#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২১)
ঝকঝকে তকতকে রুমটা আজ ভীষণ পরিত্যক্ত। দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ ছিল বিধায় ধুলোর পাহাড় জমেছে। খুলতেই কিছু ছোট ছোট প্রাণী দেখতে পেল অভিরাজ। তার ললাটের রেখা গুলো বেরিয়ে এল। সুন্দর শুভ্ররঙা মুখটা বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। বাড়ির কেয়ারটেকারকে ডেকে আনা হলো। ভদ্রলোক বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন।
“আঙ্কেল বাড়ির যত্ন নিতে বলেছিলাম।”
“বাবা দুই বছর ধইরা তো আপ্নে আসলেন ই না। কোনো বিষয়ই বুঝবাল পারতাছিলাম না।”
তবু দুঃখ প্রকাশ করলেন ভদ্রলোক। এই বাড়িটা সম্পূর্ণ নিজ অর্থে করেছিল অভি। তার আর উষশী’র ছোট্ট একটা সংসার হওয়ার কথা ছিল। তাদের ঘনিষ্ঠ, মধুমাখা মুহূর্ত গুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল রুমটি। নিজ হাতে সবটা গুছিয়েছিল ওরা। সেই রুমের অবস্থা আজ ভীষণ খারাপ। অভিরাজের অন্তঃকরণ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। দু বছর পর বাড়িটায় পা রেখেছে সে। একটু একটু স্বাভাবিক হওয়ায় চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাড়ির ডানপাশে একটি বাগান রয়েছে। সেই বাগানের একপাশে রয়েছে বাহারি ঝর্ণা। এটা উষশী’র ভীষণ পছন্দের। বৃষ্টি ভালোবাসে মেয়েটি। তাই তার জন্য রাখা হয়েছে ভীষণ সুন্দর একটি সুইমিং পুল। বৃষ্টির জলে ভিজে এখান থেকে পরিপূর্ণ গোসল করবে দুজনে। এমন সব রকমারি কল্পনা সাজিয়েছিল। কিন্তু সময়ের স্রোতে সবটা শেষ হয়ে গেল। হারিয়ে গেল উষশী নামক বৃষ্টির জল।
অতীত
ছেলের বাড়ি থেকে লোক এসে গেছে। একটা চাপা আনন্দ কাজ করছে সবার মাঝে। বিশেষ করে গেট ধরার আনন্দটা একটু বেশিই যেন। ইরা,লাবণ্য শরবত বানাচ্ছে। বিভিন্ন স্বাদ মেশানো রঙিন শরবত। তা দেখে উষশী’র মনে প্রশ্ন জাগে।
“রঙিন শরবত কেন?”
“এই চুপ চুপ এটা সিক্রেট। এখানে টক মিষ্টি ঝাল সব রকমের শরবত আছে।”
“ঝাল শরবত ওদের তো ঝাল লাগবে ইরাপু।”
“এর জন্যেই তো বানাচ্ছি।”
উষশী কিছুই বুঝল না। গ্লাস গুলো টেবিলে এনে রেখে লাবণ্য বলল,”এটা একটা রিচুয়াল বলা যেতে পারে। মেয়ে পক্ষ গেট ধরার সময় ছেলে পক্ষের সাথে একটু আনন্দ উল্লাস করে।”
শরবতের সাথে মিষ্টি,রকমারি চকলেট ও নেওয়া হলো। একটা বাটিতে অনেক ধরনের ফুলের পাপড়ি নেওয়া হয়েছে। ইরা তার ভেতরে কাঁচি লুকিয়ে রাখল। এই নিয়েও উষশী’র মনে প্রশ্ন জাগল। কিন্তু সে প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। ছেলে পক্ষ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই পরিচিত হলেও কিছু অপরিচিত মানুষ রয়েছে। তারা ছেলের বন্ধু গোছের কেউ। তারা সকলেই হাসি ঠাট্টায় ফেটে পড়ছে। উষশী বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। ওমন সময় চোখে পড়ল এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ঈশান। তার মুখে রাজ্যের মেঘ। ছেলেটার এই বিষণ্ন মুখশ্রী উষশী’র হৃদয়কে নাড়িয়ে দিল। সে ছুটে এসে বলল,”ফের মন খারাপ করেছ তুমি?”
“মন খারাপ নয় উষশী।”
“ফ্রেন্ড, তোমার কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
“না উষশী। আমি কেন কষ্ট পাব?”
“মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাচ্ছে।”
উষশী’র দিকে সরল চোখে তাকাল ঈশান। তার বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হচ্ছে। ছেলেটার হাতটা শক্ত করে ধরল সে।
“দুঃখ পেও না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
উষশী’র কথাই ঠিক সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন হয়ত ছোঁয়া নামক মানুষটিকে মনেও পড়বে না। তবে মাঝের সময়টুকু বড়ো দুঃখে যাবে। সেই হাহাকার, উন্মাদনা কাকে বোঝাবে ঈশান? কেউ নেই তার গল্প শোনার জন্য। কিংবা আছে অথচ তার বলার ইচ্ছে হয় না।
বাড়ি ভরাট করে আছে মেহমান। তাদের সমাদরে সকলেই ব্যস্ত। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকে গেছে। বিয়ের সব রকমের আনন্দ উল্লাস ও প্রায় শেষ। অভিরাজকে এত সময় পর দেখল উষশী। তার রাগ হচ্ছে খুব। ছেলেটা সারাদিনে কত টুকু সময় দিয়েছে তাকে?
“খারাপ মানুষ।”
“তোমার আবার কি হলো!”
“কথা নেই খারাপ মানুষ।”
“দেখি কি হয়েছে।”
মেয়েটিকে শক্ত করে আলিঙ্গন করল অভি। এতে অবশ্য গলল না মেয়েটি।
“বলো কি হয়েছে?”
“একটা বার সময় হয় নি দেখা করার?”
“তোমায় তো আমি দেখেই যাচ্ছি।”
“কোথায়,আমি তো দেখি নি।”
“তখন তুমি সবার সাথে ব্যস্ত ছিলে।”
“আপনি কেন নিয়ে গেলেন না।”
“সবার সাথে মেলামেশা করা ভালো উষশী। একজনের উপর নির্ভর হলে চলবে?”
উষশী বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিল। তাদের দুজনের শরীর থেকেই মন ভালো করা সুবাস আসছে। একটা সুন্দর সময় যাচ্ছে তাদের।
লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজর ঘুরিয়ে নিল। কথায় আছে মানুষ যা দেখতে চায় না তাই বার বার দেখতে হয়। এমনটাই হচ্ছে তার সাথে। বারং বার ওদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত গুলো চোখে পড়ছে। এটা একটা বিশেষ যন্ত্রণার কিংবা আক্ষেপের। হুট করেই মনে হলো এভাবে অভি’র বুকে মাথা রাখার কথা বহুবার ভেবেছে সে। অথচ এত দিনেও সেটা খেয়াল হয় নি। উষশী’র সাথে অভিরাজের অন্তরঙ্গতা দেখলেই নিজের কল্পনা গুলোর স্মরণ ঘটে। মনে হয় এসব তার বহু দিনের ভাবনা। অথচ সে বুঝতে পারে নি। আর বুঝতে পারে নি বিধায় অভিরাজ তার থেকে এত দূরে। একটা যন্ত্রণা ওকে শেষ করে দিচ্ছে। গলার কাছটা তরল শূন্য হয়ে পড়েছে। চট জলদি পানি পান করল সে। তবু তৃষ্ণা মিটছে না। খানিক বাদে ঘরে এসে শুয়ে রইল। লতিফা আয়না নেওয়ার জন্য মেয়ের ঘরে এসেছিলেন। তখন দেখলেন প্রাণহীনের মতো দেখাচ্ছে তার ছোট্ট মেয়েটিকে। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। মাথায় হাত বুলালেন ক্রমাগত। তার ঠান্ডা শীতল কণ্ঠের মাঝেও কেমন ভীরুতা।
“কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে?”
“জানি না মা। আমার কিছু ভালো লাগছে না। সবটা কেমন অশান্তি’র মনে হচ্ছে।”
“ছোঁয়া চলে যাচ্ছে দেখে এমন লাগছে। কত আদরে বড়ো করেছিস।”
“হয়ত মা।”
“কিছু খাবি?”
“না। একটু বসবে মা? আমি তোমার কোলে মাথা রাখব।”
লাবণ্য মায়ের কোলে মাথা এলিয়ে দিল। মেয়ের এই ভাঙনের কারণ লতিফা ঠিক ঠাক বুঝতে পারছেন না। তবে এতটুকু উপলব্ধি করলেন কারণটা মোটেও ফেলনা নয়।
বউ সাজে ছোঁয়াকে কি অপূর্বই না দেখাচ্ছে। তাকে আড়চোখে দেখে চলে যাচ্ছিল ঈশান। তখুনি ডেকে উঠল ছোঁয়া। লেহেঙ্গার দু পাশ ধরে কাছে এল।
“আজও বকা দিবে আমায়?”
“বকব কেন?”
“তুমি তো সবসময়ই বকা দাও।”
“এখন থেকে আর দিব না।”
“সবাই দেখা করেছে। তুমি একটিবার ও কেন এলে না? আমি বুঝি এতই পর?”
মৃদু হাসল ঈশান। মেয়েটার মাথায় স্পর্শ করতে গিয়েও করল না।
“সাবধানে থাকবি। আমি যাই রে। বন্ধুরা সব অপেক্ষা করছে।”
এইটুকুই কথা হলো ওদের। ছোঁয়া’র মন খারাপ হয়ে গেল। ঈশান সর্বদা তাকে রাগালেও তাদের সম্পর্কের কোথাও একটা সৌন্দর্য ছিল। সেটা মনে হতেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর।
ঈশানের সঙ্গে কেউ একজন চলছে। ছায়াটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। সেটা বুঝতে পেরেও তাকাল না সে। আগের গতিতেই পথ চলতে লাগল। কোনো রকম সাড়া না পেয়ে উষশী নিজ থেকেই বলল,”কোথায় যাচ্ছ?”
“বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।”
“এখন আড্ডা দেওয়ার সময়? আরেকটু বাদেই তো ছোঁয়াপু’র বিয়ে পড়ানো হবে।”
আনমনেই কথাটা বলে ফেলল উষশী। তারপর খেয়াল হতেই বলল,”যা চলে যায় তাকে কি ধরে রাখা যায় ঈশান?”
“রাখা যায় না।”
“তাহলে এমন ভেঙে যাচ্ছ কেন?”
“ভাঙি নি তো।”
“ফের মিথ্যে বলার প্রয়াস। লাইফটা এতটা ঠুনকো নয়। যা হবার নয় তা কেবল ধু ধু মরীচিকা।”
“তবু সেই মরীচিকাই কেন টানে বলতে পারো?”
“মানুষ আমরা। বস্তু নই। চোখের সামনে যা দেখি তাই রঙিন মনে হয়। ভ্রম জিনিসটা চট করেই ধরতে পারি না। অথচ একটা সময় ঠিকই বুঝে যাই যার পেছনে ছুটে যাই তা কল্প ব্যতীত কিছুই নয়।”
“ঠিক এই কারণেই নিজের উপর রাগ হচ্ছে। অর্নথক কষ্ট এসে চেপে ধরেছে। যার কোনো মানে হয় না।”
এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল ঈশান। উষশী গেটের কাছে এসে থেমে গেল। তার দুটি চোখ জলে পরিপূর্ণ। এতটা কষ্ট আগে অনুভব হয় নি। বিচ্ছেদ বুঝি এতই যন্ত্রণার?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২২)
“কি ব্যপার! ঘুমাও নি কেন?”
“ঘুম আসছিল না।”
“কেন? ঘুমের আবার কি হলো?”
“রাগ হয়েছে।”
“তা রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলে না?”
“না। রাগ ভাঙাতে গেলে সে বলবে ঢং করতে এসেছি।”
“মাঝে মাঝে ছোট খাটো ঢং মন্দ নয়।”
বাক্যটি শুনতে পেয়েই উঠে এল উষশী। সঙ্গে সঙ্গে অভিরাজের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,”এত নিষ্ঠুর কেন আপনি?”
“নিষ্ঠুর কেমন করে হলাম?”
“বললাম ঘুম আসছে না। তাও কাছে টেনে আদর করলেন না।”
“সবসময় আদর করা যায় না বাবা। একটা সীমাবদ্ধতা থাকে।”
“না,না আমার জন্য কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আমি অভিরাজের,আর অভিরাজ আমার। এর বাইরে আর কোনো সত্য নেই।”
মেয়েটির এই কথায় হেসে ফেলল অভিরাজ। ধীরে ধীরে বাদামি রঙা চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে শুধাল,”বিয়ে করতে হবে না?”
“হবে। চলেন এখনি বিয়ে করে ফেলি।”
বাচ্চাদের মতো আচরণ হয়ে এল কিশোরীর। অভিরাজ একটু শক্ত গুমোট করল মুখশ্রী।
“সবে পনের বছর বয়স তোমার। আঠারো হওয়ার জন্য আরো দুই আড়াই বছর সময় লাগবে। কোনো ভুল নয় রেইন।”
মন খারাপ করে ফেলল মেয়েটি। অভি ওকে টেনে পাশে বসাল। মন ভালো করার প্রয়াসে গালে গাল স্পর্শ করাল।
“এই তো আদর করে দিলাম। এবার ঘুমিয়ে পড়।”
উষশী ঘুমিয়ে পড়ল। তবে অভিরাজের হাতটা শক্ত করে চেপে রাখল। ওর কান্ডে না হেসে পারল না অভিরাজ। তার গলাটা এক অন্যরকম অনুভূতিতে শুকিয়ে এসেছে। এত কাছে এসেও পারছে না সর্বোচ্চ ভালোবাসায় সিক্ত হতে। প্রতিটা প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার হৃদয়ের গলিতেই সুপ্ত বাসনা লুকিয়ে থাকে। শুধু সঠিক সময় আর পরিস্থিতির কারণে ব্যক্ত হয় না। আর যারা সীমাবদ্ধতা ধরে রাখতে পারে তাদের প্রেমই হয় শুদ্ধ।
ছোঁয়া’র বিদায় হয়ে গেছে অনেকটা সময়। বাড়ির আনাচে কানাচে লোকজন। লাবণ্য’র বান্ধবী’রাও এসেছে। সেই জন্যেই অভিরাজের রুমে ঘুমিয়েছে উষশী। মেয়েটা একটু অন্যরকম। সবার সাথে সহজে মিশতে পারে না। উষশী’র ঘুম গভীর হতেই উঠে এল অভিরাজ। দরজা লক করে বেরিয়ে পড়ল ট্রেরেসের উদ্দেশ্যে। সেখানে আজ ঈশানের আধিপত্য। ছেলেটা বার বার করে বলে দিয়েছে কেউ যেন এখানে না আসে। তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সবাই। তবে অভিরাজ সর্বদাই বিপরীত। সে এল। তার সঙ্গ পেয়ে ঈশানের মোটেও খারাপ লাগল না। সে যত্ন নিয়ে গ্লাস সাজাচ্ছে। অন্য সব প্রেমিকদের মতো মদ খেয়ে সিগারে বুক পুড়িয়ে নিজের কষ্ট জানান দিচ্ছে না ঈশান। সে নীরবে বুকের ভেতর কষ্ট পুষে রাখছে। তার এই অস্বচ্ছ ব্যথাটা অভিরাজের চোখে পড়েছে। সে গ্লাসে সফট ড্রিঙ্কস ঢেলে নিয়ে বলল,”ছোঁয়াকে পছন্দ করিস সেটা আগে কেন বলিস নি?”
এ প্রশ্নের জবাব মিলল না। অভিরাজ আরো একটা গ্লাসে সফট ড্রিঙ্কস নিয়ে নিল। ছোঁয়ার বিয়ে কিছু সময় পূর্বে এই সব তাকে জানিয়েছে উষশী। কিন্তু তখন কিছু করার ছিল না। অবশ্য আগে জানালেই বা কি হতো?
আকাশের চাঁদ থালার মত বিশাল। সম্ভবত পূর্ণিমা আজ। ছোঁয়া’র সংসারকে মন প্রাণ ভরে দোয়া করছে স্বয়ং চাঁদ ও। আর এদিকে হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে ঈশানের বুক। সে বড়ো অতৃপ্ত, কাঠ হয়ে যাওয়া কণ্ঠে বিদ্রুপ মাখা হাসিতে হেসে উঠল।
“চাঁদ ও আমায় অবহেলা করে।”
ঈশান এক নয়নে আকাশের পানে তাকিয়ে রইল। চাঁদ কে ঘিরে আছে হাজার হাজার ছোট ছোট আলো। যা তারা নামেই পরিচিত। চাঁদের অহংকার ঈশানকে তেতিয়ে দিল। তার মুখ থেকে হিস হিস শব্দ বেরিয়ে পড়ল।
“সবাই হারামি। কেউ স্বার্থহীন না। সবাই স্বার্থপর।”
মাতাল না হয়েও মাতলামি শুরু হলো ঈশানের। এই সময়টা অভি চুপ করে রইল। তার চিত্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরোচ্ছে কেবল। একটা ব্যথা তর তর করে পা থেকে উঠে গিয়ে মস্তিষ্ক অবধি অবশ করে নিচ্ছে। ভাইকে সান্ত্বনা দেবার মতো শব্দ নেই তার বিশাল শব্দভান্ডারে।
এত কিছুর মাঝে সাতটা দিন পেরিয়ে গেছে। নানান ঝামেলা কিংবা স্ব ইচ্ছেতেই উষশী’র বাড়ির লোকের খোঁজ বন্ধ ছিল। বিমানবন্দর থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে উষশী’র মা সাব্রিয়া পল স্লোভেনিয়ায় ফিরে যান নি। এ কথাটা উষশীকে জানানো হলো। মেয়েটি বেশ মনমড়া হয়ে গেল। অভি’র ও ভালো লাগছিল না। তার উচিৎ ছিল আরো আগে থেকে জোর দেওয়া। সেদিনই উষশীদের লোকাল গার্জেনের বাড়িতে যাওয়া হলো। সেখানে গিয়েও হতাশ হতে হলো। কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না। এত হতাশার মাঝে উষশী যেন ভেঙে পড়ছিল। এদিকে ঈশানের অবস্থাও খারাপ হচ্ছিল। মাঝে ঠিক হলো গ্রামের বাড়িতে যাবে। সেখানে অভিরাজের চাচাতো দাদা দাদি রয়েছেন। ওনারাই ওদের বংশের সব থেকে বয়স্ক সদস্য। বেশ কিছু বছর ধরে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হচ্ছিল না। ছোঁয়া’র বিয়েতে এসে খুব করে বলে গেছেন। সকলের হাতে কিছু সময় থাকাতে এবার যাওয়াটা নিশ্চিত হয়ে গেল। উষশী কখনো গ্রামে যায় নি। তার উত্তেজনা বেশ। অভি’র রুমের কাছে ঘুরঘুর করছিল। তবে লাবণ্য’র সাথে কি যেন কথা বলছে। তাই সে আর এল না। ইরার রুমে এসে বসে রইল। গোসল শেষে উষশীকে দেখে বলল ইরা।
“আরে, তুমি কখন এলে?”
“একটু আগেই এসেছি।”
“ভালো করেছ। এমনিতে তো আসোই না।”
“ইরাপু গ্রাম কেমন হয়?”
