#বৃষ্টি থামার শেষে
#পর্ব-৪
“আমার একটা চাকরি হয়েছে”।
“সত্যি? ”
অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে ইশা। তূর্য মুখভর্তি খাবার নিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
অনিক হেসে বলল, আরে আগে সব টা শুনে তো নে তোরা!
“বল”।
“চাকরি টা খণ্ডকালীন। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে গিয়েছিলাম। ভাবিনি যে হয়ে যাবে।
তূর্য উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, বাহ! তোর কপাল বটে একটা।
ইশা কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো, আগে বলবি তো কাজ টা কিসের?
“একটা মোবাইল ফোন কোম্পানির মাঠকর্মী”। মাসে দশ হাজার করে দিবে। শুক্রবার ছাড়া এরপর আর দেখা হচ্ছে না”।
ইশা মন খারাপ করে বলল, বড় হলে এই এক জ্বালা। ক্যারিয়ার নিয়ে ছুটতে ছুটতে বন্ধুদের ভুলে যেতে হয়”।
অনিক হেসে ফেলল। তূর্য বলল,
“সেকিরে! ওর চাকরি হয়েছে তাতে তুই খুশি না হয়ে মন খারাপ করছিস!
ইশা ঠোঁট উল্টে বলল, তারজন্য মন খারাপ না। এরপর আর আমাদের আগের মতো হুটহাট আড্ডা দেয়া হবে না। তাই মন খারাপ।
অনিক বলল, শুক্রবার আমরা জমিয়ে আড্ডা দেব তো!
তূর্য মাঝখানে বলে উঠলো, আচ্ছা ইশু ধর অনিক যদি বিয়ে করে ফেলে তখন তো আর এমন আমাদের সাথে মিশতে পারবে না। তখন কী করবি!
ইশার বুক টা ধ্বক করে উঠলো। কোনো কারন ছাড়াই ওর চোখে পানি এসে গেল। অনিক বলল, আরে ধুর আমার বিয়েতে অনেক দেরি!
প্রসঙ্গ পাল্টে তূর্য বলল, আমি ভাই বেশী দেরি করবো না। সুযোগ পেলেই সোজা বিয়ে করে ফেলবো। জীবন টা আর কয়দিনের! এই ক্ষনিকের জীবনে কী দরকার নিজের বউটাকে অন্যের বাড়িতে রাখার!
দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। কথা বার্তার আড়ালে চাপা পড়ে গেল ইশার হঠাৎ অনিকের বিয়ের কথা শুনে পাল্টে যাওয়া। যদিও বড় হওয়ার পর তিনজন কথা দিয়েছিল কেউ কারও প্রেমে পড়বে না। তবুও মন হলো ষোড়শী কিশোরীর মতো অবাধ্য! সে কি আর কোনো বারন মানে!
সেদিনকার আড্ডা শেষে তূর্য অনিক কে বাইকে করে পৌছে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা অনি তুই কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছিস?”
“কেন বলতো”?
“আরে এমনি জিজ্ঞেস করছি”।
“একটা মেয়েকে ভালো লেগেছিল”।
“তারপর? বলেছিলি?
“আরে না। ইউনিভার্সিটির সরস্বতী পুজোয় দেখেছিলাম। নীল শাড়ীতে দারুণ লাগছিলো। ঠিক প্রেম কী না জানি না তবে মেয়েটাকে বেশ ভালো লেগেছিল”।
“ইশ! আমায় কেন বললি না! আমি দরকার হলে মেয়েটার হাতে পায়ে ধরতাম। ”
অনিক নিঃশব্দে হাসলো। তূর্য বলল,
“শোন এরপর প্রেমে পড়লে আমায় বলবি। একটা ব্যবস্থা করে দেব”।
তূর্য শব্দ করে হাসলো।
—— —— ———— ———- ————
সুরাইয়ার আজ মন টা বেশ ভালো। মন ভালো থাকলে ইচ্ছে করে অনেক কিছু রান্না করতে। এই কলোনীতে আসার পর সুরাইয়ার এরকম মন ভালো আর কখনো হয় নি। মন ভালো হওয়ার কারণ হলো অনিকের একটা চাকরি হয়েছে। বেতন ও হাজার দশেকের মতো। আগে তিনটা টিউশনি করে নয় পেত। এখন তার সাথে আরও দশহাজার টাকা। সুরাইয়ার খুব খুশি লাগছে। এরচেয়ে বড় খুশি হলো রুপা একটা ভালো বাসা নিয়েছে। তিন কামরার ফ্ল্যাট। বাসা টা দেখে সুরাইয়ার খুশি আর ধরে না। কতো বছর যে এই স্যাতস্যাতে কলোনীতে কাটিয়েছে! এখন শেষ বয়সে এসে যদি একটু শান্তি না করে, তাহলে করবে কবে আর!
বাসা ভাড়া নিয়ে রুপা কিছু বলেনি। অফিসের এক কলিগের শ্বশুরের ফ্ল্যাট তাই সস্তায় ই ভাড়া পেয়ে গেল।
রাতের খাবারে ডিমের তরকারির সাথে সুরাইয়া একটু পোলাও করলো। বেগুন ভাজা, ডিম, পোলাও খেতে খুব একটা খারাপ হবে না। নতুন বাসায় গেলে এসব ছোটখাট অভাব থাকবে না আর। সুরাইয়ার কেন যেন মনে হচ্ছে এরপরে যা হবে তা খুব ভালো হবে।
অনিকের বাবা আলম সাহেব পোলাও মুখে দিলেন না। দুধ, মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। সুরাইয়া এক নাগাড়ে সব গল্প বলে যাচ্ছেন। আলম সাহেব শুধু যেন শোনার জন্য শুনছেন। ভদ্রলোক কথা বলেন খুব ই কম। পঙ্গুত্ব বরণ করার পর থেকে সংসারের কোনো ব্যাপারেই কথা বলেন না। পেলে খায়, না পেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমা, খবর টক শো এসব দেখেন। তবে দু চোখ দিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন।
আলম সাহেব সুরাইয়া কে বললেন,
“রুপুর এখন একটা বিয়া দেয়ার দরকার “।
সুরাইয়া চুপ হয়ে যায়। এই একটা মাত্র কথায় সুরাইয়া নীরব থাকে। রুপার বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। বিয়ের বয়স অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে অথচ সংসারের কেউ বিয়ের কথা বলে না। বলবে ই বা কী করে! রুপার বিয়ে হয়ে গেলে কে টানবে এই সংসারের ঘানি!
“কী কথা নাই ক্যান? ”
“এই বয়সী মাইয়্যারে কে বিয়া করবে”?
“গাড়িতে কইরা মাঝে মাঝে যে লোক আসে সে করবে “।
“এইসব কি কও? সেই লোকের বউ বাচ্চা আছে! ”
“তাইলে সে তোমার মাইয়্যার কাছে আসে ক্যান! ”
সুরাইয়া চুপ করে থাকে। এই প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে নেই। আর রুপাকে জিজ্ঞেস করার সাহস ও নেই।
ইশা ছয়তলার রুমে এসেছে দুদিন হয়েছে। এই রুমে ও ছাড়া আরও দুজন মেয়ে আছে। দুজনেই চাকরি করে। তাই সারাদিন পাওয়া যায় না। এখন অবশ্য দুজনের কেউ ই নেই তাই দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে শুয়ে আছে। বারবার তূর্যর বলা কথাগুলো কানে ভাজছে। যদিও কথাগুলো মজার ছলে বলা। তবুও ইশার বুকের ভিতর অদ্ভুত এক ব্যথা শুরু হয়ে গেল। এই অদ্ভুত ব্যথার কারন ও জানে। বহু আগে টের পেয়েছে যে তূর্যকে মনে প্রানে বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবলেও অনিক কে আর একটু বেশি কিছু ভাবে। সেজন্য দিনরাত অনির কথা ভাবে। ইশা বহুবার চেষ্টা করেছে এই ভাবনাকে নির্মূল করতে কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। বরং বুকের ভিতর টা খা খা করে ওঠে। এর পরিনতি কিংবা ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা ও জানে না। প্রায় ই ভেবেছে অনিক কে বলে দেবে যে দোস্ত তূর্য শুধু আমার বন্ধু থাক, তুই বন্ধুর চেয়ে একটু বেশী কিছু হয়ে যা। কিন্তু পারে নি। ভয় তাড়া করে বেরিয়েছে অনিক কে হারানোর। যদি অনিক যোগাযোগ ই বন্ধ করে দেয়!
ইশা আর কিছু ভাবতে পারে না। এই একটা কথাই সকল ভাবনা থামিয়ে দেয়। আর তখন বুকের ভিতর আটকে থাকা কান্নার দলাটা গলায় এসে যায়। তখন নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যেমন আছে তেমন সব চলুক। প্ল্যান করে জীবন চলে না। জীবন জীবনের নিয়মে চলে যাক।
তূর্যর চোখে ভাসে ইশার পাল্টে যাওয়া মুখটা। যদিও ও প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়েছিল তবে তীক্ষ্ণ চোখে সব টা খেয়াল করেছে। এটা আজ নতুন না। এর আগেও খেয়াল করেছে অনিক কে দেখলে ইশা যেন কেমন একটু অন্যরকম হয়ে যায়। আজকের ঘটনার পর অনেক টা নিশ্চিত হয়েও কেন যেন সন্দেহ থেকে যায় ওর। আচ্ছা এরকম তো কথা ছিলো না। কথা ছিলো ওরা কখনো একজন আরেকজনের প্রেমে পড়বে না। তাহলে ইশা কেন প্রেমে পড়লো! এই কেন’র উত্তর কেবল ইশাই জানে। যদিও তূর্যর এতে মাথাব্যথা নেই। বরং ওরা এক হলে তিনজনের বন্ডিং টা স্ট্রং থাকেবে। এখন প্রশ্ন হলো অনিক কী চায়!
চলবে…….