বৃষ্টি থামার শেষে পর্ব-০৫

0
554

#বৃষ্টি থামার শেষে
#পর্ব-৫
দিনগুলো এভাবেই কাটতে লাগলো সবার। অনিক নতুন কাজে থিতু হবার চেষ্টা করছে। তূর্য লাস্ট সেমিস্টার নিয়ে ছোটাছুটি করছে। ইশাও ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করছে। এক শুক্রবার তূর্য ইশাকে নিয়ে অনিকদের নতুন বাসায় বেড়াতে গেল। এখন আর আগের মতো মঙ্গলবার তিনজনের আড্ডা হয় না। দুজন কে একসাথে দেখে অনিক ও খুব খুশি হলো। রুপা এমনিতে কথা কম বললেও তূর্য আর ইশার সাথে জমিয়ে গল্প করে। অভিকের ও তূর্যকে খুব পছন্দ। যদিও ইশাকে দেখলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কারন ছোটবেলায় একবার ইশাকে বলেছিল বড় হয়ে তোমাকে বিয়ে করবো। তারপর থেকে ইশা অভিকে দেখলে বাচ্চাবর বলে ক্ষেপায়।

ইশা আর তূর্য খালি হাতে গেল না। মহাখালী কাচা বাজারে বাইক থামিয়ে তূর্য বলল, ইশু তুই একটু দাড়া। আমি বাজার করে নিয়ে আসি।

ইশা অবাক গলায় বলল, বাজার করে নিয়ে আসবি? এতে অনিক রাগ করবে? দেখলি না সেদিন ক’টা জামাকাপড় কিনে দিয়েছিলাম বলে কী রাগ টা দেখালো।

“আরে আমার সাথে রাগবে না। বুদ্ধি করে কিছু একটা বলে দেব”।

কিছুক্ষণ পর ব্যাগ ভর্তি করে বাজার নিয়ে ফিরে এলো। চোখ কপালে তুলে ইশা বলল, এসব কী করছিস বলতো! আজকের দিন টা দেখিস তোর জন্য মাটি হয়ে যাবে।

তূর্য উড়িয়ে দিয়ে বলল, আরে চুপ কর! আমি কিভাবে ম্যানেজ করি সেটি দেখ।

অনিকের বাসায় গিয়ে তূর্য সুরাইয়াকে বলল, আন্টি একটা ঘটনা হয়েছে। গতকাল রাতে মা বাজার করতে দিয়েছিল। আমি সেভাবে সব কিনে আজ যখন বাড়ি ফিরলাম দেখলাম ঘরে তালা দেয়া। মা বড় আপার বাসায় গেছে, দুপুরে ওখানে যেতে বলেছে আমাকেও। এদিকে এতোগুলো বাজার নিয়ে পড়েছি বিপদে। তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম।

সরল মিথ্যেটা কেউ বিশ্বাস করলো না। তবে কেউ বুঝতেও দিলো না যে তূর্যর মিথ্যেটা সবাই ধরতে পেরেছে।

সুরাইয়া খুব খুশি হলো। মায়েরা সম্ভবত রান্নার জিনিস অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশী পছন্দ করেন। ব্যগ ভর্তি বাজার পেয়ে সুরাইয়া রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে গেল খুশিমনে।

অনিকদের বাসায় আলাদা কোনো বসার ঘর নেই। বসার ঘর বলতে যেটা আছে সেখানে অনিক আর অভি থাকে। এছাড়া দুটো ঘরের একটাতে রুপা আরেকটাতে অনিকের বাবা, মা থাকে।
অনিকের খাটে আড্ডার আসর জমলো। সবাই হেসে খেলে গল্প করছে। সেই আড্ডায় রুপাও আছে। মুখচোরা স্বভাবের রুপাও ফূর্তিবাজ তিন বন্ধুর সাথে মিশে গেল। সুরাইয়ার আজ মন খুব ভালো। এমনিতে ইশাকে তার খুব একটা পছন্দ না। একটা বয়সের পর মায়েরা ছেলেদের মেয়ে বন্ধুকে খুব একটা পছন্দ করেন না। সুরাইয়াও তেমন। তবে আজ মন ভালো থাকার কারনে ইশাকে খুব একটা খারাপ লাগছে না। সবার জন্য আলু চিপস আর চা এনে ইশাকে বলল, কিরে মেয়ে বিয়েশাদি কবে করবি?

ইশা লজ্জা পেল মুহুর্তেই। রুপা ঠেস মেরে বলল, বাব্বা ইশু! তুই তো লজ্জাও পাস দেখছি! প্রেম টেম করছিস নাকি!

তূর্য আড়চোখে দেখলো সব টা। অনিক বলল, আরে না। ও প্রেমে পড়লে নিশ্চয়ই জানতাম আমরা।

ইশা চুপ করে থাকলো। অনিক কিছু না বুঝলেও বাকী সকলে ব্যাপার টা আঁচ করতে পারলো।

ব্যাপার টা রুপা আর তূর্যর কাছে পরিস্কার হলো তখন যখন ইশা সুরাইয়ার কাছে অনিকের পছন্দের তেল ছাড়া গরুর মাংসের রেসিপি জানতে চাইলো। তূর্য ঠিক খুশি হতে পারলো না, কেন যেন মনে হচ্ছে বন্ধুদের প্রেমে পড়া ঠিক না। বন্ধু সম্পর্ক টা আলাদা একটা সম্পর্ক। ঠিক তেমন প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক ও আলাদা।

একফাঁকে রুপা ইশাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুই যে অনিকে ভালোবাসিস সেটা অনি জানে তো?

ইশা চমকে গেল। মাথানিচু করে ফেলল।

“শোন ইশা সময় থাকতে বলে দে। নাহলে কিন্তু পস্তাবি। ”

“কিন্তু ও যদি ভুল বোঝে?”

“ভুল বুঝবে কেন! বন্ধুদের মধ্যে প্রেম হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তোর আর তূর্যর সাথে অনির অনেক দিনের পরিচয়। বরং এই সময়ে তোদের যদি প্রেম না হয় সেটা অস্বাভাবিক ব্যাপার “।

“কিন্তু ও যদি জিজ্ঞেস করে তূর্য কে ভালো না বেসে ওকে কেন ভালোবাসলাম!”

“এই প্রশ্নের উত্তরে যেটা সত্যি সেটা বলবি”।

“কিন্তু “।

“ন্যায় অন্যায় বোধ স্পষ্ট থাকা খুব জরুরী ইশা। তুই যে বন্ধুর থেকে একটু বেশী কিছু অনিকে ভাবিস সেটা অনিকে না জানালে ওর সাথে অন্যায় করা হবে”। ওকে ভুলের সাগরে রাখা ঠিক না”।

ইশা চুপ করে থাকলো। রুপা জড়িয়ে ধরে বলল, তাছাড়া আমার ভাই যদি এমন মিষ্টি মেয়েকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে তাহলে আমি খুব কষ্ট পাব।

ইশা মিষ্টি করে হাসলো।

সেদিন অনিকের বাসা থেকে ফেরার পর থেকে ইশা দ্বিধায় আছে। কী করবে ভেবে পায় না। কয়েকটা দিন ভাবলো শুধু এই ব্যাপারে। রুপার কথা একদিক থেকে সত্যি যে অনিক কে যদি মনের কথা না জানায় তাহলে ও বুঝবে কী করে! যদি অন্য কারও সাথে জড়িয়ে যায়। ইশা আর ভাবতে পারে না। কিছুতেই পারে না অনিক কে হারানোর কথা। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, এরপর আর সারারাত ঘুম হয় না ওর।

এভাবে দিন যত যেতে লাগলো ইশার অস্বস্তি তত বাড়তে লাগলো। এদিকে খালা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে পরীক্ষা শেষে বিয়ে করতে হবে। চাকরি বাকরি দরকার হলে বিয়ের পর করবে। এসব ঝামেলার কারনে ইশার খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ হয়ে গেছে। কারও সাথে যে আলাপ করবে সে ভরসাও পাচ্ছে না। একদিন না পেরে তূর্যকে কে ফোন করে বলল,

“দোস্ত আমি একটা ভুল করে ফেলেছি”।

তূর্য আন্দাজ করতে পারলেও সেটা প্রকাশ না করে বলল, কী হয়েছে? কী করেছিস রে?

ইশা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁপা গলায় বলল, আমি অনিকে ভালোবাসি।

কথাটা বলে ফোন কেটে দিলো। তূর্য লাগাতার ফোন করে গেলেও ফোন রিসিভ করলো না। একসময় না পেরে ফোন ধরে বলল, দোস্ত তুই কী আমাকে ভুল বুঝেছিস?

তূর্য হো হো করে হাসতে লাগলো। বলল, তুই যে কতো পাগল সেটা বুঝতে পারলাম। অনিক কে ভালোবেসেছিস! খুন তো করিস নেই!

ইশা ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দোস্ত আমি মরে যাব।

“আচ্ছা”।

“আচ্ছা মানে? তুই জিজ্ঞেস করবি না কেন”?

“শোন ইশু যদি ভালোবাসার কথা না বলতে পারিস তাহলে মরে যা।” আমি এখন রাখছি আমার ক্লাস আছে”।

———- ———- ———- —————–

তূর্যর কেন যেন ভালো লাগছে না। সবকিছু কেমন তিক্ত মনে হচ্ছে। ইশার এরকম প্রেমে পড়া ব্যাপার টা মেনে নিতে পারছে না। কেন ই বা পড়বে! কথা ছিলো ওরা সবসময় কেবল বন্ধুই থাকবে। তূর্য এই ব্যাপার টা কেন মেনে নিতে পারছে না ও নিজেও জানেনা। শুধু বারবার ওর মাথার মধ্যে একটা ব্যাপার ই ঘুরপাক খায় যে ইশা আর অনিকের প্রেম টা হয়ে গেলে ওদের জীবনে ওর প্রায়োরিটি কমে যাবে। এই ভাবনাটাই কেবল তূর্যর সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়।

সাইকোলজি বলে মানুষের অবচেতন মন নাকি অনেক সময় ভবিষ্যৎ সম্পর্ক অনেক কিছু জানতে পারে। এই জানতে পারাটা ঘটে অবচেতন মনের ভাবনা থেকে। অনেকসময় ভবিষ্যতের এই ভাবনাগুলো মানুষের জীবনে ঘটে যায়। কারও ক্ষেত্রে পুরোপুরি। আবার কারও ক্ষেত্রে কিছুটা। ত্রিরত্নের জীবনে তূর্যর অবচেতন মনের ভাবনার আশিভাগ মিলে গিয়েছিল। যদিও তূর্য ভেবেছিল এরকম কিছু ঘটতে পারে কিন্তু যখন ঘটনা ঘটেছিল তখন সত্যিই সে বড়সড় এক ধাক্কা খেয়েছিল। আর সেই ধাক্কায় অনেক টা দূরে ছিটকে পড়ে নিজেকে আজীবনের জন্য আলাদা করে নিয়েছিল।

তিন বছর পরঃ

লাদাখের এই রেস্টুরেন্ট টা তূর্যর খুব পছন্দ। দেশ ছেড়ে এসেছে তিন বছর হয়েছে। এই তিন বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। বাবা হার্ট অ্যাটাক করে এক দিনের নোটিশে দুনিয়া ছেড়ে গেলেও তূর্যর যাওয়ার সুযোগ হয় নি। মা আছে তূর্যর মেজ আপার কাছে দিল্লিতে। মাঝেমধ্যে দুই তিন দিন মায়ের কাছে থেকে আসে। দেশে যাওয়ার ইচ্ছে খুব একটা নেই বরং নিজেকে লাদাখের পরিবেশে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে আপ্রাণ। আর ইশা অনিক কে ফেলে এসেছে এয়ারপোর্টে। প্লেনে ওঠার আগে সিম কার্ডসহ সোশ্যাল মিডিয়ার সব কিছু থেকে নিজেকে ডিস কানেক্টেড করে দেশ ছেড়ে এসেছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে