#বৃষ্টি থামার শেষে
পর্ব-৯
“তূর্য আমার কী মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে শুধু ওই কারনে তুমি ইশা আর অনির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করোনি। অন্য কোনো কারন ও ছিলো!
তূর্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ধারণা সত্যি। আমি অন্য একটা ব্যপারে খুব কষ্ট পেয়েছি বলেই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছি।
“কী কারন সেটা?”
“ওরা প্রেমে পরার পর কেমন যেন পাল্টে গেল। যে বন্ধুরা আমাকে কথা দিয়েছিল পাশে থাকবে, তারাই কেমন যেন বদলে গেল।
সিন্থিয়া স্মিত হেসে বলল, তুমি আসল ব্যাপার টা বলতে চাইছ না তাই তো!
তূর্য চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমি আর এই টপিকে সত্যিই কোনো কথা বলতে চাইছি না। প্লিজ।
সিন্থিয়া আরেকটু গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি তূর্য। মন দিয়ে শুনবে কিন্তু।
“হ্যাঁ বলো।
“তুমি ওদের সাথে কন্টাক্ট করো!”
তূর্য বিস্মিত চোখে সিন্থিয়ার দিকে তাকালো। সিন্থি বলল, আমার মনে হয় জমাট বাধা অভিমান তোমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। তারচেয়ে বরং তুমি ওদের সাথে কথা বলো।
তূর্য উদাস গলায় বলল, তা আর হয় না।
“কেন হয় না? শোনো তূর্য তুমি নিজেও চাও ওদের কাছাকাছি থাকতে।
তূর্য অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো, মানে?
সিন্থিয়া হেসে বলল, তোমার অবচেতন মন চাইছে তুমি বন্ধুদের কাছাকাছি থাকো।
তূর্য বিরক্ত গলায় বলল, মানে?
“হ্যাঁ তূর্য। তুমি আসলে এতো বছরের অভ্যাসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছ। ওদের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্টে তোমার কনশাস মাইন্ডে প্রভাব ফেললেও তোমার সাব কনশাস মাইন্ড চেয়েছে তুমি কাছাকাছি থাকো। আর ঠিক সে কারনেই তুমি অন্য কোনো দেশে না গিয়ে ইন্ডিয়াতে পড়ে রয়েছ।
তূর্য অবাক হলো। কেন যেন ওর এই কথাগুলো খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। সত্যিই যে ওদের সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করে নি তেমন টা না। কিন্তু শুধু একটা ভয়েই সে কোনো রকম যোগাযোগ কিংবা লুকিয়ে খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয় নি।
সিন্থিয়া গাঢ় গলায় বলল, তূর্য আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে তুমি ইশাকে পাগলের মতো ভালোবাসো অনেক আগে থেকেই! আর এই ব্যাপার টা ইশা না জানলেও অনিক আগে থেকেই জানতো। এম আই রাইট?
তূর্য কাঁপা গলায় বলল, হ্যাঁ।
সুরাইয়ার আজকাল কিছু ভালো লাগে না। রান্নাঘরে ডাল, ভাত চুলায় বসিয়ে সে বারান্দায় এসে জানালার পাশে বসে রইলো। ইচ্ছে করছে না রান্নাবান্না, ঘর, সংসার কোনো কিছুর দিকে ফিরে তাকাতে। সব ছেড়ে একদিক হেটে গেলেই বুঝি সব শান্তি! একটা বয়সের পর মহিলাদের কাছে মধুর সংসার কেও অম্ল মনে হয়। তখন তাদের ইচ্ছে করে দূরে কোথাও যেতে। যেখানে ঝামেলা ঝঞ্জাট কিছু নেই।
ভাত, ডাল চুলা থেকে নামিয়ে শুয়ে পড়লো সুরাইয়া। এর বেশী ওর পক্ষে করা সম্ভব না। কেউ যদি পারে তো খাবে, না পারলে না খেয়ে থাকবে।
সুরাইয়ার মনে হলো অনি চলে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে সবকিছু নিয়ে গেছে। শক্তি, ইচ্ছা সবকিছু। এখন আর আগের মতো কোনো কিছু ইচ্ছা করে না। পেলে খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে, না পেলেও তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অথচ একটা সময় এটা নেই, সেটা নেই করেই জীবন টা কেটে গেছে। আর এখন মনে হচ্ছে মরন কেন আসে না!
ইশা হসপিটালে গেল রিপোর্ট গুলো কালেক্ট করার জন্য। ডক্টর জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার সাথে কেউ আসে নি?”
ইশা স্মিত হেসে বলল, আসলে এ শহরে আমার কেউ নেই।
ডক্টর একটু মন খারাপ করা গলায় বলল, আসলে এমন একটা নিউজ আমরা সচরাচর পেশেন্ট দের দেই না।
ইশা ভীত গলায় বলল, আমার কী হয়েছে?
কিছুক্ষণ থেমে থেকে ডক্টর বলল, আপনি ক্যান্সারের তৃতীয় স্টেজে আছেন। আপনার উচিত অতি দ্রুত হসপিটালে এডমিট হওয়া।
ইশার মুখ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আমি আর কতদিন বেঁচে আছি ডক্টর? ”
“সেটা বলা যাবে ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়ার পর। আসলে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনি দ্রুত হসপিটালে ভর্তি হয়ে যান।
রিপোর্ট গুলো ব্যাগে ভরে ক্লান্ত ইশা রাস্তায় নেমে আসলো। ডাক্তার বলেছে ক্যান্সারের তৃতীয় স্টেজে আছে। বাচাঁর সম্ভাবনা কতটুকু আছে সেটা একবার ও বলেনি। ইশা জানে ক্যান্সারে বেঁচে থাকার প্রবাবিলিটি ওর একদম নেই বললেই চলে। তবুও একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে। আর বন্ধুরা! তারা বরং তাদের মতো ই থাক। অনেক তো খুঁজেছে। আর খুঁজবে না। যেমন ভালো আছে তারা তেমন ই থাক।
ইশা পরের সপ্তাহে ই হসপিটালে ভর্তি হলো। খবর পেয়ে ইশার খালা ছুটে এসেছেন। খালাকে পেয়ে ইশা খানিক টা ভরসা পেল। সব আশা ভরসা ছেড়ে শুরু হলো বেঁচে থাকার লড়াই।
তূর্য অনেক চিন্তা ভাবনা করেও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি যে ও কী করবে! একবার মনে হয় ইশাকে ফোন করবে, আবার ভাবে থাক কী দরকার ওরা ওদের মতো ই থাক।
শেষমেস সবকিছু এক সাইডে রেখে অনিকের নাম্বারে ফোন করলো। যথারীতি নাম্বার বন্ধ পেয়ে ইশার নাম্বারেও ট্রাই করলো বারবার। দুজনের নাম্বার বন্ধ পেয়ে শেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় দুজনের খোঁজ চালায়। আচমকা দুজনের একজনকে ও না পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যায় তূর্যর। সবরকম ভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে দুজনের একজন কে খুঁজে বের করার জন্য।
অবশেষে উপায় মিলে যায়। ইশার হোস্টেল সুপারের নাম্বারে ফোন করে। ফোন করার সময় তূর্যর ধারণা থাকে না পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী হবে। কিন্তু তূর্যকে অবাক করে ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, তূর্য আপনি কী জানেন আমরা গত তিন বছর ধরে আপনার এই ফোন টার অপেক্ষা করছিলাম।
ইশার অসুস্থতার খবর পায় প্রথমে অভি। অভি বাসায় এসে রুপাকে রুক্ষ গলায় বলে, অনেক হয়েছে তোর নাটক। এসব এখন বন্ধ করার সময় এসেছে।
রুপা শান্ত গলায় জবাব দেয়, যা কিছুই হোক না কেন সত্যিটা কোনোভাবেই ওদের জানানো যাবে না।
“কিন্তু আমি তো জানাব ই। তুই কী দেখতে পাস না যে একটা মানুষ কিভাবে পাগলের মতো ভাইয়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
রুপা রুক্ষ গলায় জবাব দেয়, হ্যাঁ আমি অন্ধ হয়ে গেছি। পরিস্থিতি আমাকে অন্ধ করতে বাধ্য করেছে।
সুরাইয়া ছেলেমেদের ঝগড়া শুনেও মুখে কিছু বলছে না। বলার মতো বোধ শক্তি কিছুই হচ্ছে না।
রুপা না পেরে শেষে বলে, মা ওকে বলো যে ও যদি খুব বাড়াবাড়ি করে তবে আমি বাড়ি ছেড়ে যাব।
অভি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করে যায়। তারপর শীতল গলায় বলে, মা তাহলে তোমরা রেডি থেকো, সিলিং এর সাথে আরেকটা লাশ ঝুলতে দেখার জন্য।
সুরাইয়া চমকে ওঠে। রুপাও চমকায়। সেই ভয়ংকর দৃশ্য! যা প্রতি রাতে তাড়া করে বেড়ায়। রুপা আচমকাই অভির গালে একটা থাপ্পড় মেরে বসে। তারপর বসে ব্যকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে।
তূর্য দেশে ফিরেছে তিনদিন পর। ইশা হসপিটালে ভর্তি এই খবর পেয়েই সব ছেড়ে দেশে ছুটে এসেছে। আসার আগে সিন্থিয়াকে ফোন করে বলেছে,
“আমি হয়তো অনেক বড় একটা ভুল করেছি সিন্থি!”
সিন্থিয়া স্মিত হেসে বলল, ইয়েস আই নো। সময় যেহেতু আছে তাহলে একবার তোমার উচিত প্রায়শ্চিত্ত টুকু করা।
তূর্য আর কিছু ভাবতে পারে না। বারবার শুধু মনে হয় সামান্য ভুলে ইশাকে, অনিকে অনেক বড় শাস্তি দিয়ে ফেলেছে।
দেশে ফিরে অনির খোঁজে পুরোনো বাসায় যায়। তিন বছর অনেক টা সময়। রাস্তা,জ্যাম, ধুলোমাখা শহর। রোজ বিকেলে চটপটি ফুচকার আমেজ সব ঠিকঠাক থাকলেও ফেলে রাখা মানুষ গুলি আর থাকার মতো নেই। তূর্য প্রথম ধাক্কা টা খেয়েছে অনিকের পুরোনো বাসার বাড়িওয়ালার থেকে। যে কি না অবলীলায় বলেছিল, আরে ওই পুলাডা তো গলায় ফাঁস নিয়া মরছে। আর ওর বইনেও তো শুনছি ধান্দা কইরা সংসার চালায়।
তূর্য বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। যেন কিছুই বুঝতে পারে নি।
চলবে……