#বুকভরা ভালোবাসা
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা মনি
আশা আনমনে বলে দেয়,
‘আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি মুগ্ধ ভাইয়া। আপনিই আমার হিরো।’
আশার কথাটা আর কেউ না শুনলেও তার বাবা ঠিকই শুনে ফেলে। ছোটবেলা থেকেই নিজের মেয়ের সব ইচ্ছা পূরণ করেন আশার বাবা। তাই তিনি মনে মনে তার মেয়েকে কথা দেন তার এই ইচ্ছাটাও পূরণ করবে।
১১.
‘সিনিয়র তোমার ফোন নম্বরটা দেবে প্লিজ?’
মেহুলের অনুরোধটা শুনে স্নিগ্ধ মৃদু হেসে বলে,
‘আচ্ছা নাও।’
স্নিগ্ধ তার ফোন নম্বরটা মেহুলকে দিয়ে দেয়। মেহুলের খুশি আর দেখে কে? মেহুল খুশি মনেই ভার্সিটি থেকে বাড়িতে ফিরে আসে।
বাড়িতে ফিরে স্নিগ্ধর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছিল মেহুলের। তাই মনে সাহসের সঞ্চার করে স্নিগ্ধর নম্বরটা ডায়াল করে কল দেয়।
স্নিগ্ধ তখন গোসল করছিল। তার ফোনটা ডাইনিং টেবিলের উপর ছিল। মুগ্ধ ফোনের শব্দ পেয়ে ফোনটা রিসিভ ক।
ফোনটা রিসিভ করতেই মেহুলের গলা ভেসে আসে,
‘হাই সিনিয়র। কেমন আছো?’
মেহুলের গলাটা শুনে মুগ্ধ বিরক্ত হয়। তারপর কল কে’টে দিয়ে মেহুলকে ব্ল্যাক লিস্ট করে দেয়। তারপর কল ডিটেইলসও ডিলিট করে দেয়।
এমনটা করে পৈশা’চিক আনন্দ পায় মুগ্ধ। মেহুলের কথা ভেবে বলতে থাকে,
‘আমি নামক দেয়ালটা থাকলে তুমি কোনদিনও আমার ভাইয়ার কাছাকাছি আসতে পারবে না মেহু।’
মেহুল বারবার থেকে স্নিগ্ধর ফোনে কল করে যাচ্ছে কিন্তু স্নিগ্ধ ফোনটা রিসিভ করছে না। মেহুল ভাবে স্নিগ্ধর কোন বিপদ হলো নাতো? কথাটা মনে আসতেই মেহুল কোনকিছু না ভেবে বেড়িয়ে পড়ে।
নিজের কিছু বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করে অনেক কষ্টে স্নিগ্ধর ঠিকানা জোগাড় করে মেহুল।
হাপাতে হাপাতে স্নিগ্ধর বাড়িতে চলে যায় মেহুল। কলিং বেল বাজানোর কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ এসে দরজা খুলে দেয়। মেহুল ভেতরে ঢুকতে চাইলে মুগ্ধ তাকে ঢুকতে দেয়না। মেহুল অনুরোধ করে বলে,
‘স্নিগ্ধর মনে হয় কোন বিপদ হয়েছে। আমি কল করছিলাম একবার রিসিভ করে কে’টে দেয় তারপর থেকে আর ফোন ধরছে না। আমাকে প্লিজ একবার ভেতরে ঢুকতে দাও। আমি স্নিগ্ধকে একবার দেখেই চলে যাব।’
মুগ্ধ একরোখা। সে কিছুতেই মেহুলকে স্নিগ্ধর সাথে দেখা করতে দেবে না। তাই মেহুলের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
মেহুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে করেই হোক স্নিগ্ধর সাথে দেখা করবে। তাই সে এবার একটি জানালার কাছে যায়। তারপর একটি ইট তুলে নেয়। ইট দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মেহুল।
মুগ্ধ ডাইনিং টেবিলে বসে মনের সুখে লাঞ্চ করছিল। মেহুল মুগ্ধকে এভাবে দেখে খুব রাগ হয়। তাকে কষ্ট দিয়ে মুগ্ধ এভাবে শান্তিতে থাকবে সেটা তো সে দেখতে পারে না। তাই সোজা মুগ্ধর পেইন্টিং রুমে চলে যায় মেহুল।
মুগ্ধকে একবার তার বন্ধুদের সাথে গল্প করতে শুনেছিল যে তাদের ডাইনিং টেবিলের পাশেই পেইন্টিং রুম আছে। যেখানে বসে মুগ্ধ মাঝে মাঝে ছবি আঁকে।
রুমে ঢুকে কালো রং নিয়ে নিজের মুখে মেখে নেয় মেহুল। তারপর এই অবস্থাতেই মুগ্ধর সামনে চলে যায়। মুগ্ধ সবে মুরগীর রানটা খেতে যাচ্ছিল। মেহুলকে এভাবে দেখে ভয়ে চিৎকার করে দেয় মুগ্ধ।
মেহুল মুগ্ধকে আরো ভয় দেখানোর জন্য বলে,
‘আমাকে রান দে। আমি রান খেতে অনেক পছন্দ করি।’
মুগ্ধ ভয়ে এবার খাওয়া থেকে উঠে ভূত ভূত করে পালাতে থাকে।
মুগ্ধকে এভাবে শায়েস্তা করতে পেরে মেহুল শান্তি পায়। তখনই মুগ্ধর চিৎকার শুনে তার মা ফরিদা দেখানে চলে আসে।
মেহুলকে দেখে তিনিও ভয় পেয়ে যান। মেহুল এবার নিজেও ভয় পেয়ে যায় এবং দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়।
মেহুলকে এভাবে দৌড়াতে দেখে ফরিদা মনে করে সে কোন চোর। তাই তিনি চোর চোর বলে মেহুলের পেছনে দৌড়াতে থাকেন।
মেহুল দ্বিতীয় তলায় উঠে একটি রুমে ঢুকে পড়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। স্নিগ্ধ তখন সবেমাত্র গোসল করে তোয়ালে পড়ে বাথরুম থেকে বের হয়েছিল। মেহুলকে এভাবে দেখে সে খুব লজ্জা আর ভয় পায়। ভয়ে চিৎকার করতে যাবে তখনই মেহুল গিয়ে তার মুখ চেপে ধরে।
‘সিনিয়র এটা আমি।’
স্নিগ্ধঃমেহুল তুমি? এখানে কি করছ?
মেহুলঃসব বলছি আগে আমায় বাঁচান আপনার মা আমায় চোর ভেবে আমার পিছনে লেগে আছেন।
তখনই দরজা ধাক্কানোর শব্দ তাদের কানে আসে। ফরিদা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে,
‘স্নিগ্ধ দরজা খোল বাড়িতে চোর ঢুকেছে।’
মেহুল খুব ভয় পেয়ে যায়। স্নিগ্ধ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেহুলকে আলমারির ভেতরে ঢুকতে বলে। তারপর গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।
ফরিদা হাফাতে হাফাতে বলে,
‘তুই ঠিক আছিস তো? আমি একটা চোরকে এখনই এদিকে আসতে দেখালাম।’
স্নিগ্ধঃএসব তুমি কি বলছ আম্মু? চোর কোথা থেকে আসবে। আমার মনে হয় তোমার ভুল হয়েছে।
ফরিদাঃতাহলে মুগ্ধ চিৎকার করেছিল কেন?
স্নিগ্ধঃতুমি তো ওকে চেনোই। নিশ্চয়ই কোন মজা করছিল। তুমি যাও গিয়ে রেস্ট নাও।
ফরিদা খুবই সহজ সরল মানুষ। তাই নিজের মনের ভুল ভেবে তিনি নিজের রুমে চলে যান রেস্ট নিতে। ফরিদা যাওয়ার পর স্নিগ্ধ মেহুলকে বেরিয়ে আসতে বলে।
মেহুল স্নিগ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে দৌড়ে চলে যায়। স্নিগ্ধ কিছুই বুঝতে পারে না। মেহুল তার মুখটা পরিস্কার করে নিয়ে বেরিয়ে যেতে ধরে তখন মুগ্ধ তাকে দেখে নেয়।
মেহুলকে দেখে মুগ্ধ ভ্রু কুচকে বলে,
‘তুমি! তারমানে তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছিলে!’
মেহুল আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মুগ্ধ রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
১২.
মেহুলের কথা মনে পড়তেই মোহনার মাথায় রাগ উঠে যায়। এত চেষ্টা করেও মেয়েটার কোন ক্ষতি করতে পারছে না।
বাড়িতে এসে দেখে তার মা মেহুলের জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখছে। এতে মোহনার রাগ আরো বেড়ে যায়। সে তার মাকে বলে,
‘এসব কাজ করা বন্ধ করো। তোমার কি একটুও লজ্জা করেনা এরকম অন্যের কাজ করে। এর থেকে তো ভালো হতো জন্মের পর আমায় বিক্রি করে দিতে। তাহলে আমাকে আর একটা কাজের লোকের মেয়ের পরিচয়ে বাঁচতে হতোনা।’
কথাটা শুনে মোহনার মায়ের চোখে জল চলে আসে। এই মেয়ের জন্য তিনি কত কষ্ট করে গেছেন সারাজীবন। আর আজ সেই তাকে এভাবে বলছে।
মেহুল বাড়িতে এসে মোহনার সব কথা শুনতে পায়। তাই সে মোহনাকে কথা শুনিয়ে বলে,
‘মামনীর জীবনে সত্যি একটা লজ্জার কাজ করেছে। আর সেটা হলো তোমার মতো একটা মেয়েকে জন্ম দেওয়া।’
মোহনাঃতুমি একদম আমাদের মা-মেয়ের ব্যাপারে নাক গলাবে না।
মেহুলঃতুমি মামনীর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারো না। উনি কিন্তু তোমার মা হন। এত যে পড়ালেখার বড়াই করো। পড়ালেখা করে কি এসব শিখেছ।
‘মেহুল, কি বলছ এসব।’
মায়ের কন্ঠটা কানে আসতেই মেহুল পিছনে ফিরে তাকায়। মেহুলের মা মেহেজাবিন আজ অনেকদিন পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরল। মাকে দেখে মেহুল খুব আনন্দিত হয়।
মেহেজাবিনকে দেখে মোহনা নাটক করে কাদতে কাদতে বলে,
‘আমি কাজের লোকের মেয়ে জন্য মেহুল সবসময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আমাকে অনেক অপমান করে আন্টি।’
মেহেজাবিন রেগে গিয়ে বলে,
‘মেহুল এসব আমি কি শুনছি। এক্ষুনি ক্ষমা চাও মোহনার কাছে। আমরা কি তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি? আমরা তোমাকে শিখিয়েছি সব মানুষকে সমান চোখে দেখতে। আর তুমি,,,’
মোহনার মা কিছু বলতে যাবে তখন মোহনা গিয়ে তাকে থামিয়ে কানে কানে বলে,
‘যদি একটা কথাও বলো তাহলে কিন্তু আমি চিরকালের মতো তোমায় ছেড়ে চলে যাব।’
মোহনাকে হারানোর ভয়ে তার মাও কিছু বলেনা।
মেহুল নিজের মাকে বলে,
‘মম, তুমি আগে আমার কথাটা শোন। মোহনা,,,’
মেহেজাবিনঃআমি তোমার কোন কথা শুনতে চাইনা আমি নিজের কানে শুনেছি তুমি মোহনার শিক্ষা নিয়ে কিভাবে তাকে অপমান করেছ। ক্ষমা চাও বলছি।
মেহুলের খুব অভিমান হয় তার মায়ের ওপর। তাই মোহনাকে সরি বলে সে দৌড়ে চলে যায় তার রুমে।
মেহেজাবিন এবার নিজেও মেহুলের হয়ে মোহনার কাছে ক্ষমা চায়। মোহনা নাটক করে বলে,
‘কোন ব্যাপার না আন্টি। মেহুলকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।’
মোহনা নিজের রুমে বসে কাদছিল। তখন তার বাবা মনির চৌধুরী এসে বলে,
‘নিজের মায়ের উপর অভিমান করে থেকো না। তোমার মা কিন্তু তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমাকে ভালোভাবে মানুষ করবে জন্য তোমার জন্মের পর আর কোন সন্তানও নিতে চায়নি। কারণ সে চেয়েছিল তোমাকে সুশিক্ষা দিয়ে বড় করবে। মেহেজাবিন অনেক ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তবুও নিজে যতটুকু পেরেছে নাওয়া খাওয়া ভুলে তোমাকে সময় দিয়েছে। তুমি যে আমাদের একমাত্র রাজকন্যা। আজ অব্দি কোনদিন তোমার গায়ে আমরা ফুলের টোকাও লাগতে দেইনি। যাও মেহুল তোমার মায়ের কাছে যাও। ও বিদেশ থেকে এসেছে থেকে তুমি খাওনি জন্য এখনো না খেয়ে বসে আছে।’
মেহুল নিচে গিয়ে দেখে তার মা ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। মেহুলকে দেখে বলে,
‘এসো মেহুল। তুমি না আমার হাতে খেতে কত পছন্দ করো। আজ আমি নিজের হাতে তোমায় খাইয়ে দেব।’
মায়ের ডাকে সব অভিমান ভুলে মেহুল ছুটে আসে। তার মাকে জড়িয়ে কাদতে থাকে। মেহেজাবিন নিজের হাতে মেহুলকে খাইয়ে দেয়।
দূর থেকে এসব দেখে হিংসায় জ্ব’লতে থাকে মোহনা। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
‘আমি ছোটবেলা থেকে বাবার ভালোবাসা পাইনি, আমার মা তো কখনো এভাবে আমায় খাইয়ে দেয়নি। এই মেহুলের এই সব সুখ আমি একদিন কেড়ে নেব। সব।’
পরেরদিন ভোরে মেহুলকে তার মা ঘুম থেকে ডেকে তোলে। দুই মা-মেয়ে একসাথে নামাজ আদায় করে নেয়।
ভার্সিটির টাইম হতেই মেহেজাবিন মেহুলকে নিয়ে চলে আসে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
মুগ্ধ তার বন্ধু ধ্রুবর সাথে মেহুলের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মুগ্ধ ভ্রু কুচকে ধ্রুবকে বলতে থাকে,
‘আজ শুধু মেহুলকে আসতে দে। তারপর দেখ আমি ওর সাথে কি কি করি।’
চলবে কি?