার আঁটোসাঁটো একটা গাউন যার হাঁটু থেকে নিচে অবধি ফাঁড়া। ভিডিওটি দেড়মাস আগের। আইনের ফাঁকফোকর গলে বেড়িয়ে যাওয়া স’ন্ত্রা’সী অ্যালেনের সঙ্গে পিয়াসার কীসের সখ্যতা ছিল!
__________________

ঘড়ির কাটা রাত আটটার ঘর পেরিয়েছে৷ মাত্রই কাজের ছুটি হলো অনন্যার। বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছিল ও। বাস ধরতে সামনের মোড়ে যেতে হবে। এখান থেকে রিকশা নেওয়া যায় অবশ্য। কিন্তু ভাড়া বেশি, তারওপর রাত। অনন্যাকে এখন একটু মিতব্যয়ী হতেই হবে। অপেক্ষাকৃত সুনসান স্থানে এসে পৌঁছাতেই অনন্যার সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা ফেরত এলো। কেউ আছে, কেউ ফলো করছে ওকে। পেছন ফিরে লক্ষ্য করল একটা কালো পাজেরো হেডলাইট জ্বালিয়ে ওকে অনুসরণ করছে। অনন্যা শক্ত হয়ে গেল। হেডলাইটের চোখ ধাঁধানো আলোতে গাড়ির ভেতরে কে আছে তার মুখটা অবশ্য দেখা গেল না। অনন্যা তড়িৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল জোর কদমে। ব্যাগের ভেতর হাতড়াতে লাগল অস্থির ভঙ্গিতে। ছু’রিটা যে কোথায় রাখল! এই তো পাওয়া গেছে। ও লম্বা লম্বা দম নেয়। আশেপাশে তাকিয়ে মানুষের উপস্থিতি খেয়াল করে। পাশ দিয়ে টুংটাং শব্দ তুলে রিকশা চলে যাচ্ছে। আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে কোনো প্রণয়বিলাসী যুগল। কেউ বা তারই মতো অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষ, যাত্রা করছে বিশ্রামনীড়ে। এই মুহূর্তে অনন্যার ওপর কোনো আ’ক্র’মণ হলে কেউ এগিয়ে আসবে সাহায্য করতে!

মাথার ওপর মস্ত আকাশ ও রোডসাইড ল্যাম্পপোস্টগুলো যেন নির্বিকার চিত্তে শুনছে অনন্যার ভীত পদধ্বনি। হুট করেই গাড়িটা স্পিড বাড়িয়ে এসে রোধ করে অনন্যার গতিপথ। আত্মা লাফিয়ে ওঠে মেয়েটির। দেখতে পায় গাড়ি থেকে নেমেছে হাবীব! ঠোঁটে তার কুৎসিত, লিপ্সাযুক্ত হাসি। অনন্যার সর্বাঙ্গে নোংরা দৃষ্টি ছুঁইয়ে উল্লাসী স্বরে বলল,
“ঘুঘু পাখি, একলা বাড়ি যাও? আমার গাড়িতে চলো। এসির বাতাস খেতে খেতে পৌঁছে যাবে। এত কষ্টের তো কারণ দেখি না।”

হাবীর দুই পা এগিয়ে এসেছে। তার মুখ বলছে সে আজ খালি হাতে ফিরবে বলে আসেনি। কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে অনন্যার গতিবিধি নজরে রেখেই মোক্ষম সময়টা বেছে নিয়েছে। এমন সুন্দর ঘুঘু হাত ছাড়া করা যায়! হাবীবের নাকে এখনো মেয়েটির গায়ের মিষ্টি সুবাস ধাক্কা দেয়। নে’শা ধরানোর জন্য কামুকে পুরুষের কাছে এটুকুই যথেষ্ট। তাই ঘুঘুর ফাঁদ তৈরি করেই মাঠে নেমেছে।
অনন্যা দুই পা পিছিয়ে গেল। ব্যাগে ঢোকানো হাতটা ছু’রির হাতল শক্ত করে ধরে। ওকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই মে’রে দেবে। কিন্তু হাত ঘেমে গেছে। ছু’রিটা পিছলে যাচ্ছে।

“ডোন্ট মুভ!” ভারী গমগমে স্বর সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে বেজে উঠল। চকিতে তাকাতেই হাবীব থতমত খেয়ে গেল। রাস্তার অপর পাশে গাড়ির দরজা ঠেলে নামছে শ্রাবণ। হাতের পি’স্তলটা হাবীবের দিকে তাক করা। হাবীব এক দর্শনেই বুঝে গেল পরিচয়। সে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। অনন্যার হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গেছে। শ্রাবণ পি’স্তল তাক করেই এগিয়ে এসে একহাতে দিশেহারা মেয়েটিকে আগলে নিল। সঙ্কিত, ভীত চিত্ত হুট করেই নির্ভরতা পেয়ে নিজেকে আর সামলাতে পারল না। প্রতিনিয়ত চিন্তার ভারে মস্তিষ্ক তার এমনিতেই ভারী। তাই এইটুকুনি ভরসাস্থল খুঁজে পেয়ে অনন্যা শ্রাবণ মেঘের মতোই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আঁকড়ে ধরল ভরসাযোগ্য কাঁধটি।

শ্রাবণ হিং’স্র চোখে হাবীরের দিকে চেয়ে অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে দুষ্টুমির স্বরে বলল,
“শ্রাবণের উষ্ণ বারিধারা! অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। আজ তোমার অশ্রুতে আমার বৃষ্টিবিলাস হলে মন্দ হবে না।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে