#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[১৩]
পুরো বাড়িতে অঘোষিতভাবে আমার ও ইকরাম ভাইয়ের বিয়ের আলোচনা হচ্ছে। কেউ এতে খুশি কেউ বা গুমোট। বড়ো মামী নানাজানের ইচ্ছে শুনে একবার বলেই বসলেন,
“অনুর জন্য ছেলের অভাব হবে? আশ্রিতের কাছে দেওয়ার কী দরকার?”
বড়ো মামা ও ছোটো মামার মতে,
“স্ট্যাটাস যেমনই হোক, ছেলে আমাদের চোখের সামনে বড়ো হয়েছে। বংশের না হয়েও আব্বার সুযোগ্য অনুসারী। এমন সৎ চরিত্রের পরিশ্রমী পাত্র পাওয়া মুশকিল।”
আশ্রিত শব্দটা ওঠার পর যথারীতি বাসস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠল। ইকরাম ভাইয়ের নিজের বাড়ি নেই। গ্রামে যা ছিল তাও বংশের লোকেরা কব্জা করে ফেলেছে। উনার জীবিকাই নানাজানের ছায়াতলে। প্রশ্ন উঠল,
“তা বিয়ের পর কি ইকরাম বউসহ এ বাড়িতেই থাকবে?”
প্রশ্নের স্বপক্ষের উত্তর,
“থাকুক না। সে তো পরিবারের সদস্য হয়েই আছে এতকাল। অনুও নাহয় এ বাড়িতেই থাকল। বাড়ির ছেলে-মেয়ে বাড়িতেই রইল।”
আর বিপক্ষের সুক্ষ্ম উত্তর,
“ইকরাম তবে এ বাড়িতে গেঁড়ে বসল!”
মায়ের অবশ্য কোনো কিছুতেই বিশেষ আপত্তি নেই। আমার মনে হয় নানাজান যদি একজন বোবা-কালা ধরে এনে বলেন উনার ইচ্ছে তাকে নাতজামাই বানানো, মা তাতেও সায় দেবে। মোটকথা মেয়ের বিয়ে হলেই হলো। মায়ের মনে তীব্র ভয় আমিও না শুভ্রা আপার মতো কিছু ঘটিয়ে ফেলি! নানাজান অবশ্য আমার সঙ্গে এখনো কথা বলেননি। আমার বিশ্বাস তিনি আমার মতামত ব্যতীত বিবাহ নির্ধারণ করবেন না। কিন্তু নানাজান মতামত চাইলে আমার উত্তর কী হবে? কী হওয়া উচিৎ আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। ইকরাম ভাই, ছোটোবেলা থেকে যাকে নানাজানের একনিষ্ঠ ভক্ত ও দায়িত্বশীল মানুষ জেনে এসেছি, তাকে স্বামী রূপে কল্পনা করতেও জড়তা কাজ করছে। তাছাড়া উনার সঙ্গে এযাবতকাল দরকারের বাইরে বোধহয় তেমন কোনো কথাই হয়নি। অন্য কোনো নজরে তাকানোর অবকাশও পাইনি বোধহয়। তাকে নিয়ে হুট করে সংসার সাজানোর ভাবনা আমার মনে ডালপালা মেলতে পারছে না।
ইকরাম ভাইকেও বুঝে উঠতে পারছি না। তিনি আমায় একপ্রকার এড়িয়ে চলছেন। একই বাড়তে থাকার দরুন চলার পথে সামনে পড়ে গেলে তিনি অপ্রতিভ হয়ে ওঠেন। যত দ্রুত সম্ভব আমার সামনে থেকে সরে যান। অস্বস্তিতে আমিও আড়ালে আড়ালে থাকি। কিন্তু এভাবে কতদিন? দুজনের মুখোমুখি হওয়া উচিৎ। খোলাখুলি কথা বলা উচিৎ। কিন্তু আমার মনের কাছে আমি পরিষ্কার নই বলেই হয়তো সহজ হতে পারছি না।
এরই মাঝে ধারাকে নিয়ে নতুন চিন্তার রেখা উদিত হয়েছে। বাড়ির বড়ো মেয়ে ধারা, সকলের আদরের। সব সময় অনিয়ম, দুষ্টুমি কিংবা অসম বয়সের ভাইবোনদের সঙ্গে সাপে-নেউলের মতো ঝ’গড়া করা মেয়েটা হুট করেই থমকে গেছে। তার কথায় আগের মতো আবেগ ঝরে পড়ে না। জারার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে কথা বলে না। ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না। পড়াশোনাতেও মন নেই। কোচিং থেকে ফোন করে ধারার নিয়মিত টেস্ট এক্সামগুলোর রেজাল্ট জানালো। শেষের এক সপ্তাহের টেস্টে ধারা অপ্রত্যাশিতভাবে খুবই কম নম্বর পেয়েছে। শুধু পড়াশোনাতেই নয়, সেদিন খেতে বসে মেয়েটা হুট করেই কেঁদে ফেলল। মামা-মামী সবাই অস্থির হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করল। ধারা জবাব দিতে পারল না। শুধু বলল,
“ভালো লাগছে না।”
এরপর থেকে বড়ো মামী চিন্তিত মেয়ে কোনো রোগ বাঁধালো কিনা। রোগ অবশ্যই বেঁধেছে। তবে সেটা মনের। কেন জানি মনে হয় ধারা আমাকে সহ্য করতে পারে না। এর কারণ তো অবশ্যই আছে। এমন উদাসী ভাব, শোকের আবহ নিয়ে ঘোরাঘুরি করার কারণটা কোনোভাবে আমিই নয়তো! নিশ্চিত হতে হবে। ধারা আমার ছোটো বোন। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকা সমীচীন নয়। সুতরাং সরাসরিই কথা বলা উচিৎ মনে করলাম।
বিকেল গড়িয়েছে অনেকক্ষণ। খোলা চুলে আঙুল চালিয়ে পনিটেইল বাধতে বাধতে ধারার রুমে গেলাম। ধারা রুমে নেই। করিডোরে দেখা হলো বড়ো মামীর সাথে। জিজ্ঞেস করলাম,
“ধারা কোথায় মামী?”
“ছাদে গেল। ঘরে নাকি দমবন্ধ লাগছে। একটু যা তো, মা। তোর সঙ্গে তো মন খুলে কথা বলে। জানতে চেষ্টা কর কী হয়েছে ওর। এইটুকুনি মেয়ের এত কীসের মন খারাপ?”
মামীকে আস্বস্ত করে মাথায় ওড়না চড়ালাম। পা বাড়ালাম সিড়ির দিকে। একদম শেষ ধাপে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হলো। সবিস্ময়ে দেখলাম পড়ন্ত বিকেলের লালিত মেদুর আকাশের নিচে অগোছালো, এলোকেশী কিশোরী এক ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত পূর্ণবয়স্ক যুবকের হাত ধরে হাপুস নয়নে কাঁদছে। বিপরীতে যুবকটি করুণ দৃষ্টি মেলে, পরম যত্নে মেয়েটির হাত আঁকড়ে ধরে আছে। কয়েক মুহূর্তের সেই দৃশ্য আমার সকল দ্বিধা দূর করে দিলো। ধারার হুট করে পরিবর্তন, আমাকে সহ্য করতে না পারা, ইকরাম ভাইয়ের আমাকে এড়িয়ে চলা, বিয়ের কথা ওঠার পর আমাকে ভার্সিটি পৌঁছে দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ সবের কারণ যেন স্পষ্ট হয়ে গেল। একই বাড়িতে বেড়ে ওঠা দুই মানব-মানবীর মাঝে এ ধরনের সম্পর্ক অস্বাভাবিক নয়। ফিরে যেতে পা বাড়ালাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কানে এলো ধারার আকুতিভরা কিছু বাক্য,
“আমি আপনাকে অন্য কারো সঙ্গে মানতে পারব না। কিছুতেই না। সে দৃশ্য দেখার আগে যেন আমি অন্ধ হয়ে যাই।”
“চুপ! এসব বাজে কথা বোলো না ধারা। নিজেকে সামলাও। শক্ত হও।”
“পারছি না। আপনি এত কঠোর হবেন না। নানাজানকে বলুন আপনি এ বিয়ে করতে পারবেন না। আমার ভালোবাসাকে এভাবে পায়ে ঠেলবেন না, প্লিজ!”
“নানাজানের সিদ্ধান্তে দ্বিমত করার সাধ্য নেই আমার। তুমি তো জানো উনি আমার জীবনে কী? ওই মানুষটা না থাকলে আজকের আমিটা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতাম না। নানাজান কিংবা এ পরিবারের মানুষকে দুঃখ দেওয়ার সাধ্য নেই আমার।”
“এভাবে বলবেন না প্লিজ! চলুন পালিয়ে যাই।”
“পালিয়ে থাকবে কোথায়?”
“আপনার ছায়ায় থাকব। পারবেন না আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাকতে?”
“নিজেকে সামলাও ধারা। এ পরিবারের প্রতি আমার অনেক ঋণ, অসীম কৃতজ্ঞতা। তা কখনো শোধ করার নয়।”
ধারার কণ্ঠ জেদি শোনায়,
“দায়িত্ব, কৃতজ্ঞতা, ঋণ এসবের মাঝে আমার ভালো থাকার কোনো মূল্য নেই?”
“ভালো থাকা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে ধারা। হয়তো একসময় অন্যকিছুতে ভালো থাকা শিখে যাবে।”
আর শোনার সাহস হলো না। ছুটে ঘরে চলে এলাম। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ধারাকে আমি অনুভব করতে পারছি। এ যে কি অসহ্য অনুভূতি আমার চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে! ইকরাম ভাইয়ের অসহায়ত্ব, ধারার অনুনয়ে নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম যেন। চোখ মুছে নিলাম। এ বিয়ের কথা আমি কিছুতেই এগোতে দেব না। খুব করে চাই পৃথিবীতে সুন্দর প্রেমগুলো টিকে থাকুক। ভালো থাকুক। আমার মতো কারো প্রেমের বৃষ্টি বিরহের অশ্রু হয়ে না নামুক। সেদিন সারাটি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে মনে মনে বেশ কয়েকটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম।
________________
নিকষ রাত পেরিয়ে ভোর হলো। বিদায়ী মাঘের শীতলতায় লেপের আলসেমি ছেড়ে উঠে পড়লাম। জানালার পর্দা সরাতেই রুমের জমাটবদ্ধ অন্ধকার আলোর গহ্বরে মিলিয়ে গেল। পূর্বদ্বার হতে নিসৃত নরম আলোয় আমার মন ব্যতীত সব আলোকিত হতে শুরু করেছে। হুট করেই কর্কশ স্বর কানে এলো,
“আরে অনন্যা! নিজে ঘুমাবে না বলে কি অন্যদেরও ঘুমাতে দেবে না?”
তড়িঘড়ি করে পর্দা টেনে দিলাম। আবারো রুম ছেয়ে গেল আবছায়ায়। ক্ষীণ স্বরে বললাম,
“সরি তমা আপু!”
তমা আপুর কুচকানো ভ্রু যুগল কম্বলের আড়াল হয়ে গেল। তমা আপু আমার রুমমেট। খুবই স্ট্রিক্ট মানুষ।
আড়মোড়া ভেঙে ফ্রেস হয়ে নিলাম। পরিপাটি হতে হতে ক্যালেন্ডারে চোখ চলে গেল। মেসে ওঠার একমাস হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজনের থেকে দূরে থাকারও এক মাস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিলাম। ছুটতে হবে টিউশনিতে। রিকশা ভাড়া বাঁচাতে ঘুম কমিয়েছি। নির্মল সকালে হেঁটে যেতে মন্দ লাগে না। দুই ঘন্টা পড়িয়ে যখন বেরুলাম সূর্যের তেজে চোখ মেলে রাখা দায়। খিদেয় পেটে বেসুরে শব্দে তবলা বাজছে ক্ষণে ক্ষণে। ভার্সিটি এসে পরোটা ও চা কিনে নিলাম। বট গাছের ছায়ায় বসে গরম চায়ে পরোটা ডোবানো মাত্রই ফোনটা বেজে উঠল। ধারা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই হড়বড় করে বলে উঠল,
“আপু, কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছিরে। তোরা কেমন আছিস?”
“আমরাও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। নাশতা করেছো?
“এইতো করছি।”
“কী খাচ্ছ?”
“পরোটা।”
“দুপুরে চলে এসো। ভালো ভালো রান্না হচ্ছে।”
“কী উপলক্ষে?”
“আমার পরীক্ষার জন্য। খেয়ে দোয়া দিয়ে যাবে।”
আমি হাসলাম। বললাম,
“দোয়া সব সময় করি। তার জন্য ভালোমন্দ খাওয়ার দরকার হবে না।”
“তাহলে আসবে না?”
“আসব তো। তোর বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খেতে আসব।”
“ধ্যাৎ!”
ধারার কণ্ঠ অপ্রতিভ শোনায়। হেসে বললাম,
“মা কী করছে?”
“রুমে আছে। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে।”
“একটু দেখেশুনে রাখিস সোনা। একা কোথাও বেরোতে দিস না।”
“তুমি চলে এসো আপু। আমাদের ব্যবহারে প্লিজ দুঃখ নিয়ো না।”
“ধুর পাগলি! তোদের ওপর আমার কোনো রাগ নেই। কারো ওপরই আমার কোনো রাগ বা দুঃখ নেই। এসব ভেবে মন খারাপ করবি না। ভালো করে পরীক্ষাটা দে। এরপর ইকরাম ভাই আর তোর বিয়েটা খাব। আচ্ছা শোন, আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। রাখছি।”
ইচ্ছে করেই ফোন কাটলাম। চায়ের কাপে হাত ছোঁয়াতে বুঝলাম ওটা শরবতে পরিণত হয়েছে। তাতে চুমুক দিতে দিতে মনে পড়তে লাগল মাস দুই আগের স্মৃতিগুলো। নানাজানকে যখন জানালাম এই বিয়েটা আমি করব না তিনি মন খারাপ করেছিলেন।
যেহেতু আমার সঙ্গে ইকরাম ভাইয়ের বিয়ের কথা হয়েছিল তাই আমি ও ইকরাম ভাই দুজনই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। ধারাও তখন আমায় অপছন্দ করতে শুরু করে। বুঝেছিলাম সরে যাওয়া উচিৎ। অনেক কষ্ট করে ইতুর সাহায্য নিয়ে একটা টিউশনি জোগার করে মেসে ওঠার সিদ্ধান্ত নেই। মা তখন বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে চরম রেগে ছিল। একটা থা’প্পড়ও জুটে গেছিলো গালে। বাড়ি ছাড়ার কথা শুনে মা দূরছাই করে বলেছিল বেরিয়ে যেতে। শুভ্রা আপার মতো নাকি আমিও নাক কা’টব মায়ের ধারণা। তাই আমাকে এখন সহ্যই করতে পারে না।
আমার চলে আসায় মন থেকে দুজন মানুষ দুঃখ পেয়েছে। নানাজান ও ভাইয়া। এই দুজনই মানুষই দূর থেকে আমার ছায়া হয়ে আছেন। মায়ের দেখাশোনার অভাবে ভাইয়া আপাতত নতুন বাসায় উঠবে না। আমি চলে আসার সময় ইকরাম ভাই ও ধারার ব্যাপারটা নানাজানকে জানিয়ে এসেছিলাম। বাড়িতে জানাজানি হলে বড়ো মামা-মামী মেনে নেয়নি। আশ্রিতের কাছে আদরের মেয়েকে উনারা কিছুতেই বিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন না। অথচ আমার বেলাতে ইকরাম ভাই উনাদের চোখে ছিল সুযোগ্য। ধারার বেলায় শুধুই আশ্রিত মানুষ। অশান্তি চরমে পৌঁছে গেছিল। ইকরাম ভাইও নিজের যোগ্যতা প্রকাশ করতে সে বাড়ির ছায়া থেকে সরে গেছিল। পরবর্তীতে নানাজানের নির্দেশে মামা-মামীকে নিমরাজি হতে হয়েছে।
সুড়ুৎ করে শেষ চুমুকটা দিলাম ঠান্ডা চায়ে। এবার সত্যি সত্যিই ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ব্যাগটা কাঁধে তুলে ছুটলাম। জীবনের তাগিদে একাই ছুটতে হবে। এবার নাহয় অশ্রুরা পরিশ্রমের ঘাম হয়ে ঝরুক।
চলবে।