বুকভরা ভালোবাসা পর্ব-১২

0
699

#বুকভরা ভালোবাসা
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃদিশা মনি

ভেতর থেকে মুগ্ধর প্রাণহীন দেহটা বাইরে নিয়ে আসা হয়। মুগ্ধর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আশা। তার মনে পড়ে যায় মুগ্ধ তাকে কথা দিয়েছিল, কিছুতেই সে মুগ্ধকে পাবে না। মুগ্ধ সেই কথা রেখেছে। নিজেকে আর আটকাতে পারে না আশা। ডুকরে কেদে ওঠে। স্নিগ্ধর অবস্থাও ভালো না। নিজের ভাইকে যে খুব ভালোবাসত সে। ভাইয়ের এই অকালমৃত্যু তাই কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বারবার তার নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। যদি সে মুগ্ধকে আটকিয়ে নিজে ভেতরে যেত মেহুলকে উদ্ধার করতে। তাহলে হয়তো এসব কিছুই হতো না। মুগ্ধর মা-বাবাও খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। ফরিদা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। কোন মা-ই বা তার ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারে? স্নিগ্ধ আর তার বাবা অনেক চেষ্টা করেও ফরিদাকে সামলাতে পারছে না।

২৩.
হাসপাতালের বেডে ঘুমিয়ে ছিল মেহুল। এখনো তার জ্ঞান ফেরেনি। মনির আর মেহেজাবিন হাসপাতালে এসে বসে আসে। ইতিও এসেছে মেহুলকে দেখার জন্য।

মেহুলের জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই সে ‘মুগ্ধ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মেহেজাবিন ভেতরে গিয়ে বলে,
‘শান্ত হ মেহুল।’

মেহুলঃমম, মুগ্ধ কোথায়? কেমন আছে ও? আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জিবনের রিস্ক কেন নিতে গেলো? ও ঠিক আছে তো?

মনির চৌধুরী বলেন,
‘তুমি আগে শান্ত হও মেহুল। তোমার রেস্টের প্রয়োজন।’

মেহুলঃআগে বলো মুগ্ধ কেমন আছে।

মনিরঃমুগ্ধ মারা গেছে।

মুগ্ধর মৃত্যুর খবরটা শুনে মেহুলের অবস্থা পাগলপ্রায় হয়ে যায়। সে সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করে। মেহুল চিৎকার করে বলতে থাকে,
‘সব আমার দো’ষ। আমাকে বাঁচানোর জন্যই মুগ্ধ এভাবে প্রাণ দিল। আর আমি মুগ্ধকে কত কষ্ট দিয়েছি, ওর ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করেছি।’

মেহুলের কথা শুনে মেহেজাবিন হতবাক চাহনিতে বলে,
‘এসব তুই কি বলছিস? তোর সাথে তো স্নিগ্ধর সম্পর্ক ছিল। মুগ্ধও কি তোকে ভালোবাসত?’

মনিরঃএখন এসব কথা বলার সময় নেই। আমাকে আগে নিজেদের মেয়েটাকে সামলাতে হবে।

মেহুলঃআমি তোমাদের কারো সাথে কথা বলতে চাইনা। আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। তোমরা চলে যাও এখান থেকে। আমাকে একা থাকতে দাও। আমি একা থাকতে চাই।

মেহেজাবিনঃমেহুল নিজেকে সামলাও।

মনিরঃমেহুল যা বলছে তাই আমাদের করা উচিৎ। তোমরা বাইরে এসো।

ইতিঃআপনারা যান আঙ্কেল আমার মেহুলের সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।

মনির আর মেহেজাবিন বাইরে চলে যায়। ইতি মেহুলকে জিজ্ঞেস করে,
‘যখন আ’গুন লাগল তখন সবাই তো বাইরে বের হয়ে গেছিল। তাহলে তুই ভেতরে কি করছিলি?’

মেহুল তখন ইতিকে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে ইতি রাগান্বিত হয়ে বলে,
‘আমি তোকে আগেই বলেছিলাম মোহনাকে এত বিশ্বাস করিস না। আজ দেখলি তো মোহনার জন্য তোর কত বড় ক্ষতি হলো। আমার তো মনে হয় এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও মোহনার হাত আছে।’

মেহুলঃআমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। আমার এখনো মুগ্ধর বলা শেষ কথাটা মনে পড়ছে। মুগ্ধ মৃত্যুর আগে আমায় জিজ্ঞেস করেছিল যে আমি কি ওকে একটুও ভালোবাসিনি? আমি ওকে উত্তরটুকুও দিতে পারিনি। হ্যা আমি পছন্দ করতাম মুগ্ধকে। স্নিগ্ধর সাথে রিলেশনে যাওয়ার আগে আমি মুগ্ধকেই পছন্দ করতাম। যদি কথাটা বলতে পারতাম তাহলে হয়তো ছেলেটা একটু হলেও শান্তি পেতো। জানিনা কত কষ্ট পেয়ে মুগ্ধ মারা গেছে। সব আমার দোষ সব। আমাকে বাচানোর জন্য মুগ্ধ,,,,,,

মেহুল ডুকরে কাদতে থাকে। তাকে এভাবে কাদতে দেখে ইতিরও খারাপ লাগে।

মুগ্ধর বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। ফরিদা এখনো পুত্রশোক কাটিয়ে উঠতে পারে নি। স্নিগ্ধর বাবার অবস্থাও বেশি ভালো না। স্নিগ্ধ নিজেও তো খুব কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সব কষ্ট উপেক্ষা করে তাকে শক্ত থাকতে হচ্ছে। তার উপর যে এখন অনেক দায়িত্ব। নিজের বাবা-মাকে সামলাতে হবে। ভাইয়ের চিরবিদায়ের ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে। এসবের মধ্যে মেহুলের কথাও তাকে ভাবতে হচ্ছে। ইতির কাছে কল দিয়ে মেহুলের খোঁজ খবর নেয় স্নিগ্ধ।

২৪.
আশার অবস্থাও ভালো না। মুগ্ধর মৃত্যুতে সে সম্পূর্ণ ট্রোমায় চলে গেছে। আশার বাবা নিজের একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা দেখে একেবারে ভেঙে পড়েছেন।

আশা তার আব্বুর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তুমি না বলেছিলে আব্বু। আমার সাথে মুগ্ধর মিল করিয়ে দেবে। নিজের কথা রাখবে না তুমি আব্বু? মে’রে ফেলো আমায়। আমি যে আর পারছি না। আমাকেও মুগ্ধর কাছে পাঠিয়ে দাও। পাঠিয়ে দাও।’

মেয়ের পাগলামিতে আশার বাবা কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। ছোট থেকে নিজের মেয়ের সব ইচ্ছা তিনি পূরণ করেছেন। কিন্তু আজ চাইলেও যে এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারবেন না। এই ইচ্ছা পূরণ করার কোন সামর্থ্য যে তার নেই। তিনি শুধু আশাকে শান্তনা দিতে থাকেন।

আশা পাগলামি করতে করতে ছুটে মুগ্ধর বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় পা পিছলে সিড়ি থেকে পড়ে যায় আশা। সিড়ি থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় সে। নিচে পড়ে মুগ্ধর কথা ভেবে মুচকি হেসে আশা বলে,
‘আপনি নিজের কথা রাখতে পারেন আর আমি পারবোনা মুগ্ধ ভাইয়া? আমিও যাচ্ছি পৃথিবীতে যেমন আপনার পিছু করেছি এখন মৃত্যুর পরেও আপনার পিছু করবো। আপনার পিছু আমি ছাড়ছি না।’

কথাটা বলার সাথে সাথে আশা নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আশার বাবা ছুটে এসে নিজের মেয়ের এই অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি গাড়িতে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু ডাক্তার আশাকে মৃত ঘোষণা করেন। যেই মেয়েকে ছোটবেলা থেকে এত আগলে মানুষ করেছেন সেই মেয়ের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে যান আশার বাবা। এতদিন টাকা আর ক্ষমতার পেছনে কত ছুটেছেন। অথচ আজ তার সব টাকা, সব ক্ষমতা বিলিয়ে দিলেও নিজের মেয়েকে আর ফিরে পাবেন না। মেয়ের লাশ ধরে ডুকরে কেদে ওঠেন আশার বাবা। চিৎকার করে বলতে থাকেন,
‘আল্লাহ আমি তোমার কাছে না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে গেছি। আজ প্রথমবার একটা জিনিস চাচ্ছি। আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমার যে আর আপন বলতে কেউ নেই। আমার সব সম্পত্তি সব ক্ষমতা তুমি কেড়ে নাও। প্রয়োজনে আমাকেও তুমি নিয়ে নাও,,,কিন্তু আমার মেয়েটাকে বাচিয়ে দাও আল্লাহ,,,আমার মেয়েটাকে বাচিয়ে দাও।’

মুগ্ধর মনে আশার জন্য কোন যায়গা না থাকলেও আশার বুকজুড়ে শুধু মুগ্ধই ছিল। মুগ্ধর প্রতি আশার ছিল বুকভরা ভালোবাসা। তাইতো এত অপমান, এত অবহেলা-অবজ্ঞা স্বত্বেও সে ছুটে গেছে মুগ্ধর পেছনে। এই বুকভরা ভালোবাসাকে হারানোর ক্ষমতা মৃত্যুরও নেই। তাইতো মৃত্যুও আজ আশার ভালোবাসার কাছে হেরে যেতে বাধ্য হলো। বরাবরের মতো এবারও আশা মুগ্ধর পিছু নিল। মুগ্ধকে অনুসরণ করা যে তার অনেক পুরাতন স্বভাব। মুগ্ধ তো প্রায়ই আশাকে বলতো,
‘তুমি কবে আমার পিছু ছাড়বে?’

আশা তখন হেসে বলত,
‘মৃত্যুর পরেও আপনার পিছু ছাড়ব না মুগ্ধ ভাইয়া।’

আশা নিজের কথা রেখেছে। সে মুগ্ধর পিছু ছাড়েনি। মুগ্ধর পর সেও বিদায় নিল এই কষ্টে ভরা পৃথিবী থেকে। এই পৃথিবী যে বড়ই নিষ্ঠুর। তার থেকেও বেশি নিকৃষ্ট এই পৃথিবীর পশুর থেকেও নিকৃ’ষ্ট কিছু জীব। মোহনা তাদেরই একজন।

মোহনার জন্য যে এত কিছু হয়ে গেল তাতে তার কোন ভাবান্তর নেই। মোহনা নিজের মতো ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। সে জানে এখানে থাকলে তার বিপদ অনিবার্য। তাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেওয়া খুবই দরকার। মোহনা তার মাকে বলে,
‘মা তাড়াতাড়ি চলো। আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।’

মোহনার মা বলে,
‘কি বলছিস এসব তুই? কোথায় যাবো আমরা?’

মোহনা রাগ দেখিয়ে বলে,
‘যেতে বলেছি যখন চলো।’

মোহনা তার মাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। তখন ইতি এসে তার গেট আটকে বলে,
‘কোথায় যাচ্ছিস ডা’ইনি? সবাইকে কষ্ট দিয়ে তুই সুখে থাকবি সেটা হবে না। তোকেও এবার শাস্তি পেতে হবে।’
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে