#বুকভরা ভালোবাসা
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃদিশা মনি
মেহুল বেরিয়ে এসে মুগ্ধকে ধন্যবাদ জানায় তাকে আজ এভাবে সাহায্য করার জন্য। বিনিময়ে মুগ্ধ বাকা হেসে বলে,
‘আমি চিরকাল তোমার বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও তোমাকে রক্ষা করতে চাই মেহুল। আমি যে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।’
শেষের কথাটা মুগ্ধ আনমনেই বলে ফেলে। মেহুল বিব্রতবোধ করে সেখান থেকে চলে যায়।
২১.
আশা ডিশিসন নিয়েছে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আশার বাবা তার এই সিদ্ধান্তের কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। তিনি আশাকে জিজ্ঞেস করেন,
‘কেন তুই এই দেশ ছেটে যাবি? কি সমস্যা তোর বল আমায়।’
আশা তখন কাদতে কাদতে সব ঘটনা তার বাবাকে খুলে বলে। আশার বাবা আশাকে কথা দেয়,
‘মুগ্ধর সাথেই তোর বিয়ে দেব। এটা তোর বাবার ওয়াদা।’
আশা খুশিমনে ভার্সিটিতে আসে। ভার্সিটিতে ঢুকেই মুগ্ধকে দেখতে পায়। মুগ্ধ আশাকে ইগনোর করে চলে যাচ্ছিল। তখন আশা পিছন থেকে বলে,
‘আমায় আর ইগনোর করতে পারবে না মুগ্ধ ভাইয়া। তোমাকে আমার হতেই হবে।’
মুগ্ধ তা’চ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
‘তুমি কোনদিনও আমাকে পাবেনা আশা। আমি তোমায় কথা দিলাম।’
আশা মুখ বাকিয়ে বলে,
‘দেখা যাবে।’
মুগ্ধ আর না দাড়িয়ে চলে আসে। আশায় তার ক্লাসের দিকে যায়। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে মুগ্ধ দেখে স্নিগ্ধ আর মেহুল একসাথে বসে গল্প করছে। তাদের এভাবে একসাথে দেখে মুগ্ধর বুকে যেন আ’গুন জ্ব’লছিল। মুগ্ধ আল্লাহর কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করে বলে,
‘আমার যেন মৃত্যু হয়। আমি যে ওদেরকে একসাথে এভাবে মেনে নিতে পারছি না। নিজের ভাইয়াকেও আমি কষ্টে দেখতে চাইনা। মেহুলকেই সুখী দেখতে চাই। কিন্তু বুকভরা ভালোবাসার কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকাও যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
স্নিগ্ধ মেহুলকে বলে,
‘পরশু তো আমাদের এনগেজমেন্ট। কাল চলো আমরা গিয়ে ডেকোরেশন দেখে আসি। আমাদের একটা ফার্ম হাউজে তো ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
মেহুল বলে,
‘আইডিয়াটা তো খারাপ না। আমি নাহয় ইতিকেও সাথে নেব।’
স্নিগ্ধঃতাহলে আমিও মুগ্ধকে সাথে নিয়ে যাবো।
মুগ্ধর কথা শুনে মেহুলের কিছুটা অস্বস্তি হলেও সে নিজেকে সামলে নেয়।
পরের দিন,
মেহুল সকাল সকাল রেডি হচ্ছিল কারণ আজ সে ডেকোরেশন দেখতে যাবে। আচমকা মোহনা তার সামনে এসে বলে,
‘আমাকে ক্ষ’মা করে দাও মেহুল। আমি আমার করা অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত। আমাকে তো ভার্সিটি থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে। আমার তো ফিউচার শেষ। তুমি অন্তত আমায় ক্ষমা করো।’
মোহনার উপর মেহুলের মায়া হয়। মেহুল বলে,
‘তুমি কিছু মনে করোনা। আমি কথা বলে দেখব যেন কোনভাবে তোমাকে আবার ভার্সিটিতে ফিরিয়ে নেওয়া যায়। আমি তোমার ভালো চাই। তোমার উপর মামনীর কত ভরসা, তুমিই তো তার শেষ আশা।’
মোহনা মেহুলকে ধন্যবাদ জানায়। তারপর সে মেহুলকে বলে,
‘চলো আমার সাথে।’
মোহনাও রাজি হয়ে যায়। এরপর মেহুল ইতিকেও ফোন করে ডাকে। ইতি তো মোহনাকে দেখে খুব রেগে যায়। কিন্তু মেহুল তাকে অনেক বোঝায়। তাই ইতিও আর কিছু করতে পারে না।
তারা সবাই স্নিগ্ধদের ফার্ম হাউজে চলে যায়। স্নিগ্ধ আর মুগ্ধর সাথে আশাকে দেখে মেহুল অবাক হয়।
আশা এগিয়ে এসে বলে,
‘আমার খুব ইচ্ছা ছিল এখানে আসার। মুগ্ধ ভাইয়া তো নিয়ে আসতেই চায়নি। তারপর স্নিগ্ধ ভাইয়াকে বলাতে উনি আমায় নিয়ে এলেন।’
মেহুলঃখুব ভালো করেছ এসে। চলো আমরা ভেতরে ডেকোরেশন দেখতে যাই।
সবাই যখন ডেকোরেশন দেখতে ব্যস্ত ছিল সেই ফাকে মোহনা স্নিগ্ধকে বলে,
‘ভাইয়া চলুন। আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
স্নিগ্ধ মোহনার কথা শোনার জন্য ভেতরে যায়। তখন মোহনা স্নিগ্ধকে একটা ভিডিও দেখায়। ভিডিওটাতে ইতি আর মেহুলের কথোপকথন ছিল। যেখানে মেহুল ইতিকে বলছিল,
‘আমি তো মুগ্ধকে ভালোবাসতাম। তাই ওর কাছাকাছি যাওয়ার জন্য স্নিগ্ধ ভাইয়ার সাথে প্রেমের অভিনয় করি।’
ভিডিওটা দেখে স্নিগ্ধ খুব রেগে যায়। তারপর রাগে ছুটে যায় বাইরে। এদিকে মোহনা শয়’তানী হাসি হেসে বলে,
‘বলেছিলাম না আমি কাউকে ছাড়বো না। এবার তুই বুঝবি মেহুল কত ধানে কত চাল। তোর জন্য আমি ভার্সিটি থেকে বের হয়েছি। এবার তুই বোঝ ঠে’লা। ভাগ্য ভালো সেদিন তোদের কথোপকথন শুনেছিলাম আর ভিডিও করেছিলাম। তারপর ভিডিও এডিট করে এই কথাটাই শুধু রাখলাম।’
ভিডিওটা দেখে স্নিগ্ধর মাথা গরম হয়ে যায়। সে মেহুলকে টেনে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বলে,
‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম আর তুমি এভাবে আমায় ঠকালে।’
মেহুলঃকি বলছ তুমি এসব স্নিগ্ধ?
স্নিগ্ধঃতুমি আসলে মুগ্ধকে ভালোবাসো আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করছিলস তাইনা?
মেহুলঃতুমি ভুল বুঝছ স্নিগ্ধ। এটা ঠিক আমার প্রথমে মুগ্ধকে ভালো লাগত আর তোমার সাথে অভিনয় করেছিলাম কিন্তু এখন আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
স্নিগ্ধঃতুমি ঠিক বলছ?
মেহুলঃহুম।
স্নিগ্ধঃএমনটা হলেই খুশি হবো।
কথাটা বলে স্নিগ্ধ বেরিয়ে যায় আর মেহুল দাড়িয়ে ভাবতে থাকে স্নিগ্ধ কিভাবে এসব জানল?
মেহুলের মোহনাকে সন্দেহ হয়। তাই সরাসরি মোহনার রুমে চলে যায়। মোহনাকে গিয়ে জেড়া করলে সে সব স্বীকার করে। মোহনা নিজের দোষ স্বীকার করে। মেহুল তখন মোহনার সাথে মা’রামা’রি শুরু করে। মোহনা মেহুলকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে মেহুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে।
২২.
আচমকা শর্ট শার্কিট থেকে স্নিগ্ধদের ফার্ম হাউজে আ’গুন লেগে যায়। সবাই নিরাপদে বাইরে চলে এলেও মেহুলের কোন খোঁজ পাওয়া যায়না।
স্নিগ্ধ সবাইকে জিজ্ঞেস করে,
‘মেহুল কোথায়?’
মোহনা সব জেনেই চুপ থাকে। আর মনে মনে ভাবে,
‘খুব ভালো হবে যদি ঐ মেহুল আজ এই আ’গুনেই পু’ড়ে মরে।’
মেহুলের কোন খোঁজ না পেয়ে স্নিগ্ধ বাড়ির ভেতরে যেতে চায়। তখন মুগ্ধ তাকে আটকিয়ে বলে,
‘তোর তো ধোয়াত সমস্যা হয় ভাইয়া। তুই থাক আমি যাচ্ছি। কোন টেনশন করিসনা আমি মেহুলকে নিয়ে চলে আসব।’
মোহনা আটকিয়ে বলে,
‘আ’গুন লেগেছে তো যাবে কিভাবে?’
মুগ্ধঃএখনো আ’গুন সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি তাছাড়া খুব শীঘ্রই ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা চলে আসবে। চিন্তার কারণ নেই আমি জলদি মেহুলকে নিয়ে বেরিয়ে আসব।
স্নিগ্ধঃসাবধানে যাস ভাই।
মুগ্ধ ভেতরে চলে যায়। এক এক করে সব রুমে মেহুলকে খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পায়না।
আ’গুনের তেজ ততক্ষণে অনেক বেড়ে গেছে। ধোয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়াই কষ্টসাধ্য। মুগ্ধ অনেক কষ্টে একটা রুমের দিকে যায়। দরজা বাইরে থেকে লক করা। ভেতর থেকে মেহুলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সে বাঁচার জন্য আকুতি করছিল।
মুগ্ধ লক খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে মেহুল রক্তমাখা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। মেহুলকে এভাবে দেখে মুগ্ধ বলে,
‘তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো?’
মেহুল অনেক কষ্টে বলে,
‘তাড়াতাড়ি আমাকে বাইরে নিয়ে চলো। এখানে থাকা বিপজ্জনক।’
মুগ্ধ আর দেরি না করে মেহুলকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। চারিদিকে আ’গুনের লেলিহান শিখা, তার উপর বি’ষাক্ত ধোয়ায় পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে গেছিল। মুগ্ধ অনেক কষ্টে মেহুলকে নিয়ে যাচ্ছিল। মেহুল বলে,
‘আমাকে রেখে যাও মুগ্ধ। আমাকে নিয়ে তুমি এভাবে যেতে পারবে না।’
ধোয়ায় মুগ্ধর টম একদম আটকে আসছিল, চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। অনেক কষ্টে আড়ষ্ট গলায় বলে,
‘আমি ভাইয়াকে কথা দিয়েছি তোমায় নিয়ে আসব। নিজের জীবনের বিনময়ে হলেও আজ আমি তোমায় বাঁচাব।’
মুগ্ধর কথা শুনে মেহুলের চোখে জল চলে আসে। মুগ্ধ মেহুলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। এরমধ্যে মেহুল বুঝতে পারে মুগ্ধর পিঠে আগুন লেগেছে। মুগ্ধ ক্ষীণ কন্ঠে বলে,
‘তুমি কি আমায় কখনো একটুও ভালোবাসো নি মেহুল? আমি যে তোমায় ভালো বেসেছিলাম, বুকভরে ভালোবেসেছিলাম তোমায়।’
মেহুল ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে। মুগ্ধ মেহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ভালো থেকো তুমি। ভাইয়ার সাথে সুখে সংসার করো। আল্লাহ যে এত তাড়াতাড়ি আমার ইচ্ছা পূরণ করবে ভাবতেও পারিনি।’
মুগ্ধ এভাবে আর কিছু পা এগিয়ে যায়। দরজার একদম কাছাকাছি চলে এসেছিল সে। বাইরে থেকে স্নিগ্ধদের দেখা যাচ্ছে। সামনে ভয়াবহ আগুন। আগুন ডিঙিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য মুগ্ধর নেই। তাই মেহুলকে ছু’ড়ে মা’রে দরজার দিকে। মেহুল নিরাপদে বাইরে পৌছাতে পারলেও মুগ্ধ আগুনে দগ্ধ হতে থাকে। চারিদিকে ভয়াবহ আগুন মুহুর্তেই মুগ্ধকে ঘিরে ফেলে। তবে নিজের এই মৃত্যুতে মুগ্ধর কোন কষ্ট নেই। সে যে তার ভালোবাসার মানুষকে রক্ষা করতে পেরেছে। এটাই তো বেশি। মুগ্ধ মৃত্যুর আগেও শুধু মেহুলের কথাই ভাবছিল। মেহুলের সাথে তার প্রথম দেখা, তারপর কত ঝগড়া, কত খুনশুটি। এসব স্মৃতি নিয়েই মুগ্ধ এই জগৎ ত্যাগ করে।
চলবে…