#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[১২]
মৃদু কুয়াশার প্রলেপে পরিবেশ ধুসর হয়ে আছে। ভোরের শিশির ভেজা ঘাস জানান দিচ্ছে শীতকাল ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। সেই নিশ্বাসের দাপটে সর্দি-জ্বর কাবু করে ফেলছে কমবেশি সবাইকে। আমিও কাবু হলাম। গতকাল রাত থেকে হুট করেই মাথা ধরা, চোয়াল ব্যথা শুরু হয়। সকাল সকাল সর্দি-কাশিতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কাশির শব্দে শান্তি বিনষ্ট হওয়ার ভয়ে রুম ছেড়েও বের হতে ইচ্ছে করছে না। মা শান্ত চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে রাখ। ধোয়া-মোছার কাজ করার দরকার নেই। পানি থেকে দূরে থাকবি।”
মা যন্ত্রের মতো বেরিয়ে গেল। মানুষটা যেন বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুড়িয়ে গেছে। চামড়ার বলিরেখাগুলো আগের চেয়েও প্রকটিত। বাড়ির বাইরের পৃথিবীর প্রতি কোনো আকর্ষণ, আগ্রহ নেই। নেই কোনো ভবিষ্যত চিন্তা। প্রাণের মেয়াদ ফুরায়নি বলেই যেন বেঁচে থাকা। মায়ের ভাবনার বিষয় এখন দুটো জিনিসই ঠাঁই পায়। এক, আমার বিয়ে দেওয়া। আর দুই, ভাইয়ার গোছানো জীবন দেখা। বলাবাহুল্য আমার বিয়ের কাজ সেরেই মা ভাইয়াকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। ভাইয়া অফিস যাওয়ার আগে আমার কাছে এলো একবার।
“ঠান্ডা বাঁধিয়েছিস নাকি।”
নাক টেনে বললাম,
“তেমন কিছু না।”
কথাটা শেষ করতেই কেশে উঠলাম। ভাইয়া ভ্রু কুচকে বলল,
“আবার কাশিও হয়েছে। জ্বর নেই তো?”
এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখল আমার। জ্বর নেই।
“আসার সময় ঠান্ডার ওষুধ নিয়ে আসব।”
ভাইয়া চলে যেতে নিলে পিছু ডাকলাম,
“ভাইয়া?”
“হু?”
“ভাবীর সাথে কথা হয়েছে?” ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম। ভাইয়া থমথমে মুখে উত্তর দিলো ,
“কথার কিছু নেই। যা হবার ছিল তাই হবে। এসব নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করার কোনো দরকার নেই।”
ভাইয়া একপ্রকার নজর এড়িয়ে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না আমি। মাসখানেক আগে বাবুর মৃ ত্যুর পর ভাবী নিজে থেকে ফোন করেছিল। ক্ষো ভ ঝেরে বলেছিল আমরা নাকি তার মানসিক শান্তি কেড়ে নিয়েছি। অভি-শাপ দিয়েছি। তাই বাবুকে বাঁচানো যায়নি। বাবুর মৃ ত্যুর দায়ও সে আমাদের ওপরই দিয়েছে। ভাইয়া শুধু জিজ্ঞেস করেছিল কোন দোষে নিজের বাচ্চার মুখটাও দেখার সুযোগ পেল না। ভাবী উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল। এরপরের সপ্তাহেই ভাবীর কাছ থেকে উকিল নোটিস এসেছে। ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। হায়! কোথায় সেই ভালোবাসা যা আমাকেও প্রেমের প্রতি আকর্ষিত করেছিল? সব কেমন মিথ্যা হয়ে গেল! চোখের সামনে আরেকটি প্রণয়ের পরাজয় ঘটল। এতসবের মাঝে আমার বিয়ে নিয়ে আর কোনো আলোচনা ওঠেনি। কিছুটা স্বস্তি মিলেছে তাতে।
বেলা হতেই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে মন টিকছে না। গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছি ইকরাম ভাই আমাকে পৌঁছে দিতে আসছে না। আমি বেরোনোর আগেই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সামনেও আসছেন না খুব একটা। হয়তো ব্যস্ত খুব। তাছাড়া আমারও উচিৎ নয় উনার ওপর ভরসা করে বসে থাকা। বাসে ঝুলে ভার্সিটি পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটা ক্লাস ছুটে গেল। কাজেই ক্লাসের অভিমুখে না এগিয়ে পুকুরঘাটে বসে রইলাম। ক্লাস শেষে ইতু কল দিলো।
“তুই এখনো পৌঁছাতে পারিসনি?”
“এইতো পুকুরপাড়ে। আসছি।”
ক্লাসে যেতেই ইতু জিজ্ঞেস করল,
“এত লেইট করলি কেন আজ?”
“লোকাল বাস, বুঝিসই তো কেমন গতিতে চলে। আমারই ভুল। আরো আগে বেরোনো উচিৎ ছিল।”
ইতু থুতনিতে হাত রেখে কৌতুকের ভঙ্গিতে বলল,
“তোর সেই মাসুম বদনের বডিগার্ড আজকাল আসছে না যে?”
চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালাম। কাশি সামলে বললাম,
“ইকরাম ভাই আমার বডিগার্ড হতে যাবে কেন?”
“তারচেয়েও তো কম নয়। নতুন কিছু ভাবছিস নাকি?”
“কী ভাবব?”
“ইশ! কিচ্ছু বোঝো না তুমি? আমার আগেই তো প্রেমের নদীতে পা ভিজিয়েছো।”
“যাকে নিয়ে প্রেমের নদীতে নেমেছিলাম সে আমায় সাঁতার শেখায়নি ইতু। মাঝ নদীতে ফেলে চলে গেছে। একবার হাবুডুবু খেয়ে শিক্ষা হয়ে গেছে। আমি এখন নদী তো দূর পানিকেও ভয় পাই।”
ইতু রেগে বলল,
“এসব সেন্টিমেন্টাল বেশভূষাও পানিতে ভাসিয়ে দিতে শেখ। সেই কবে একজন ছেড়ে গেছে এখনো তার বিরহে জ্ব’লে ম’র’ছে! দেখ গিয়ে আদনান এতদিনে কোনো ককেশীয় ললনাতে মজে গেছে।”
“তার বর্তমান নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”
“অতীতের মাথাব্যথাও রাখিস না। না পারলে মলম লাগা।”
দুহাত বুকে গুজে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললাম,
“তা তোর কাছে মলমটা কী শুনি?”
“আরেকটা প্রেম কর। বাইকওয়ালা তো হাতেই আছে।”
“ছি! উনাকে জড়িয়ে এসব বলবি না। আমরা একে অপরকে শ্রদ্ধা করি।”
“ভালোবাসায় শ্রদ্ধাটাই মুখ্য।”
ইতুর ইঙ্গিতকে অগ্রাহ্য করলেও কথাটা আমি পুরোপুরি অস্বীকার করলাম না। আসলেই ভালবাসায় শ্রদ্ধাটা ভীষণ জরুরী।
_______________
সন্ধ্যায় বড়ো মামীকে রাতের রান্নার জোগার করে দিচ্ছিলাম। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। হাত মুছে ছুটে গেলাম। শ্রাবণ পড়াতে এসেছে। দরজা ছেড়ে ভেতরে আসতে দিলাম। শ্রাবণ কিছু না বলেই লম্বা পা ফেলে রিডিংরুমে চলে গেল। আমিও চলে গেলাম রান্নাঘরে। খানিক বাদে বসার ঘর থেকে গলা খাকারি দেওয়ার শব্দ শুনে কৌতুহলী হয়ে উঁকি দিলাম। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে চায় কিনা জানতে এগিয়ে গেলাম। শ্রাবণ বলল,
“ধারা কী অসুস্থ?”
“কই নাতো!”
“তবে পড়তে এলো না যে?”
আমার কপালে ভাজ পড়ল। ধারাকে তো রুমেই দেখে এলাম। শ্রাবণকে অপেক্ষা করতে বলে ধারার রুমে ছুটে গেলাম। দেখলাম সে চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে কী অদ্ভুত শূন্যতা। কী হলো মেয়েটার? আমি নিঃশব্দে ধারার পাশে গিয়ে বসলাম। ও চমকে তাকালো।
“পড়াতো এসেছে। যাসনি কেন?”
“ইচ্ছে করছে না৷”
“শ্রাবণ অপেক্ষা করছে তো।”
“চলে যেতে বলো। এমনিতেও উনি দুদিন পর থেকে আমায় পড়াতে পারবে না।”
“সেকি! কেন?”
“জানো না? শ্রাবণ ভাই পুলিশ ক্যাডার হয়েছে। ট্রেনিং-এ যাবে। এরপর বড়ো পদ নিয়ে কোনো এক থানায় পোস্টিং হয়ে চলে যাবে।”
আমি সন্দেহি দৃষ্টিতে তাকালাম। শ্রাবণ চলে যাবে বলেই কি কিশোরীর এই অভিমান? কোনোভাবে ধারা শ্রাবণের প্রতি দুর্বল নয়তো? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? কোমল স্বরে বললাম,
“তোর মন খারাপ? আমাকে বল।”
ধারা বিরক্ত হয়ে কর্কশ স্বরে বলে উঠল,
“আমাকে একা থাকতে দাও আপু। এ ঘর থেকে গেলে খুশি হই।”
আমি বজ্রা হ ত চোখে তাকিয়ে রইলাম। এ কেমন ব্যবহার ধারার? ও তো কখনো আমার সঙ্গে এমন স্বরে কথা বলে না! তবে? মনে কিছুটা আ ঘা ত পেলেও প্রকাশ করলাম না। শ্রাবণকে গিয়ে বললাম,
“তুমি আজ এসো। ধারার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। পরীক্ষার প্রেশার, পড়াশোনার টেনশনে মেয়েটা শুকিয়ে গেছে।”
শ্রাবণ চলে গেল। খেয়াল করলাম তার মুখটাও অদ্ভুত গম্ভীর আজকে। বেশি ভাবতে পারলাম না। মামীর ডাকে রান্নাঘরে ছুটে যেতে হলো। সেদিন রাতেই পুনরায় আমার বিয়ের গুঞ্জন কানে এলো। নানাজান পাত্র হিসেবে ইকরাম ভাইকে ভাবছেন শুনে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলাম।
চলবে…