“গ্রাম দেখো নি কখনো?”
“না।”
“গেলেই দেখতে পারবা। আগে বলে দিলে তো স্পয়লার হয়ে যাবে।”
ইরা চুল মুছে নিয়ে উষশী’র পাশে বসল। তাদের মাঝে কিছু সময় আলাপ হলো। এর মাঝেই ফোন এল ইরার। মেয়েটি ব্যস্ত হতেই বেরিয়ে পড়ল উষশী। অভিরাজের ঘর ফাঁকা। মন খারাপ নেমে এল কিশোরীর। যে চলে যেতে নিলেই পেছন থেকে আগলে নিল শক্ত পোক্ত হাতটা।
“সকাল থেকে দেখা নাই। ঘরেও পাচ্ছি না। সারাক্ষণ কোথায় থাকেন আপনি?”
“এসেছিলাম তো।”
“কখন?”
“একটু আগেই। যখন লাবণ্যপুর সাথে কথা বলছিলেন।”
“ভেতরে আসো নি কেন?”
“এমনি।”
“ঠিক আছে। বসো একটু।”
উষশী বসল না। সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। এর মাঝেই কিছু জিনিস পত্র গুছিয়ে ফেলল অভিরাজ। একটু পর পর মেয়েটিকে দেখে চলেছে। মেয়েটির সুন্দর মুখশ্রীতে আজ একটু বেশিই খুশি দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেঘ সরিয়ে সূর্য উঠেছে।
ক্লোজেট থেকে এক গাদা শপিং ব্যাগ বের করল অভিরাজ। সব গুলো খুলে দেখছে উষশী। এখানে অনেক রকমারি জামা কাপড়। তবে এ ধরণের জামা পরে না সে।
“গ্রামে গিয়ে এসব পরবে।”
“আগের জামা গুলো?”
“ওগুলো গ্রামে পরার দরকার নেই।”
“কেন নেই?”
“অন্য চোখে দেখবে মানুষ। শহরে যতটা সহজে শর্ট ড্রেপআপ মেনে নেওয়া হয় গ্রামে ততটাই আলোচনা হয়। এটা আসলে একেক জায়গায় একেক কালচার।”
“ঠিক আছে।”
উষশী দেখল এক পাশে আরো কিছু ব্যাগ। সেগুলো ও খুলল সে। এগুলো অভিরাজের জামা কাপড়। সব গুলো টি শার্ট দেখল সে। অভি ফোন হাতে নিয়ে বসেছে। হুট করেই মেয়েটি একটা টি শার্ট পরে ফেলল। তারপর অভিরাজের সামনে এসে দাঁড়াল। সব দিক দিয়েই ভীষণ ঢিলেঢালা হয়েছে। তাকে দেখতে এলিয়েন লাগছে।
“ভালো লাগছে না?”
“এলিয়েনের মতো দেখাচ্ছে।”
“পঁচা মানুষ।”
“রাগ করলে?”
“হুম। রাগ ভাঙান এবার।”
“কিভাবে ভাঙাব?”
“এভাবে।” বলেই গালে চুমু খেল উষশী। এত দ্রুত ঘটে গেল বিষয়টা অভি বুঝতে পারল না। হেসে উঠল সে। উষশী একে একে সব গুলো টি শার্ট পরে দেখাল। অভি’র ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। সে মেয়েটিকে শক্ত হাতে আলিঙ্গন করল। একদম বুকের সাথে মিশিয়ে বলল,”এখন তো আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে রেইন।”
“কেন,কেন?”
“এই যে টি শার্ট গুলো থেকে তোমার শরীরের মিষ্টি সুবাস আসবে। আমি তো এখনি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
মুখ টিপে হাসল উষশী। অভিরাজের বুকে থেকেই তার মসৃণ গালে হাত বুলাতে লাগল। ছেলেটার গলার কাছটা ভীষণ সুন্দর। চোখ লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। অভিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল সে। একটা সময় পর বলল,
“এত সুন্দর কেন আপনি?”
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি