বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-১৯+২০

0
796

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [১৯]
প্রভা আফরিন

শফিকের শান্ত দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা। না বলে হঠাৎ অফিস কামাই করায় শফিকের রাগ জায়েজ আছে। অনন্যা তাতে বিচলিত না হলেও তার মাঝে এক ধরনের চাপা অস্থিরতা। তবুও যথাসম্ভব সুস্থির রয়েছে তার দৃষ্টি, দৃঢ় কণ্ঠস্বর। শফিক বলল,
“এভাবে বিনা নোটিশে ডুব মা’রলে কেন?”

অনন্যা কৌশলগত সত্যিটা বলল,
“মায়ের অসুখ করেছিল, স্যার। ছেড়ে আসতে পারিনি।”

“ফোন ধরোনি কেন?”

“ফোন ধরার অবসরটাও মেলেনি।”

“আন্টির অবস্থা সিরিয়াস?”

“আপাতত একটু ভালো। কিন্তু পুরোপুরি নয়।”

শফিক আর কথা বাড়ালো। অনন্যার যান্ত্রিক স্বরের সীমাবদ্ধ উত্তরের ফলে খুব একটা আলাপ জমে না মেয়েটার সাথে। কেন জানি ইচ্ছে করেই দূরত্বের রেখা টেনে রেখেছে। অনন্যা ওর কাজে মন দিল। তবুও অন্তরে কিছুটা বিক্ষিপ্ততা বিরাজ করছে।

হাই কোয়ালিটি মেইনটেইন করা টপ রেটেড এবং এক্সপেন্সিভ ব্র‍্যাণ্ড হওয়ায় এই শো-রুমে সব স্বচ্ছল, বিলাসী ও অর্থশালী মানুষের আনাগোনা। গতানুগতিক ক্রেতার বাইরে মাঝে মাঝে কিছু অসময় বয়সের জুটিও আসে। উঠতি অনেক মডেলরা বিজনেস ম্যানদের বাহু আঁকড়ে এসে এক্সপেন্সিভ প্রোডাক্ট বাগিয়ে নেয়। চাহিদা একটু বেশি থাকলে লোক সমাগমের মাঝেই গায়ে ঢলে পড়াও বাদ রাখে না। চালচলন দেখেই বলে দেওয়া যায় তাদের সম্পর্কের ধরন। অনন্যা কর্মজীবনে এসব দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ যখন এমনই এক কাস্টমারের সামনে পড়ল অজান্তেই ওর মুখ বিকৃত হলো। সকালের সেই বিদঘুটে সময়টার কথা, সেই কুতকুতে চোখটার কথা স্মরণ হতেই ঘেন্না জেঁকে বসল মুখাবয়বে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেছিল এটা তার কর্মস্থল। এখানে প্রফেশনালি সব হ্যান্ডেল করতে হয়। ব্যক্তিগত আবেগ তখন বাইরে রেখে আসতে হয়। অনন্যার এই মুখভঙ্গি দেখে কাস্টমাস রেখে গেল। তার ওপর চো’টপাট করতেও ছাড়ল না। শফিক ওকে সেখান থেকে সরিয়ে এনে বলল,

“কী ব্যাপার অনন্যা? এমন বিহেভ করছিলে কেন? তোমাকে আজ অশান্ত লাগছে।”

“স্যরি স্যার!” অনন্যা নিজের কাণ্ডে লজ্জিত হয়।

শফিক ধরে নেয় মায়ের অসুস্থতাতেই বোধহয় ও চিন্তিত। তাই জানায়,
“আর ইউ অলরাইট? তুমি চাইলে ছুটি নিতে পারো।”

অনন্যা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে জানায় একটু সময় পেলেই সে সামলে নেবে। ছুটির প্রয়োজন নেই। কিন্তু সারাটা দিন ও মনমরা হয়েই রইল। নিজের ব্যক্তিত্ব যেন খসে পড়ছিল বারবার। না পেরে সন্ধ্যার সময় ডিউটি টাইম শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে নিজের অপারগতা স্বীকার করে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে ও। হোস্টেলের পথে রওনা হয়ে খেয়াল হয় বাজার করা হয়নি। কিছু না নিয়ে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে। অনন্যা নিউমার্কেট কাঁচা বাজারে গেল। ডিম, আলু, বেগুন, পেয়াজ ও কাঁচামরিচ কিনে নিল। ব্যস্ত পথে, একঝাঁক অচেনা মানুষের মাঝে একাকী হাঁটতে হাঁটতে নিজেই নিজেকে বোঝায় অনন্যা, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে কেমন করে? তার সামনে সম্পূর্ণ জীবনটা অনিশ্চিত পড়ে আছে। নিশ্চিত করার মহা দায়িত্ব ঘাড়ে। এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ করা যাবে না। ভালো হয় যদি আত্মরক্ষার কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারে। মুক্ত বাতাসে লম্বা শ্বাস নিয়ে একটু নির্ভার হলো মন।

নারীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সদা সতর্ক। বিশেষ করে যার প্রতি পদে প্রতিকূলতা বিছিয়ে আছে সে বাতাসের ধাক্কাতেও কেঁপে ওঠে। হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে হঠাৎই অনন্যার মনে হলো কেউ যেন ওকে অনুসরণ করছে। খুব গভীরভাবে দেখছে ওকে। এই অনুভূতিটায় তার সমস্ত প্রফুল্লতা আবারো মিইয়ে গেল। তড়িৎ পেছনে তাকায় ও। সঙ্গে সঙ্গেই একটা ধীরে চলা গাড়ি আচমকা স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে ওকে ডিঙিয়ে ব্যস্ত পথে মিলিয়ে গেল। অনন্যা স্থবির হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এটা কী নিছকই মনের ভুল! অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা পেয়ে বসল নাকি!

অনন্যা হোস্টেলে ফির কোনোমতে দুমুঠো ভাত ফুটিয়ে ডিম ভেজে খেয়ে নিল। ঘুমাতে যাওয়ার সময় সমস্ত ভাবনা ভুলে আপার মৃত্যুর দিনটা আচ্ছন্ন করে ফেলল ওকে। আপার অসহায় চাহনি, অনুনয় ঝরা কণ্ঠ যেন এখনো ওকে ডাকে,
“অনন্যা, তুই অন্তত আমার কথাটা শোন।”
আজ বুকের ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খায় সেই বাক্যগুলো। ও কেন শুনল না আপার কথা!
____________________

শাহনেওয়াজের অপজিট সিটে এখন যে ব্যক্তিটি বসে আছে তাকে সে নিজেই দাওয়াত করে অফিসে এনেছে বলা চলে। লোকটি যেন তাকে ডাকার কারণ সম্পর্কে বুঝতে পারছে না। চোখে-মুখে হাজারো প্রশ্ন ভাসছে। তবে তামাটে মুখশ্রী অতিশয় শান্ত। দেহাবয়ব আকর্ষণীয়, দীপ্তিময়। লোকটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল,
“আমাকে ডাকার কারণটা এখনো বললেন না অফিসার। প্রায় এক মাস পর গতকাল রাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরেছি। এরই মাঝে…”

“আপনি এয়ারপোর্ট থেকে চেকআউট করার খবর পেয়েই আমার ফোন গেছিল, মি. রাশেদ।”

“হঠাৎ এত জরুরি তলব?”

শাহনেওয়াজ একইসাথে অনুচ্চ অথচ কঠিন স্বরে বলে উঠল,
“আপনার সম্বন্ধীর প্রাক্তন স্ত্রী মা’রা গেছে। শুনেছেন তো?”

রাশেদ চোখ ছোটো ছোটো করা ফেলে। বুঝতে না পেরে বলল, “সরি!”

শাহনেওয়াজ ক্ষীণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
“তুষার আপনার সম্বন্ধীই তো!”

রাশেদের যেন এতক্ষণে খেয়াল হলো। ভীষণ লজ্জিত ও বিব্রতও দেখালো তাকে। বলল,
“তুষার! ওদের সঙ্গে তো আমার অনেকদিন যোগাযোগ নেই। ওর প্রাক্তন স্ত্রী মা’রা গেছে? মানে পিয়াসা ভাবি?”

“মা’রা গেছে না বলে খু’ন হয়েছে বলা যায়।”

রাশেদ চমকে তাকায়, “পিয়াসা ভাবি খু’ন হয়েছে? কবে?”

“চার দিন আগে।”

“কিন্তু এর সঙ্গে আমাকে ডেকে আনার কারণটা বুঝলাম না অফিসার। ওদের সঙ্গে আমার অনেকদিন যোগাযোগ নেই। আমার কাছে কোনো ইনফরমেশন পাবেন বলে মনে হয় না।”

“অবশ্যই পাব। কারণ পিয়াসা মা’র্ডার কেইস ঘাটতে গিয়ে আপনার প্রয়াত ওয়াইফের নামটাও চলে এসেছে।”

রাশেদের বিস্ময় যেন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কপালে ভাজের রেখা। অস্থির স্বরে বলল,
“শুভ্রা! ওর কী সম্বন্ধ এর সাথে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

শাহনেওয়াজ এবার তীক্ষ্ণ চোখটি সরাসরি রাশেদের কালোমণি যুক্ত চোখে স্থাপন করে। বলে,
“আপনার স্ত্রীর অটোপসি রিপোর্টে যে ড্রা’গ পাওয়া গেছিল, পিয়াসার রিপোর্টে একই ড্রা’গের অস্তিত্ব মিলেছে, মি. রাশেদ। তবে আমাদের কনসার্ন সেটা নয়। আমরা জানতে চাই আপনি শুভ্রার অটোপসি রিপোর্টটাকে ধামাচাপা দিয়েছিলেন কেন আগের ওসির সাহায্য নিয়ে? এমনকি সম্বন্ধীর করা কেইসটাকেও গুটিয়ে নিতে বলেছিলেন। কেন?”

শাহনেওয়াজের কক্ষ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। সে রিমোট টিপে এসির তাপমাত্রা আরেক ডিগ্রি কমায়। যেন বুঝে যায় রাশেদের গরম লাগছে। রাশেদ একটুক্ষণ চুপ রইল। এরপর ধীর স্বরে বলল,
“দেখুন অফিসার, আমি খোলামেলাভাবেই বলছি।”

জামশেদ প্রবেশ করেছে কক্ষে। সে স্মিত হেসে বলল,
“পুলিশ খোলামেলা শুনতেই পছন্দ করে, মি. রাশেদ। রাখঢাক করতে চাইলে তাকে নগ্ন করা আমাদের কর্তব্য। পুলিশের সঙ্গে অপরাধীর জিজ্ঞাসাবাদ অনেকটা বাসর ঘরের নববধূর কাপড় খোলার মতো আনন্দ। বধূবেশী অপরাধী প্রথমে একটু লজ্জা করে। তাতে বরবেশী পুলিশের থেমে গেলে তো চলে না।”

জামশেদ নিজের অশ্লীল রসিকতায় নিজেই মজা পেয়েছে। অন্যদিকে রাশেদ ভড়কে গেছে। শাহনেওয়াজ হাসি চাপল সন্তর্পণে। জামশেদের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে চুপ থাকার নির্দেশ দিল।

রাশেদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“শুভ্রাকে আমি ভালোবাসতাম। অফিশিয়াল কাজে ব্যস্ত থেকে সময়টা একটু কম দেওয়া হলেও ভালো রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওর যে আমার বোনের দেবরের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক তৈরি হবে সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি। দোষটা আমি আমার ঘাড়েই নিই। ওকে আমি কেন পর্যাপ্ত সময় দিতে পারিনি। হয়তো একাকিত্ব থেকেই সঙ্গ খুঁজেছিল…”

সাংসারিক পাঁচালী! শাহনেওয়াজ বাধ সেধে বলল,
“স্বল্প কথায় পয়েন্টে আসুন।”

রাশেদ যেন এই তরুণ অফিসারের ঔদ্ধত্য, দাপুটে স্বভাবের ওপর কিঞ্চিৎ বিরক্ত। কথার খেই ধরে আবার বলতে লাগল,
“শুভ্রাকে আমি ভালোবাসলেও এটা ঠিক যে সাগরের সঙ্গে ওর পরকিয়ার খবর ফাঁস হয়ে আমার ফ্যামিলিকে লোক সমাজে অপদস্ত হতে হয়েছে। পারিবারিক, পেশাগত উভয় দিক থেকেই সেটা আমাদের কাছে বিব্রতকর ছিল। তাই অটোপসিতে যখন ড্রা’গের অস্তিত্ব মেলে বিষয়টাতে আর ঘি ঢালতে দিইনি। সাগরের ড্রা’গ নেওয়ার অভ্যাস ছিল। ওর এইসব নে’শা-টেশার গুণ আছে বলেই ধারণা করেছিলাম হয়তো শুভ্রাও ওর সঙ্গে মিলে… তাই এটাকে আর জানাজানি হতে দিইনি। মেয়েটা এমনিতেও কম অপবাদ নিয়ে তো পৃথিবী ছাড়েনি। কী দরকার আরো ছোটো করার। এতে তো আখেরে আমার সম্মানেরই অটোপসি হতো। ওদিকে বোনের শ্বশুরবাড়ির অবস্থা নাজুক। বোনটা সন্তান সম্ভবা ছিল। আমার ফ্যামিলি চায়নি ওর সংসারেও আর ঝামেলা হোক। তাই তুষারকেও বলেছিলাম কেইসটা যদি তুলে নেয় সবাই-ই বেঁচে যাওয়া সম্মানটা নিয়ে থাকতে পারব।”

তুষারের বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া গেল রাশেদের কথায়। শাহনেওয়াজ সবটাই নোটেড করে নেয়। এরপর বলে,
“স্কো’পা’লামিন ড্রা’গ নিতো সাগর? আপনি শিওর তো কী বলছেন?”

রাশেদ হতভম্ব চোখে চাইল। “স্কোপালামিন!”

শাহনেওয়াজ ভুরু কুচকে বলল,
“আপনি কী জানতেন না আপনার ওয়াইফের শরীরে কোন ড্রা’গ পাওয়া গেছে?”

“নাহ, পরিস্থিতি ছিল না বা প্রয়োজন মনে করিনি।”

“এমনটা কী হতে পারে না, শুভ্রাকে ড্রা’গ দিয়ে অচেতন করে এরপর ইচ্ছাকৃত অশ্লীল মুহূর্ত তৈরি করে সেটা ভাইরাল করা হয়েছে! আপনার কী মনে হয়? এই কাজে কার বেশি ফায়দা হতে পারে?”

রাশেদ হাহাকার করে ওঠে, “শুভ্রা! শুভ্রাকে ফাঁসানো হয়েছে?”

শাহনেওয়াজ তার উত্তর না দিয়ে ফের প্রশ্ন করে,
“শুভ্রা এপ্রিলের চৌদ্দ তারিখ অর্থাৎ আপনাদের বিবাহবার্ষিকীর একদিন আগে বাপের বাড়ি চলে গেছিল আপনার সঙ্গে মনমালিন্য হওয়ায়। ঠিক কোন কারণে আপনার স্ত্রী এমন বিশেষ দিনের আগে বাড়ি ছেড়েছিল জানতে পারি, মি. রাশেদ?”

রাশেদের সে ঘটনা বিস্মরণ হয়েছিল। পুনরায় মনে পড়তেই বলল,
“পহেলা বৈশাখে বাড়িতে টুকটাক আয়োজন ছিল। অথচ শুভ্রা সেদিন বউ হিসেবে পারিবারিক প্রোগ্রাম এটেন্ড না করেই বন্ধুদের সঙ্গে হ্যাংআউট করতে যায়। ফিরেছিল যখন তখন আমি একটু রূঢ় আচরণ করেছিলাম। কৈফিয়ত চাইতেই তর্ক বেঁধে যায়। এরপরই ও বাড়ি ছাড়ে। আমি রাগ দেখিয়ে আর যাইনি ওকে ফেরাতে।”

শাহনেওয়াজ সন্দেহি চোখে চেয়ে বলিল,
“আচরণে অসংলগ্নতা পাননি?”

“ঠিক মনে নেই, তখন ভীষণ রেগে ছিলাম আমি। পরিবারের সবাই ওর ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অফিসার, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে শুভ্রা চক্রান্তের স্বীকার! আপনারা সাগরকে এখনো ধরছেন না কেন? ওহ গড! আমি কিনা সম্মানের ভয়ে ওকেই সেইভ করতে চেয়েছিলাম! নাও আই ইনসিস্ট ইউ, সাগরকে অ্যারেস্ট করুন। সব সত্যি বেরিয়ে আসবে।”

শাহনেওয়াজ দীপ্ত চোখে চায়। যেন কৌতুক করছে এমন ভাব করেই বলল,
“আপনি নিশ্চয়ই এটাও জানেন না যে সাগর পলাতক! তাও আবার পিয়াসা কেইসের সাসপেক্ট হয়ে!”

রাশেদের অভিব্যক্তি দেখল না তরুণ এসপি। সে জামশেদকে জানাল ফরেনসিকে পাঠিয়ে রাশেদের ডিএনএ নমুনা ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট কালেক্ট করতে। এরপর নিজের টিম রেডি করে ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে গেল। একটি মা’দক অভিযান পরিচালনা করতে হবে আজ।

চলবে…

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২০]
প্রভা আফরিন

রাশেদের সঙ্গে ডিএনএ কিংবা ক্রাইম সীনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলবে না এ বিষয়ে পুলিশ আগে থেকেই অবগত। কেননা রাশেদ গত একমাস সত্যিই দেশে ছিল না। সুতরাং সরাসরি সে কোনো সীনে যুক্ত নয় এটা নিশ্চিত। তাছাড়া পিয়াসা কেইসে রাশেদকে সন্দেহ করার সরাসরি কোনো কারণ নেই। তবে নজরে নিশ্চয়ই রাখা হবে। শুভ্রা কেইসের প্রচ্ছন্নতা দূর করার জন্যই মূলত সাগরের খোঁজ নেওয়া হয়। আর আশ্চর্যজনকভাবে চারদিন হলো সে নিখোঁজ। ফোনে ট্র‍্যাক করার উপায় নেই। দুটো কেইসের ভিক্টিম একসময় আত্মীয় ছিল বলে এবং তাদের সঙ্গে রাশেদ ও সাগরের সম্পর্ক ছিল বলেই সাগরের গা ঢাকা দেওয়াটাকে নিছক কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সাগরকে প্রাইম সাসপেক্ট ধরার বিষয়টাও শুধু মুখে মুখে, শুভ্রা কেইসের সন্দেহের জেরে। পিয়াসার সঙ্গে সরাসরি তাদের যোগাযোগ আছে সেটা প্রমাণ না করা পর্যন্ত ওদের নিয়ে এগোনো না গেলেও ইনফরমেশন জোগাড়ে ঘাটতি রাখছে না জামশেদ।

আরো একটা খটকার বিষয় হলো বাড়ির কাজের মহিলাটির হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া। কাজের লোক দ্বারা তো খু’ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্পষ্টই ভিক্টিমকে রেই’প করে এরপর খু’ন করা হয়েছে। তাহলে কী কাজের লোকটা খু’নিকে সাহায্য করেছে! খু’ন বা খু’নির সঙ্গে সংযোগ জোড়ালো না হলে সামান্য কাজের লোক নিখোঁজ হওয়ার কথা নয়। জামশেদের মহা বিরক্ত লাগছে। স্ট্রং কোনো প্রুভ না পেয়েও কেইস যেভাবে ডালপালা ছড়াচ্ছে তাতে গাছের শেকড় অবধি পৌঁছাতে পারলে হয়। জামশেদ বর্তমানে বসে আছে পিয়াসার বাবার বাড়ির বসার ঘরে। প্রশস্ত ঘরের চারিদিকে পরিমিত রুচিশীলতার ছাপ। দেয়ালে ঝুলছে পারিবারিক ফটো। যেখানে দুই সন্তান নিয়ে বাবা-মায়ের হাস্যজ্জ্বল মুখখানি ভাসছে। দেখলে যে কেউ এক শব্দে বলে দেবে হ্যাপি ফ্যামিলি। বর্তমানে অবশ্য তা নয়। বাড়িতে দুজন মানুষ বসবাস করে আপাতত। তাদের এক পুত্র ইউরোপে সেটেল। আরেক মেয়ে অপঘাতে কবরবাসী, যার জন্য জামশেদের এখানে আসা।

চোখে চশমা আঁটা ভদ্রমহিলা নাশতা সাজিয়ে বসার ঘরে পদার্পণ করলেন। জামশেদের মনোযোগ সরে সেদিকে। নাশতার ডালা তার মনকে প্রফুল্ল করে। যাক, চায়ের কাপটা আছে! কথাবার্তা খুব একটা বিরস হবে না তাহলে। মিসেস লিপি বাকি ভিক্টিমের পরিবারের মতোই প্রশ্ন করলেন,
“কেইসের অগ্রগতি কতদূর?”

“আমরা পুরোদমে তদন্তে নেমেছি। সৌভাগ্যের বিষয় আমাদের এসপি স্যারেরও বিশেষ আগ্রহ আছে অপরাধীকে বের করার। আশা করছি খুব শীঘ্রই অগ্রগতি দেখবেন।”

বলে জামশেদ চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। প্রিমিয়াম টেস্ট! ল্যাভেন্ডারের স্মেল আসছে৷ কোন ব্র‍্যাণ্ডের চা পাতা জিজ্ঞেস করবে কি! জামশেদ নিজেকে দমন করে। মনকে স্মরণ করায় তিনি এখানে তদন্তে এসেছেন চায়ের আলাপে নয়। জিজ্ঞেস করলেন,
“আলফাজ সাহেব বাসায় নেই?”

মিসেস লিপি মাথা নাড়েন,
“আছে বাড়িতেই। সিডেটিভের প্রভাবে ঘুমাচ্ছে। মেয়ের ডেডবডি দেখার পর থেকে ঘুম কি জিনিস জানি না। ওর হাই ব্লাড প্রেশার আছে। উত্তেজিত হলে হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। সেই ভয়েই…”

জামশেদ বুঝতে পেরেছেন এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন। পিতা-মাতার চোখে সন্তানের লাশ দেখা কতটা পীড়াদায়ক তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সময় নষ্ট না করে জামশেদ সরাসরি আলোচনায় গেল।
“পিয়াসা আপনাদের থেকে কবে থেকে দূরে?”

“ডিভোর্সের কিছুদিন পর থেকেই।”

“সে কী এভাবেই একা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল আগে?”

মিসেস লিপি হঠাৎ শব্দ করেই একটা শ্বাস ফেললেন। বললেন,
“আগে ছিল না। আসলে পিয়াসা ছোটোবেলা থেকেই জেদি, একগুয়ে স্বভাবের। নিজে যা করতে চায় বলে মনস্থির করবে, তা করেই ছাড়বে। বিয়েটাও করেছিল আমাদের অমতে। শেষমেষ মধ্যবিত্ত টানাটানির পরিবারে টিকতে না পেরে ফিরে এলো। এবার জেদ চাপল আলাদা থাকবে। মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়ে বাড়ি থেকে দূরে চলে গেল। মন চাইলে যোগাযোগ করে মন না চাইলে করে না।”

“পিয়াসার কারো সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কিনা এ বিষয়ে কিছু জানেন? আবার বিয়ে দিতে চেষ্টা করেননি?”

“আমাদের মাঝে কখনোই ফ্রেন্ডলি রিলেশনশিপ ছিল না। পিয়াসা কখন কী করে কিচ্ছু জানায় না। তাহলে তো আর এই দিন দেখতে দিতাম না ওকে।”

মহিলার চোখ ছাপিয়ে কান্না এলো। জামশেদেরও সান্ত্বনা দিতে ব্যথিত হওয়া উচিত। তবে পিয়াসার স্বভাব নিয়ে যা শুনেছে তাতে খুব একটা সরল মেয়েটা ছিল না বোঝাই যাচ্ছে। উগ্র জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। মহিলা নিজেকে সামলে আবার বললেন,
“তবে বলত যে সবুর করো। বিয়ে করব শীঘ্রই।”

জামশেদের ভ্রু বক্র হয়, “তারমানে পছন্দ ছিল?”

“ইঙ্গিতে মনে হতো। খোলাসা করে বলত না কখনো।”

জামশেদের মাথায় তখন ফোনের বিষয়টা এলো। পিয়াসার যে ফোনটা পুলিশের কাছে জমা আছে তাতে বিশেষ কোনো তথ্য নেই। মিসেস লিপি জানালেন পিয়াসার ব্যবহৃত ফোনটা মৃ’ত্যুর কয়েক দিন আগে চুরি গেছিল। সেদিনই পিয়াসা বাড়ি এসে তার পুরোনো ফোনটা আলমারি ঘেটে নিয়ে যায়। কথাটা শুনে জামশেদ নিশ্চিত হলো ইচ্ছে করেই তার ফোনটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নিশ্চয়ই অপরাধী শনাক্তের রাস্তাটা তাতে ছিল। তাই আগেই সেটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পিয়াসাকে মা’রার জন্য আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল ক্রিমিনাল! কিন্তু কেন? এত কীসের সতর্কতা! সামান্য প্রেমের ক্ষোভে গঠিত খু’ন বা ধ’র্ষ’ণ এতটা নিখুঁত হওয়ার কথা নয়। নাকি প্রফেশনাল কারো হাত রয়েছে!
________________

শহরের ইট-পাথরের দেয়ালের ভেতর যেমন স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা আছে, দেয়ালের বাইরে তেমন নোংরা আবর্জনার ছড়াছড়ি। যে মানুষ নিজ আবাসস্থলকে চকচকে রাখে, সে-ই আবার দেখা যায় চলার পথে খাবারের প্যাকেটের খোসাটা অন্যের জমিতে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না। সভ্য জাতীর শিক্ষিত মানুষের মধ্যে খুব কম মানুষই সমাজ সচেতন। সকলে স্ব-সচেতন। নিজের ঘর ছাড়া পৃথিবীর আবর্জনা তাদের চোখে পড়ে না। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হাশেমের মেজাজ বেজায় খারাপ। এই জঞ্জাল সাফের জীবন তার আজকাল আর ভালো লাগে না। তাই মেজাজ বিগড়ালেই বড়োলোকদের তুলোধোনা করতে শুরু করে। তখন অনেকটা বিজ্ঞের মতো ভাবনা আসে মাথায়। সমস্ত জঞ্জাল, আবর্জনা একত্র করে শহরের নিকটবর্তী নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার স্থানে এসেছে সে। দুর্গন্ধে টেকা দায় এখানে। ভাগাড়ের রাস্তার পাশ দিয়ে কেউ গেলে নাক চেপে যায়। হাশেমের অবশ্য নাক চাপতে হয় না। গলায় দুই ঢোক উষ্ণ তরল গেলে সারা দুনিয়া তার কাছে সুরভিত। কিন্তু কানে পাখিদের বেসুরো চেঁচামেচি ঢুকতে নিবারণ করার মতো কিছু নেই। কে জানে আবর্জনায় কী পেয়েছে সব। কাকের পাশাপাশি শকুনও দেখা যাচ্ছে। তবে রাজত্ব দখল করে নিয়েছে কুকুরের দল। জঞ্জালের গাড়িটা খালাস করে হাশেম নিজের মনেই চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখ পড়ল কুকুরের দল একটা বস্তা ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছে। হাশেম তার স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বিভ্রম দেখল মনে হলো। চোখ কচলে আবারো তাকালো। উহু, ভুল নয়। হাশেমের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোতের ঢল নামে। একটা র’ক্তাক্ত মনুষ্য পা বস্তা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে।
_________________

শ্রাবণের প্রেস ব্রিফিং ছিল সকালে। সম্প্রতি ঢাকার অলিগলতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক প্রতারক চক্রকে মূল হোতাসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। এই চক্রের জ্বালাতনে নগরবাসী প্রায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছিল৷ সেসবের ফিরিস্তিসহ লাইট, ক্যামেরা, সাংবাদিকের প্রশ্ন শেষ করতে করতে বেলা এগারোটা গড়িয়ে গেছে। বিকেলে আবার একটা প্রোগ্রাম এটেন্ড করতে হবে। জেলাভিত্তিক একটি প্রোগ্রামে জেলা প্রশাসকের পাশাপাশি শ্রাবণকেও প্রধান অতিথি হিসেবে যেতে হবে। প্রতি মাসেই বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রামে তাকে হাজিরা দিতে হয় এখন।

শ্রাবণের জন্য এখন অফিশিয়াল গাড়ি আছে। সে সেটা নিয়েই যাতায়াত করে। ব্রিফিং শেষে নিজেই ড্রাইভ করে বেড়িয়ে এলো। ক্যাম্পাস এড়িয়ার নিকটবর্তী হয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিল। একসময় থেমেও গেল। ফোন বের করে ডায়াল করল এক পরিচিত নাম্বারে।

ভার্সিটি লাইফে কারো হুট করেই এক পাল বন্ধু মিলে যায়। আবার কেউ মিশতে না পেরে, মনের মতো কাউকে না পেয়ে বিষন্নতায় গুমড়ে থাকে। আবার কারো ফার্স্ট ইয়ারে দশটা বন্ধু থাকলে ও ফাইনাল ইয়ার অবধি একটাও থাকে না। এখানে বেশিরভাগ হাই-হ্যালো বন্ধুত্ব। অনুর ফার্স্ট ইয়ারে ক্যাম্পাস জুড়ে বন্ধু ছিল। সেকেন্ড ইয়ারে কেউ পাশে রইল না, এক ইতু ছাড়া। ফাইনাল ইয়ারেও সুখ-দুঃখের আলাপনের ওই এক সাথী। শেষের ক্লাসটা কোনো কারণে না হওয়ায় ওরা ক্যাম্পাসের বাইরে ফুটপাতের ওপর বসে চা খাচ্ছিল। তখনই অনন্যার ফোন বেজে ওঠে। শ্রাবণের নাম্বার দেখে অনন্যা অবাক হয়। রিসিভ করতেই ভারী স্বর ভেসে আসে,
“অনন্যা, তুমি বিজি?”
“না, বলো।”
“হাতের ডান সাইডে তাকাও একবার।”

অনন্যা তাকাল। কালো গাড়িটার দরজা ঠেলে শ্রাবণ বেরিয়ে এসে হাত নাড়ছে। অনন্যা বলল,
“দাঁড়াও, আসছি।”

অনন্যা কান থেকে ফোন নামায়। ইতু পাশ থেকে খোঁচা মেরে বলল,
“এটাই কী সেই পুলিশটা? ওয়াও! কী হ্যান্ডসাম দেখতে দোস্ত। তোর জন্য এসেছে বুঝি! দৌড়ে যা, এটাকে ছাড়িস না একদম। নিজে সেটিং করতে না পারলে আমার সঙ্গে সেটিং করে দে।”

অনন্যা বিব্রত হয়৷ ফোনটা সবে কান থেকে নামিয়েছে। লাইনও কাটেনি হ্যাং হওয়ার জন্য। এরই মাঝে ফাজিল ইতুটার টিটকিরি মা’রা শেষ। অনন্যা খেয়াল করে দেখল দূরে শ্রাবণের কানে তখনো ফোনটা। শুনে ফেলেছে নাকি! ছি! কী লজ্জার ব্যাপার হবে শুনলে! অনন্যা ফোন রেখে চিমটি কাটল বান্ধবীর হাতে।
“মানসম্মান ডুবিয়ে ছাড়লি তুই! শুনে ফেললে তোর একদিন কী আমারই একদিন।”

ইতু শ্রাগ করে বলল,
“শুনে ফেললে আরো ভালো। অন্তত বুঝল এদিক থেকে সিগন্যাল দিচ্ছি। সে যদি পালটা সিগন্যাল দেয় তবে একটা লাভস্টোরি হয়েও যেতে পারে।”

অনন্যা বিরক্তিভরা চোখে চেয়ে স্থান ত্যাগ করে। শ্রাবণের ঠোঁটে তখন যেন চোরা হাসি নিভু নিভু করছে। অনন্যা নিকটে পৌঁছে বলল,
“হঠাৎ? কোনো দরকারে?”

“এ পথেই ফিরছিলাম। তোমাকে দেখে থামলাম। বিরক্ত হলে?”

অনন্যা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“না না। আমিই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম আপার বিষয়ে। কিন্তু ব্যস্ত থাকতে পারো ভেবে আর করি না।”

শ্রাবণ স্মিত হেসে বলল,
“ব্যস্ত থাকি কথাটা সত্যি। তবে দরকারে একটা টেক্সট করতে পারো নির্দ্বিধায়। আমি ফ্রি টাইমে রেসপন্স করব।”

অনন্যা কথা ঘুরিয়ে বলল,
“আপার ব্যাপারটায় নতুন কিছু জানতে পারলে?”

তখনই শ্রাবণের ফোন বেজে উঠল। জামশেদের কল। রিসিভ করতেই বলে উঠল,
“পিয়াসার বাড়ির কাজের মহিলাটাকে পাওয়া গেছে, স্যার। তবে বস্তাবন্দি লা’শ হয়ে।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে